পিআইএ ৭১১, ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’ এবং ১৯৭১

[...] মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সময়, যখন মহাকালের আবেদন জেগে ওঠে এমনকি তুচ্ছ প্রাণেও। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা প্রতিভাবান। ১৯৭১-এর আগস্টেই তাঁরা গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষদের। কিন্তু তেমন কিছু তো করার ছিল না জাঁ কুয়ে কিংবা মারিও রয়ম্যান্সের -- তাঁরা তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, বিমান ছিনতাই করে, পেইন্টিং চুরি করে চেষ্টা করেছেন বিপন্ন উদ্বাস্তু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। [...]

অক্টোবর ১৯৭৩। বিমান হাইজ্যাকার জাঁ কুয়ে’র বিচার হচ্ছে ফ্রান্সের আদালতে। বছর দুয়েক আগে পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ফ্রান্স সফরে আসার দিন প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এক যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে পশ্চিমা বিশ্বে হইচই ফেলে দেন জাঁ কুয়ে। হঠাৎ জানা গেল, সেই জাঁ কুয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যেই কি না আদালতে উপস্থিত হতে চলেছেন ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মাল্‌রো!

জাঁ কুয়ে

জাঁ কুয়ে

বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। খ্যাতিমান দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক মাল্‌রো, যিনি ৭০ বছর বয়সে পৌঁছেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অস্ত্র ধরতে চেয়েছিলেন, তিনি কি না সাফাই গাইতে আসছেন এক হাইজ্যাকারের! কী এমন ঘটেছিল যে, মাল্‌রো মতো একজন সজ্জন দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ককে সেদিন এই হাইজ্যাকারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল? আর সেই মামলায় জাঁ কুয়ের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছিলেন ফ্রান্সের প্রখ্যাত আইনজীবী জাঁ মার্ক ভারাউত?

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের প্যারিস শহরে নিবিষ্ট মনে জাঁ কুয়ে লিখে চলেছেন তাঁর বই ‘দ্য উয়েপন ইন দ্য হার্ট’। ফরাসি লেখক জাঁ ইউজিন পল কুয়ে ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, চলার পথে বিভিন্ন মতাদর্শের সংস্পর্শে তার জীবন হয়ে উঠেছিল অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ, নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শিক অবস্থানে এসে থিতু হয়েছিলেন — হয়ে উঠছিলেন ক্রমশই বিশ্বমানব, বিশ্বপথিক। বাবার বাড়ির কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্টে দিনের পর দিন লেখালেখিতে একমনা কুয়ে’র চোখ বই লেখা শেষ হতেই গিয়ে পড়ল সারা বিশ্বের ঘটনাবলীর দিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে।

কেন বিশেষভাবে বাংলাদেশই কুয়ে’র দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছিল? অনুমান করছি, আঁদ্রে মাল্‌রো-ই এর মূল কারণ। ১৯৭১-এর শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে বের হন। প্রায় একই সময়ে আঁদ্রে মাল্‌রো পত্রপত্রিকায় এমন এক বিবৃতি দেন, যা এক দিকে ইন্দিরা গান্ধীর এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করে তোলে। তিনি তার ওই বিবৃতিতে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার ইচ্ছা জানান। মাল্‌রোর এ বিবৃতি বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকাতে তুমুল আলোড়ন তৈরি করে।

এই মাল্‌রো ছিলেন জাঁ কুয়ে’র আদর্শিক পথিকৃৎ। মানুষ হিসাবে, আগেই লেখা হয়েছে, জাঁ কুয়ে ছিলেন বিচিত্র ধরনের। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে, ১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি, আলজেরিয়ার মিলিয়ানাতে। তবে খুব অল্প সময়ই তিনি তাঁর জন্মভূমিতে কাটিয়েছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলাতেই জন্মভূমির আস্বাদ বুঝে ওঠারও আগেই স্থানান্তরিত হন কুয়ে। তাঁর বাবা, সামরিক বাহিনীর সিগন্যাল কর্মকর্তা, ওই সময় ব্রিটানি’র মিলিটারি একাডেমিতে বদলি হয়ে যান। তার আরেক ভাইও ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। মাত্র আট বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি এবং মাতৃহীন পরিবারে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের গোঁড়ামিতে ভরা শিক্ষাই পেতে শুরু করেন। তিনি এমন শিক্ষা পান, যা তাকে শিক্ষা দেয় টাকার জন্যে নয়, বরং আদর্শের জন্যে জীবন দিয়ে দিতে।

বাবার মতো কুয়েও ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর একজন। কিন্তু অচিরেই তিনি বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে এবং যুক্ত হন ওএসএস-এ। এই গোপন বাহিনী আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে মনে করত। ওএসএস-এর অন্য সদস্যদের মতো কুয়েও মনে করতেন যে, আলজেরিয়াকে কিছুতেই ফ্রান্সের মানচিত্র থেকে বাদ দেয়া যাবে না। ক্রমশই তিনি পরিণত হচ্ছিলেন বদ্ধ চিন্তার মানুষে। খ্রিস্টীয় মূল্যবোধে প্রাণিত জাঁ কুয়ে ছিলেন সাম্যবাদের ঘোরতর বিরোধী। ‘এই আদর্শ অন্যায়, দুর্নীতি, অবিচার ও মৃতুøর জন্ম দেয়’ — সাম্যবাদ সম্পর্কে এই ছিল জাঁ কুয়ের ধারণা। কিন্তু আঁদ্রে মাল্‌রোর লেখা পড়ে জাঁ কুয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় এবং তিনি ওএসএস থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে পুরনো মতাদর্শ ছেড়ে এলেও এর কার্যপ্রণালীর প্রতি তার আকর্ষণ ছিল ষোলআনাই। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে তিনি যুক্ত হয়েছেন স্পেন, লিবিয়া ও বায়াফ্রার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে।

আঁদ্রে মাল্‌রোর বিবৃতিও তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের জন্যে কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি এ কাজে তার চেনা পথই অনুসরণ করেন — তেসরা ডিসেম্বর তিনি এমন এক ঘটনা ঘটান যা দেশে-বিদেশে আলোচিত হতে থাকে। পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই, পৃথিবীর মানুষ জানতে শুরু করে, হতবাক করে দেয়ার মতো এক ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর এমন এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে, যার কি না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার অধিকার রয়েছে; এই রাষ্ট্রের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং হাইজ্যাক করেছেন জাঁ কুয়ে।

ছিনতাই করা বিমান পিআইএ

‘আমার কাছে অস্ত্র আছে, বোমাও আছে, আমার কথা না শুনলে এ বিমান উড়িয়ে দেব’ — ককপিটে ঢুকে বোয়িংটি হাইজ্যাক করার সঙ্গে সঙ্গে জাঁ কুয়ে এ কথার পাশাপাশি ঘোষণা দেন, বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে এ বিমানের মাধ্যমে ২০ টন মেডিক্যাল সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বসহ বিশ্বের সব মানুষের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায় — নিছক টাকা-পয়সা নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালদের নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব বাঙালি উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, রোগেশোকে ভুগছিলেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর তীব্র এক মানসিক তাড়না থেকে কম্যুনিস্ট বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।

ওই দিন ফ্রান্স সফর করছিলেন পশ্চিম জার্মানির ওই সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। ফরাসি রাষ্ট্রপতি পম্পেদুর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্যে ফ্রান্স সফরে গিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের শীতল সম্পর্ক নিরসনের নিরিখে এই সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই উইলি ব্র্যান্ডটের সফরের দিনেই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ফ্রান্সের জন্যে হয়ে দাঁড়ায় স্পর্শকাতর একটি বিষয়।

‘আমার কথা না শুনলে বিমান উড়িয়ে দেব’ — জাঁ কুয়ে’র এই কথা যে কথার কথা ছিল না, তা বিমানের যাত্রীদের বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল না। কুয়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছিল বোমার সঙ্গে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার। বিমানে ছিলেন ২৮ জন যাত্রী। প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এ ঘটনার শুরু হয় স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে। আর তার অবসান ঘটে বিকেলে। বিকেল পাঁচটা ১৫ মিনিটে জাঁ কুয়ে’র দাবি মেনে নেন ফরাসি কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দরে ওষুধের প্রথম চালান এসে পৌঁছায়। কুয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম দফায় শিশুসহ আট বিমানযাত্রীকে মুক্তি দেন।

জাঁ ক্যুয়েকে আটক করার পর বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ

পেশাদার হাইজ্যাকার নন বলেই বিমান হাইজ্যাক করার পরও জাঁ কুয়ে যাত্রীদের প্রতি ছিলেন সদয়। ফরাসি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই জানা ছিল না কুয়ের। তাই যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন দোভাষী নিয়োগ করেন তিনি। কিন্তু তারপরও বিশেষ করে পাকিস্তানি যাত্রীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কেননা কুয়ে জানান, ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর আগে বেলরুটে পাকিস্তানি ছাড়া অন্য সব যাত্রীকেই নামিয়ে দেবেন তিনি।

কিন্তু জাঁ কুয়ে বিষয়টিকে যত সহজ মনে করেছিলেন, বাস্তবে তা তত সহজ ছিল না। কর্তৃপক্ষ সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তার প্রস্তাবে; কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে, তারা বিকল্প পথে ছিনতাই হয়ে যাওয়া বিমান ও সেটির যাত্রীদের বিকল্প পথে উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন না। জাঁ কুয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন, মেডিক্যালসামগ্রী তোলার পর পিআইএ’র এই ফ্লাইটে করেই ভারতে চলে যাবেন। প্রথম দফায় তিনি যেসব যাত্রীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাদের কাছে পৌঁছানোর আগেই তারা রওনা হয়ে যান প্যারিসের দিকে। বিমানের রানওয়েতে তখনও অ্যান্টি-এয়ার ইনফেকশন, পাউডার মিল্ক ইত্যাদি অপরিহার্য জিনিসপত্রসহ মেডিসিন তোলার কাজ চলছে। কুয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন আসবে ওষুধপত্রের দ্বিতীয় চালান। রাত ৭টার দিকে মেডিক্যাল সামগ্রী ভর্তি দ্বিতীয় ট্রাকটি এসে পৌঁছে বিমানের কাছে। কিন্তু এই পর্বে ওয়্যরহাউজম্যানদের বেশে আসেন পুলিশের কর্মকর্তারা। এমনকি বিমানের ক্রুরাও বুঝতে পারেননি, এরা আসলে পুলিশের লোকজন। এদের হাতেই ধরা পড়েন জাঁ কুয়ে। পেনিসিলিন পৌঁছানোর ছলে এক পুলিশ পৌঁছে যায় ককপিটের কাছে। কুয়ের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন তিনি।

