মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ : আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ নয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল যে-সব গোষ্ঠী তাদের সবার ক্ষেত্রেই অবস্থানগত মিলটি হল - এরা সবাই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে সবসময়ই হয় "গৃহযুদ্ধ" (civil war), না-হয় "অভ্যন্তরীণ সংঘাত" (internal conflict), নয়তো "ইন্দো-পাক যুদ্ধ" হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করে এসেছে। ঠিক কেন? ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে "সিভিল ওয়ার" বলে চালিয়ে দিতে পারলে ১৯৭১-এর "অপরাধীপক্ষ" আইনগত বা কৌশলগত কোনো সুবিধা পায় কি না, এবং পক্ষান্তরে তা ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের অসুবিধা বয়ে আনে কিনা, সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই লেখা।

ব্রিটেনের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা দি সানডে টাইমস-এর সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে গত ৫ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির একটি বিশেষ ক্রোড়পত্রে ফটোগ্রাফার ডন ম্যাককালিন-এর তোলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি আলোকচিত্র নিয়ে সম্প্রতি ফেসবুক এবং ব্লগসহ বেশ কিছু প্লাটফর্মে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে ((দেখুন: The Sunday Times-এর ক্রোড়পত্র Spectrum-এর ৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপানো আলোকচিত্রটি ও তার ক্যাপশন))। ছবিটিতে কলেরা-আক্রান্ত স্ত্রীকে বহনকারী জনৈক উদ্বাস্তু শরণার্থীকে দেখা যাচ্ছে। ছবিটির ক্যাপশনে বাসস্থানচ্যুতি বা displacement-এর প্রেক্ষাপট বর্ণনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে “civil war” বা “গৃহযুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই নিয়েই বিতর্ক। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই “গৃহযুদ্ধ তত্ত্বকে” ব্যবহার করার মতো একটি শ্রেণী রয়েছে যারা দেশে এবং বিদেশে যথেষ্ট সক্রিয়। তবে, এই ক্ষেত্রে দি সানডে টাইমস-এর ক্যাপশনটিকে আমার কাছে সচেতনতার অভাবজনিত একটি ত্রুটি বলে মনে হয়েছে, যা একটি দায়িত্বশীল পত্রিকার (যদিও অনেকেই সানডে টাইমসকে “দায়িত্বশীল”-দের কাতারে ফেলেন না) পক্ষ থেকে হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু এই ক্যাপশনটিকে কেন্দ্র করে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা কারণেই প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যাঁরা “সিভিল ওয়ার” হিসেবে বর্ণনা করেছেন বা এখনো করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন — সাম্প্রতিকদের মধ্যে শর্মিলা বোস, ইয়াসমিন সাইকিয়া; একটু পুরনোদের মধ্যে হামুদুর রহমান কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস (ICJ)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও রয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তীকালের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়া, যারা অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে “সিভিল ওয়ার” হিসেবেই বর্ণনা করে এসেছে।

লক্ষণীয় বিষয় হল, মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল যে-সব গোষ্ঠী (যেমন: তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী), কিংবা অপরাধীচক্রের সহায়তাকারী বা সহযোগী হিসেবে যারা যুক্ত ছিল (যেমন: জামায়াতে ইসলামী, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদি), কিংবা যারা এযুগেও তাদের সমর্থক — তাদের সবার ক্ষেত্রেই একটা বিষয়ে অবস্থানগত একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায় – আর তা হল, এরা সবাই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে সবসময়ই হয় “গৃহযুদ্ধ” (civil war), না-হয় “অভ্যন্তরীণ সংঘাত” (internal conflict), নয়তো “ইন্দো-পাক যুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করে এসেছে। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন?

