আদালত কক্ষে প্রবেশ করতে আমার কিছুটা বিলম্ব ঘটে গিয়েছিল। প্রধান ফটক দিয়ে এলাকায় প্রবেশের মুখে জেরা ও তল্লাশি থেকে বোঝা যাচ্ছিল আজকের আদালতের রয়েছে ভিন্নতা। একাত্তরে গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতে উপস্থিত করা হবে প্রধান এক অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। মূল ভবনে ঢোকার মুখে আবারও তল্লাশি এবং পরিচয়প্রদান ও পরিদর্শকের কার্ড সংগ্রহের জন্য বিলম্ব হয়ে গেল আরো। ঢোকার সময়ে গুঞ্জন শোনা গেল, বেশ কিছুটা হৈ-হল্লা ঘটেছে প্রবেশাধিকার নিয়ে। মূল এজলাশ সুপরিসর বটে, তবে ভেতরে প্রবেশের দাবিদার হয়েছেন যত মানুষ ততজনকে স্থান দেয়ার কোনো উপায় নেই। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এজলাশে উপস্থাপনেও কিছু বিলম্ব ঘটেছে, প্রিজন ভ্যানে তিনি যখন পৌঁছলেন আদালত-প্রাঙ্গণে তখন পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের কেউ কেউ পুলিশী বারণ উপেক্ষা করে অভিযুক্তের সঙ্গে পার করলেন দীর্ঘ সময়। ফলে ঘটেছিল অনভিপ্রেত বিলম্ব।
আমি যখন প্রবেশ করি আদালত-কক্ষে তখন অভিযুক্তের আইনজীবীর জমাকৃত ওকালতনামা বৈধ হয় নি বিধায় বিচারকমণ্ডলী সে-বিষয়ে মত-প্রকাশ করছিলেন। অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবীকে সংযত থাকতেও উপদেশ দিচ্ছিলেন ট্রাইবুন্যালের মান্যবর প্রধান বিচারক। সেসব কথা শুনছিলাম বটে, কিন্তু আমার নজর পড়ে ছিল কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অভিযুক্তের দিকে। তিনি বলিষ্ঠ পুরুষ, তাঁর দাঁড়িয়ে থাকায় শারীরিক সেই বলিষ্ঠতার কোনো কমতি ছিল না। তাঁর চেহারায় বা শরীরে বা শরীরের ভাষায় নির্যাতনের কোনো ছাপ নেই। মনে পড়ছিল মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে পুলিশ রিমাণ্ডে নির্যাতন করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেয়া বিবৃতির কথা। সেই বিবৃতিতে অনেক ধরনের নির্যাতনের উল্লেখ করা হয়েছিল, পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎ শলাকা প্রয়োগ, ক্ষুর দিয়ে তলপেটে চির ধরানো ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ সংক্রান্ত গবেষক আব্বাস ফায়েজ এইসব নির্যাতনের কথা বলে বাংলাদেশ সরকারের জবাবদিহিতা কামনা করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবেকের বন্দিদের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। কিন্তু পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গি যে তাদের চিন্তা-চেতনা অনেকাংশে আচ্ছন্ন করে রাখে সেই পরিচয়ও তারা সময় সময় দিয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা বিচারের হাত থেকে নিজেদের জন্য অব্যাহতি নিশ্চিত করেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু-হত্যা ছিল তাদের এই অব্যাহতি আদায়করণ প্রচেষ্টার অংশ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর বাতিল ঘোষিত হয় দালাল আইন, রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় ঘাতক ও তাদের দোসর রাজনীতিবিদরা এবং চলে সংবিধানের ওপর বলাৎকার। দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে জাতি আজ আবার প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন বিচারশালা, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুন্যাল। একাত্তরের গণহত্যা পশ্চিম দুনিয়ার সরকারের যোগসাজশ কিংবা নীরব অনুমোদন অথবা নিদেনপক্ষে কোনো বিরোধিতার সম্মুখীন না হলেও পশ্চিমী বিশ্বের সর্বস্তরের জনমানুষ ও বিবেকী সংগঠনসমূহ রুখে দাঁড়িয়েছিল মানবতার চরম লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে। প্রায় চার দশক পর ২০১০ সালের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বাংলাদেশ আজ শুরু করেছে। সেই আদালতে অন্যতম প্রধান অভিযুক্তের দিকে তাকিয়ে আমি অ্যামনেস্টি কথিত নির্যাতনের লেশটুকুও খুঁজে পাই নি।
কথিত সেই নির্যাতিত রাজনীতিবিদ শরীরে বলবান হলেও মানসিকভাবে তাকে তেমন বলিষ্ঠ মনে হলো না। বারবার তিনি বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলতে চাইছিলেন, বিচারকের কথার মধ্যেও কথা বলতে চেষ্টা করছিলেন। বিচারক অভিযুক্তকে বলছিলেন আগে তিনি রায় শুনুন, তারপর কিছু বলার থাকলে বলবেন। কিন্তু সাকা চৌধুরী শিষ্টাচারের সীমা মানবার পাত্র নন, তার বারংবার চেষ্টায় এক পর্যায়ে বিচারক তাকে কথা বলবার সুযোগ দেন। তিনি দাবি জানান যে, তাকে যেন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ দেয়া হয় এবং তার স্বাস্থ্যগত চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবারও অ্যামনেস্টি কথিত ধরনের কোনো পীড়নের অভিযোগ তোলেন নি। যাই হোক, অভিযুক্তের বক্তব্যের পর ট্রাইবুন্যালের পক্ষে প্রধান বিচারক তাঁর রায় ঘোষণা করলেন। রায়ে বলা হয় অভিযুক্তের পক্ষে অ্যাডভোকেট ফখরুল ইসলাম যে ওকালতনামা পেশ করেছেন অভিযুক্তের প্রেপ্তার হওয়ার আগেই সেখানে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল বিধায় বর্তমান মামলায় তা বিধিসম্মত বিবেচিত হয় নি, তাই অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবীর নতুন ওকালতনামা দাখিল করা প্রয়োজন। জেল কোড অনুযায়ী আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ওকালতনামা গ্রহণের যথাযথ রীতি অনুসরণের জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন মাননীয় বিচারপতি। পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয়ে জেল কোড অনুযায়ী অভিযুক্ত সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন বলে আদালত মত প্রকাশ করে। এর অন্যথা হলে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের শরণ নিতে পারেন। রায় ঘোষণার পর অভিযুক্তের আর কিছু বলবার অবকাশ ছিল না।