জাঁ কুয়েকে আটক করেছিলেন পুলিশ অফিসার অ্যান্তোইন সিবলো। সাংবাদিকদের কাছে পরে তিনি বলেছিলেন, জাঁ কুয়ের সেই অসতর্ক মুহূর্তটির কথা। তিনি ছিলেন কুয়ের কাছাকাছি এবং মুহূর্তটিকে কাজে লাগাতে একটুও দেরি করেননি তিনি। তাদের দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে চমকে ওঠেন তিনি এবং তারপরই গুলি করেন সিবলোকে লক্ষ্য করে। গুলি এড়ানোর জন্যে দ্রুত সরে যান তিনি এবং বুলেট ছুঁয়ে যায় তার পুলওভার ও ব্লেজার।

তবে জাঁ কুয়ে ধরা পড়লেও তার বিমান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য ছুঁয়ে গিয়েছিল ফরাসিদের সবার হৃদয়। জাঁ কুয়ে ধরা পড়ার পরপরই সাংবাদিকরা মালতে অদ্রে’র (দ্য অদ্রে অব দ্য নাইটস হসপিটালিয়ার্স অব মালতে) এক কর্মকর্তা মার্কেজ অব অগোস্‌টি’র কাছে মেডিক্যাল সামগ্রীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাই বলেছিলেন, ‘আমরা এসব সামগ্রী মালটা অর্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানেই (অর্থাৎ বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্যে) নিয়ে যাব, কেননা সেগুলোকে তো সেখানেই পাঠানোর কথা হয়েছে।’

এরই মধ্যে ভারতও বাংলাদেশের মতোই পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ডামাডোলে বিমান ছিনতাইয়ের এ ঘটনার গুরুত্ব কমে যায়। তবে এনবিসি এবং সিবিএস টিভিতে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রচারিত হয়। এসব খবরেও জানানো হয়, জাঁ কুয়েকে গ্রেফতার করা হলেও মেডিক্যাল সামগ্রী বাংলাদেশের জন্যে পাঠানো হবে।

জাঁ কুয়েকে গ্রেফতার করার পর দেখা গেল, তার ব্যাগের মধ্যে বোমার ‘ব’ থাকলেও বোমা-টোমা কিছু নেই। বোমার সেই ‘ব’ হলো কিছু এলোমেলো বই, একটি মোটাসোটা বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রনিক রেজর, যার মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ব্যাগের বাইরে একটি বৈদ্যুতিক তার।

এইভাবে জাঁ কুয়ে বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। বিচারের সময় আদালতে তার পক্ষে এসে হাজির হন ফ্রান্সের অনন্য রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্বযুদ্ধ ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের সরাসরি যোদ্ধা, দ্য গলের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, দার্শনিক আঁদ্রে মাল্‌রো — যিনি নিজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নিক্সনের কাছে এক চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের দৈনিক লে ফিগারোতে প্রকাশিত হয় তার সে চিঠি। এই আঁদ্রে মার্লো যে জাঁ কুয়ের পক্ষে আদালতে যেতে দ্বিধা করবেন না, তাতে আর সন্দেহ কী!

১৯৭৩-এর অক্টোবরে আঁদ্রে মাল্‌রো জাঁ ক্যুয়ের পক্ষে আদালতে গিয়েছিলেন; একই বছর তিনি রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন, যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা ও যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় তার। তিনি কি এ সাক্ষাতের সময় জাঁ কুয়ের কথা বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে? এর উত্তর জানা নেই আমাদের। তবে বিচারে জাঁ কুয়ের ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ততদিনে তার বই ‘উয়েপন ইন দ্য হার্ট’ বাজারে এসে গেছে, তা ছাড়া জেলে বসে তিনি লিখেছিলেন আরেকটি উপন্যাস ‘লেস ফাউস ওয়্যর’। তবে ইতিমধ্যেই তিন বছরের কারাবাস হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৩-এর শেষের দিকেই জাঁ কুয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি লেবাননে ফিরে যান এবং আবারও ‘খ্রিস্টীয় ফ্যালাঞ্জি’দের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন।

একজন লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরও জাঁ কুয়ে’র শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা তত পরিষ্কার নয়। যতদূর জানা যায়, জাঁ কুয়ে এবং তার পরিবার নব্বইয়ের দশকে তাদের সবচেয়ে ছোট মেয়েটিকে বড় করে তোলার জন্যে বেছে নেন স্পেনের বার্সেলোনা এবং তোলাউস অঞ্চলের মধ্যবর্তী কোনো এলাকাকে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশ পায় তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ওয়ারির অব হোপ’। ফরাসি ভাষায় লেখা তার এ বইয়ে পিআইএ’র বিমান হাইজ্যাক পর্বটিকে জাঁ কুয়ে কীভাবে বর্ণনা করেছেন, কিংবা আদৌ করেছেন কি না, তা জানা নেই আমাদের — তবে অচিরেই আমাদের ফরাসি জানা সতীর্থ বন্ধুরা বিষয়টি জানাবেন আশা করা যায়। দক্ষিণ ফ্রান্সে ছোট মেয়েকে মানুষ করে তোলার জন্য যে-স্বর্গ জাঁ কুয়ে গড়ে তুলেছিলেন, ট্রাজিক এক ঘটনায় সেটি ভেঙে তছনছ হয়ে যায় — ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার স্ত্রী মারা যান। বছর ১৫ আগে লেখা একটি বইয়ে এই দ্বীপ সম্পর্কে জাঁ কুয়ে লিখে গেছেন, ‘ভালোবাসা যেখানে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে’। ২০০৪ সালে জাঁ কুয়ে তার প্রিয় মেয়ের সঙ্গে সমুদ্রবাসে যান। এখন, হয়তো তিনি নিভৃতবাসে আছেন।

দুই·

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ঘটনাস্থল ব্রাসেল্‌স, বেলজিয়াম।

মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে সেদিনই শুরু হয়েছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ শিল্পীদের চিরায়ত সব শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনী। এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই প্রদর্শনী যে তা উন্মুক্ত করার এসেছেন ডাচ রাজকন্যা পামেলা। আমন্ত্রিতজনদের কেউই হাতছাড়া করেননি প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে আসার আমন্ত্রণ।

মারিও র‍য়ম্যান্স

পেইন্টিং নিয়ে এসে অর্থ দাবি করেন মারিও র‍য়ম্যান্স

এদেরই একজন মারিও রয়ম্যান্স। সাধারণ এক ছেলে, বয়স মাত্র ২১ বছর। এমনকি তিনি নিজেও তখন জানতেন না, আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তিনি বেলজিয়ামের অপরাধের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চলেছেন — পরিণত হতে চলেছেন ডাচদের রবিনহুডে। পরে তিনি রেডিও বিআরটিতে বর্ণনা করেছিলেন, কী করে সেদিন মিউজিয়ামে ঢোকার সুযোগ করে নিয়েছিলেন তিনি। অস্থির চোখে গ্যালারিতে টাঙানো ছবি দেখে চলেছেন রয়ম্যান্স, সঠিক শিল্পকর্মটিই বেছে নিতে চান তিনি। যত শিল্পজ্ঞানই থাক না কেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ডেনমার্কের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে নিয়ে আসা উলেস্নখযোগ্য সব শিল্পকর্মের মধ্যে থেকে ঈপ্সিত লক্ষ্যের উপযোগী একটি শিল্পকর্ম বেছে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রয়ম্যান্স তাই বারবার ঘুরেফিরে দেখছেন দেয়াল জুড়ে থাকা ছবিগুলোকে।

অবশেষে রয়ম্যান্সের চোখ স্থির হয়ে গেল ইয়োহান ভারমিয়ারের চিত্রকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার’-এ। সপ্তদশ শতাব্দীর শিল্পী ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’ নিয়ে আসা হয়েছে আমস্টারডামের রাইখস মিউজিয়াম থেকে। ছবিটির মূল্য ওই সময়েই পাঁচ মিলিয়ন ডলার- ১৫ গুণন ১৭ ইঞ্চির ক্যানভাসে আঁকা এ ছবিটিকেই সব দিক থেকে উপযোগী মনে হলো তার।

ভারমিয়ার-এর ‘দ্য লাভ লেটার’

ভারমিয়ার-এর অনবদ্য শিল্পকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার।’

প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, দর্শকরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু মারিও রয়ম্যান্স হালকা তালে ছবি দেখে চলেছেন। দেখতে দেখতেই তিনি একসময় টুক করে লুকিয়ে পড়লেন গ্যালারির একটি দেরাজের মধ্যে। এখনকার মত তখন সিসিটিভি ছিল না, নিরাপত্তা প্রহরীরও তেমন প্রয়োজন ছিল না জাদুঘরগুলোতে। ব্রাসেল্‌সের ওই মিউজিয়ামে তখন রাতের বেলা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন মাত্র চারজন নিরস্ত্র পুলিশ। দর্শকদের সবাই বেরিয়ে গেছেন ভেবে একসময় তারাও গ্যালারির দরজা বন্ধ করে দিলেন। রয়ম্যান্স তখন মটকা মেরে পড়ে আছেন দেরাজের মধ্যে।

রাত আরও একটু গভীর হতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন মারিও রয়ম্যান্স। এবার আর এদিকসেদিক নয়, সোজা ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’-এর দিকে হেঁটে গেলেন তিনি। চেষ্টা করলেন পেইন্টিংটি খুলে নেয়ার। কিন্তু সহজে খোলা যাবে না দেখে পকেটের মধ্যে থেকে বের করে আনলেন তার আলু কাটার ছুরি। ফ্রেমের চারপাশ ঘেঁষে সতর্কতার সঙ্গে কেটে আলাদা করে ফেললেন ছবির মূল ক্যানভাসটিকে। তারপর সেটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন এবং মিউজিয়ামের ভেন্টিলেটর বেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর ট্যাক্সিতে করে চলে গেলেন সোজা টঙ্গারেনের এক কয়লাখনির পাশে, সেখানেই থাকেন তিনি এক বাসায়।

পাঁচ মিলিয়ন ডলার দামের একটি ছবি — এটিকে তো এখন ঠিকমতো লুকিয়ে রাখতে হবে! অতএব মারিও বাড়ি ফিরে সেটিকে লুকিয়ে রাখলেন কাছের একটি জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, শুরু হলো বৃষ্টি। রয়ম্যান্স বিছানা ছেড়ে ছুটলেন জঙ্গলের দিকে, শিল্পকর্মটিকে নিয়ে এলেন ঘরে।

এদিকে পরদিন গ্যালারি উন্মুক্ত করার পর হতবাক হয়ে গেলেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। নেই, কোথাও নেই ভারমিয়ার-এর অনবদ্য শিল্পকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার।’ হইচই পড়ে গেল সবখানে। পুলিশ তৎপর হলো সেটি উদ্ধারের জন্যে। ওদিকে, রয়ম্যান্স সেইদিনই নিজেকে খানিকটা নিরাপদে রাখার উদ্দেশ্যে ওয়েটারের কাজ নিলেন বল্ডারবার্গের হোটেল সিতেওয়েতে।

কিন্তু কেন এ কাজ করতে গেলেন মারিও রয়ম্যান্স? এতই নিখুঁতভাবে তিনি পেইন্টিংটি চুরি করেছিলেন যে পুলিশের ধারণা জন্মেছিল, কোনো পেশাদার চোরই এ কাজ করেছে। কিন্তু রয়ম্যান্স যে নিছক চুরি করার জন্যে এ কাজ করেননি সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। পহেলা অক্টোবর রাতে হঠাৎ একটি ফোন গেল বেলজিয়ামের দৈনিক পত্রিকা ‘লা সয়ের’-এ। ফোন ধরার পর পত্রিকা থেকে জানতে চাওয়া হলো, ‘কে বলছেন?’

