অক্টোবর ১৯৭৩। বিমান হাইজ্যাকার জাঁ কুয়ে’র বিচার হচ্ছে ফ্রান্সের আদালতে। বছর দুয়েক আগে পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ফ্রান্স সফরে আসার দিন প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এক যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে পশ্চিমা বিশ্বে হইচই ফেলে দেন জাঁ কুয়ে। হঠাৎ জানা গেল, সেই জাঁ কুয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যেই কি না আদালতে উপস্থিত হতে চলেছেন ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মাল্রো!
বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। খ্যাতিমান দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক মাল্রো, যিনি ৭০ বছর বয়সে পৌঁছেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অস্ত্র ধরতে চেয়েছিলেন, তিনি কি না সাফাই গাইতে আসছেন এক হাইজ্যাকারের! কী এমন ঘটেছিল যে, মাল্রো মতো একজন সজ্জন দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ককে সেদিন এই হাইজ্যাকারের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল? আর সেই মামলায় জাঁ কুয়ের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছিলেন ফ্রান্সের প্রখ্যাত আইনজীবী জাঁ মার্ক ভারাউত?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের প্যারিস শহরে নিবিষ্ট মনে জাঁ কুয়ে লিখে চলেছেন তাঁর বই ‘দ্য উয়েপন ইন দ্য হার্ট’। ফরাসি লেখক জাঁ ইউজিন পল কুয়ে ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, চলার পথে বিভিন্ন মতাদর্শের সংস্পর্শে তার জীবন হয়ে উঠেছিল অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ, নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শিক অবস্থানে এসে থিতু হয়েছিলেন — হয়ে উঠছিলেন ক্রমশই বিশ্বমানব, বিশ্বপথিক। বাবার বাড়ির কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্টে দিনের পর দিন লেখালেখিতে একমনা কুয়ে’র চোখ বই লেখা শেষ হতেই গিয়ে পড়ল সারা বিশ্বের ঘটনাবলীর দিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
কেন বিশেষভাবে বাংলাদেশই কুয়ে’র দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছিল? অনুমান করছি, আঁদ্রে মাল্রো-ই এর মূল কারণ। ১৯৭১-এর শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে বের হন। প্রায় একই সময়ে আঁদ্রে মাল্রো পত্রপত্রিকায় এমন এক বিবৃতি দেন, যা এক দিকে ইন্দিরা গান্ধীর এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করে তোলে। তিনি তার ওই বিবৃতিতে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার ইচ্ছা জানান। মাল্রোর এ বিবৃতি বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকাতে তুমুল আলোড়ন তৈরি করে।
এই মাল্রো ছিলেন জাঁ কুয়ে’র আদর্শিক পথিকৃৎ। মানুষ হিসাবে, আগেই লেখা হয়েছে, জাঁ কুয়ে ছিলেন বিচিত্র ধরনের। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে, ১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি, আলজেরিয়ার মিলিয়ানাতে। তবে খুব অল্প সময়ই তিনি তাঁর জন্মভূমিতে কাটিয়েছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলাতেই জন্মভূমির আস্বাদ বুঝে ওঠারও আগেই স্থানান্তরিত হন কুয়ে। তাঁর বাবা, সামরিক বাহিনীর সিগন্যাল কর্মকর্তা, ওই সময় ব্রিটানি’র মিলিটারি একাডেমিতে বদলি হয়ে যান। তার আরেক ভাইও ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। মাত্র আট বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি এবং মাতৃহীন পরিবারে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের গোঁড়ামিতে ভরা শিক্ষাই পেতে শুরু করেন। তিনি এমন শিক্ষা পান, যা তাকে শিক্ষা দেয় টাকার জন্যে নয়, বরং আদর্শের জন্যে জীবন দিয়ে দিতে।
বাবার মতো কুয়েও ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর একজন। কিন্তু অচিরেই তিনি বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে এবং যুক্ত হন ওএসএস-এ। এই গোপন বাহিনী আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে মনে করত। ওএসএস-এর অন্য সদস্যদের মতো কুয়েও মনে করতেন যে, আলজেরিয়াকে কিছুতেই ফ্রান্সের মানচিত্র থেকে বাদ দেয়া যাবে না। ক্রমশই তিনি পরিণত হচ্ছিলেন বদ্ধ চিন্তার মানুষে। খ্রিস্টীয় মূল্যবোধে প্রাণিত জাঁ কুয়ে ছিলেন সাম্যবাদের ঘোরতর বিরোধী। ‘এই আদর্শ অন্যায়, দুর্নীতি, অবিচার ও মৃতুøর জন্ম দেয়’ — সাম্যবাদ সম্পর্কে এই ছিল জাঁ কুয়ের ধারণা। কিন্তু আঁদ্রে মাল্রোর লেখা পড়ে জাঁ কুয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় এবং তিনি ওএসএস থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে পুরনো মতাদর্শ ছেড়ে এলেও এর কার্যপ্রণালীর প্রতি তার আকর্ষণ ছিল ষোলআনাই। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে তিনি যুক্ত হয়েছেন স্পেন, লিবিয়া ও বায়াফ্রার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে।
আঁদ্রে মাল্রোর বিবৃতিও তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের জন্যে কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি এ কাজে তার চেনা পথই অনুসরণ করেন — তেসরা ডিসেম্বর তিনি এমন এক ঘটনা ঘটান যা দেশে-বিদেশে আলোচিত হতে থাকে। পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই, পৃথিবীর মানুষ জানতে শুরু করে, হতবাক করে দেয়ার মতো এক ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর এমন এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে, যার কি না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার অধিকার রয়েছে; এই রাষ্ট্রের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং হাইজ্যাক করেছেন জাঁ কুয়ে।
‘আমার কাছে অস্ত্র আছে, বোমাও আছে, আমার কথা না শুনলে এ বিমান উড়িয়ে দেব’ — ককপিটে ঢুকে বোয়িংটি হাইজ্যাক করার সঙ্গে সঙ্গে জাঁ কুয়ে এ কথার পাশাপাশি ঘোষণা দেন, বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে এ বিমানের মাধ্যমে ২০ টন মেডিক্যাল সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বসহ বিশ্বের সব মানুষের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায় — নিছক টাকা-পয়সা নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালদের নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব বাঙালি উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, রোগেশোকে ভুগছিলেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর তীব্র এক মানসিক তাড়না থেকে কম্যুনিস্ট বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।