আদালত-শেষে বিচারকবৃন্দ কক্ষত্যাগের পর আবার সোচ্চার হয়ে উঠলেন সাকা চৌধুরী। সঙ্গে আসা পুলিশেরা তাকে যথোচিত বিনয়ের সঙ্গে কাঠগড়া ত্যাগের অনুরোধ করলে তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, কই, ডিজিএফআই কই, তাঁরা আসুক, তারপর আমি যাবো। তিনি চেচাঁতে থাকেন, আমি সংসদ-সদস্য, আমার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। পাশ থেকে একজন স্মরণ করিয়ে দেয়, বলুন, আপনি ছয়বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। মানবাধিকার-কর্মী ডেভিড বার্গম্যান সাংবাদিক হিসেবে এজলাশে উপস্থিত ছিলেন। বিদেশি কাউকে সামনে পেয়ে সাকা চৌধুরীর উৎসাহ আরো বেড়ে যায়, ইংরেজিতে তিনি চেঁচাতে থাকেন, তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি, তার অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তাকে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয় নি ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস্তবতা ছিল ওকালতনামা উপযুক্তভাবে তৈরি ও দাখিল করতে তিনি ও তার আইনজীবীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু সেই দোষ এখন বিচারশালার ওপর চাপাতে তিনি মহাব্যস্ত। ছয়বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে তার যে দাবি সেটা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল ইন্টান্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রানজিশন্যাল জাস্টিসের ক্যাটলিন রেইজারের কথা। বিগত মে মাসে তিনি এসেছিলেন ঢাকায়, বিচারশালা যেমন পরিদর্শন করেছেন, তেমনি দেখা করেছিলেন জামাত-বিএনপির নেতাদের সঙ্গে। যাবার আগে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর সদ্য-প্রকাশিত বই, প্রসিকিউটিং হেডস অব স্টেটস, সতেরটি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান যে আন্তর্জাতিক অপরাধে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে সে বিবরণী মিলবে এই বইয়ে। সেই নিরিখে ছয়বারের সংসদ সদস্য যে কল্কে পাওয়ার নন তা কে তাকে বোঝাবে!
তবে সাকা চৌধুরীকে দাঁড়াতে হয়েছে কাঠগড়ায় সেটা স্মরণ না করে তার উপায় ছিল না। বিচারকের বক্তব্যের মাঝখানে তিনি যেমন কথা বলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তেমনি মি লর্ড, মি লর্ড বলে বারবার নিজেকে সংযতও করে নিচ্ছিলেন। আর যেসব কথা আদালত-শেষে বলছিলেন তার মধ্যে পরম্পরা খুঁজে পাওয়া ছিল মুশকিল। ডেভিডকে দেখে তার যে উৎসাহ, সেটা বুঝি উবে যেত যদি তিনি জানতেন যে, এই ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশের ফেরারি চার যুদ্ধাপরাধী নিয়ে গ্রেনেডা টেলিভিশন প্রযোজিত ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’-এর অন্যতম নির্মাতা। যাই হোক, ডেভিড এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, গ্রেপ্তারের পর তার ওপর নির্যাতন পরিচালিত হয়েছিল কিনা। জবাবে গলা আরো উঁচিয়ে সাকা চৌধুরী বললেন, ‘হ্যাঁ, তার ওপর নির্যাতন পরিচালিত হয়েছে। তিনি বারো দিন যাবৎ অভুক্ত রয়েছেন।” এমন অদ্ভুত অভিযোগ শুনে বোঝা যায়, কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে আছেন সাকা চৌধুরী, এলোপাথারি অভিযোগ তুলে আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার খেলায় নেমে অভিযোগের আর কোনো ঠিক-ঠিকানা রাখতে পারছেন না।
আমি কাঠগড়ায় দেখছি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে, আর ভাবছি আইনের হাত কতটা দীর্ঘ হতে পারে। বাংলাদেশ কখনো ভুলতে পারবে না একাত্তরের লাখো শহীদের কাছে তাদের দায়, সেই সাথে কখনো বিসর্জন দিতে পারবে না ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকার। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে আরো তথ্যনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল হতে হবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার বিষয়ে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের নিশ্চয় অধিকার রয়েছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির, কিন্তু ন্যায়দণ্ড কলুষিত করবার জন্য তাদের প্রয়াস সম্পর্কে সচেতনতাও বিশেষ প্রয়োজন। নতুবা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকেও তো একদিন করতে হবে জবাবদিহি।
![wpdiscuz](https://muktangon.blog/wp-content/plugins/wpdiscuz/assets/img/plugin-icon/icon_info.png)