‘আমি থিল ফন লিমবার্গ।’

রাতে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেসে যাবে পত্রিকা — তাই ব্যস্ত অফিস। এরই মধ্যে কেউ যদি ফোন করে ‘থিল ফন লিমবার্গ’, মানে ইংরেজিতে ‘থিল অব লিমবার্গ’ বলে তা হলে মেজাজ কার না খারাপ হয়! ফ্লেমিশ লোকগাথার রবিনহুড হিসাবে পরিচিত একটি চরিত্র হল থিল উইলেনস্পিজেল — এই থিলের প্রতিকৃতিই ব্যবহার করা হয় তাসের কার্ডে জোকার হিসাবে। লোকগাথা অনুযায়ী, মশকরা করতে করতেই থিল অন্যায়কারী-দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে ফেলেন, ধনীদের সম্পদ নিয়ে আসেন গরিবদের জন্যে।

‘থিল’ পরিচয়ে সংবাদপত্র অফিসে সেদিন আসলে কথা বলছিলেন রয়ম্যান্স। তার ফোন ধরেছিলেন সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেন। তিনিই প্রথম জানতে পারেন, কেন চুরি করা হয়েছে ‘দ্য লাভ লেটার।’ শুল্ডেনকে রয়ম্যান্স ওই সময় জানান, ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক বা চার মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ পেইন্টিংটি ফেরত পেতে পারে। তবে এর একটা ফুটো ফ্রাঙ্কও ব্যক্তিগতভাবে তিনি নেবেন না। ওই দুশ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পৌঁছে দিতে হবে ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসের কাছে — কারিতাস সেটি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে।

নিজের জন্যে নয়, পেইন্টিং চুরি করা হয়েছে আরেকটি দেশের শরণার্থী মানুষের জন্যে, যে দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে স্বাধীনতার জন্য, যে দেশের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আর তাদের দালাল ধর্মবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর অত্যাচারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে, ট্রেনিং ক্যাম্পে যাচ্ছে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে। বিস্ময়কর আর অবিশ্বাস্য ঘটনাই বটে! শুল্ডেন চেষ্টা করলেন থিল নামে টেলিফোনকারীর আসল পরিচয় জানতে। কিন্তু থিল আর কিছুই বললেন না। দিনের পর দিন টিভিতে তিনি দেখেছেন পূর্ব বাংলার ভয়ার্ত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে এক কাপড়ে পাড়ি জমাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অপর দেশে, দেখেছেন উন্মূল মায়ের কোলে কান্নার শক্তি হারানো হাড় জিরজিরে পৃথিবীর প্রতি নিরাসক্ত শিশু। তিনি দেখেছেন পথেপ্রান্তরে পড়ে থাকা লাশের প্রাচুর্যে ঝগড়াবিবাদ ভুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মুখ ও ঠোঁট ডোবাচ্ছে শিয়াল, কুকুর ও শকুন। দিনের পর দিন টিভি আর রেডিওতে বাংলাদেশের যুদ্ধরত মানুষদের মরণপণ যুদ্ধগাথা আর ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের অবর্ণনীয় কষ্টকর জীবনযাপনের কথা। তার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো, ‘আমারও মা নেই, বয়স মাত্র কুড়ি। মানুষের এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।’ তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘হয় আমার কথামতো কাজ করতে হবে, নয়তো ও ছবি আমি বেচে দেব। ল্যাটিন আমেরিকার একজনের সঙ্গে আমার এর মধ্যেই কথা হয়েছে। তিনি ওটা কিনতে রাজি আছেন। আর আমাকে ধরার চেষ্টা করবেন না, তা হলে ওই ছবি একেবারে নষ্ট করে ফেলব।’

শুল্ডেন বুঝতে পারছিলেন না, টেলিফোনের ওপাশ থেকে কথা বলা মানুষটিকে বিশ্বাস করা যায় কি না। সে কথা তুলতেই রয়ম্যান্স তাকে ক্যামেরা নিয়ে ভোর রাতের মধ্যে লিমবার্গের জঙ্গলের কাছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যেতে বলেন। সেখানে প্লাস্টিকের মুখোশপরা রয়ম্যান্স এসে শুল্ডেনের দু’চোখ বেঁধে ফেলেন এবং নিয়ে যান পেইন্টিং দেখাতে। পেইন্টিং দেখার পর শুল্ডেন সেটির ছবিও তোলেন গাড়ির হেডলাইটের আলোতে ফ্লাশ জ্বালিয়ে। পরদিন সেই ছবি ও সংবাদসহ ‘থিল ফন লিমবার্গ’ মারিও রয়ম্যান্স-এর দাবিগুলো নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয় লা সয়ের-এ। পুরো বেলজিয়ামে তোলপাড় শুরু হয় ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরে। এমনকি সিএনএন-এও প্রচারিত হয় পেইন্টিং চুরি যাওয়ার সংবাদ।

এরই মধ্যে বেলজিয়াম রেডিও জানায়, তারাও একই ধরনের একটি টেলিফোন পেয়েছিলেন ক’দিন আগে। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি বলে পুলিশকে খবরটি জানিয়েই ক্ষান্তি দিয়েছেন। এদিকে ডাচ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ব্রাসেলস-এ এসে জানান, থিল ফন লিমবার্গ-এর দাবি মেটানোর আগে তারা নিশ্চিত হতে চান, পেইন্টিংটি সত্যি-সত্যিই ‘দ্য লাভ লেটার’-এর কি না। তারা প্রতিশ্রুতি দেন, একজন বিশেষজ্ঞ সেটি পরীক্ষা করে দেখার সময় পুলিশ কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। রয়ম্যান্স ফাঁদে পড়তে চাননি, তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কয়েকদিন পর রয়ম্যান্স টেলিফোন করেন ‘হেট ফক’ নামের আরেকটি পত্রিকাতে; টেলিফোন করে মুক্তিপণ দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দেন। তিনি জানান, ৬ অক্টোবরের মধ্যে উদ্বাস্তুদের জন্যে অর্থ দেয়া না হলে পেইন্টিংটি নষ্ট করে ফেলা হবে। তিনি আরও জানান, কেবল অর্থ দিলেই হবে না, অর্থপ্রদান সংক্রান্ত চুক্তির অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে টেলিভিশনে এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে দ্য লাভ লেটারের ব্রিটিশ বীমা কোম্পানির প্রতিনিধি গ্রায়েম মিলারকে। রয়ম্যান্সের এ দাবি জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, এত অল্প সময়ের মধ্যে, তাও সরাসরি সম্প্রচার করা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এত অর্থ দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব।

কর্তৃপক্ষের এই অস্বীকৃতির খবর প্রচারিত হয় ৬ অক্টোবর সকালে বিআরটি রেডিওতে। আর তা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাসেটের এক পেট্রোল পাম্পে গিয়ে রেডিও স্টেশনে টেলিফোন করেন মারিও রয়ম্যান্স। ওই সময় সেখানে চলছিল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘টু বেড অর নট টু বেড’। ওই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন তিনি। সবাইকে জানান, তার এই পেইন্টিং নিয়ে আসার কারণ ও উদ্দেশ্য। এদিকে পেট্রোল পাম্পের অপারেটর কথা শুনে বুঝতে পারে, ফোনে কে, কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে কথা বলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চড়া পুরস্কারের আশায় পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ পিছু নেয় রয়ম্যান্সের। পুলিশের গাড়িকে এড়ানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে রয়ম্যান্স আশ্রয় নেন এক গোয়ালের মধ্যে। পুলিশ তাকে যখন আটক করে, তিনি তখন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন দুটি গরুর মাঝখানে গোবরের স্তূপের মধ্যে খড়ের নিচে। ধরা পড়লেও তিনি আগের মতোই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমি যা করেছি, তা আমার কর্তব্য। অবোধ ছেলেপেলে মারা যেতে দেখলে, আমি এ রকমই করব।’

এ ঘটনায় ২ বছরের কারাদণ্ড হলেও রয়ম্যান্স মাত্র ছয় মাস পরই ছাড়া পেয়ে যান। কেননা গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে বেলজিয়ামের সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ২১ বছরের এক তরুণ মহৎ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এমন একটি কাজ করেছে দেখে তার পক্ষে রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষ। রয়ম্যান্স যে হোটেলে ওয়েটারের কাজ নিয়েছিলেন সেই হোটেল সিতেওয়ে’র মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যন্ত তার নিঃশর্ত মুক্তির জন্যে প্রচারাভিযান চালায়। অচেনা ওয়েটার তরুণ মারিও রয়ম্যান্স হয়ে ওঠেন থিল অব লিমবার্গ।

রয়ম্যান্সকে আটক করার পর পুলিশ ‘দ্য লাভ লেটার’ উদ্ধার করে হোটেল সিতেওয়ের রান্নাঘরের পেছনে তার শোবার ঘর থেকে। জাদুঘর থেকে ট্যাক্সি করে ঘরে ফেরার সময় সেটির ওপরেই বসে থাকায় বাঁকাচোরা হয়ে গিয়েছিল সেটি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ শেলডন কেকের তত্ত্বাবধানে চেষ্টা চলে পেইন্টিংটির আগের চেহারা ফিরিয়ে আনার। ছয় মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে সেটিকে মোটামুটি ঠিক করতে পারেন তারা- ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ এই সান্ত্বনা নিয়ে পেইন্টিংটি দেখার সুযোগ ফিরে পান শিল্পবোদ্ধারা।

‘দ্য লাভ লেটার’-এর মুক্তিপণ পাওয়া না গেলেও এ ঘটনার সুবাদে যুদ্ধরত বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে বেলজিয়ামে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশের (পশ্চিমা কূটনৈতিক পরিভাষা অনুযায়ী তখনও পূর্ব পাকিস্তান) শরণার্থী মানুষদের জন্যে সাহায্য পাঠাতে শুরু করে। এমনকি পোপও নাগরিকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার পক্ষে মুখ খোলেন।