ওই দিন ফ্রান্স সফর করছিলেন পশ্চিম জার্মানির ওই সময়ের ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। ফরাসি রাষ্ট্রপতি পম্পেদুর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্যে ফ্রান্স সফরে গিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের শীতল সম্পর্ক নিরসনের নিরিখে এই সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই উইলি ব্র্যান্ডটের সফরের দিনেই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ফ্রান্সের জন্যে হয়ে দাঁড়ায় স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
‘আমার কথা না শুনলে বিমান উড়িয়ে দেব’ — জাঁ কুয়ে’র এই কথা যে কথার কথা ছিল না, তা বিমানের যাত্রীদের বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল না। কুয়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছিল বোমার সঙ্গে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার। বিমানে ছিলেন ২৮ জন যাত্রী। প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এ ঘটনার শুরু হয় স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে। আর তার অবসান ঘটে বিকেলে। বিকেল পাঁচটা ১৫ মিনিটে জাঁ কুয়ে’র দাবি মেনে নেন ফরাসি কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দরে ওষুধের প্রথম চালান এসে পৌঁছায়। কুয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম দফায় শিশুসহ আট বিমানযাত্রীকে মুক্তি দেন।
পেশাদার হাইজ্যাকার নন বলেই বিমান হাইজ্যাক করার পরও জাঁ কুয়ে যাত্রীদের প্রতি ছিলেন সদয়। ফরাসি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই জানা ছিল না কুয়ের। তাই যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন দোভাষী নিয়োগ করেন তিনি। কিন্তু তারপরও বিশেষ করে পাকিস্তানি যাত্রীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কেননা কুয়ে জানান, ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর আগে বেলরুটে পাকিস্তানি ছাড়া অন্য সব যাত্রীকেই নামিয়ে দেবেন তিনি।
কিন্তু জাঁ কুয়ে বিষয়টিকে যত সহজ মনে করেছিলেন, বাস্তবে তা তত সহজ ছিল না। কর্তৃপক্ষ সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তার প্রস্তাবে; কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে, তারা বিকল্প পথে ছিনতাই হয়ে যাওয়া বিমান ও সেটির যাত্রীদের বিকল্প পথে উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন না। জাঁ কুয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন, মেডিক্যালসামগ্রী তোলার পর পিআইএ’র এই ফ্লাইটে করেই ভারতে চলে যাবেন। প্রথম দফায় তিনি যেসব যাত্রীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাদের কাছে পৌঁছানোর আগেই তারা রওনা হয়ে যান প্যারিসের দিকে। বিমানের রানওয়েতে তখনও অ্যান্টি-এয়ার ইনফেকশন, পাউডার মিল্ক ইত্যাদি অপরিহার্য জিনিসপত্রসহ মেডিসিন তোলার কাজ চলছে। কুয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন আসবে ওষুধপত্রের দ্বিতীয় চালান। রাত ৭টার দিকে মেডিক্যাল সামগ্রী ভর্তি দ্বিতীয় ট্রাকটি এসে পৌঁছে বিমানের কাছে। কিন্তু এই পর্বে ওয়্যরহাউজম্যানদের বেশে আসেন পুলিশের কর্মকর্তারা। এমনকি বিমানের ক্রুরাও বুঝতে পারেননি, এরা আসলে পুলিশের লোকজন। এদের হাতেই ধরা পড়েন জাঁ কুয়ে। পেনিসিলিন পৌঁছানোর ছলে এক পুলিশ পৌঁছে যায় ককপিটের কাছে। কুয়ের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন তিনি।
জাঁ কুয়েকে আটক করেছিলেন পুলিশ অফিসার অ্যান্তোইন সিবলো। সাংবাদিকদের কাছে পরে তিনি বলেছিলেন, জাঁ কুয়ের সেই অসতর্ক মুহূর্তটির কথা। তিনি ছিলেন কুয়ের কাছাকাছি এবং মুহূর্তটিকে কাজে লাগাতে একটুও দেরি করেননি তিনি। তাদের দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে চমকে ওঠেন তিনি এবং তারপরই গুলি করেন সিবলোকে লক্ষ্য করে। গুলি এড়ানোর জন্যে দ্রুত সরে যান তিনি এবং বুলেট ছুঁয়ে যায় তার পুলওভার ও ব্লেজার।
তবে জাঁ কুয়ে ধরা পড়লেও তার বিমান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য ছুঁয়ে গিয়েছিল ফরাসিদের সবার হৃদয়। জাঁ কুয়ে ধরা পড়ার পরপরই সাংবাদিকরা মালতে অদ্রে’র (দ্য অদ্রে অব দ্য নাইটস হসপিটালিয়ার্স অব মালতে) এক কর্মকর্তা মার্কেজ অব অগোস্টি’র কাছে মেডিক্যাল সামগ্রীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাই বলেছিলেন, ‘আমরা এসব সামগ্রী মালটা অর্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানেই (অর্থাৎ বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্যে) নিয়ে যাব, কেননা সেগুলোকে তো সেখানেই পাঠানোর কথা হয়েছে।’
এরই মধ্যে ভারতও বাংলাদেশের মতোই পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ডামাডোলে বিমান ছিনতাইয়ের এ ঘটনার গুরুত্ব কমে যায়। তবে এনবিসি এবং সিবিএস টিভিতে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রচারিত হয়। এসব খবরেও জানানো হয়, জাঁ কুয়েকে গ্রেফতার করা হলেও মেডিক্যাল সামগ্রী বাংলাদেশের জন্যে পাঠানো হবে।
জাঁ কুয়েকে গ্রেফতার করার পর দেখা গেল, তার ব্যাগের মধ্যে বোমার ‘ব’ থাকলেও বোমা-টোমা কিছু নেই। বোমার সেই ‘ব’ হলো কিছু এলোমেলো বই, একটি মোটাসোটা বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রনিক রেজর, যার মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ব্যাগের বাইরে একটি বৈদ্যুতিক তার।
এইভাবে জাঁ কুয়ে বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। বিচারের সময় আদালতে তার পক্ষে এসে হাজির হন ফ্রান্সের অনন্য রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্বযুদ্ধ ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের সরাসরি যোদ্ধা, দ্য গলের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, দার্শনিক আঁদ্রে মাল্রো — যিনি নিজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নিক্সনের কাছে এক চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের দৈনিক লে ফিগারোতে প্রকাশিত হয় তার সে চিঠি। এই আঁদ্রে মার্লো যে জাঁ কুয়ের পক্ষে আদালতে যেতে দ্বিধা করবেন না, তাতে আর সন্দেহ কী!
