সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসবো, আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভোরের তরতাজা দৈনিকের পাতায় চোখ বুলাবো এই সামান্য শখটা দিবাস্বপ্নই থেকে গেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সকাল সোয়া সাতটার ট্রেন ধরার দৌড়, আর এখন সাড়ে সাতটার চাকরীর দৌড়ে ভোরের পত্রিকা পড়ার সাধটা শিকেয় তোলাই থেকেছে।
শুক্রবারে আনন্দটা পাওয়া হতো কখনো সখনো। ছুটির একটা দিন। কিন্তু যে শুক্রবারগুলো পত্রিকার পাতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ দিত, সেই শুক্রবারগুলোও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকা পড়ার সেই তীব্র সাধটা আলগা হতে হতে কখন যেন মরে গেছে। আজকাল পত্রিকা হাতে নিয়ে শিরোনামটা দেখেই রেখে দেই। পত্রিকার প্রতি আগ্রহ হারানোর কারণ ভাবতে গিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। সমস্যাটা কি পত্রিকার না পাঠকের?
একসময় পত্রিকার চরিত্র বিশ্লেষণ করা হতো কেবলমাত্র রাজনৈতিক মেরু দিয়ে। ডান, বাম কিংবা সুবিধাবাদী মধ্যম ইত্যাদি। ডান বা জামাতী লোক পড়বে সংগ্রাম/ইনকিলাব, বামধারার লোক সংবাদ, মোটামুটি মধ্যমধারা পড়বে ইত্তেফাক, আবার কট্টর আওয়ামী লীগ হলে বাংলার বাণী ধরনের পত্রিকা।
সংবাদপত্রের আসল বিপ্লব শুরু হয় এরশাদ পতনের পর। আজকের কাগজ নামে নতুন চেহারার একটা পত্রিকা আসে বাজারে এবং সম্পূর্ণ নতুন ধারার প্রচলন করে পত্রিকায়। প্রচলিত ফরমেটের পত্রিকা বদলে গিয়ে সৃষ্টি হয় কলামিষ্ট ধারার। মাঝখানের বিশাল দুটি পাতা বরাদ্দ কয়েক রকমের কলামিষ্টের জন্য। নিউজের চেয়ে ভিউজ প্রাধান্য পেতে থাকে পত্রিকায়। মানুষ নতুন আগ্রহ নিয়ে পত্রিকা পড়তে শুরু করে।
কিন্তু মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হঠাৎ একদিন মালিক সাংবাদিক বিরোধে আজকের কাগজ ভেঙ্গে গেল। পত্রিকা থেকে মূলধারার অংশটি বেরিয়ে ভোরের কাগজের জন্ম দিল। পাঠক কিছুদিন হতবাক হলেও অল্প সময়ে ভোরের কাগজও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আমরা জানতে পারি ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ সাবের হোসেন চৌধুরী এই পত্রিকার মালিক। এই প্রথম সংবাদপত্র একটা কর্পোরেট শক্তির ছোঁয়ায় আসে। সেই সময় আরেক কর্পোরেট পত্রিকা জনকন্ঠও ব্যাপক জনপ্রিয় পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আজকের কাগজের ভাঙ্গনের মহামারী কিছুকাল পর ভোরের কাগজেও ফাটল ধরায়। এবারো মালিক সাংবাদিক দ্বন্দ্ব। কর্পোরেট ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার জন্য বিদ্রোহী সাংবাদিকগন নতুন একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ পত্রিকা গড়ার ঘোষনা দেয়। আসে প্রথম আলো।
ভোরের কাগজের সাদাকালোর গাম্ভীর্য ছাড়িয়ে সম্পূর্ন রঙিন প্রথম আলো। শোনা গেল এবার দেখা যাবে সত্যিকারের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা। পূর্বে যাদের চারখানা পত্রিকা পড়ে সত্য জানতে হতো, তাদের এখন একটি পত্রিকা পড়লেই চলবে। এমনকি কিছু জামাতী লোকজনকেও দেখা গেল প্রথম আলোর ভালত্বে আগ্রহ প্রকাশ করতে। কেউ ভাবলো, বাহ বাকশাল আমলে এরকম একটা পত্রিকা থাকলেই তো ল্যাটা চুকে যেত।
