মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিতে গুরুচাপ লঘুচাপ দুটোই সমান শক্তিশালী – সভ্যতাকে ঘাড় ধরে টেনে নামাতে, লেখক শিল্পীর নির্বাসন নিশ্চিত করতে, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ‘মৌলবাদের মুখ, তার ভাষা এবং মতলব’ সমান সক্রিয়।[...]

মুহম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইয়ে ১৯৯৪ সালের ৯ আগস্ট তারিখে ‘তসলিমা নাসরিনের দেশত্যাগ’ কথাটি ঠিক লেখেননি। এটা ছিল মোটা দাগের নির্বাসন দণ্ড : নিশ্চিত গলাধাক্কা। মৌলবাদের কাছে পরাজিত রাষ্ট্র ও সরকার সেদিন তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। সেসাথে দেশের পত্রপত্রিকা ও প্রকাশকরা তার কলাম ও বই প্রকাশও বন্ধ করে দিয়েছিল।

১৯৯৮ সালে তসলিমা নাসরিন একবার বাংলাদেশে আসার সুযোগ পান এবং মাস তিনেক থাকার পর মৌলবাদীদের চাপে রাষ্ট্র ও সরকার আবার তাকে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তসলিমার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, তখন সুইডেন তাকে সেদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে।

সুইডিশ পাসপোর্টে ভারতের রেসিডেন্সি ভিসা নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে তসলিমা কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। তার ভারতে পদার্পনের পর থেকেই ভারতীয় মুসলিম মৌলবাদীরা বোম্বে হায়াদ্রাবাদ ও কলকাতায় তার ভারতে অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীদের তাণ্ডবের পর আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার তসলিমাকে তার বাসস্থান ত্যাগে বাধ্য করে ও প্রাথমিকভাবে রাজস্থানে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাকে রাজস্থান থেকে সরিয়ে দিল্লিতে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে যায়। ৭/৮ মাস অজ্ঞাতবাসের পর ভারত ত্যাগের শর্তে তসলিমার ভারতের রেসিডেন্সি ভিসার নবায়ন করে তাকে ভারত ত্যাগে বাধ্য করা হয়।

২০০৮ সালে তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাসপোর্টের আবেদন করলে তার আবেদন যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন তসলিমা তার ইউরোপিয়ান পাসপোর্টে ‘বাংলাদেশ ভ্রমণে ভিসার প্রয়োজন নেই’ এই ছাপ মারতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন, এতেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি সাধারণ টুরিস্ট ভিসার আবেদন করেন এবং তাতেও প্রত্যাখ্যাত হন। আর এসব কিছুর পর ২০০৮ সালেই বাংলাদেশ সরকার তার ‘কালো তালিকা’য় তসলিমা নাসরিনের নাম অর্ন্তভুক্ত করে।
২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে বেশ কয়েকবার তিনি বাংলাদেশে এসে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো আশ্বাস বা অনুমতি তসলিমা পাননি।
এরমধ্যে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার দিল্লির অজ্ঞাতবাসে ফিরে আসেন, এখনো তিনি অজ্ঞাতবাসেই সিদ্ধান্তহীনভাবে দিন কাটাচ্ছেন।

তসলিমা হয়তো একমাত্র দৃষ্টান্ত যিনি পাশাপাশি দুটি দেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী ও সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের হুমকিতে জীবনযাপন করেছেন। মুসলিম মৌলবাদীরা যেমন তাকে বাংলাদেশছাড়া করেছে, ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরাও তাকে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে যেতে ও ফলশ্রুতিতে ভারত ছাড়তে বাধ্য করতে পেরেছে। নারীবাদীর শত্রু অনেক, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় শত্রু মৌলবাদীরাই। এবং এই মৌলবাদীরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হোক বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হোক, তাদের উন্মত্ততার প্রতিক্রিয়াশীলতা সমান ক্ষুরধার। কারণ সরকারের কাছে সংখ্যাগুরুরা স্বাভাবিকভাবেই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলেও সংখ্যালঘুরা আবার ভোটে হারজিতের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তাই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিতে গুরুচাপ লঘুচাপ দুটোই সমান শক্তিশালী – সভ্যতাকে ঘাড় ধরে টেনে নামাতে, লেখক শিল্পীর নির্বাসন নিশ্চিত করতে, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ‘মৌলবাদের মুখ, তার ভাষা এবং মতলব’ সমান সক্রিয়।

সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ-যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনো রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনো নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনো মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি ত্যাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adopts himself to the world. An unreasonable man persists in trying to adopt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিশীল লোকেরা পৃথিবরি সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। এতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুাক্তহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করাছ না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার উপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই তো মুখে কুলুপ আঁটিনি, যে কথা বলতে মানা সে কথা বলেছি, পুরো একটি সমাজ আমাকে থুথু দিচ্ছে দেখেও তো সরে দাঁড়াইনি, নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যাঁরা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহকগণ! ওই মহাপুরুষেরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে।

বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক কালে অনেক নারীবাদীর লেখাই পড়েছি, দেহহীন নারীবাদীদের প্রাধান্যের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক জন দেহী নারীবাদী আছেন – এর মধ্যে সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আমাদের তসলিমা নাসরিন। আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় এতোই পশ্চাদপদ ও স্বাধীন মত প্রকাশে অভ্যস্ত কারো প্রতি এতোই প্রতিশোধ পরায়ণ, যে, আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ নারীবাদীকে আমরা হত্যা করতে চেয়েছি, আমরা তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি – হয়তো বা চিরকালের জন্য বিতাড়িত করেছি। আর এটা এমন এক বিতাড়ন, যা, আমাদের দেশকে শুধু নারীপ্রগতিতেই পিছিয়ে দেবে না, আমাদের দেশে মানবতার স্ফূরণকেও ব্যাহত করছে ও করবে।

আমি চাই তসলিমা নাসরিনকে তার প্রিয় স্বদেশ ফিরিয়ে দেয়া হোক – দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ নারীবাদী তাকে অন্যরা বলুক – আমরা তাকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নারীবাদী হিসেবে বাংলাদেশে উদযাপিত দেখতে চাই। আর সবার আগে চাই অচিরেই দেশের প্রধান পত্রিকাগুলো তার লেখা ছাপাক – অন্তত, দুয়েকটি পত্রিকা তার লেখা ছেপে দেখাক মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলাদেশের দুয়েকটি পত্রিকা শামিল আছে।

  • মাসুদ করিম

    লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

79 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
79
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.