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে — ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে যদি নিছক একটি “অভ্যন্তরীণ সংঘাত” হিসেবে, কিংবা বাংলাদেশের কথা পুরোপুরি বাদ দিয়ে একে “পাক-ভারত যুদ্ধ” হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তার একটা রাজনৈতিক সুবিধা তো থাকেই। কারণ, এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ব্যাপ্তি, এর পেছনে বাঙালির গড়ে ওঠা সংগ্রাম, অকল্পনীয় ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত একটি জাতির সকল অর্জনকে ছোট করা যায়। কিন্তু এর বাইরেও এই জাতীয় প্রচারণাগুলোর একটি আইনগত উদ্দেশ্যও রয়েছে। বহু-প্রতীক্ষিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। সেই প্রেক্ষাপটে, নিজেদের ধারণাগুলো আরেকবার ঝালিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে আসুন দেখার চেষ্টা করি মুক্তিযুদ্ধকে “সিভিল ওয়ার” বলে চালিয়ে দিতে পারলে ১৯৭১-এর “অপরাধীপক্ষ” ((তৎকালীন (পশ্চিম) পাকিস্তান প্রশাসন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর)) আইনগত বা কৌশলগত কোনো সুবিধা পায় কি না, এবং পক্ষান্তরে তা ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের অসুবিধা বয়ে আনে কিনা।

 

ক. “আগ্রাসনের অপরাধ” কেবল আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের ক্ষেত্রেই হতে পারে

আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এক দেশের আরেক দেশের ওপর আক্রমণ বা আগ্রাসন (aggression) বেআইনী, যদি না তা আত্মরক্ষামূলক হয়, কিংবা তার পেছনে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সমাজের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মধ্য দিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কার্যক্রম শুরু হল, তা আসলে কী ছিল? মুক্তিযুদ্ধ যদি অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কেবল একই দেশের ভেতর বিশেষ একটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বই তো অন্য কিছু না। আর যদি সেটা একটি স্বাধীন দেশের আরেকটি স্বাধীন দেশের ওপর আক্রমণ হয়ে থাকে, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের দিক থেকে ২৫ মার্চের আক্রমণ ছিল স্পষ্টতই আগ্রাসন, এবং এর পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশের মাটিতে কাটানো তাদের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল বেআইনী দখলদারিত্ব (illegal occupation), এবং বলাই বাহুল্য, আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ((১৯৭১ এর সশস্ত্র সংঘাতকালীন সময়টুকু এবং সংঘাতের পক্ষদের বোঝার ক্ষেত্রে সংশয় দূর করার স্বার্থে এই লেখায় পাকিস্তান এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানকে সমার্থক (interchangeable) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং একইভাবে বাংলাদেশ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে সমার্থক হিসেবে ব্্যবহার করা হয়েছে)) আগ্রাসন বা শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ (crime against peace) ন্যুরেমবার্গ নীতিতেও ((নীতি VI(a): Crimes against peace: (i) Planning, preparation, initiation or waging of a war of aggression or a war in violation of international treaties, agreements or assurances; (ii) Participation in a common plan or conspiracy for the accomplishment of any of the acts mentioned under (i). )) স্বীকৃত অপরাধ, পরবর্তীকালে যা জাতিসংঘ সনদেও ((দেখুন ৭ম অধ্যায়)) অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনের ৩(২)(খ) ধারাতেও “শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ”কে বিচার এবং শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে।

উল্লেখ প্রয়োজন, “আগ্রাসন” প্রযোজ্য হতে হলে যুদ্ধটি হতে হবে আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয়, গৃহযুদ্ধ হলে হবে না। প্রশ্ন হল, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করে, তখন কি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল? নাকি অখন্ড পাকিস্তানের অংশ ছিল? নীচে আরও বিস্তারিত লিখছি, তবে আপাতত এখানে বলে রাখছি — সংজ্ঞানুযায়ী ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ সন্দেহাতীতভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল যা আন্তর্জাতিক আইনের সাম্প্রতিকতম ধারণা দ্বারাও সমর্থিত। সুতরাং —