তারপর খুব বেশিদিন লাগেনি, বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছে — তবে বাংলাদেশের মানুষের সেই একাগ্র শুভাকাঙ্ক্ষী মারিও রয়ম্যান্সকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে ভয়ানক ছন্নছাড়া অবস্থাতে। কারাগার মাত্র ২১ বছরের এই তরুণের মানসিক শান্তি নষ্ট করে ফেলেছিল। ছয় মাস পর কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি হোটেল সিতেওয়ে’তে আগের কাজে ফেরেন। কিন্তু সবাই হতবাক হয়ে যায় তাকে দেখে- কোথায় আগের সেই প্রাণচঞ্চল তরুণ মারিও? সব চুল পড়ে গেছে, চোখ অস্থির- এ কেমন মারিও রয়ম্যান্স? এক মাস পেরুতে না পেরুতেই কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে হোটেল ছেড়ে তিনি কোথায় যে চলে যান, কেউই বলতে পারে না।

পরে জানা গেছে, পরিচিত এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এক মেয়ে হয় তাদের। কিন্তু মানসিক অস্থিরতার শিকার রয়ম্যান্স মনে করতেন, শয়তান ভর করেছে তার বউয়ের ওপর। খুব দ্রুতই তারা আলাদা হয়ে যান। রয়ম্যান্সের জীবনীকার স্যু সমার্স জানাচ্ছেন, রয়ম্যান্স এক সময় দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা চুরি করারও পরিকল্পনা করে প্যারিসে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে, ছন্নছাড়া রয়ম্যান্সের জীবন কেটেছে পথে পথে, পার্কিং করা কিংবা বাতিল হয়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে শুয়ে থেকে। এ রকমই এক গাড়ির মধ্যে থেকে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালে উদ্ধার করা হয় মৃতপ্রায় রয়ম্যান্সকে। কারও কারও মতে, তিনি তখন আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলেন। আরও দিনদশেক পর ৫ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান তিনি। থিল ফন লিমবার্গের, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান এক সুহৃদের মৃত্যু ঘটে এমনই একাকিত্বের মধ্য দিয়ে। তিনি এখন শুয়ে আছেন তার জন্মস্থান টঙ্গারেনের নেরেম-এর পুরনো কবরস্থানে।

এমন করুণ মৃত্যুর বছর পঁচিশ পরে বেলজিয়ামে নতুন করে জেগে ওঠেন এই থিল ফন লিমবার্গ, মারিও রয়ম্যান্স। ২০০৭ সালে ‘দ্য কোয়েস্ট’ নামের একটি থিয়েটার গ্রুপ তাকে নিয়ে নাটক করে- সেই নাটকের মধ্যে দিয়ে পুরনো ইতিহাস উঠে আসে দর্শকদের কাছে। এই ইতিহাসকে সম্প্রতি দ্রষ্টব্য করে তুলেছেন এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জুটি; মারিও রয়ম্যান্সকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন সম্প্রতি। তা ছাড়া মারিও রয়ম্যান্সকে নীরবে নিভৃতে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন হোটেল সিতেওয়ের মালিকের ছেলে। জীবিত রয়ম্যান্স হয়ে উঠেছিলেন তার কাছে গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার। রয়ম্যান্সকে গ্রেফতার করার পর তিনি তার প্রাণের সমস্ত আবেগ ঢেলে হ্যাসেল্টের কুরিঞ্জেন ব্রিজের কাছে এক দেয়ালে গ্রাফিত্তি আঁকেন এবং সঙ্গে লেখেন, ‘লং লিভ থিল।’ এত বছর পরে সেই গ্রাফিত্তি কত না বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও কারও না কারও চোখ আটকে যায় সেখানে। ওই ব্রিজের পাশ দিয়ে প্রায়ই যেতেন স্যু সমার্স ও স্টিন মিউরিস। একদিন হঠাৎ করেই মনোযোগ দিয়ে গ্রাফিত্তিটি দেখতে থাকেন স্যু। ওই গ্রাফিত্তির অর্থ প্রেমিকা স্যু সমার্স জানতে চান তার প্রেমিক স্টিন মিউরিসের কাছে। মিউরিস ওই সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু আসলে তিনি একের ভেতর অনেক- গায়ক, সংগীতকার, চলচ্চিত্রকার, টিভির অনুষ্ঠান নির্মাতা। অন্যদিকে, স্যু সমার্স নিজেও কোর্ট রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন সেখানকার দৈনিক দ্য মর্নিং-এ। ১৯৭১ সালে স্টিনের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। তারপরও ঘটনাটি আবছাভাবে জানা ছিল তার। লোকশ্রুতি থেকে জানা আবছা ঘটনাটিই তিনি শোনালেন তার প্রেমিকাকে। শুনতে শুনতে, বলতে বলতে তাদের দু’জনের মধ্যেই জেগে উঠল ঘটনাটি ভালো করে জানার আগ্রহ।

রয়ম্যান্স স্যু সমার্স

রয়ম্যান্সকে নিয়ে লেখা বইয়ের পাশে স্যু সমার্স

তাঁদের ওই আগ্রহের ফসল, স্টিন মিউরিসের ডকুমেন্টারি ‘থিল ফন লিমবার্গ’ আর স্যু সমার্সের বই ‘মারিও’। তবে তাদেরও আগে থমাস বিয়ারটেন নামের এক ডাচ পরিচালক ওই একই নামে নির্মাণ করেছিলেন একটি শর্ট ফিল্ম। এসব সাংস্কৃতিক নির্মাণযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে মারিও রয়ম্যান্স বেলজিয়ামে এক দৃষ্টান্ত স্থানীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কেবল মনে রাখিনি আমরাই- যাদের জন্যে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ওই দায়ভার। ‘থিল ফন লিমবার্গ’-এর শেষ দৃশ্যে একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘কী তখন অথবা কী তার পরে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু কেউ একজন অন্তত চেষ্টা তো করেছে। (বাংলাদেশ ওয়াজ নট রেসকিউড, নট দেন অর ল্যাটার। বাট সামওয়ান অ্যাট লিস্ট ট্রায়েড)।’ পরিচালক মিউরিসের তির্যক এ সংলাপে পুরো সত্য নেই- কিন্তু বলা কি যায় একেবারে মিথ্যাও সে কথা?

৩·

মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সময়, যখন মহাকালের আবেদন জেগে ওঠে এমনকি তুচ্ছ প্রাণেও। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা প্রতিভাবান। ১৯৭১-এর আগস্টেই তারা গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষদের। কিন্তু তেমন কিছু তো করার ছিল না জাঁ কুয়ে কিংবা মারিও রয়ম্যান্সের — তাঁরা তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, বিমান ছিনতাই করে, পেইন্টিং চুরি করে চেষ্টা করেছেন বিপন্ন উদ্বাস্তু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। এমন করে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করার মধ্য দিয়ে, জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে জীবনের একটি অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন তারা। মানুষ যদি তার কোনো একটি টুকরো মুহূর্তের মধ্যেও জীবনের অর্থময়তা খুঁজে পায়, সেই অর্থময়তার মাধুর্যটুকু নিয়েই তারা বেঁচে থাকতে পারে পুনরায় নিরুদ্দিষ্ট হয়েও। জাঁ কুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সও বেঁচে ছিলেন তেমনি করে।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারসংক্রান্ত কার্যক্রম নিরীক্ষণ করতে গিয়ে বছর দুয়েক আগে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের কয়েক সংগঠক যুগপৎ খুঁজে পান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই দুই সহযোদ্ধার কথা। তারপর শুরু হয় অনুসন্ধানপর্ব এবং উঠে আসতে থাকে বিস্মৃত এক পর্ব। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের পক্ষ থেকে তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে আইসিজে’র বিতর্কিত ভূমিকা তুলে ধরার পাশাপাশি দাবিও জানানো হয়, আমাদের ঋণে আবদ্ধ করে ফেলা বিদেশি সহমর্মীদের স্বীকৃতি দেয়ার। আমরাও অনুরোধ করব, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি দেয়ার, যাদের মধ্যে, লেখাই বাহুল্য, থাকবেন জাঁ ক্যুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সও; চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রতিও অনুর]ধ রইল এ সংক্রান্ত যেসব ডকুফিল্ম নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার; ফরাসি ও ডাচ ভাষায় সুশিক্ষিত বাংলাভাষীদের প্রতি অনুরোধ থাকল, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বই ও নিবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করার- যাতে তাদের সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানতে পারি আমরা।

আর আরও দুটি কাজ আমরা সম্মিলিতভাবে করতে পারি। এক· সোচ্চার হয়ে উঠতে পারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, বিচারের সহায়ক বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। দুই· পাশে দাঁড়াতে পারি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের- যাদের অনেকে হয়তো নিঃসঙ্গ, অনেকে হয়তো দরিদ্র। তাদের জন্যে নির্মাণ করতে পারি সামাজিক সৌহার্দ্যের বলয়, নিরাপত্তার বলয়। কেবল এরকম কাজগুলো করার মধ্য দিয়েই আমরা হয়তো খানিকটা মুক্ত হতে পারি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জাঁ কুয়ে, মারিও রয়ম্যান্সদের মতো সহযোদ্ধাদের মনে না রাখার গ্লানি থেকে।

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এম এম আর জালাল, রায়হান রশিদ, রেজাউল করিম সুমন, অমি রহমান পিয়াল, কাউসার রুশো।)

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

১৩ comments

  1. রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ (২:৩৭ অপরাহ্ণ)

    শামীম ভাই, অসাধারন এই লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। জাঁ কুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সের কথা পড়তে পড়তে চোখ প্রায় ভিজে যাচ্ছিল। আমরা এমন এক সময়ে এসেছি, যেখানে কেবল নিজেদের জাতি ও গৌরব গাঁথা নিয়ে ব্যস্ত। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ব্যাক্তি মানুষ পর্যন্ত সবাই কেবল ১৯৭১ সালে কি করেছি কি করিনি তার হিসেব নিয়ে ঝগড়া করি। এমনকি তরুন প্রজন্ম ও বাংলিঙ্কের জাগরনের গান গেয়ে হাল্কা রক স্টাইল এ দেশপ্রেমিক ভাবতে চায়। কিন্তু আমাদের জন্য যে মানুষগুলো অনুভব করলো, তাদের প্রতি আমরা কি সম্মান প্রদর্শন করলাম ? ডিলান বা জর্জ হ্যারিসনের টিশার্ট গায়ে আমরা তাদের খুব শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেলেছি ? আসলে আমাদের কারা বন্ধু ছিল, তারা কেমন ছিল, কোথায় কিভাবে তারা আমাদের জন্য বুকের গভীরে তীব্র কষ্ট অনুভব করেছিল- তা দেশবাসীকে জানাবার সময় এসেছে। আমি সেই চেষ্টা করব, তাদের উপর নির্মিত প্রামাণ্য দলিলাদি সংগ্রহ করার। আবারো ধন্যবাদ আপনাকে এবং আপনাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের, অসাধারন এই পোস্টটির জন্য।