১৯৭৩-এর অক্টোবরে আঁদ্রে মাল্রো জাঁ ক্যুয়ের পক্ষে আদালতে গিয়েছিলেন; একই বছর তিনি রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন, যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা ও যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় তার। তিনি কি এ সাক্ষাতের সময় জাঁ কুয়ের কথা বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে? এর উত্তর জানা নেই আমাদের। তবে বিচারে জাঁ কুয়ের ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ততদিনে তার বই ‘উয়েপন ইন দ্য হার্ট’ বাজারে এসে গেছে, তা ছাড়া জেলে বসে তিনি লিখেছিলেন আরেকটি উপন্যাস ‘লেস ফাউস ওয়্যর’। তবে ইতিমধ্যেই তিন বছরের কারাবাস হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৩-এর শেষের দিকেই জাঁ কুয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি লেবাননে ফিরে যান এবং আবারও ‘খ্রিস্টীয় ফ্যালাঞ্জি’দের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন।
একজন লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরও জাঁ কুয়ে’র শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা তত পরিষ্কার নয়। যতদূর জানা যায়, জাঁ কুয়ে এবং তার পরিবার নব্বইয়ের দশকে তাদের সবচেয়ে ছোট মেয়েটিকে বড় করে তোলার জন্যে বেছে নেন স্পেনের বার্সেলোনা এবং তোলাউস অঞ্চলের মধ্যবর্তী কোনো এলাকাকে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশ পায় তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ওয়ারির অব হোপ’। ফরাসি ভাষায় লেখা তার এ বইয়ে পিআইএ’র বিমান হাইজ্যাক পর্বটিকে জাঁ কুয়ে কীভাবে বর্ণনা করেছেন, কিংবা আদৌ করেছেন কি না, তা জানা নেই আমাদের — তবে অচিরেই আমাদের ফরাসি জানা সতীর্থ বন্ধুরা বিষয়টি জানাবেন আশা করা যায়। দক্ষিণ ফ্রান্সে ছোট মেয়েকে মানুষ করে তোলার জন্য যে-স্বর্গ জাঁ কুয়ে গড়ে তুলেছিলেন, ট্রাজিক এক ঘটনায় সেটি ভেঙে তছনছ হয়ে যায় — ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার স্ত্রী মারা যান। বছর ১৫ আগে লেখা একটি বইয়ে এই দ্বীপ সম্পর্কে জাঁ কুয়ে লিখে গেছেন, ‘ভালোবাসা যেখানে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে’। ২০০৪ সালে জাঁ কুয়ে তার প্রিয় মেয়ের সঙ্গে সমুদ্রবাসে যান। এখন, হয়তো তিনি নিভৃতবাসে আছেন।
দুই·
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ঘটনাস্থল ব্রাসেল্স, বেলজিয়াম।
মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে সেদিনই শুরু হয়েছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ শিল্পীদের চিরায়ত সব শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনী। এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই প্রদর্শনী যে তা উন্মুক্ত করার এসেছেন ডাচ রাজকন্যা পামেলা। আমন্ত্রিতজনদের কেউই হাতছাড়া করেননি প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে আসার আমন্ত্রণ।
এদেরই একজন মারিও রয়ম্যান্স। সাধারণ এক ছেলে, বয়স মাত্র ২১ বছর। এমনকি তিনি নিজেও তখন জানতেন না, আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তিনি বেলজিয়ামের অপরাধের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চলেছেন — পরিণত হতে চলেছেন ডাচদের রবিনহুডে। পরে তিনি রেডিও বিআরটিতে বর্ণনা করেছিলেন, কী করে সেদিন মিউজিয়ামে ঢোকার সুযোগ করে নিয়েছিলেন তিনি। অস্থির চোখে গ্যালারিতে টাঙানো ছবি দেখে চলেছেন রয়ম্যান্স, সঠিক শিল্পকর্মটিই বেছে নিতে চান তিনি। যত শিল্পজ্ঞানই থাক না কেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ডেনমার্কের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে নিয়ে আসা উলেস্নখযোগ্য সব শিল্পকর্মের মধ্যে থেকে ঈপ্সিত লক্ষ্যের উপযোগী একটি শিল্পকর্ম বেছে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রয়ম্যান্স তাই বারবার ঘুরেফিরে দেখছেন দেয়াল জুড়ে থাকা ছবিগুলোকে।
অবশেষে রয়ম্যান্সের চোখ স্থির হয়ে গেল ইয়োহান ভারমিয়ারের চিত্রকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার’-এ। সপ্তদশ শতাব্দীর শিল্পী ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’ নিয়ে আসা হয়েছে আমস্টারডামের রাইখস মিউজিয়াম থেকে। ছবিটির মূল্য ওই সময়েই পাঁচ মিলিয়ন ডলার- ১৫ গুণন ১৭ ইঞ্চির ক্যানভাসে আঁকা এ ছবিটিকেই সব দিক থেকে উপযোগী মনে হলো তার।
প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, দর্শকরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু মারিও রয়ম্যান্স হালকা তালে ছবি দেখে চলেছেন। দেখতে দেখতেই তিনি একসময় টুক করে লুকিয়ে পড়লেন গ্যালারির একটি দেরাজের মধ্যে। এখনকার মত তখন সিসিটিভি ছিল না, নিরাপত্তা প্রহরীরও তেমন প্রয়োজন ছিল না জাদুঘরগুলোতে। ব্রাসেল্সের ওই মিউজিয়ামে তখন রাতের বেলা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন মাত্র চারজন নিরস্ত্র পুলিশ। দর্শকদের সবাই বেরিয়ে গেছেন ভেবে একসময় তারাও গ্যালারির দরজা বন্ধ করে দিলেন। রয়ম্যান্স তখন মটকা মেরে পড়ে আছেন দেরাজের মধ্যে।
