অবশেষে যাত্রা শুরু করলো বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল : প্রথম দিন

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর মফিদুল হক বর্ণনা করছেন ঐতিহাসিক এই প্রথম দিনের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা ...। চালু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম, আমি বিস্ফারিত চোখে রুদ্ধশ্বাস হয়ে দেখছিলাম ইতিহাসের এই অপরূপ উদ্ভাবন[....]

মফিদুল হক লিখেছেন প্রথমদিনের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা

২৬ জুলাই সোমবার ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকক্ষে প্রবেশ করলেন তিন বিজ্ঞ বিচারক। আইনজীবী, কৌসুলী, আদালত কর্মকর্তা, দর্শক, সাংবাদিক সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো বিচারপতিদের। আসন গ্রহণ করবার পর তিন সদস্যের প্যানেলের প্রধান বিচারপতি নাজমুল হক ট্রাইবুন্যালের প্রধান কৌসুলীকে তাঁর বক্তব্য পেশ করতে বললেন। প্রবীণ আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু তাঁর নির্ধারিত স্থানে উঠে গিয়ে বক্তব্য প্রদান শুরু করলেন। চালু হয়ে গেল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম, আমি বিস্ফারিত চোখে রুদ্ধশ্বাস হয়ে দেখছিলাম ইতিহাসের এই অপরূপ উদ্ভাবন। বাংলাদেশে একাত্তর সালে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সংহারক বাহিনী গঠন করে যারা ঘৃণ্য অপরাধ কর্ম করেছে তাদের চারজন নিজামী, মুজাহিদ, কামরুজ্জামান ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা মেলে ধরতে লাগলেন গোলাম আরিফ টিপু। ইউর লর্ডশিপ, বলে গোড়াতে এক সংক্ষিপ্ত বাক্যে তিনি স্মরণ করলেন সেই সমস্ত মহান শহীদদের যাঁদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমার আপনার সবার প্রিয় বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই সূচনা বিশাল এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রা সূচিত করলো। এই যাত্রা বিচারহীনতা থেকে বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে, সত্য ও ন্যায়ের বিজয় নিশ্চিত করবার দিকে। বিচার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো, দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাই সম্মান জানালেন বিচারপতি ও আদালতকে, তখন মনে হচ্ছিল শতবর্ষী লাটভবনে স্থাপিত বিচারশালায় উপস্থিতজনেরা কেবল নয় গোটা বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে একত্রে, যে যেখানে রয়েছে সবাই যেন দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আদালতকে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নব-নির্বাচিত সংসদ সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় – গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যত বলবানই হোক, আন্তর্জাতিক চাপ ও সমর্থনে অপরাধীরা সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেলেও বিচারের দাবির বাইরে তারা কখনো যেতে পারবে না। সঙ্গতভাবেই গণহত্যার মূল হোতা পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক গোষ্ঠী ছিল আইনের প্রধান লক্ষ্য, সেই সাথে ছিল তাদের সহযোগী ও তাদের দ্বারা লেলিয়ে দেয়া হন্তারক বাহিনী হিসেবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী দেশীয় গোষ্ঠীর সম-অপরাধমূলক ভূমিকার বিচার অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে রক্তস্নাত জাতি ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর যাত্রা শুরু করেছিল সেই চেতনা এবং মাহাত্ম্য ১৯৭৩ সালে গৃহীত এই আইনের পরতে পরতে মিশে আছে।

তারপর বইয়ে দেয়া হলো কত অবিশ্বাস্য রক্তধারা, ৩২ নম্বরের আটপৌরে বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে রইলো জাতির জনকের মৃতদেহ, ঘৃণা ও নৃশংসতার ভান্ড উপচে পড়লো পরিবারে সদস্যদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, কারাগারের অভ্যন্তরে ঘটলো নৃশংসতার আরেক প্রকাশ, বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেল জাতীয় চার নেতার বুক।