(১) বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধটি ছিল আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ তো নয়ই,
(২) বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করার ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণ্য হবে “শান্তি বিনষ্টকারী” বা “আগ্রাসী শক্তি” হিসেবে,
(৩) স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভু্যুদয়ের মুহুর্ত (নিচে বিস্তারিত) থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিলোপ ঘটে, এবং তা বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিতি লাভের অধিকার অর্জন করে,
(৪) নয় মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান ছিল অবৈধ দখলমূলক (illegal occupation), এবং
(৫) মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাঁদের সহযোগীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল আত্মরক্ষামূলক।

সুতরাং, উপরের আলোচনার পর এটা নিশ্চয়ই আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই কেন একটি পক্ষ সবসময়ই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা গৃহযুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। মজার ব্যাপার হল, এমনকি যদি তর্কের খাতিরেও আমরা ১৯৭১-এর যুদ্ধকে “গৃহযুদ্ধ” হিসেবে মেনে নিই, তাতেও কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত যাবতীয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যা জায়েজ হয়ে যায় না। কারণ, আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে চাইলেই কোনো সরকার এমনকি তার নিজের নাগরিকদের ওপরও এই মাত্রায় ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না যা গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে; তা সে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরেই হোক কিংবা আর যে-উদ্দেশ্যেই হোক।

 

খ. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠিক কবে থেকে?

মুক্তিযুদ্ধ আসলে “গৃহযুদ্ধ” নাকি “আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ” ছিল, সে প্রশ্নের মীমাংসার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তারিখটি নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের দোসরদের যাবতীয় অপরাধ সংঘটনের কাল হল ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, প্রায় নয় মাস। এবং এই নয় মাস পাকিস্তানী শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিও প্রবল সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধকাল বলি। এখন প্রশ্ন হল, এই অপরাধগুলো পাকিস্তানীদের দিক থেকে কি নিজ রাষ্ট্রের একাংশের উপর করা হয়েছিল (যেমনটি হয়েছে বালুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে), নাকি আরেকটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগণের উপর করা হয়েছিল? যদি প্রথমটি হয়ে থাকে তাহলে অপরাধগুলো কিংবা পুরো সশস্ত্র সংঘাতটিকেই “অভ্যন্তরীণ সংঘাত” বা “গৃহযুদ্ধ” হিসেবেই দেখতে হবে। কিন্তু যদি পরেরটি হয়ে থাকে, তাহলে সশস্ত্র সংঘাতের প্রকৃতিই গুণগতভাবে বদলে যায়। কিন্তু পরেরটি তখনই প্রযোজ্য হবে যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পুরো সশস্ত্র সংঘাতকাল এবং অপরাধ সংঘটনের নয় মাসই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হয়।

এখানে বালুচ বা পাঞ্জাবীদের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মূল যে পার্থক্য তা হল, বাঙালিরা এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। এভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করাকে বলা হয় Unilateral Declaration of Independence বা সংক্ষেপে UDI. এখন কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, জনগোষ্ঠীর কোনো একটি অংশ কি এভাবে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলেই তারা স্বাধীন হয়ে যাবে এবং এর ফলে তারা একটি পৃথক রাষ্ট্র হয়ে যাবে? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কারণ, এভাবে যদি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একাংশ নিজেদের খেয়ালখুশিমতো স্বাধীনতা ঘোষণা করতেই পারতো তাহলে পৃথিবীর দেশগুলো আরও বহু ছোট ছোট টুকরো হয়ে যেতো। এভাবে স্বাধীন হওয়া বা রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অভ্যুদয় (Statehood) বলবৎ করার বিষয়টি এবং অন্য রাষ্ট্রসমূহের চোখে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিরূপিত হয়ে থাকে।