রাত আরও একটু গভীর হতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন মারিও রয়ম্যান্স। এবার আর এদিকসেদিক নয়, সোজা ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’-এর দিকে হেঁটে গেলেন তিনি। চেষ্টা করলেন পেইন্টিংটি খুলে নেয়ার। কিন্তু সহজে খোলা যাবে না দেখে পকেটের মধ্যে থেকে বের করে আনলেন তার আলু কাটার ছুরি। ফ্রেমের চারপাশ ঘেঁষে সতর্কতার সঙ্গে কেটে আলাদা করে ফেললেন ছবির মূল ক্যানভাসটিকে। তারপর সেটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন এবং মিউজিয়ামের ভেন্টিলেটর বেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর ট্যাক্সিতে করে চলে গেলেন সোজা টঙ্গারেনের এক কয়লাখনির পাশে, সেখানেই থাকেন তিনি এক বাসায়।
পাঁচ মিলিয়ন ডলার দামের একটি ছবি — এটিকে তো এখন ঠিকমতো লুকিয়ে রাখতে হবে! অতএব মারিও বাড়ি ফিরে সেটিকে লুকিয়ে রাখলেন কাছের একটি জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, শুরু হলো বৃষ্টি। রয়ম্যান্স বিছানা ছেড়ে ছুটলেন জঙ্গলের দিকে, শিল্পকর্মটিকে নিয়ে এলেন ঘরে।
এদিকে পরদিন গ্যালারি উন্মুক্ত করার পর হতবাক হয়ে গেলেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। নেই, কোথাও নেই ভারমিয়ার-এর অনবদ্য শিল্পকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার।’ হইচই পড়ে গেল সবখানে। পুলিশ তৎপর হলো সেটি উদ্ধারের জন্যে। ওদিকে, রয়ম্যান্স সেইদিনই নিজেকে খানিকটা নিরাপদে রাখার উদ্দেশ্যে ওয়েটারের কাজ নিলেন বল্ডারবার্গের হোটেল সিতেওয়েতে।
কিন্তু কেন এ কাজ করতে গেলেন মারিও রয়ম্যান্স? এতই নিখুঁতভাবে তিনি পেইন্টিংটি চুরি করেছিলেন যে পুলিশের ধারণা জন্মেছিল, কোনো পেশাদার চোরই এ কাজ করেছে। কিন্তু রয়ম্যান্স যে নিছক চুরি করার জন্যে এ কাজ করেননি সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। পহেলা অক্টোবর রাতে হঠাৎ একটি ফোন গেল বেলজিয়ামের দৈনিক পত্রিকা ‘লা সয়ের’-এ। ফোন ধরার পর পত্রিকা থেকে জানতে চাওয়া হলো, ‘কে বলছেন?’
‘আমি থিল ফন লিমবার্গ।’
রাতে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেসে যাবে পত্রিকা — তাই ব্যস্ত অফিস। এরই মধ্যে কেউ যদি ফোন করে ‘থিল ফন লিমবার্গ’, মানে ইংরেজিতে ‘থিল অব লিমবার্গ’ বলে তা হলে মেজাজ কার না খারাপ হয়! ফ্লেমিশ লোকগাথার রবিনহুড হিসাবে পরিচিত একটি চরিত্র হল থিল উইলেনস্পিজেল — এই থিলের প্রতিকৃতিই ব্যবহার করা হয় তাসের কার্ডে জোকার হিসাবে। লোকগাথা অনুযায়ী, মশকরা করতে করতেই থিল অন্যায়কারী-দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে ফেলেন, ধনীদের সম্পদ নিয়ে আসেন গরিবদের জন্যে।
‘থিল’ পরিচয়ে সংবাদপত্র অফিসে সেদিন আসলে কথা বলছিলেন রয়ম্যান্স। তার ফোন ধরেছিলেন সাংবাদিক ওয়াল্টার শুল্ডেন। তিনিই প্রথম জানতে পারেন, কেন চুরি করা হয়েছে ‘দ্য লাভ লেটার।’ শুল্ডেনকে রয়ম্যান্স ওই সময় জানান, ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক বা চার মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ পেইন্টিংটি ফেরত পেতে পারে। তবে এর একটা ফুটো ফ্রাঙ্কও ব্যক্তিগতভাবে তিনি নেবেন না। ওই দুশ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক পৌঁছে দিতে হবে ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিতাসের কাছে — কারিতাস সেটি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
নিজের জন্যে নয়, পেইন্টিং চুরি করা হয়েছে আরেকটি দেশের শরণার্থী মানুষের জন্যে, যে দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে স্বাধীনতার জন্য, যে দেশের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আর তাদের দালাল ধর্মবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর অত্যাচারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে, ট্রেনিং ক্যাম্পে যাচ্ছে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে। বিস্ময়কর আর অবিশ্বাস্য ঘটনাই বটে! শুল্ডেন চেষ্টা করলেন থিল নামে টেলিফোনকারীর আসল পরিচয় জানতে। কিন্তু থিল আর কিছুই বললেন না। দিনের পর দিন টিভিতে তিনি দেখেছেন পূর্ব বাংলার ভয়ার্ত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে এক কাপড়ে পাড়ি জমাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অপর দেশে, দেখেছেন উন্মূল মায়ের কোলে কান্নার শক্তি হারানো হাড় জিরজিরে পৃথিবীর প্রতি নিরাসক্ত শিশু। তিনি দেখেছেন পথেপ্রান্তরে পড়ে থাকা লাশের প্রাচুর্যে ঝগড়াবিবাদ ভুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মুখ ও ঠোঁট ডোবাচ্ছে শিয়াল, কুকুর ও শকুন। দিনের পর দিন টিভি আর রেডিওতে বাংলাদেশের যুদ্ধরত মানুষদের মরণপণ যুদ্ধগাথা আর ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের অবর্ণনীয় কষ্টকর জীবনযাপনের কথা। তার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো, ‘আমারও মা নেই, বয়স মাত্র কুড়ি। মানুষের এত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।’ তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘হয় আমার কথামতো কাজ করতে হবে, নয়তো ও ছবি আমি বেচে দেব। ল্যাটিন আমেরিকার একজনের সঙ্গে আমার এর মধ্যেই কথা হয়েছে। তিনি ওটা কিনতে রাজি আছেন। আর আমাকে ধরার চেষ্টা করবেন না, তা হলে ওই ছবি একেবারে নষ্ট করে ফেলব।’
