অক্টোবর ১৯৭৩। বিমান হাইজ্যাকার জাঁ কুয়ে’র বিচার হচ্ছে ফ্রান্সের আদালতে। বছর দুয়েক আগে পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ফ্রান্স সফরে আসার দিন প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এক যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে পশ্চিমা বিশ্বে হইচই ফেলে দেন জাঁ কুয়ে। হঠাৎ জানা গেল, সেই জাঁ কুয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যেই কি না আদালতে উপস্থিত হতে চলেছেন ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মাল্রো! বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। খ্যাতিমান দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক মাল্রো, যিনি ৭০ বছর বয়সে পৌঁছেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অস্ত্র ধরতে চেয়েছিলেন, তিনি কি না সাফাই গাইতে আসছেন এক হাইজ্যাকারের! কী এমন ঘটেছিল যে, মাল্রো মতো একজন সজ্জন দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ককে সেদিন এই হাইজ্যাকারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল? আর সেই মামলায় জাঁ কুয়ের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছিলেন ফ্রান্সের প্রখ্যাত আইনজীবী জাঁ মার্ক ভারাউত? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের প্যারিস শহরে নিবিষ্ট মনে জাঁ কুয়ে লিখে চলেছেন তাঁর বই ‘দ্য উয়েপন ইন দ্য হার্ট’। ফরাসি লেখক জাঁ ইউজিন পল কুয়ে ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, চলার পথে বিভিন্ন মতাদর্শের সংস্পর্শে তার জীবন হয়ে উঠেছিল অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ, নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শিক অবস্থানে এসে থিতু হয়েছিলেন -- হয়ে উঠছিলেন ক্রমশই বিশ্বমানব, বিশ্বপথিক। বাবার বাড়ির কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্টে দিনের পর দিন লেখালেখিতে একমনা কুয়ে'র চোখ বই লেখা শেষ হতেই গিয়ে পড়ল সারা বিশ্বের ঘটনাবলীর দিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে। কেন বিশেষভাবে বাংলাদেশই কুয়ে'র দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছিল? অনুমান করছি, আঁদ্রে মাল্রো-ই এর মূল কারণ। ১৯৭১-এর শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে বের হন। প্রায় একই সময়ে আঁদ্রে মাল্রো পত্রপত্রিকায় এমন এক বিবৃতি দেন, যা এক দিকে ইন্দিরা গান্ধীর এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করে তোলে। তিনি তার ওই বিবৃতিতে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার ইচ্ছা জানান। মাল্রোর এ বিবৃতি বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকাতে তুমুল আলোড়ন তৈরি করে। এই মাল্রো ছিলেন জাঁ কুয়ে'র আদর্শিক পথিকৃৎ। মানুষ হিসাবে, আগেই লেখা হয়েছে, জাঁ কুয়ে ছিলেন বিচিত্র ধরনের। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে, ১৯৪৩ সালের…
[...] মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সময়, যখন মহাকালের আবেদন জেগে ওঠে এমনকি তুচ্ছ প্রাণেও। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা প্রতিভাবান। ১৯৭১-এর আগস্টেই তাঁরা গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষদের। কিন্তু তেমন কিছু তো করার ছিল না জাঁ কুয়ে কিংবা মারিও রয়ম্যান্সের -- তাঁরা তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, বিমান ছিনতাই করে, পেইন্টিং চুরি করে চেষ্টা করেছেন বিপন্ন উদ্বাস্তু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। [...]