ঠিক কখন একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় বলবৎ হবে তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত চালু আছে। একটি স্বীকৃতিযোগ্য সার্বভৌম রাষ্ট্র অনেকভাবে তৈরি হতে পারে, যেমন: আন্তর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে, চুক্তির মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে, অন্য রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতির মাধ্যমে, নির্দিষ্ট একটি ভুখন্ডে নির্দিষ্ট জনগণের নিজেদের প্রশাসন ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আবার কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নিরিখে এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার (UDI) মাধ্যমেও একটি রাষ্ট্র “স্বাধীন সার্বভৌম” হয়ে উঠতে পারে, ঠিক যেমনটি ঘটেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ক্ষেত্রে; এই ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব অন্য কোন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে না। যেটা বোঝা জরুরী তা হল – বাঙালিদের এই একক ঘোষণা কোনো বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর আকস্মিক কোনো ঘোষণা ছিল না; বরং সে ঘোষণা এসেছিল এমন এক জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছ থেকে, যারা এর ঠিক আগের সাধারণ নির্বাচনেই নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল। এবং সেটি ছিল এমনই এক নির্বাচন যার ম্যানডেটের মূলেই ছিল ‘ঐতিহাসিক ছয় দফা’, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর কয়েক দশকের বৈষম্য ও শোষণের বয়ান এবং তা থেকে মুক্তির দাবী দলিলবদ্ধ করা হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে ভিত্তিমূল, তা রচিত হয়েছিল এখানেই। সুতরাং, বাঙালির তথা পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষ থেকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর হয়ে যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন সে ঘোষণা আর সব কিছুকেই ছাপিয়ে যায়। বাঙালির স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় তখন কোনো আন্তর্জাতিক মহলের সমঝোতা, বা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করে বসে থাকে না। কারণ, জাতিসমূহের এবং জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের যে অধিকার (right of self-determination) তা এতোই মৌলিক যে তা আর সব আইনী আনুষ্ঠানিকতাকে ছাপিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের আইনী বৈধতার (legitimacy) জন্ম দেয়।

এই কারণেই, আগেই লিখেছি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ঠিক কবে থেকে পৃথক এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হচ্ছে, তা সুস্পষ্টভাবে বুঝে-নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ বোঝার জন্যই দরকারী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন এবং সার্বভৌম হয়ে ওঠার এই মুহূর্তটি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখের যে-কোনো একটি থেকে। উল্লেখ্য, এই তারিখগুলোর কোনোটিই কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর নয়, কিংবা পরবর্তীকালে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয়ার তারিখও নয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হল সেই দিন যেদিন আমরা বিজয় অর্জন করেছি, স্বাধীনতা নয়। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আরও আগে হয়েছে। স্বাধীন দেশ বাংলাদেশকে আগ্রাসী পাকিস্তান বাহিনীর দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার যে যুদ্ধ তাকে এজন্য Liberation War বলা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF)-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে (ডাউনলোড লিংক) এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছিল, সেখান থেকে কিছু বিষয় নীচে তুলে ধরছি। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সম্ভাব্য কয়েকটি তারিখ হল:
১) ২ মার্চ ১৯৭১: এই দিন স্বাধীন বাংলার পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলিত হয়। এই সময়টিকেই বর্ণনা করতে গিয়ে এমনকি ICJ-এর সেক্রেটারি জেনারেল নিয়াল ম্যাকডারমট-ও (যিনি নিজেও ১৯৭১-কে “গৃহযুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন) স্বীকার করে নিয়েছেন — “it is hardly an exaggeration to say that Awami League led by Mujibur Rahman provided the de facto government of East Pakistan” ((Niall Macdermot. “Crimes Against Humanity in Bangladesh”. International Lawyer 7.2 (1973): 476-484, at p.477. Available at ICSF E-Library: http://icsforum.org/library/show.php?record=34))।

২) ২৬ মার্চ ১৯৭১: আগ্রাসী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটিও (Declaration of Independence) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মুহূর্তটিকে নির্দেশ করে। আগেই বলেছি, এখানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা অন্য যে-কোনো সাধারণ নেতার বা ব্যক্তির দেয়া ঘোষণা থেকে আলাদা। কারণ, ঘোষণাটি আসছে এমন একজনের কাছ থেকে যিনি দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা। নির্বাচনের ফলাফল এবং ম্যানডেট-ই সে নিরঙ্কুশতার প্রমাণ, আর সে নির্বাচনও ছিল এমনই এক নির্বাচন যার মূল চালিকা শক্তিই ছিল ঐতিহাসিক ৬ দফা, যা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে লিপিবদ্ধ-করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