শুল্ডেন বুঝতে পারছিলেন না, টেলিফোনের ওপাশ থেকে কথা বলা মানুষটিকে বিশ্বাস করা যায় কি না। সে কথা তুলতেই রয়ম্যান্স তাকে ক্যামেরা নিয়ে ভোর রাতের মধ্যে লিমবার্গের জঙ্গলের কাছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যেতে বলেন। সেখানে প্লাস্টিকের মুখোশপরা রয়ম্যান্স এসে শুল্ডেনের দু’চোখ বেঁধে ফেলেন এবং নিয়ে যান পেইন্টিং দেখাতে। পেইন্টিং দেখার পর শুল্ডেন সেটির ছবিও তোলেন গাড়ির হেডলাইটের আলোতে ফ্লাশ জ্বালিয়ে। পরদিন সেই ছবি ও সংবাদসহ ‘থিল ফন লিমবার্গ’ মারিও রয়ম্যান্স-এর দাবিগুলো নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয় লা সয়ের-এ। পুরো বেলজিয়ামে তোলপাড় শুরু হয় ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরে। এমনকি সিএনএন-এও প্রচারিত হয় পেইন্টিং চুরি যাওয়ার সংবাদ।
এরই মধ্যে বেলজিয়াম রেডিও জানায়, তারাও একই ধরনের একটি টেলিফোন পেয়েছিলেন ক’দিন আগে। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি বলে পুলিশকে খবরটি জানিয়েই ক্ষান্তি দিয়েছেন। এদিকে ডাচ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ব্রাসেলস-এ এসে জানান, থিল ফন লিমবার্গ-এর দাবি মেটানোর আগে তারা নিশ্চিত হতে চান, পেইন্টিংটি সত্যি-সত্যিই ‘দ্য লাভ লেটার’-এর কি না। তারা প্রতিশ্রুতি দেন, একজন বিশেষজ্ঞ সেটি পরীক্ষা করে দেখার সময় পুলিশ কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। রয়ম্যান্স ফাঁদে পড়তে চাননি, তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কয়েকদিন পর রয়ম্যান্স টেলিফোন করেন ‘হেট ফক’ নামের আরেকটি পত্রিকাতে; টেলিফোন করে মুক্তিপণ দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দেন। তিনি জানান, ৬ অক্টোবরের মধ্যে উদ্বাস্তুদের জন্যে অর্থ দেয়া না হলে পেইন্টিংটি নষ্ট করে ফেলা হবে। তিনি আরও জানান, কেবল অর্থ দিলেই হবে না, অর্থপ্রদান সংক্রান্ত চুক্তির অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে টেলিভিশনে এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে দ্য লাভ লেটারের ব্রিটিশ বীমা কোম্পানির প্রতিনিধি গ্রায়েম মিলারকে। রয়ম্যান্সের এ দাবি জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, এত অল্প সময়ের মধ্যে, তাও সরাসরি সম্প্রচার করা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এত অর্থ দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব।
কর্তৃপক্ষের এই অস্বীকৃতির খবর প্রচারিত হয় ৬ অক্টোবর সকালে বিআরটি রেডিওতে। আর তা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাসেটের এক পেট্রোল পাম্পে গিয়ে রেডিও স্টেশনে টেলিফোন করেন মারিও রয়ম্যান্স। ওই সময় সেখানে চলছিল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘টু বেড অর নট টু বেড’। ওই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন তিনি। সবাইকে জানান, তার এই পেইন্টিং নিয়ে আসার কারণ ও উদ্দেশ্য। এদিকে পেট্রোল পাম্পের অপারেটর কথা শুনে বুঝতে পারে, ফোনে কে, কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে কথা বলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চড়া পুরস্কারের আশায় পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ পিছু নেয় রয়ম্যান্সের। পুলিশের গাড়িকে এড়ানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে রয়ম্যান্স আশ্রয় নেন এক গোয়ালের মধ্যে। পুলিশ তাকে যখন আটক করে, তিনি তখন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন দুটি গরুর মাঝখানে গোবরের স্তূপের মধ্যে খড়ের নিচে। ধরা পড়লেও তিনি আগের মতোই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমি যা করেছি, তা আমার কর্তব্য। অবোধ ছেলেপেলে মারা যেতে দেখলে, আমি এ রকমই করব।’
এ ঘটনায় ২ বছরের কারাদণ্ড হলেও রয়ম্যান্স মাত্র ছয় মাস পরই ছাড়া পেয়ে যান। কেননা গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে বেলজিয়ামের সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ২১ বছরের এক তরুণ মহৎ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এমন একটি কাজ করেছে দেখে তার পক্ষে রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষ। রয়ম্যান্স যে হোটেলে ওয়েটারের কাজ নিয়েছিলেন সেই হোটেল সিতেওয়ে’র মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যন্ত তার নিঃশর্ত মুক্তির জন্যে প্রচারাভিযান চালায়। অচেনা ওয়েটার তরুণ মারিও রয়ম্যান্স হয়ে ওঠেন থিল অব লিমবার্গ।
রয়ম্যান্সকে আটক করার পর পুলিশ ‘দ্য লাভ লেটার’ উদ্ধার করে হোটেল সিতেওয়ের রান্নাঘরের পেছনে তার শোবার ঘর থেকে। জাদুঘর থেকে ট্যাক্সি করে ঘরে ফেরার সময় সেটির ওপরেই বসে থাকায় বাঁকাচোরা হয়ে গিয়েছিল সেটি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ শেলডন কেকের তত্ত্বাবধানে চেষ্টা চলে পেইন্টিংটির আগের চেহারা ফিরিয়ে আনার। ছয় মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে সেটিকে মোটামুটি ঠিক করতে পারেন তারা- ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ এই সান্ত্বনা নিয়ে পেইন্টিংটি দেখার সুযোগ ফিরে পান শিল্পবোদ্ধারা।
‘দ্য লাভ লেটার’-এর মুক্তিপণ পাওয়া না গেলেও এ ঘটনার সুবাদে যুদ্ধরত বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে বেলজিয়ামে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশের (পশ্চিমা কূটনৈতিক পরিভাষা অনুযায়ী তখনও পূর্ব পাকিস্তান) শরণার্থী মানুষদের জন্যে সাহায্য পাঠাতে শুরু করে। এমনকি পোপও নাগরিকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার পক্ষে মুখ খোলেন।