  2. ইমতিয়ার - ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ (৩:৫৩ অপরাহ্ণ)

    # রফিকুল আনোয়ার রাসেল
    এটি জেনে ভালো লাগছে যে, আপনি লক্ষ্য করেছেন এ লেখা মূলত একটি যুক্ত প্রচেষ্টার ফসল এবং আমরা চাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের তাদের প্রাপ্য সম্মানের স্থানে স্থাপন করতে, চাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাদেরও মনে রাখতে।

    আমি সেই চেষ্টা করব, তাদের উপর নির্মিত প্রামাণ্য দলিলাদি সংগ্রহ করার।

    আপনিও আমাদের এই প্রয়াসে যুক্ত হচ্ছেন জেনে ভালো লাগছে। যত দূরত্বেই থাকি না কেন, আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ…

  3. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (৭:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    চমৎকার_ খুবই ভালো লাগল।

  4. মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১০:৪১ পূর্বাহ্ণ)

    এই পত্রিকায় নামটা যেভাবে লেখা আছে Jean Kay তাতে তার নামের উচ্চারণটা হওয়া উচিত ‘জঁ ক্যাই’ বা ‘জঁ কাই’ কিন্তু ‘কুয়ে’ বা ‘ক্যুয়ে’ কেন লেখা হচ্ছে। অজ্ঞতাবশত হলে এখন ঠিক করে নিলেই চলবে, কিন্তু আমি ভাবছি এই পত্রিকায় রোমান হরফে তার নাম যেভাবে লেখা আছে সেটা ঠিক আছে তো? মানে আমাদের সব খোঁজখবর তো ওই নাম দিয়েই চালাতে হবে, তাই ওই রোমান হরফে লেখা নামটা ঠিক আছে কিনা আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

    • মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১১:১৪ পূর্বাহ্ণ)

      রোমান হরফে নামটা ঠিকই আছে মনে হচ্ছে, কারণ Jean Kay (Jean-Eugène-Paul Kay তার পুরো নামটা বেশ বড়, জঁ-উজেন-পোল ক্যাই/কাই) সার্চ দিয়ে ফ্রেঞ্চ উইকিপিডিয়ায় এই ভুক্তি পাওয়া গেল এবং সেখানে তার এই মহৎ বিমান ছিনতাইয়ের কথা সংক্ষেপে লেখা আছে। তাহলে আমাদের এখন ‘কুয়ে’ বা ‘ক্যুয়ে’ বর্জন করে তার নাম লেখা উচিত ‘জঁ ক্যাই’ বা ‘জঁ কাই’: দুটিই ঠিক কিন্তু আমার পক্ষপাত দ্বিতীয়টি মানে ‘জঁ কাই’-এর প্রতি।

      • মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১:৪৯ অপরাহ্ণ)

        @ ইমতিয়ার শামীম

        আমার মতে নামটি ‘জঁ কাই’ এভাবে সম্পাদনা করা হোক। অবশ্য আমাদের বেশির ভাগ পাঠক Jeanকে ‘জাঁ’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, সেক্ষেত্রে ‘জাঁ কাই’ও লেখা যেতে পারে। তবে ‘Kay’এর ক্ষেত্রে ফরাসি উচ্চারণভেদে ‘ক্যাই’ ও ‘কাই’ দুটি ফরাসিরা উচ্চারণ করে — এখন Jean Kayকে প্রচলিতভাবে তার পড়শি ও পরিচিতরা ঠিক ‘ক্যাই’ বা ‘কাই’ কোন উচ্চারণে ডাকত তা আর সম্ভবত জানা সম্ভব নয়। তাই আমার পক্ষপাত গৃহীত হলে ‘কাই’ ব্যবহার করার দিকেই মত দেব।

  5. ইমতিয়ার - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:১৯ অপরাহ্ণ)

    আপনি ঠিকই বলেছেন, মাসুদ করিম। নামের উচ্চারণ নিয়ে আমি একদম নিশ্চিত নই, বলতে পারেন অজ্ঞই-তবে সঠিক উচ্চারণেই সেটি লেখা উচিত। এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে নামটি সম্পাদনা করে দেয়া যেতে পারে।

    # কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
    ধন্যবাদ, জাহাঙ্গীর ভাই। আপনার ভালো লাগা বরাবরই প্রেরণাদায়ক।

  6. মাসুদ করিম - ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:০৭ পূর্বাহ্ণ)

    একটি বই খুঁজছিলাম, কারণ ভাবছিলাম ওই বইতে ওই বিমান ছিনতাইয়ের প্রসঙ্গ থাকতে পারে, বইটি অঁদ্রে মালরোকে নিয়ে, লিখেছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — আজ বইটি পেলাম চট্টগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লাইব্রেরিতে — বইটির নাম ‘অঁদ্রে মালরো : শতাব্দীর কিংবদন্তী’ প্রকাশক অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা এবং প্রকাশকাল ১৯৮৬। খুঁজতে খুঁজতে বইয়ের ৮৪ নম্বর পৃষ্টায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে ওই বিমান ছিনতাইয়ের কথা একটি ভুল তথ্যসহ পাওয়া গেল।

    যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও প্যারিসে এক ফরাশি তরুণ একটি বিমান হাইজ্যাক করে বাংলাদেশের জন্য ঔষধপত্র দাবী করে। তাকে সমর্থন করে আদালতে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন মালরো।

    তথ্যের ভুলটি কার, মালরোর স্মৃতি ভুল করেছে না কোরেশী ভুল লিখেছেন, আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি এরকম একটি প্রসঙ্গ মাহমুদ শাহ কোরেশী এইভাবে সাদামাটা ভাষায় কয়েক শব্দে শেষ করলেন? মালরো বাংলাদশে এসেছিলেন ২১ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে, তার বাংলাদেশে অবস্থানকালে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — মালরো বাংলাদেশ ভ্রমণকালে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে যে ৩/৪ দিন কাটিয়েছিলেন সে কয়েকদিন তিনটি শহরে তার সব সফরসূচিতে দোভাষী ছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — তিনি কোনোভাবেই এই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে তেমন বড় করে দেখেননি বলেই মনে হয়। তাছাড়া মাহমুদ শাহ কোরেশীর সাথে এই দোভাষীতার সূত্রে ১৯৭৬ সালে মালরোর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার চিঠিতে যোগাযোগ ছিল — এবং জঁ কাইকে সমর্থন করে আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার কথাও তিনি পরবর্তীতে চিঠি বা পত্রিকা মারফত জানতে পারেন — কারণ এই সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল মালরোর বাংলাদেশ সফরের আরো কয়েকমাস পরে ১৯৭৩-এর অক্টোবরে।

    মনে হচ্ছে মাহমুদ শাহ কোরেশী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জঁ কাইয়ের এই বীরত্বপূর্ণ অবদানকে তেমন একটা গুরুত্ব একবারেই দেননি। অথচ ইতিহাসের এই অনালোচিত ঘটনার তথ্য পাওয়ার কী সুযোগটাই না তিনি পেয়েছিলেন। মাহমুদ শাহ কোরেশীর সাক্ষাৎকারে ও লেখায় বহুবার গর্বভরে উল্লেখ দেখেছি ১৯৭১ সালে তিনি বৈরুতে মোল্লা জালালের (ইনি কে সে উল্লেখ স্পষ্ট পাইনি, কিন্তু মনে হয় মোল্লা জালাল তখনকার লেবাননে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত ছিলেন) সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের দেশের কত বুদ্ধিজীবী এভাবে মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ পেয়ে সব ভুলে বড় বড় সম্মাননার পেছনে ছুটেছেন?

  7. সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ (৩:৫৬ পূর্বাহ্ণ)

    মানুষ যদি তার কোনো একটি টুকরো মুহূর্তের মধ্যেও জীবনের অর্থময়তা খুঁজে পায়, সেই অর্থময়তার মাধুর্যটুকু নিয়েই তারা বেঁচে থাকতে পারে পুনরায় নিরুদ্দিষ্ট হয়েও…ইমতিয়ারভাই, এমন অসাধারণ লেখার জন্যে আন্তরিক অভিনন্দন। পড়তে পড়তে কেঁদেই ফেললাম। আমরা কী অভাগা দেশ, শত্রু চিনি না, মিত্র চিনি না, শুভার্থী চিনিনা, শুভৈষীর নাম অব্দি জানি না।

  8. মাসুদ করিম - ২ জানুয়ারি ২০১২ (১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ)

    jean kay ও mario roymans এর পর আরেক দুঃসাহসী সীমান্তবিহীন মুক্তিযোদ্ধারা Taylor and a group of american protesters।

    Forty years ago this month, the country of Bangladesh declared its independence from Pakistan. Then-President Richard Nixon supported Pakistan during the war because he wanted to prove the US would stand by an ally.

    Many Americans disagreed with that stance. And when a ship headed for Pakistan with military equipment and ammunition was set to stop at a US port, one group of Americans felt it was necessary to get involved.

    “I was ready to risk my life there,” says 78-year-old Richard Taylor. “I just wanted to get in front of that ship.”

    In July 1971, Taylor and a group of protesters used canoes and kayaks to try and block the Pakistani freighter Padma from reaching the Port of Baltimore.

    The ship was coming from Canada, bound for Pakistan. It was said to be carrying military equipment and ammunition, presumably to aid the government in its war with what was then called East Pakistan.

    The US had ordered an arms embargo on new shipments to Pakistan. But newspapers reported that Pakistani freighters like The Padma were still visiting US ports to load military equipment that had been purchased before the embargo.

    Taylor’s flotilla of two canoes, three kayaks and a rubber raft left from Baltimore’s Broening Park. The police and Coast Guard tried to stop it. But Taylor says the group was undaunted.

    “One of key parts of this was that the US government was sending military aid to the West Pakistani government that was doing the invasion,” says Taylor. “So that made it poignant. People were suffering thousands of miles away, but our government was helping that suffering to happen.”

    Timmy Aziz knew that suffering first hand. He grew up in East Pakistan. He was 10 when war broke out. He now teaches environmental design here in Baltimore.

    “It’s really impressive how far they would have had to have gone,” says Aziz. “They would have been way in the middle of the water and completely in harm’s way. This massive freighter and these tiny little canoes, which would easily get washed away in the wake of the ship that size.”