এই রক্তধারা দু’পায়ে মাড়িয়ে সামনে উঠে এলো অন্ধতার শক্তি, তাদের অট্টহাসি ও উল্লাসের মুখে নিভৃতে কেঁদে ফিরলো বিচারের বাণী। কিন্তু বিচারের তাগিদ তো কখনো মুছে যায় নি মানুষের বুক থেকে, বুকের গভীরে ধুকপুক স্পন্দনের সঙ্গে মিশে থাকে অশ্র“ত অথচ নিয়ত বহমান আরেক আকুতি, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিনিধি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক….এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে ন্যায়ের বিধাতা। আর তাই রক্তনদী পার হয়ে দুঃখের অশ্র“ভেজা কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, কত চাপা ক্ষোভ ও উচ্চকিত শ্লোগানের আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে, কত মানুষের কত অযুত সাধনার সম্মিলিত অবদানে, পতাকা হাতে রাজপথে বিরামহীন হেঁটে যাওয়া জাহানারা ইমামের অনুগামী হয়ে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বহন করা পরিবার-কথা ও লোকস্মৃতির পরম্পরা বেয়ে, নবীন-নবীনার সোচ্চার বিচার-দাবির বলিষ্ঠতায় পুষ্ট হয়ে আজ সূচিত হয়েছে ঐতিহাসিক আরেক পর্ব। কৌঁসুলী গোলাম আরিফ টিপু এক বাক্যে নিবেদন করেছেন তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য, মনে হচ্ছিল রক্তসাগর যেন উন্মোচিত হয়ে উঠছিল নতুন প্রত্যাশায়, বিচার হবে, বিচার হবেই , অসুস্থ বর্বর ওহে, কোথায় পাবে নিস্তার!

শতবর্ষের পুরনো লাটভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাত্তরে গণহত্যার জন্য গঠিত বিচারশালা, যা-ছিল বলনাচের কক্ষ তা এখন রূপান্তরিত হয়েছে সুষ্ঠুভাবে সজ্জিত আদালত কক্ষে। যে-কাঠের মেঝে তৈরি হয়েছিল নৃত্যকুশলী নারী-পুরুষদের জন্য, ইতিহাসের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আজ তা সেজে উঠছে ন্যায় ও সত্যের নৃত্যপরায়ণতার জন্য, দুর্ভোগ ও বেদনার কত দীর্ঘ-পথ পাড়ি দিয়ে জাতি উপনীত হয়েছে এই আদালত কক্ষে তা বর্ণনার ভাষা খুঁজে পাওয়া শক্ত। কিন্তু আমাদের সকলের হয়ে, গোটা জাতির হয়ে, বিশ্বমানবতার পক্ষে এই সুপরিসর সুশোভিত ঐতিহাসিক আদালত-কক্ষ এখন থেকে পালন করবে ইতিহাসের দায়, মেটাবে সত্য ও ন্যায়ের দাবি। সোমবারের সকাল সেই ঐতিহাসিক সত্য মেলে ধরলো জাতির সামনে।

৩ comments

  1. মাসুদ করিম - ২৭ জুলাই ২০১০ (১:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    এমন ভাল সোমবার আমি অনেক দিন কাটাইনি। সোমবার আমার শুরু হয় অসম্ভব কাজের চাপে। বাইরের পৃথিবীর অফিস গুলো এদিনই খোলে, এবং সকাল থেকেই ভয়ংকর ব্যস্ততায় নিজের অবস্থান ও পরিকল্পনা সবাইকে জানান দিতে হয়। কিন্তু সকালের শুরুতেই এই খবর Khmer Rouge torturer jailed for 30 years, এদিকে সকাল ১১টার পরপরই ডেইলি স্টার পড়তে গিয়ে দেখি শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল, এবছর ২৫ মার্চের পর প্রতিটি দিন যেখবরটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তাই পেলাম শেষ পর্যন্ত সোমবার ২৬ জুলাই ২০১০-এ।

    • বিনয়ভূষণ ধর - ২৭ জুলাই ২০১০ (৪:২৮ অপরাহ্ণ)

      এমন ভাল সোমবার আমি অনেক দিন কাটাইনি।

      আপনার মতো আমার অনুভূতিও একইরকম মাসুদ ভাই!!!…

  2. kamruzzaman Jahangir - ৭ আগস্ট ২০১০ (৪:৫৩ অপরাহ্ণ)

    ভালো লাগল লেখাটি_বড়োই উদ্দীপনাময়।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.