তারপর খুব বেশিদিন লাগেনি, বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছে — তবে বাংলাদেশের মানুষের সেই একাগ্র শুভাকাঙ্ক্ষী মারিও রয়ম্যান্সকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে ভয়ানক ছন্নছাড়া অবস্থাতে। কারাগার মাত্র ২১ বছরের এই তরুণের মানসিক শান্তি নষ্ট করে ফেলেছিল। ছয় মাস পর কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি হোটেল সিতেওয়ে’তে আগের কাজে ফেরেন। কিন্তু সবাই হতবাক হয়ে যায় তাকে দেখে- কোথায় আগের সেই প্রাণচঞ্চল তরুণ মারিও? সব চুল পড়ে গেছে, চোখ অস্থির- এ কেমন মারিও রয়ম্যান্স? এক মাস পেরুতে না পেরুতেই কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে হোটেল ছেড়ে তিনি কোথায় যে চলে যান, কেউই বলতে পারে না।
পরে জানা গেছে, পরিচিত এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এক মেয়ে হয় তাদের। কিন্তু মানসিক অস্থিরতার শিকার রয়ম্যান্স মনে করতেন, শয়তান ভর করেছে তার বউয়ের ওপর। খুব দ্রুতই তারা আলাদা হয়ে যান। রয়ম্যান্সের জীবনীকার স্যু সমার্স জানাচ্ছেন, রয়ম্যান্স এক সময় দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা চুরি করারও পরিকল্পনা করে প্যারিসে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে, ছন্নছাড়া রয়ম্যান্সের জীবন কেটেছে পথে পথে, পার্কিং করা কিংবা বাতিল হয়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে শুয়ে থেকে। এ রকমই এক গাড়ির মধ্যে থেকে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালে উদ্ধার করা হয় মৃতপ্রায় রয়ম্যান্সকে। কারও কারও মতে, তিনি তখন আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলেন। আরও দিনদশেক পর ৫ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান তিনি। থিল ফন লিমবার্গের, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান এক সুহৃদের মৃত্যু ঘটে এমনই একাকিত্বের মধ্য দিয়ে। তিনি এখন শুয়ে আছেন তার জন্মস্থান টঙ্গারেনের নেরেম-এর পুরনো কবরস্থানে।
এমন করুণ মৃত্যুর বছর পঁচিশ পরে বেলজিয়ামে নতুন করে জেগে ওঠেন এই থিল ফন লিমবার্গ, মারিও রয়ম্যান্স। ২০০৭ সালে ‘দ্য কোয়েস্ট’ নামের একটি থিয়েটার গ্রুপ তাকে নিয়ে নাটক করে- সেই নাটকের মধ্যে দিয়ে পুরনো ইতিহাস উঠে আসে দর্শকদের কাছে। এই ইতিহাসকে সম্প্রতি দ্রষ্টব্য করে তুলেছেন এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জুটি; মারিও রয়ম্যান্সকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন সম্প্রতি। তা ছাড়া মারিও রয়ম্যান্সকে নীরবে নিভৃতে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন হোটেল সিতেওয়ের মালিকের ছেলে। জীবিত রয়ম্যান্স হয়ে উঠেছিলেন তার কাছে গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার। রয়ম্যান্সকে গ্রেফতার করার পর তিনি তার প্রাণের সমস্ত আবেগ ঢেলে হ্যাসেল্টের কুরিঞ্জেন ব্রিজের কাছে এক দেয়ালে গ্রাফিত্তি আঁকেন এবং সঙ্গে লেখেন, ‘লং লিভ থিল।’ এত বছর পরে সেই গ্রাফিত্তি কত না বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও কারও না কারও চোখ আটকে যায় সেখানে। ওই ব্রিজের পাশ দিয়ে প্রায়ই যেতেন স্যু সমার্স ও স্টিন মিউরিস। একদিন হঠাৎ করেই মনোযোগ দিয়ে গ্রাফিত্তিটি দেখতে থাকেন স্যু। ওই গ্রাফিত্তির অর্থ প্রেমিকা স্যু সমার্স জানতে চান তার প্রেমিক স্টিন মিউরিসের কাছে। মিউরিস ওই সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু আসলে তিনি একের ভেতর অনেক- গায়ক, সংগীতকার, চলচ্চিত্রকার, টিভির অনুষ্ঠান নির্মাতা। অন্যদিকে, স্যু সমার্স নিজেও কোর্ট রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন সেখানকার দৈনিক দ্য মর্নিং-এ। ১৯৭১ সালে স্টিনের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। তারপরও ঘটনাটি আবছাভাবে জানা ছিল তার। লোকশ্রুতি থেকে জানা আবছা ঘটনাটিই তিনি শোনালেন তার প্রেমিকাকে। শুনতে শুনতে, বলতে বলতে তাদের দু’জনের মধ্যেই জেগে উঠল ঘটনাটি ভালো করে জানার আগ্রহ।
তাঁদের ওই আগ্রহের ফসল, স্টিন মিউরিসের ডকুমেন্টারি ‘থিল ফন লিমবার্গ’ আর স্যু সমার্সের বই ‘মারিও’। তবে তাদেরও আগে থমাস বিয়ারটেন নামের এক ডাচ পরিচালক ওই একই নামে নির্মাণ করেছিলেন একটি শর্ট ফিল্ম। এসব সাংস্কৃতিক নির্মাণযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে মারিও রয়ম্যান্স বেলজিয়ামে এক দৃষ্টান্ত স্থানীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কেবল মনে রাখিনি আমরাই- যাদের জন্যে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ওই দায়ভার। ‘থিল ফন লিমবার্গ’-এর শেষ দৃশ্যে একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘কী তখন অথবা কী তার পরে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু কেউ একজন অন্তত চেষ্টা তো করেছে। (বাংলাদেশ ওয়াজ নট রেসকিউড, নট দেন অর ল্যাটার। বাট সামওয়ান অ্যাট লিস্ট ট্রায়েড)।’ পরিচালক মিউরিসের তির্যক এ সংলাপে পুরো সত্য নেই- কিন্তু বলা কি যায় একেবারে মিথ্যাও সে কথা?