    Forty years on, Bengalis are expressing a renewed interest in their country’s independence movement. One of them is New Yorker Aris Yousuf. He finds the canoe blockade story so fascinating that he’s making a documentary on it.

    “I wanted to see if I could make a film about the history of 1971, Bangladesh’s independence war and what happened in the US and be able to put it together from the people who participated at that time,” says Yousuf.

    What happened that time in July 1971 was that the US Coast Guard foiled Richard Taylor and his friends. The Padma made it into the harbor; it was eventually loaded and left. The following month, protesters expanded their actions to include any Pakistani ship trying to dock in the US, regardless of its cargo. And they enticed longshoremen at the Port of Philadelphia to join the boycott.

    “The cause had a heart, had a deep heart,” says 64-year-old Elliot Gevis. “And there were tremendous atrocities that were going on.”

    Today, Gevis is a pediatrician. But back in 1971, he worked the docks in Philadelphia. He learned about the war in East Pakistan and the canoe protest from flyers, and helped convince other longshoremen not to load ships. The first freighter affected was The Al-Ahmadi. Richard Taylor and other protesters again used canoes and kayaks to try and block the ship. When it ran the blockade, Gevis and other dockworkers refused to unload it.

    “Not everybody was supportive of that,” Gevis recalls. “But then again, they did respect unions. And they did respect not crossing picket lines, things of that sort. But at the same time, they had to pay bills and feed families. That was a big consideration.”

    When the ship pushed off, no cargo had been loaded or unloaded.

    After four more months of intense protests–and picketing in front of the White House– the US government finally ended all arms exports to Pakistan. It marked the end of one of the more unusual protest movements in America’s history.

    “We’ve been just humbled by people who are Bengalis saying we couldn’t have done it without this movement here,” says Phyllis Taylor, Richard’s wife.

    She, too, was involved in the protests.

    “Not us necessarily, but a small group of committed people giving us hope, as Dick said, in the jungles that you could make a change.”

    After nine months of fighting, East Pakistanis won the war. Their prize: a country now known as Bangladesh.

    লিন্ক : American Activists and the Birth of Bangladesh

  9. রায়হান রশিদ - ২৩ মার্চ ২০১২ (৩:৪৪ অপরাহ্ণ)

    বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে পাঁচ কিশোরের বিমান ছিনতাই পরিকল্পনা। এখানে

    বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলছে, এ সময় করাচিতে পাঁচ বাঙালি কিশোর অস্ত্র জোগাড় করে পরিকল্পনা নিল পিআইএর বিমান ছিনতাইয়ের। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল…

    আলতাফুরের খোঁজ পাই আমার পরিচিত এক মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিকের কাছে। আলতাফুর ছিলেন পাঁচ কিশোর দলের একজন যাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানের করাচিতে বসে পরিকল্পনা নিয়েছিল পিআইএর একটি বিমান ছিনতাইয়ের। আলতাফুর ছিলেন মূলত ওই কিশোর দলটির নেতা। প্রথমে এই ঘটনাটা জেনে অবাক হয়েছি ভীষণরকম, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি।
    তারপরও আলতাফুরকে খুঁজতে তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। সম্ভবত সেটি ছিল কোনো ছুটির দিন। পুরো অফিস ফাঁকা। সাক্ষাত হলো মাঝবয়সী সুদর্শন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনিই আলতাফুর। তাঁর ঘরে বসে আলাপ শুরু হলো। আলতাফুর ফিরে গেলেন তাঁর ফেলে আসা কৈশোরের সেই স্বর্ণালি অধ্যায়ে। আমি ক্রমশ তাঁর স্মৃতির পাতায় নিমজ্জিত হতে থাকলাম।
    ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পিআইএর একটি বিমান ছিনতাই করার কথা মাথায় আসে আলতাফুরের। আলতাফুর তখন পাকিস্তানের করাচিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। করাচির বাংলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। গোপনে স্কুলের আরো কয়েকজন বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করলেন যে, যাত্রীবেশে টিকিট কেটে পিআইএর একটি বিমানে চড়ে বসবেন তাঁরা। তারপর বিমান আকাশে উড়ার পর অস্ত্রের মুখে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন, যেমনটা তাঁরা সিনেমায় দেখেছেন।
    ওই পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আলতাফুর বলেন, ‘পরিকল্পনা নিলাম ঠিকই। কিন্তু সমস্য অনেক। টিকিটের জন্য দরকার টাকার, অস্ত্রও যোগাড় করতে হবে, সেটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এছাড়া মেটাল ডিটেক্টরকে ফাকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠতে হবে। আমরা প্লেনবিষয়ক নানা ধরনের বুলেটিন ও ডায়াগ্রাম পড়তে শুরু করলাম। সুযোগ করে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থাও পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।’
    একাত্তরের নভেম্বরে একদিন আলতাফুর ও তাঁর বন্ধুরা করাচির জাহাঙ্গীর পার্কে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ওই পার্কে বেলুচিস্তানের কোয়েটা শহরের অধিবাসী জনৈক দুররানির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে। দুররানি কোয়েটা থেকে কী এক কাজে করাচিতে এসেছিলেন এবং তখন ওই পার্কে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে দুররানি জানান, কোয়েটায় অনায়াসে পিস্তল কেনা যায়। তিনি নিজেকে সংগ্রামী বেলুচিস্তানের লাল কোর্তা সংগঠনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।
    গোপন কিশোর দলে আলতাফুরসহ মোট সদস্য পাঁচজন: দশম শ্রেণীর ছাত্র আখতার হোসেন, আলী আনসার, জিয়াউল হক মন্টু এবং নবম শ্রেণীর ছাত্র কায়সার হালিম ডাবলু। স্কুলের টিফিনের পয়সা, বাসার পুরোনো বইপত্র, ইলেকট্রিক ও খেলার সরঞ্জাম বিক্রির টাকা এবং স্কুল সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা একত্র করে যোগাড় হলো অস্ত্র ও প্লেনের টিকিট কেনার টাকা । আলী আনসার অবশ্য নিজেই দুটি পিস্তল কেনার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর কায়সার হালিম, যাঁকে সবাই ডাবলু বলে ডাকত, আখতার হোসেন এবং জিয়াউল হক মন্টু করাচি থেকে হাজার মাইল দূরে আফগান সীমান্তের কাছে কোয়েটা শহরে তিনবার গিয়ে দুররানির সাহায্যে পাঁচটি পিস্তল সংগ্রহ করেন। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ফলে তখন ঠিক হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের মুক্তির দাবিতে বিমান ছিনতাই করা হবে। এবং এটা করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই ২৫ মার্চের করাচি থেকে লাহোরগামী প্লেনের পাঁচটি টিকিট কেনা হলো। শেডিউল অনুযায়ী প্লেনটির সকাল সাতটায় করাচি বিমানবন্দর ছেড়ে যাবার কথা।
    ২৪ মার্চ বিকেলে আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন ও জিয়াউল হক মন্টু যাঁর যাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। আগেই ঠিক করা ছিল, রাতে তাঁরা আনসারের বাসায় থাকবেন। কিন্তু আনসারের বাসায় গেস্ট থাকায় ওখানে থাকা হলো না। আনসারও বাসায় অতিথি রেখে বেরুতে পারলেন না। অগত্যা বাকি চারজন অর্থাৎ আলতাফ, আখতার, জিয়াউল হক মন্টু ও ডাবলু এয়ারপোর্টের কাছে এক রাতের জন্য টুরিস্ট ইন নামের একটি হোটেলে রাত কাটান।
    ২৫ মার্চ ভোর ছটায় তাঁরা চারজন একটি ট্যাক্সি করে হাজির হন করাচী এয়ারপোর্টে। সময়ের চেয়ে বেশি আগে চলে আসায় তাঁরা দেখলেন বোর্ডিং লাউঞ্জে একেবারেই ফাঁকা। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক তখনই আখতারের বাবা ও মামা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ পর আলতাফুরের ছোট চাচাও চলে এলেন। পরিবারের কাছে তাঁদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে। আলতাফের বাবা তাঁদের এয়ারপোর্ট বাড়িতে নিয়ে এলেন ঠিকই কিন্তু ওখান থেকে বাসার লোকজনকে পিস্তল দেখিয়ে আবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দিলেন আলতাফুর ও অন্যরা। এবার প্রথমে এয়ারপোর্টের কাছে একটি রেলওয়ের স্টক ইয়ার্ডে তাঁরা জড়ো হলেন এবং ওখান থেকে এয়ারপোর্টের দক্ষিণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর কাছে চলে এলেন লুকিয়ে। কারণ তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন তাঁদের অভিভাবকেরা এয়ারপোর্টের প্রবেশপথে অপেক্ষা করবেন তাঁদের ধরার জন্য। তাঁদের ফাকি দেওয়া জন্যই এই বিকল্প পথে, কাঁটাতারের বেষ্টনী পেরিয়ে লাহোরগামী প্লেনে উঠার সিদ্ধান্ত। কিন্তু মুশকিল হলো তার কেটে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢোকার মতো কোনো কিছু তাঁদের হাতে নেই। খানিক নানা উপায় নিয়ে ভেবে শেষে বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা স্থগিত করে বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা।
    তবে সোজা বাসায় না গিয়ে একটি ট্রাকে লিফট নিয়ে শহরের দিকে চলে আসেন তাঁরা। তারপর জাহাঙ্গীর পার্কে ঢুকে ওখানেই বসে থাকেন। বাসায় ফেরেন আরো পরে।
    এপ্রিল মাসের কোনো এক দিন মধ্যরাতে আলতাফুর ও তাঁর সঙ্গীদের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। গ্রেফতার হয় আলতাফুর, আখতার, কায়সার, আনসার ও জিয়াউল হক। রাতেই তাঁদের থানায় নিয়ে তখনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একত্র করা হয়। কথা আদায়ের জন্য শুরু হয় নির্যাতন। জানতে চাওয়া হয়, অস্ত্র কোত্থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হলো। প্লেন ছিনতাই করার পরিকল্পনা কবে, কখন থেকে এবং কী উদ্দেশ্যে করার চিন্তা করা হয়েছিল? কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। প্রায় তিন দিন ধরে চলে নির্যাতন। আলতাফুরের ভাষায়, ‘দুজন লম্বা-চওড়া পুলিশ বেত দিয়ে আমাদের সজোরে পেটাতে লাগল। মারতে লাগল চড় ও ঘুষি। একপর্যায়ে তারা আমাকে বেমক্কা আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমাদের পা দুটো উঁচু করে টেবিলে রাখা কাঠের একটা রোলার এবং বেত দিয়ে সজোরে পায়ের পাতায় আঘাত করা হতে থাকে। আঘাতে চোখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করি।’
    তিন দিন পর (১৩ এপ্রিল ১৯৭২) দুপুরে আলতাফুর ও তাঁর দলকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য হাজির করা হয়। সেখান থেকে তাঁদের সবাইকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিছুদিন পর ওঁদের বাবাদেরও গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সন্তানদের পরিকল্পনা জানার পরও পুলিশকে খবর দেননি তাঁরা। ১৯ এপ্রিল তাঁদের মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। অভিভাবকদের চেয়ারে বসতে দিয়ে আলতাফুরদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জগুলো পড়ে শোনানো হলো। তাঁদের বিরুদ্ধে যে ধারায় কোর্টে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাতে মার্শাল লর ১০ ধারা ও পেনাল কোডের ৩৯৯ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা কোর্ট রাখে। আলতাফুরের পক্ষের আইনজীবী কোর্টে যুক্তি তুলে ধরলেন, তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ তখন অনেক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থন দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত এবং এর জন্য তাঁদের সময় দরকার। আসলে আলতাফুরের আইনজীবী চাচ্ছিলেন, যাতে কোর্টের প্রসিডিং কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। কারণ, তখন শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানে মার্শাল ল উঠিয়ে নেওয়া হবে। ফলে মামলা কিছুদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। এর কয়েক দিন পর মার্শাল ল তুলে নেওয়া হয়। আর আলতাফুরদের মামলা চলে যায় বেসামরিক আদালতে বা সাধারণ কোর্টে। এরপর বিচার চলাকালীন আলতাফুরদের দল এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত জেলে ছিলেন এবং তাঁদের অভিভাবকদেরও জুন পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়েছিল। জুনে অভিভাবকেরা এবং আগস্টে আলতাফুরের দল জামিন লাভ করে। পাকিস্তানে তখন বাঙালিদের বাংলাদেশে সরকারিভাবে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। আলতাফুর রহমান, আখতার হোসেন, কায়সার হালিম, আলী আনসার, জিয়াউল হক তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এত দিন পর মধ্যবয়সী আইনজীবী আলতাফুর সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন: ‘বাস্তবে তখন সম্ভব ছিল কি না; সে কথা না ভেবেই কত বড় বড় পরিকল্পনাই না করেছিলাম। আমার এবং আমাদের বন্ধুদের সেদিনের এ রকম প্রচেষ্টাকে অনেকেই হাস্যকর বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমরা যা কিছু করেছিলাম, মাতৃভূমির সঙ্গে আমাদের অকৃত্রিম নাড়ির টান থেকে, গভীর দেশপ্রেমের বোধ থেকেই।’
    বিমান ছিনতাই স্কোয়াডের সেদিনের সেই কিশোর সদস্যরা এখন কোথায়। আলতাফুরের কাছে জানা গেল, আখতার হোসেন একটি প্রাইভেট এয়ারলাইনসের পাইলট, আর আলী আনসার চট্টগ্রামে একটি ফটো স্টুডিওর মালিক এবং কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন। জিয়াউল হক মন্টু আছেন কানাডায়। তাঁর খুব কাছের বন্ধু কায়সার হালিম, যাকে তিনি ডাবলু বলে ডাকতেন তিনি বেঁচে নেই। অসমসাহসী এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ডাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুয়োলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের দিকে এক মেয়ের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

