সোমবার ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল না স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল, ভাবতে ভাবতেই ফ্রয়েডের এই কথাগুলো মনে পড়ল[...]

ফ্রয়েড বলেছিলেন, ঘুম থেকে উঠেই স্বপ্ন লিখুন – স্বপ্নের বিস্তারটা ধরতে পারবেন আর স্বপ্ন দেখতে দেখতে যদি ঘুম ভেঙে যায় এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ুন – আকস্মিক স্বপ্নভঙ্গের পটভূমিটা ফুটে উঠবে। সোমবার ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল না স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল, ভাবতে ভাবতেই ফ্রয়েডের এই কথাগুলো মনে পড়ল, সেই ২৩/২৪ বছর বয়সে যা করতাম তাই করতে বসে গেলাম, স্বপ্ন লিখতে শুরু করলাম। অজয় দেবগনের ঘরে আমি চা বানাচ্ছি, অজয় দেবগন আমাকে বলছে, আজ তোমার দেশের একজন মানুষ আমার সাথে দেখা করতে আসবে শুধু চা বানালে হবে না ভাল করে চায়ের সাথে বাঙালি ভাজাভু্জিও কিছু করো, আমার মৃত বন্ধু মাহবুব শীতকালে গরুর গায়ে দেয়া ছালা জড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালের ভেতর দিয়ে বাহিরে চলে গেল, আমিও তার সাথে চলে গেলাম, একটা কার্পেটে একটা বিড়ালের পাশে তসলিমা নাসরিন বসে আছে, অজয় দেবগন ট্রেতে করে চা আর ভাজাভুজি নিয়ে এসে আমাকে খেতে বলল, আমি চা ও ভাজাভুজির প্রশংসা করলাম, তসলিমা নাসরিন বলল আমি বানিয়েছি ওগুলো আমার করা, অজয় দেবগন বারবার কী খুঁজছে বকছে নিজামি মুজাহিদ মন্ত্রীর গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তোমাদের একেবারে মাথা কাটা যাচ্ছে, কই খালেদা জিয়া যে কতবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেল তুমি তসলিমা একথা বলতে পার না, একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আমি বলতে পারব না তিনি যুদ্ধের সময় সেনানিবাসে কী করছিলেন, না আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তুমি এভাবে বলতে পার না অজয়, আমি তোমার দেশে আশ্রিত তাই তুমি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এভাবে বলতে পার না, তুমি তসলিমা নারীবাদী আমি জানি তোমার তো জাপানের রাজাদের সেনাবাহিনীর কথা মনে আছে, যেখানে যেত চীনে ভিয়েতনামে কোরিয়ায় এজেন্ট দিয়ে মেয়ে জোগাড় করে একঘর করে বিলাসরমণী বানিয়ে রাখত তাদের সাথে সময় কাটাত, একটা পিয়ানো মুছে দিচ্ছে কয়েকজন কয়েদি, একজন উর্দিপরা পরা লোক পিঠ দিয়ে বসে আছে আমাদের দিকে, শুধু কালো রিডগুলোতেই চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আমি অজয় না তসলিমা কে যেন বিড়বিড় করছি মনে হচ্ছে সবাই করছি, স্ববিলাসরমণী, স্ববিলাসরমণী, স্ববিলাসরমণী, স্ববিলাসরমণী, স্ববিলাসর সোমবার ভোররাত ১২ ডিসেম্বর ২০১১

মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিতে গুরুচাপ লঘুচাপ দুটোই সমান শক্তিশালী – সভ্যতাকে ঘাড় ধরে টেনে নামাতে, লেখক শিল্পীর নির্বাসন নিশ্চিত করতে, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ‘মৌলবাদের মুখ, তার ভাষা এবং মতলব’ সমান সক্রিয়।[...]