৩·
মুক্তিযুদ্ধ এমন এক সময়, যখন মহাকালের আবেদন জেগে ওঠে এমনকি তুচ্ছ প্রাণেও। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা প্রতিভাবান। ১৯৭১-এর আগস্টেই তারা গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষদের। কিন্তু তেমন কিছু তো করার ছিল না জাঁ কুয়ে কিংবা মারিও রয়ম্যান্সের — তাঁরা তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, বিমান ছিনতাই করে, পেইন্টিং চুরি করে চেষ্টা করেছেন বিপন্ন উদ্বাস্তু মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। এমন করে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করার মধ্য দিয়ে, জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে জীবনের একটি অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন তারা। মানুষ যদি তার কোনো একটি টুকরো মুহূর্তের মধ্যেও জীবনের অর্থময়তা খুঁজে পায়, সেই অর্থময়তার মাধুর্যটুকু নিয়েই তারা বেঁচে থাকতে পারে পুনরায় নিরুদ্দিষ্ট হয়েও। জাঁ কুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সও বেঁচে ছিলেন তেমনি করে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারসংক্রান্ত কার্যক্রম নিরীক্ষণ করতে গিয়ে বছর দুয়েক আগে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের কয়েক সংগঠক যুগপৎ খুঁজে পান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই দুই সহযোদ্ধার কথা। তারপর শুরু হয় অনুসন্ধানপর্ব এবং উঠে আসতে থাকে বিস্মৃত এক পর্ব। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের পক্ষ থেকে তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে আইসিজে’র বিতর্কিত ভূমিকা তুলে ধরার পাশাপাশি দাবিও জানানো হয়, আমাদের ঋণে আবদ্ধ করে ফেলা বিদেশি সহমর্মীদের স্বীকৃতি দেয়ার। আমরাও অনুরোধ করব, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি দেয়ার, যাদের মধ্যে, লেখাই বাহুল্য, থাকবেন জাঁ ক্যুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সও; চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রতিও অনুর]ধ রইল এ সংক্রান্ত যেসব ডকুফিল্ম নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার; ফরাসি ও ডাচ ভাষায় সুশিক্ষিত বাংলাভাষীদের প্রতি অনুরোধ থাকল, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বই ও নিবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করার- যাতে তাদের সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানতে পারি আমরা।
আর আরও দুটি কাজ আমরা সম্মিলিতভাবে করতে পারি। এক· সোচ্চার হয়ে উঠতে পারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, বিচারের সহায়ক বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। দুই· পাশে দাঁড়াতে পারি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের- যাদের অনেকে হয়তো নিঃসঙ্গ, অনেকে হয়তো দরিদ্র। তাদের জন্যে নির্মাণ করতে পারি সামাজিক সৌহার্দ্যের বলয়, নিরাপত্তার বলয়। কেবল এরকম কাজগুলো করার মধ্য দিয়েই আমরা হয়তো খানিকটা মুক্ত হতে পারি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জাঁ কুয়ে, মারিও রয়ম্যান্সদের মতো সহযোদ্ধাদের মনে না রাখার গ্লানি থেকে।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এম এম আর জালাল, রায়হান রশিদ, রেজাউল করিম সুমন, অমি রহমান পিয়াল, কাউসার রুশো।)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৩ comments
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ (২:৩৭ অপরাহ্ণ)
শামীম ভাই, অসাধারন এই লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। জাঁ কুয়ে আর মারিও রয়ম্যান্সের কথা পড়তে পড়তে চোখ প্রায় ভিজে যাচ্ছিল। আমরা এমন এক সময়ে এসেছি, যেখানে কেবল নিজেদের জাতি ও গৌরব গাঁথা নিয়ে ব্যস্ত। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ব্যাক্তি মানুষ পর্যন্ত সবাই কেবল ১৯৭১ সালে কি করেছি কি করিনি তার হিসেব নিয়ে ঝগড়া করি। এমনকি তরুন প্রজন্ম ও বাংলিঙ্কের জাগরনের গান গেয়ে হাল্কা রক স্টাইল এ দেশপ্রেমিক ভাবতে চায়। কিন্তু আমাদের জন্য যে মানুষগুলো অনুভব করলো, তাদের প্রতি আমরা কি সম্মান প্রদর্শন করলাম ? ডিলান বা জর্জ হ্যারিসনের টিশার্ট গায়ে আমরা তাদের খুব শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেলেছি ? আসলে আমাদের কারা বন্ধু ছিল, তারা কেমন ছিল, কোথায় কিভাবে তারা আমাদের জন্য বুকের গভীরে তীব্র কষ্ট অনুভব করেছিল- তা দেশবাসীকে জানাবার সময় এসেছে। আমি সেই চেষ্টা করব, তাদের উপর নির্মিত প্রামাণ্য দলিলাদি সংগ্রহ করার। আবারো ধন্যবাদ আপনাকে এবং আপনাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের, অসাধারন এই পোস্টটির জন্য।
ইমতিয়ার - ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ (৩:৫৩ অপরাহ্ণ)
# রফিকুল আনোয়ার রাসেল
এটি জেনে ভালো লাগছে যে, আপনি লক্ষ্য করেছেন এ লেখা মূলত একটি যুক্ত প্রচেষ্টার ফসল এবং আমরা চাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের তাদের প্রাপ্য সম্মানের স্থানে স্থাপন করতে, চাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাদেরও মনে রাখতে।
আপনিও আমাদের এই প্রয়াসে যুক্ত হচ্ছেন জেনে ভালো লাগছে। যত দূরত্বেই থাকি না কেন, আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ…
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (৭:২৬ পূর্বাহ্ণ)
চমৎকার_ খুবই ভালো লাগল।
মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১০:৪১ পূর্বাহ্ণ)