৩) ১০ এপ্রিল ১৯৭১: এই তারিখে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথমটি ‘স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা’ ((একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। ২৬ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা’ থেকে আলাদা। )) (Proclamation of Independence) যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সংবিধানের অংশ করে নেয়া হয়; এবং, দ্বিতীয় ঘটনাটি হল প্রবাসে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন। এখানে যেটা লক্ষনীয় হল তা হল – ১০ এপ্রিল ঘোষিত হলেও ‘স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা’ (Proclamation of Independence)-টিকে আইনগত কার্যকারীতা দেয়া হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখ থেকেই। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “We further resolve that this proclamation of independence shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.”

এই তিনটি তারিখের মধ্যে আমরা যে-কোনো একটিকেও যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন ধরে নিতাম, তার ফলাফল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কার্যক্রম কেবল ভিন্ন একটি স্বাধীন দেশে আগ্রাসনমূলক হিসেবেই পরিগণিত হয় না, সশস্ত্র সংঘাতটিও (armed conflict) তখন একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতে (internaional war) রূপ নেয় এবং সে অনুযায়ীই গণ্য হয় — “গৃহযুদ্ধ” বা “সিভিল ওয়ার” হিসেবে নয়।

একটি দেশ ঠিক কবে থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে সেটা একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রশ্ন, ঠিক তেমনি সেটা একটি আইনগত এবং সাংবিধানিক প্রশ্নও বটে। এই বিশ্লেষণের উপসংহারে তাই যে কথাটা স্পষ্ট করা দরকার তা হল – উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তারিখ ২৬ মার্চ ১৯৭১ । কারণ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাতেও শেষ পর্যন্ত সেই দিনটিকেই স্থির করে আইনগত এবং সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে । দেশকে আগ্রাসী শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করা বিজয়ের তারিখ (১৬ ডিসেম্বর), কিংবা স্বাধীন দেশ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিংবা জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি লাভের তারিখগুলোর সাথে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের তারিখের কোনো সম্পর্ক নেই।

 

গ. আন্তর্জাতিক আইনে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করবার অধিকার

বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং সে অনুযায়ী নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার অধিকারের ভিত্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। ICSF-এর পূর্বোক্ত গবেষণাতেও বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে আমি এখানেও উল্লেখ করছি। জাতিসংঘের ১৯৭০ সালের রেজোল্যুশন ২৬২৫(XXV) ((আনুষ্ঠানিক নাম: Declaration on the Principles of International Law concerning Friendly Relations and Co-operation among States in accordance with the Charter of the United Nations (A/8082). ই-লাইব্রেরি লিংক: http://icsforum.org/library/files/328_UNGeneralAssembly.pdf । “By virtue of the principle of equal rights and self-determination of peoples enshrined in the Charter of the United Nations, all peoples have the right to freely determine, without external interference, and their political status and to pursue their economic, social and cultural development, and every State has the duty to respect this right in accordance with the provisions of the Charter. . . The establishment of a sovereign and independent State, the free association or integration with an independent State or the emergence into any other political status freely determined by a people constitute modes of implementing the right of self-determination by that people.”)) মতে, সব ধরণের প্রভাব এবং চাপ থেকে মুক্ত থেকে নিজেদের পছন্দের সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পরিচয়, এবং নিজেদের অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শাসনের প্রক্রিয়া নির্ধারণের অধিকার “জনগণের”। আর ১৯৭১-এ এই “জনগণের” আকাঙ্ক্ষা ঠিক কী ছিল তা ৬-দফা দলিলেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে একক স্বাধীনতার ঘোষণার (UDI) বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস একটি যুগান্তকারী রায় দেন। একক ঘোষণার মাধ্যমে কসোভোর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে ওঠার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া এই রায়ে ((Advisory Opinion of the International Court of Justice determining Accordance with International Law of the Unilateral Declaration of Independence in respect of Kosovo. International Court of Justice, 2010. Full text of the judgment available for download at ICSF E-library: http://icsforum.org/library/show.php?record=258.)) বলা হয়:

During the eighteenth, nineteenth and early twentieth centuries, there were numerous instances of declarations of independence, often strenuously opposed by the State from which independence was being declared. Sometimes the declaration resulted in the creation of a new State, at others it did not. In no case, however, does the practice of States as a whole suggest that the act of promulgating the declaration was regarded as contrary to international law. On the contrary, State practice during this period points clearly to the conclusion that international law contained no prohibitions of declarations of independence. During the second half of the twentieth century, the international law of self-determination developed in such a way as to create a right to independence for the peoples of non-self-governing territories and peoples subject to alien subjugation, domination and exploitation. [অনুচ্ছেদ — ৭৬]

সুতরাং, এককভাবে ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এখন আর কোনো সংশয়েরই অবকাশ নেই।

 

ঘ. অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক সমাজের হস্তক্ষেপের দায়

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা যখন বাংলাদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ব্যাপক গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ছিল, তখন সীমিত পরিসরে হলেও পুরো বিশ্বের কাছে সে-খবর পৌঁছে যায়। আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে চলমান গণহত্যা বন্ধে হস্তক্ষেপও কামনা করা হয়। এ ধরণের পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যে-যুক্তিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে তা হল — কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপক্ষসমূহের হস্তক্ষেপ করা উচিত না!

সুতরাং, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যদি দুটি পৃথক রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংঘাত (international armed conflict) না হয়ে অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত (internal armed conflict) বা গৃহযুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে, অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে তাতে হস্তক্ষেপ কঠিন হয়ে যায়। সুতরাং ১৯৭১-এর বিরোধী পক্ষসমূহের মধ্যে একটি পক্ষ এবং তাদের কূটনৈতিক বন্ধুরা যে সর্বশক্তিতে বাকি পৃথিবীকে এই সংঘাতে হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, তাতে পাকিস্তানের আগ্রাসী শক্তি তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হোক বা যেভাবেই হোক না কেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অটুট রাখার চেষ্টা শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে পারে, আর আন্তর্জাতিক মহলও “অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি”র দোহাই দিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত যখন বাংলাদেশকে নানাভাবে (যেমন: শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, প্রবাসী সরকারকে আশ্রয়দান) সহায়তা করছিল তখন ভারতের দিক থেকে “মানবিক সহায়তামূলক হস্তক্ষেপ” (humanitarian intervention) এবং “আত্মরক্ষামূলক হস্তক্ষেপ” এর যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান আর তার সমর্থক বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ (যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, চীন) ভারতের “মানবিক সহায়তামূলক হস্তক্ষেপকে” সমালোচনা করেছিল একে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে (পড়ুন: অভ্যন্তরীন সশস্ত্র সংঘাত) ভারতের অবৈধ হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করে।

উপরে লিখেছি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ করা “কঠিন”, যদিও ঠিক “অসম্ভব” নয়। কারণ, ১৯৭১-এর পর আন্তর্জাতিক আইনের উপলদ্ধিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি যেমন রয়েছে, তার বিপরীতে সমান শক্তিশালী পাল্টা নীতিও রয়েছে, যেমন: “আন্তর্জাতিক মহলের নিপীড়িতকে রক্ষা করার দায়” (Responsibility to Protect)। যাই হোক, সে অন্য বিষয়; তোলা থাকলো অন্য কোনো লেখার জন্য। বতর্মানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শুধু এটুকু মনে রাখলেই চলবে যে, ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধসমূহের প্রেক্ষাপটকে “গৃহযুদ্ধ” বা “অভ্যন্তরীণ সংকট” বলে চালিয়ে দিলেও সংঘটিত অপরাধ কিছুমাত্র লাঘব হয় না, আন্তর্জাতিক আইনের আধুনিক উপলদ্ধির আলোকে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপের দায়ও তাতে কিছুমাত্র কমে যায় না।