মুহম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইয়ে ১৯৯৪ সালের ৯ আগস্ট তারিখে ‘তসলিমা নাসরিনের দেশত্যাগ’ কথাটি ঠিক লেখেননি। এটা ছিল মোটা দাগের নির্বাসন দণ্ড : নিশ্চিত গলাধাক্কা। মৌলবাদের কাছে পরাজিত রাষ্ট্র ও সরকার সেদিন তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। সেসাথে দেশের পত্রপত্রিকা ও প্রকাশকরা তার কলাম ও বই প্রকাশও বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালে তসলিমা নাসরিন একবার বাংলাদেশে আসার সুযোগ পান এবং মাস তিনেক থাকার পর মৌলবাদীদের চাপে রাষ্ট্র ও সরকার আবার তাকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তসলিমার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, তখন সুইডেন তাকে সেদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। সুইডিশ পাসপোর্টে ভারতের রেসিডেন্সি ভিসা নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে তসলিমা কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। তার ভারতে পদার্পনের পর থেকেই ভারতীয় মুসলিম মৌলবাদীরা বোম্বে হায়াদ্রাবাদ ও কলকাতায় তার ভারতে অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীদের তাণ্ডবের পর আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার তসলিমাকে তার বাসস্থান ত্যাগে বাধ্য করে ও প্রাথমিকভাবে রাজস্থানে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাকে রাজস্থান থেকে সরিয়ে দিল্লিতে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে যায়। ৭/৮ মাস অজ্ঞাতবাসের পর ভারত ত্যাগের শর্তে তসলিমার ভারতের রেসিডেন্সি ভিসার নবায়ন করে তাকে ভারত ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ২০০৮ সালে তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাসপোর্টের আবেদন করলে তার আবেদন যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন তসলিমা তার ইউরোপিয়ান পাসপোর্টে ‘বাংলাদেশ ভ্রমণে ভিসার প্রয়োজন নেই’ এই ছাপ মারতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন, এতেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি সাধারণ টুরিস্ট ভিসার আবেদন করেন এবং তাতেও প্রত্যাখ্যাত হন। আর এসব কিছুর পর ২০০৮ সালেই বাংলাদেশ সরকার তার ‘কালো তালিকা’য় তসলিমা নাসরিনের নাম অর্ন্তভুক্ত করে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে বেশ কয়েকবার তিনি বাংলাদেশে এসে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো আশ্বাস বা অনুমতি তসলিমা পাননি। এরমধ্যে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার দিল্লির অজ্ঞাতবাসে ফিরে আসেন, এখনো তিনি অজ্ঞাতবাসেই সিদ্ধান্তহীনভাবে দিন কাটাচ্ছেন। তসলিমা হয়তো একমাত্র দৃষ্টান্ত যিনি পাশাপাশি দুটি দেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী ও সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের হুমকিতে জীবনযাপন করেছেন। মুসলিম মৌলবাদীরা যেমন তাকে বাংলাদেশছাড়া করেছে, ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরাও তাকে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে যেতে…

আজো বুকটা ভারী হয়ে আছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯, হয়তো অনন্তকাল ধরে, এই আঘাত আমরা ভুলতে পারব না, আমরা যারা লেখক বা লেখক হতে চাই, আমাদের ওপর এই আঘাত, এই আঘাতের প্রতীক হয়ে হুমায়ুন আজাদ, প্রতিদিন আমাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার হিংস্রতার কথা মনে করিয়ে দেবে। সফদর হাশমি যেমন ভারতে আমাদের দেশে হুমায়ুন আজাদ, আমরা ভুলতে পারব না, ভুললেই শেষ হয়ে যাব, বুকটা ভারী হয়ে আছে, প্রকাশ অক্ষম, কিন্তু সাবধান, শুধুই সাবধান। আমরা আজ ২০০৮-এর নির্বাচনের পর যে সময় কাটাচ্ছি, তাতে নিরাপদ বোধ করলে চরম ভুল করব। তাই ১২ আগস্ট-কে আমাদের আরো ব্যাপক পরিসরে পালন করা উচিত, লেখকদের ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’র মতো একটি আন্দোলনের কথা ভাবা উচিত, আরো ঐক্যবদ্ধ শক্তিই পারে লেখকদের আরো স্বাধীন করতে, তসলিমা নাসরিন-ও দেশে ফেরার আকুতি নিয়ে বাহিরে পড়ে আছেন, কিন্তু কেন এমন হবে? ১২ আগস্ট ‘লেখক দিবস’ হয়ে উঠুক, এবং একে ঘিরে লেখকদের সম্মিলন আন্দোলন সম্ভব হোক, এখনই হোক, না হলে বাংলাদেশে লেখকদের ভবিষ্যৎ আরো ভয়ংকর বিভীষিকাময় হয়ে উঠবে।

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.