  10. ইমতিয়ার শামীম - ২ জানুয়ারি ২০১৬ (৪:০৫ অপরাহ্ণ)

    জাঁ কাই সম্পর্কে আরো কিছু বিষয় জানা গেল আজ প্রথম আলো থেকে।
    এতে লেখা হয়েছে :

    ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫। প্যারিসের অভিজাত আবাসিক এলাকা রু লুই নিকোলার চার নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলা। বাইরে তখন শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রা। তৃতীয়তলার কক্ষটির ভেতরে যান্ত্রিক উত্তাপ নিতে নিতে হুইলচেয়ারে বসেছিলেন পৃত্থিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বাঘা যতিনের নাতি পৃত্থিন্দ্রনাথ। তিনি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন একাত্তর সালের সেই দিনগুলোতে। আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন বিস্মৃত প্রায় এক ফরাসি মুক্তিযোদ্ধার দুঃসাহসী অভিযানের কথা।
    আবার একাত্তর
    কিঞ্চিৎ খোলা জানালার দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজতে থাকলেন ৮৪ বছর বয়সী পৃত্থিন্দ্রনাথ। বললেন, ‘হুমম এই তিন ডিসেম্বরেই। ৭১ সালের ঠিক আজকের দিনটিতেই তো জঁ ক্যার সঙ্গে দেখা করতে প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম।’ জঁ ক্যা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। সেটা বুঝতে পেরেই পৃত্থিন্দ্রনাথ গড়গড় করে বলা শুরু করলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য প্যারিসে বসে আমরা তখন অনেকে অনেক কিছু করেছি। কবিতা-কলাম লিখেছি, বাংলাদেশি কবিদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ছেপেছি। কিন্তু সবচেয়ে কাজের কাজটি করেছিলেন ২৮ বছর বয়সী জঁ। প্যারিসের সব পুলিশ যেন সেই দিন অরলি বিমানবন্দরে এসে হাজির হয়েছিল। গ্রেপ্তার অবস্থাতেই জানতে পারলাম, দীর্ঘ আট ঘণ্টার অপারেশন শেষে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের ( পিআইএ) বিমানটিকে জঁ-এর কাছ থেকে মুক্ত করেছে পুলিশ। জঁকে গ্রেপ্তার করে অরলি পুলিশ ফাঁড়িতে নেওয়া হয়েছে।’
    ‘বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্র হাতে নিতে আমি প্রস্তুত।’ এমন ঘোষণা দিয়ে ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপজুড়ে তখন তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন ৭০ বছর বয়সী আন্দ্রে মারলো। জঁ গ্রেপ্তার হয়েছেন খবর পেয়ে তিনিও ছুটে গেলেন অরলি পুলিশ স্টেশনে। ফ্রান্স সরকারের সঙ্গে কথা বলে গল-এর মন্ত্রিসভার মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী মারলো আমাকে থানা থেকে মুক্ত করলেন। এরপর মারলো নামলেন জঁর মুক্তির লড়াইয়ে।’ এ কথা বলে কিছুক্ষণ দম নিলেন পৃত্থিন্দ্রনাথ।
    বিমান ছিনতাইয়ের বিস্তারিত
    পৃত্থিন্দ্রনাথের কাছ থেকে জঁর মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব তোলপাড় করা ভূমিকা নিয়ে নতুন অনেক কিছু জানলাম। কিন্তু এ তো শেষ নয়। দুনিয়া কাঁপানো ওই বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার তৃষ্ণা যে আরও বেড়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্যারিসেই থাকেন ফ্রান্সের এক সময়কার প্রভাবশালী দৈনিক লে ফিগারোর সাংবাদিক ফ্রাসোয়া মঁতিয়ে। তিনি তখন তাঁর পত্রিকার হয়ে জঁ ক্যার বিমান ছিনতাইয়ের পুরো ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে মঁতিয়ের কাছে পৌঁছালাম। জানা গেল সেই উত্তাল সময়ে জঁ-এর ইউরোপ কাঁপানো ঘটনার কথা।
    আশি-ঊর্ধ্ব মঁতিয়ে তরুণ তুখোড় সাংবাদিকের মতোই দিন-ক্ষণ-নামসহ পুরো ঘটনা যখন বলছিলেন, তখন চোখের সামনে যেন ৭১-এর রক্তমাখা সেই ডিসেম্বর ভেসে উঠছিল। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের একটি বোয়িং-৭২০বি বিমান প্যারিস অরলি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ১৭ জন যাত্রী ও ছয়জন ক্রু নিয়ে বিমানটি লন্ডন থেকে প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে করাচি যাবে। এর মধ্যে পাঁচজন যাত্রী প্যারিস থেকে উঠবে। ওই পাঁচজনের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যূহ পেরিয়ে বোয়িংটিতে উঠে বসলেন ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যা।
    বেলা তখন ১১টা ৫০ মিনিট। পাইলট আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি হিসেবে বিমানটি চালু করতেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে জঁ ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। কেউ তাঁর নির্দেশ অমান্য করলে সঙ্গে থাকা বোমা দিয়ে পুরো বিমানবন্দর উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন তিনি। ওয়্যারলেসটি কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে জঁ নির্দেশ দিলেন, বিমানটিতে যাতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিত্সা সামগ্রী তুলে তা যুদ্ধাহত ও বাংলাদেশি শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। বললেন, ‘আমার এই দাবি নিয়ে কোনো আপস চলবে না (নন নেগোশিয়েবল)।’ দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেও তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নাড়ানো গেল না।
    ছিনতাইয়ের পর
    জঁ ক্যার ওই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা মুহূর্তে পুরো ফ্রান্স ছাড়িয়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সসহ বিশ্বের প্রভাবশালী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কিছুক্ষণ পরপর ঘটনার হালনাগাদ সংবাদ দিতে থাকল। বিশ্বজুড়ে চলা যুদ্ধবিরোধী ও মানবতার পক্ষের আন্দোলনকারীদের কাছে জঁ নামের ওই বাবরি দোলানো যুবক রীতিমতো হিরো বনে গেলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ফ্রান্সের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা অরলি বিমানবন্দরে এসে জড়ো হতে থাকলেন। তাঁদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হলেন।
    পিআইএর বিমানটিকে মুক্ত করতে ফরাসি সরকার তখন নতুন এক ফাঁদ আটল। তারা জঁ ক্যার দাবি অনুযায়ী ওষুধ আনতে ফরাসি রেডক্রসকে খবর দিল। রেডক্রস আরেক ফরাসি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অর্ডি দ্য মানতে’র সহায়তায় বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। ওই গাড়ির চালক ও স্বেচ্ছাসেবকের পোশাক পরে বিমানটিতে প্রবেশ করলেন ফরাসি পুলিশের বিশেষ শাখার চারজন সদস্য। তাঁরা বিমানে তোলা ওষুধের বাক্সে পেনিসিলিন রয়েছে, এ কথা বলে বিমানের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো সাজিয়ে রাখার ভান করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলেন। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা ওষুধের বাক্স নামানোতে সহায়তার নাম করে জঁ ক্যার হাতে একটি বাক্স তুলে দিলেন। এরপরই তাঁর ওপর আক্রমণ শুরু করলেন পুলিশের সদস্যরা।
    পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রাত আটটায় জঁ পুলিশের হাতে আটক হলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো অরলি পুলিশ স্টেশনে। সেখানে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জঁ জানালেন, তিনি ইচ্ছা করেই ৩ ডিসেম্বর বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। কারণ ওই দিন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ওই বিমানবন্দরে এসে নেমেছিলেন। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তাঁকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
    কে এই তরুণ?
    আলজেরীয় সৈনিক বাবার একমাত্র সন্তান জঁ ক্যা। বাবা-মা দুজনই গত হয়েছিলেন। জঁ বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন ’৭১-এ জুনের মাঝামাঝি কোনো এক দিনে। তিনি তখন সবে ফরাসি সেনাবাহিনীর হয়ে বিদ্যুৎ প্রযুক্তিবিদ হিসেবে ইয়েমেনে চাকরি শেষে দেশে ফিরেছেন। যুদ্ধে আহত শিশু ও শরণার্থীদের কষ্টের স্মৃতি তখন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষদের ওপর হামলা শুরু করার পর থেকে জঁ ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল রাখছিলেন। ফরাসি পত্রিকায় বাঙালিদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা তাঁকে ব্যাপকভাবে পীড়িত করে। বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু একটা করার উপায় খুঁজতে গিয়েই বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা আঁটেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি অনুপ্রেরণা পান আন্দ্রে মারলোর বাংলাদেশ নিয়ে লেখা ও বক্তৃতা থেকে।
    দৃশ্যপটে আন্দ্রে মারলো
    আন্দ্রে মারলো অবশ্য তাঁর ওই খ্যাপাটে অনুরাগীকে মুক্ত করতে সব চেষ্টাই করেন। মারলোর আইনজীবী বন্ধু বিনা পারিশ্রমিকে জঁ ক্যারের পক্ষে লড়াইয়ে নামেন। আইনজীবী ছিনতাই হওয়া ওই পাকিস্তানি বিমানের সব যাত্রী ও বিমানের ক্রুদের সাক্ষ্য নেন। তাঁরা সবাই একবাক্যে বললেন, জঁ ক্যা তাঁদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি। এমনকি কারও দিকে সরাসরি পিস্তল তাক করেননি। তিনি উল্টো যাত্রীদের উদ্দেশে বলেছেন, আমি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত শিশু ও শরণার্থীদের ওষুধ পাঠানোর জন্য বিমানটি ছিনতাই করেছি। তাঁরা যাতে বাংলাদেশের ওই মানুষদের জীবন বাঁচাতে তাঁকে সহযোগিতা করেন। সেই আহ্বানই তিনি যাত্রী ও ক্রুদের উদ্দেশে জানিয়েছিলেন।
    এত সব চেষ্টা করেও অবশ্য জঁ-এর শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁকে ফরাসি আদালত পাঁচ বছরের জন্য জেল দেয়। জঁ কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তাঁর পক্ষে আন্দ্রে মারলোর নেতৃত্বে ফ্রান্স ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। অনেক আইনি লড়াইয়ের পর আদালত জঁ-এর শাস্তির মেয়াদ তিন বছর কমিয়ে তাঁকে ১৯৭৩ সালে মুক্তি দেন।
    জঁ ক্যার বাকি জীবন
    জঁ যখন জেল থেকে মুক্ত হলেন বাংলাদেশ তো তত দিনে স্বাধীন। এরপর জঁ কী করলেন, কোথায় গেলেন। সে খোঁজ না পৃত্থিন্দ্রনাথ, না মঁতিয়ে কেউই দিতে পারলেন না। এবার খোঁজ শুরু করলাম জঁ-এর কোনো আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না। আরেক প্রবীণ ফরাসি সাংবাদিকদের সাহায্য নিয়ে জঁ-এর নাতি ফ্রাঙ্কো পাভেলের খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু প্যারিসের ববিনি আবাসিক এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল না।
    তবে শেষ পর্যন্ত দাদা জঁ ক্যাকে নিয়ে ফ্রাঙ্কোর একটি লেখা পাওয়া গেল। ফরাসি ভাষায় দৈনিক নভেল্লিয়েস ডি ফ্রান্স-এ ২০১২ সালে প্রকাশিত ওই লেখা জঁ-এর ৭২-পরবর্তী জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দিকে চোখ খুলে দিল। ওই লেখা থেকে জানা যায়, জেল থেকে মুক্ত হয়ে ওই ফরাসি তরুণ চলে যান লেবাবনে। সেখানে গিয়ে তিনি নানা ধরনের সামাজিক অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে পড়েন। এরপর স্পেন, অস্ট্রেলিয়া হয়ে তিনি ভারতের দিল্লিতে এসে আস্তানা গাড়েন। সেখানে এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করে সংসার পাতেন।
    দিল্লিতে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় ভারত সরকারের তোপের মুখে পড়েন জঁ। চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে দরিদ্র ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে মুরগির স্যুপ বিলি করতেন তিনি। জঁ-কে নিয়ে একাধিক ফরাসি পত্রিকায় লেখা সংবাদে জানা যায়, ১৯৮২ থেকে ’৮৬-এর মধ্যে কলকাতা থেকে একাধিকবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন দেখে ক্ষুব্ধ হন জঁ। ’৮৫ সালে কলকাতা ত্যাগ করে হিমালয়ের পাদদেশে একটি গুহায় ধ্যানে মগ্ন হন বলে তাঁর বন্ধুরা জানিয়েছিল। ধ্যানে দেড় বছরের মতো কাটিয়ে কলকাতা ফিরে সেখানকার বিভিন্ন গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর। খবর পেয়ে ভারত সরকার তাঁকে ১৯৮৬ সালে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়।
    ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে জঁ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে একটি নৌকায় তাঁর সংসার পাতেন। ওই নৌকাতেই তাঁর চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়। সেখান থেকে আবারও কোথায় যেন ডুব দেন তিনি। এর অনেক বছর পর ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জনপ্রিয় দৈনিক লা ফিগারোতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। বলা হয়, সামাজিক আন্দোলনের কর্মী ও লেখক জঁ ক্যা ৬৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। ২৭ ডিসেম্বর প্যারিসের নিম্ন মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ‘লজে টার্ন-এট-গারোন্নে’তে পারিবারিকভাবে তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। লা ফিগারো পত্রিকায় জঁ-এর পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অনেক দেশে অনেক কাজে যুক্ত হওয়ার বর্ণনা আছে। তবে তাতে বলা আছে, তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিমান ছিনতাই করা।
    বিস্মৃত একজন
    জঁ ক্যার ওই তিরোধান—না প্যারিস, না বাংলাদেশ কেউই স্মরণে রাখেনি। ’৭১-এ বিশ্ব কাঁপানো জঁ-এর জীবনের শেষ কটা বছর কেটেছে একান্ত পারিবারিক পরিসরে। তবে ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর প্যারিস বিমানবন্দরে তিনি যে দুঃসাহসী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তা কিন্তু বৃথা যায়নি। ডিসেম্বরের ৮ তারিখে জঁ ক্যা জেলে থাকা অবস্থাতেই ফরাসি রেডক্রস ও নাইটস হাসপাতাল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও শিশু খাদ্য পাঠায়। পাকিস্তানি বাহিনীর বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে জনমত তীব্র হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ে। বিস্ময়করভাবে জঁর মৃত্যুও হয়েছিল আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই। দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর।