 

উপসংহার

সৌভাগ্যক্রমে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের আলোকে কোনো সশস্ত্র সংঘাত “গৃহযুদ্ধ” নাকি “আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত”, তাতে এর আইনগত ফলাফলে এখন আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ, আইনের দৃষ্টিতে সংঘটিত “আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোই” (যেমন: যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ) এখন মূল বিচার্য বিষয়, সশস্ত্র সংঘাতের প্রকৃতি নয়। তাই, সশস্ত্র সংঘাতের প্রকৃতি সংক্রান্ত পার্থক্যটুকু বর্তমানে অনেকটাই “একাডেমিক”। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯)-এর প্রোটোকল-১ [অনুচ্ছেদ ১(৪)] ((অনুচ্ছেদ ১(৪):”The situations referred to in the preceding paragraph include armed conflicts in which peoples are fighting against colonial domination and alien occupation and against racist regimes in the exercise of their right of self-determination, as enshrined in the Charter of the United Nations and the Declaration on Principles of International Law concerning Friendly Relations and Co-operation among States in accordance with the Charter of the United Nations.” এই অনুচ্ছেদটির সাথে মিলিয়ে পড়ুন অনুচ্ছেদ ৯৬(৩): “The authority representing a people engaged against a High Contracting Party in an armed conflict of the type referred to in Article 1, paragraph 4, may undertake to apply the Conventions and this Protocol in relation to that conflict by means of a unilateral declaration addressed to the depositary. Such declaration shall, upon its receipt by the depositary, have in relation to that conflict the following effects: (a) the Conventions and this Protocol are brought into force for the said authority as a Party to the conflict with immediate effect; (b) the said authority assumes the same rights and obligations as those which have been assumed by a High Contracting Party to the Conventions and this Protocol; and (c) the Conventions and this Protocol are equally binding upon all Parties to the conflict.” http://www.icrc.org/ihl.nsf/FULL/470?OpenDocument))-এর মাধ্যমে খুব স্পষ্টভাবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংঘাত (international armed conflict)-এর সংজ্ঞার আওতায় জনগণের পক্ষ থেকে সকল ধরণের সশস্ত্র সংঘাতকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যেখানেই সশস্ত্র সংঘাতের উদ্দেশ্য ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই, বহিঃশক্তির দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই, বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই, সেখানেই জাতিসমূহের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার (Right to Self-Determination) প্রাধান্য পাবে। এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন কেবল ঔপনিবেশিক শোষণমূলকই ছিল না, ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন বর্ণের পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দিক থেকে তা ছিল একইসাথে বাঙালিদের প্রতি জাতিবিদ্বেষমূলকও। একথা এখন দলিলবদ্ধ সত্য। বলাই বাহুল্য, অপরাধী পক্ষের অপরাধ নিরূপণে “আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ” এবং “গৃহযুদ্ধের” মধ্যে পার্থক্যটুকু নিতান্তই তত্ত্বীয় হওয়ার পরও এই পার্থক্যটুকুকেই পুঁজি করে ১৯৭১-এর অপরাধীপক্ষ “গৃহযুদ্ধ তত্ত্ব”-কে বারবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, এবং ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে – এর পেছনে উদ্দেশ্য হল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা, ইতিহাস বিকৃত করা, এবং এর পাশাপাশি আইনগত ফলাফল নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করা।

———————————————
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
— আইসিএসএফ-এর লিগ্যাল টিম-এর সহযোদ্ধাদের প্রতি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট-এর একটি রিপোর্টের প্রত্যুত্তরে গবেষণাপত্রটি যারা লিখেছেন।

———————————————

  • রায়হান রশিদ

    জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.