এই পত্রিকায় নামটা যেভাবে লেখা আছে Jean Kay তাতে তার নামের উচ্চারণটা হওয়া উচিত ‘জঁ ক্যাই’ বা ‘জঁ কাই’ কিন্তু ‘কুয়ে’ বা ‘ক্যুয়ে’ কেন লেখা হচ্ছে। অজ্ঞতাবশত হলে এখন ঠিক করে নিলেই চলবে, কিন্তু আমি ভাবছি এই পত্রিকায় রোমান হরফে তার নাম যেভাবে লেখা আছে সেটা ঠিক আছে তো? মানে আমাদের সব খোঁজখবর তো ওই নাম দিয়েই চালাতে হবে, তাই ওই রোমান হরফে লেখা নামটা ঠিক আছে কিনা আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১১:১৪ পূর্বাহ্ণ)
রোমান হরফে নামটা ঠিকই আছে মনে হচ্ছে, কারণ Jean Kay (Jean-Eugène-Paul Kay তার পুরো নামটা বেশ বড়, জঁ-উজেন-পোল ক্যাই/কাই) সার্চ দিয়ে ফ্রেঞ্চ উইকিপিডিয়ায় এই ভুক্তি পাওয়া গেল এবং সেখানে তার এই মহৎ বিমান ছিনতাইয়ের কথা সংক্ষেপে লেখা আছে। তাহলে আমাদের এখন ‘কুয়ে’ বা ‘ক্যুয়ে’ বর্জন করে তার নাম লেখা উচিত ‘জঁ ক্যাই’ বা ‘জঁ কাই’: দুটিই ঠিক কিন্তু আমার পক্ষপাত দ্বিতীয়টি মানে ‘জঁ কাই’-এর প্রতি।
মাসুদ করিম - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১:৪৯ অপরাহ্ণ)
@ ইমতিয়ার শামীম
আমার মতে নামটি ‘জঁ কাই’ এভাবে সম্পাদনা করা হোক। অবশ্য আমাদের বেশির ভাগ পাঠক Jeanকে ‘জাঁ’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, সেক্ষেত্রে ‘জাঁ কাই’ও লেখা যেতে পারে। তবে ‘Kay’এর ক্ষেত্রে ফরাসি উচ্চারণভেদে ‘ক্যাই’ ও ‘কাই’ দুটি ফরাসিরা উচ্চারণ করে — এখন Jean Kayকে প্রচলিতভাবে তার পড়শি ও পরিচিতরা ঠিক ‘ক্যাই’ বা ‘কাই’ কোন উচ্চারণে ডাকত তা আর সম্ভবত জানা সম্ভব নয়। তাই আমার পক্ষপাত গৃহীত হলে ‘কাই’ ব্যবহার করার দিকেই মত দেব।
ইমতিয়ার - ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:১৯ অপরাহ্ণ)
আপনি ঠিকই বলেছেন, মাসুদ করিম। নামের উচ্চারণ নিয়ে আমি একদম নিশ্চিত নই, বলতে পারেন অজ্ঞই-তবে সঠিক উচ্চারণেই সেটি লেখা উচিত। এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে নামটি সম্পাদনা করে দেয়া যেতে পারে।
# কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
ধন্যবাদ, জাহাঙ্গীর ভাই। আপনার ভালো লাগা বরাবরই প্রেরণাদায়ক।
মাসুদ করিম - ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ (১২:০৭ পূর্বাহ্ণ)
একটি বই খুঁজছিলাম, কারণ ভাবছিলাম ওই বইতে ওই বিমান ছিনতাইয়ের প্রসঙ্গ থাকতে পারে, বইটি অঁদ্রে মালরোকে নিয়ে, লিখেছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — আজ বইটি পেলাম চট্টগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লাইব্রেরিতে — বইটির নাম ‘অঁদ্রে মালরো : শতাব্দীর কিংবদন্তী’ প্রকাশক অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা এবং প্রকাশকাল ১৯৮৬। খুঁজতে খুঁজতে বইয়ের ৮৪ নম্বর পৃষ্টায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে ওই বিমান ছিনতাইয়ের কথা একটি ভুল তথ্যসহ পাওয়া গেল।
তথ্যের ভুলটি কার, মালরোর স্মৃতি ভুল করেছে না কোরেশী ভুল লিখেছেন, আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি এরকম একটি প্রসঙ্গ মাহমুদ শাহ কোরেশী এইভাবে সাদামাটা ভাষায় কয়েক শব্দে শেষ করলেন? মালরো বাংলাদশে এসেছিলেন ২১ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে, তার বাংলাদেশে অবস্থানকালে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — মালরো বাংলাদেশ ভ্রমণকালে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে যে ৩/৪ দিন কাটিয়েছিলেন সে কয়েকদিন তিনটি শহরে তার সব সফরসূচিতে দোভাষী ছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশী — তিনি কোনোভাবেই এই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে তেমন বড় করে দেখেননি বলেই মনে হয়। তাছাড়া মাহমুদ শাহ কোরেশীর সাথে এই দোভাষীতার সূত্রে ১৯৭৬ সালে মালরোর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার চিঠিতে যোগাযোগ ছিল — এবং জঁ কাইকে সমর্থন করে আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার কথাও তিনি পরবর্তীতে চিঠি বা পত্রিকা মারফত জানতে পারেন — কারণ এই সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল মালরোর বাংলাদেশ সফরের আরো কয়েকমাস পরে ১৯৭৩-এর অক্টোবরে।
মনে হচ্ছে মাহমুদ শাহ কোরেশী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জঁ কাইয়ের এই বীরত্বপূর্ণ অবদানকে তেমন একটা গুরুত্ব একবারেই দেননি। অথচ ইতিহাসের এই অনালোচিত ঘটনার তথ্য পাওয়ার কী সুযোগটাই না তিনি পেয়েছিলেন। মাহমুদ শাহ কোরেশীর সাক্ষাৎকারে ও লেখায় বহুবার গর্বভরে উল্লেখ দেখেছি ১৯৭১ সালে তিনি বৈরুতে মোল্লা জালালের (ইনি কে সে উল্লেখ স্পষ্ট পাইনি, কিন্তু মনে হয় মোল্লা জালাল তখনকার লেবাননে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত ছিলেন) সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের দেশের কত বুদ্ধিজীবী এভাবে মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ পেয়ে সব ভুলে বড় বড় সম্মাননার পেছনে ছুটেছেন?
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৭ ডিসেম্বর ২০১১ (৩:৫৬ পূর্বাহ্ণ)
মানুষ যদি তার কোনো একটি টুকরো মুহূর্তের মধ্যেও জীবনের অর্থময়তা খুঁজে পায়, সেই অর্থময়তার মাধুর্যটুকু নিয়েই তারা বেঁচে থাকতে পারে পুনরায় নিরুদ্দিষ্ট হয়েও…ইমতিয়ারভাই, এমন অসাধারণ লেখার জন্যে আন্তরিক অভিনন্দন। পড়তে পড়তে কেঁদেই ফেললাম। আমরা কী অভাগা দেশ, শত্রু চিনি না, মিত্র চিনি না, শুভার্থী চিনিনা, শুভৈষীর নাম অব্দি জানি না।
মাসুদ করিম - ২ জানুয়ারি ২০১২ (১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
jean kay ও mario roymans এর পর আরেক দুঃসাহসী সীমান্তবিহীন মুক্তিযোদ্ধারা Taylor and a group of american protesters।
লিন্ক : American Activists and the Birth of Bangladesh।
রায়হান রশিদ - ২৩ মার্চ ২০১২ (৩:