কিন্তু প্রথম আলোর ওই রঙিন যাত্রা যে সাংবাদিকতার কর্পোরেট যাত্রা তা আমজনতার জানা ছিল না। আরো কয়েক বছর যাবার পর বাজারে আরো নতুন নতুন পত্রিকা বের হবার সংবাদ এলো। প্রত্যেকে সত্যের প্রতি নির্ভীক ও নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করে যাত্রা শুরু করলো। দরিদ্র পেশা থেকে সাংবাদিকতার উত্তরন ঘটলো এক্সিকিউটিভ পেশায়। নতুন পত্রিকা এলেই পুরোনো দৈনিক থেকে লোকক্ষয় হবে, বেশী বেতনে যোগ দেবে সদ্যপ্রকাশিত পত্রিকায়, এটাই হয়ে গেল নিয়ম। একসময় এসে দেখা গেল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার তালিকায় যে নামগুলো দেখা যায় তার সবগুলোর পেছনে কোন না কোন ধনবান শিল্প প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সাইনবোর্ড বসানো আছে। কোন পত্রিকাই আর এতিম নয়। শুধুমাত্র সংবাদ প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলো হারিয়ে যেতে থাকলো। শীর্ষ পত্রিকাগুলো হয়ে উঠলো গোত্রপতিদের মুখপত্র।
অদৃশ্য অভ্যুত্থানে পত্রিকার নিয়ন্ত্রন সাংবাদিকদের হাত থেকে চলে যায় বসুন্ধরা ট্রান্সকম কিংবা যমুনার হাতে। তাই কোন সংবাদ বিক্রিত হয় আর কোন সংবাদ বিকৃত হয় আমাদের জানা হয় না। কোন পত্রিকার সাংবাদিক কতটা স্বাধীন সেটাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমরা এটা স্পষ্ট বুঝি যে সংবাদপত্র ব্যাপারটা আর সাংবাদিকদের হাতে নেই। ফলে প্রথম আলো কখনো ট্রান্সকম গ্রুপের বিপক্ষে লিখবে বা, কালের কন্ঠ কখনো লিখবে না বসুন্ধরার দুর্নীতি, কিংবা যুগান্তর লিখবে না যমুনার কোন অনিয়ম। ওরা কেবল অন্যের দুর্নীতি অনিয়ম খুঁড়ে বের করবে, আর নিজেদের রাখবে নিষ্পাপ নিরপেক্ষ।
আর তাই, যদিও এখনো শুক্রবার আসে, আধোঘুমে শুনি দরোজার নীচ দিয়ে আলগোছে পত্রিকা ঠেলে দিচ্ছে নবীন হকার। কিন্তু দৌড়ে গিয়ে পত্রিকা তুলে নিয়ে পড়ার গোগ্রাস আগ্রহ খুঁজে পাই না আর। পুরোনো অভ্যেসে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে তাজা ঘ্রানটা শুঁকে আলগোছে ভাঁজ করে রেখে দেই পাশের টেবিলে।
স্বাধীন সংবাদপত্র বিষয়টা সম্ভবতঃ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
আরিফ রুবেল - ১৪ ডিসেম্বর ২০১০ (১১:২২ অপরাহ্ণ)
সময়োপযোগী লেখা। পোস্ট করার জন্য ধন্যবাদ। সমাধান চাই।
নুর নবী দুলাল - ১৫ ডিসেম্বর ২০১০ (৩:২৯ পূর্বাহ্ণ)
কর্পোরেট বলয়ে দৈনিক প্রত্রিকাগুলোর বন্দীদশার বিমূর্ত চরিত্র লেখক সাবলীল শব্দের প্রয়োগে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তবে, সংবাদপত্রের এই সংস্কারায়ণ ঢাকাভিত্তিক জাতীয় দৈনিকগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলো এখনো স্বাধীণ সাংবাদিকতার কিছুটা নির্যাস পাঠককে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী বা পূর্বকোণ সাংবাদিকতার পূর্বের ধারা বজায় রেখে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে।
ঢাকায় ইদানিংকালে ২ টাকা মূল্যের দৈনিক প্রকাশ করার ধুম লেগেছে। যারা বেশী মূল্যে দৈনিক সংবাদপত্র পড়ার ক্ষমতা রাখেন না, তারা ঢাকার তীব্র যানজটে কর্মস্থলে যাওয়া বা আসার সময় ঐসব স্বল্পমূল্যের সংবাদপ্রত্র পড়তে পড়তে যানজটের বিরক্তি ও ক্লান্তি থেকে জোর করে হলেও পরিত্রান পাওয়ার চেষ্টা করেন। একটি দৈনিকতো একধাপ এগিয়ে কর্মস্থল ফেরত মানুষদের জন্য রাত ৮-টায় পরের দিনের তারিখের প্রকাশিত সংবাপত্র পিচ্চি হকারদের মাধ্যমে বাজারজাত শুরু করেছেন। জানিনা, সংবাদপত্রের এই ধরনের নব নব সংস্কারায়ন কোথায় গিয়ে ঠেকে ?