    এ এক অনন্য অবদান।

  11. মাসুদ করিম - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

    পাকিস্তানি জাহাজ আটকে দেওয়ার স্মৃতি ‘ব্লকেড’

    একাত্তরের রণাঙ্গনে যখন বাঙালি সীমিত শক্তি নিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি সেনাবাহিনীর মুখোমুখি, সে সময় পাকিস্তানি জাহাজ ‘পদ্মা’ পাড়ি জমিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজভর্তি অস্ত্র নিয়ে ফিরে এসে সেসব অস্ত্র বাঙালিদের নিধনে ব্যবহার।

    কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ যুক্তরাষ্ট্রেরই কয়েকজন সাহসী নাগরিক।

    ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে জাহাজ ‘পদ্মা’কে ভিড়তে দেননি তারা। ওই জাহাজে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জন্য অস্ত্র দেওয়ার কথা পেন্টাগনের।

    ছোট কয়েকটি ডিঙি নৌকা নিয়ে জীবন বাজি রেখে সেদিন ‘পদ্মা’র যাত্রা আটকে দিয়েছিলেন পেনসিলভেনিয়া ও বাল্টিমোরের সেই সাহসী মানুষেরা।

    নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে এই ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
    বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে ‘পদ্মা’ অবরোধে নেতৃত্ব দেওয়া রিচার্ড টেইলারের লেখা ‘ব্লকেড’ বইটিই এবার একই নামে উঠে এসেছে তথ্যচিত্রে।

    যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালি আরিফ ইউসুফ ও তসবির ইমাম স্বাক্ষর নির্মিত তথ্যচিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয়ে গেল শনিবার নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানের বারুক কলেজের এঙ্গেলম্যান রিসাইটাল হল মিলনায়তনে।

    কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে প্রদর্শনীতে উপস্থিত হন বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি ও মার্কিন নাগরিক।

    প্রদর্শনী শেষে তথ্যচিত্র ‘ব্লকেডের’ অন্যতম নির্মাতা আরিফ ইউসুফ সাংবাদিকদের জানান, ২০০৮ সাল থেকে তিনি এবং স্বাক্ষর এটির নির্মাণ শুরু করেন।

    দুজন হাজার মাইল দূরে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় মানুষের সামনে তুলে ধরার পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

    আরিফ বলেন, “স্বাক্ষর থাকে ওয়াশিংটন ডিসিতে। আর আমি নিউ ইয়র্কে। হাজার মাইলের ব্যবধানও আমাদের দমাতে পারেনি।যাবতীয় পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে নেওয়ায় ছবিটি বানাতে এতদিন লেগেছে।”

    তাসবির ইমাম স্বাক্ষর বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমামের ছেলে।

    “তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন যে পাক হায়েনাদের সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে, তা সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে আরও স্পষ্ট করার অভিপ্রায়ে আমরা এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছি,” বলেন আরিফ।

    আশি মিনিটের তথ্যচিত্রে ‘পদ্মা’ অবরোধে অংশ নেওয়া কয়েকজনের সাক্ষাৎকার এবং সেসময়ের কিছু ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে।
    তথ্যচিত্র ‘ব্লকেড’ শিগগিরই বাংলাদেশে প্রদর্শণ করার কথা জানান কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালক আরিফ।

    “আসছে জুলাইতে ঢাকায় যাব। তারপর সেটি প্রদর্শনের সময় ঠিক করব।”

    শনিবার ‘ব্লকেড’ তথ্যচিত্রটি ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোর বে এরিয়াতেও প্রদর্শিত হয়েছে।

    এছাড়া ওয়াশিংটন, বোস্টন, নিউজার্সি ও কানাডায় তথ্যচিত্রটি প্রদর্শণ এবং অনলাইনে ছাড়া হবে বলে আরিফ জানান।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.