নীড় সন্ধানী - ১৫ ডিসেম্বর ২০১০ (১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ)
স্থানীয় পত্রিকাগুলো এখনো পুরোনো ধারা ধরে রেখেছে। পূর্বকোন আজাদী কর্পোরেট পত্রিকা না হলেও প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে তাদের। যে কোন ইস্যুতে নিজস্ব অবস্থান থেকে সরব হতে পারেনা এরা। বিজ্ঞাপন আর প্রেসবিজ্ঞপ্তি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার কোন লক্ষণ নেই। প্রথম পাতা আর শেষ পাতা বাদ দিলে বাকী সবগুলো পাতাই হয় প্রেসবিজ্ঞপ্তি নয়তো বিজ্ঞাপন। ২ টাকার পত্রিকা আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু আমাদের সময়ের মতো কেবল উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা হিটলোভী সংবাদ প্রকাশ হলে সমস্যা আছে।
নিরাভরণ - ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ (৫:১৪ পূর্বাহ্ণ)
ডান বা বাম না হলেই সুবিধাবাদি হতে হবে কেন ঠিক স্পষ্ট হলো না। রাজনৈতিক মতাদর্শতো একমাত্রিক ব্যপার নয় যে সর্ববাম থেকে সর্বডান পর্যন্ত একটা বিন্দু ধরতে পারলেই একজনের আদর্শিক পরিমন্ডলকে বুঝে ফেলা যাবে! একজন ব্যক্তির ভাবনা জগত অনেক গভীর ব্যপ্ত — অন্যকোন ব্যক্তির পক্ষে তার একটা সরলিকৃত ধারনা পাওয়া সম্ভব মাত্র। সেই নিরিখে একটা অবস্থানকে ‘সুবিধাবাদি’ হিসাবে কি করে দেখা যায় সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
একটাই সুবিধা এখানে নানা তরফ বা পক্ষ গজিয়ে গেছে এরমধ্যেই। ফলে একটা ভারসাম্য হয়ত তৈরি হবে এমনটা আশা করা যায়। যে কারনে প্রথম আলো ট্রান্সকমের বিরুদ্ধে লিখবেনা সে কারনেই হয়ত কালের কণ্ঠ কিছু একটা দোষ খুঁজে পেলে সেটা ফলাও করে লিখবে। এটা কিছুটা আশার কথা কারন কর্পোরেট জগত একাট্টা হয়ে না পড়ে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগীতায় একটু হলেও প্রবৃত্ত হয়েছে। বাকি ক্ষেত্রগুলোতে কর্পোরেটিসমের সাথে যদি কিছুটা পেশাদারিত্ব ঢুকে থাকে সেটাও হয়ত সাধারনের জন্য কিছুটা স্বস্তির কারন। যদিও এক্ষেত্রে আলাদাভাবে একটা পত্রিকা হয়ত তাদের পক্ষপাতের যায়গাগুলোতে পেশাদারিত্ব ঠিক রাখতে ব্যর্থ হবে। এইযে এখানে নির্মোহ হবার চেষ্টা করলাম এটাতো এক অর্থে মধ্যমপন্থা — ভাবছি এটাকে আসলে সুবিধাবাদি বলা যায় কিভাবে?
কর্পোরেট দলাদলির চেয়ে রাজনৈতিক মেরুভিত্তিক পক্ষপাত বেশি উত্তেজনা জাগিয়ে রাখত সেটা অনুমান করা যায়। তারপরো যতটুকু পেশাদারিত্ব এসেছে এর মধ্য দিয়ে সেটাকে সাধুবাদ জানানো যায় হয়ত। পেশাদারিত্বের ব্যপারটা অবশ্য আমার জাজমেন্ট।
নুর নবী দুলাল - ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ (১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
…আর পেশাদারিত্বের সততা যখন কর্পোরেট দলাদলিতে বিলীন হয়ে যায়, তখন কি বলবেন?
নিরাভরণ - ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ (১০:১৫ পূর্বাহ্ণ)
এই জন্যই “যতটুকু” বলেছিলাম। স্বাধীন মিডিয়া বলতে এখনকার সময়ে কিছু আছে কিনা, বা হতে পারে কিনা বলা কঠিন। পেশাদারিত্বের সাথে নিরপেক্ষতার একটা যোগাযোগ আছে অবশ্যই। আমার মতে এখনকার রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নিরপেক্ষ না নির্মোহ হয়ে বসবাস করাটা কঠিন — যে জন্য সংবাদ পত্রগুলো নিরপক্ষতাকে ফুটনোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। সেইজন্য নিরপেক্ষ বা নির্মোহ অবস্থানকে সুবিধাবাদি বলা উচিত নাকি ঠিক তার বিপরীতটা সত্যি সেটাই ভাবছি। পক্ষপাতে পেশাদারিত্ব নষ্ট হয় — কিন্তু কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় বলেই না পক্ষপাত! কর্পোরেট বায়াসড মিডিয়া আর রাজনৈতিক আদর্শিক বায়াসড মিডিয়ার মধ্যে একটা ফারাক হয়ত এই যে কর্পোরেট যদি শোষন করে সে ক্ষেত্রে x, y আর z এর মধ্যে সত্ত্বাগত পার্থক্য থাকলেও তাদের চরিত্র অভিন্ন। সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যপারে সত্যি হলেও যারা অনুসারি তারা হয়ত আদর্শিক ব্যনারটাতে বিশ্বাস করে কিছুটা প্রবোধ পান। (অভিমত)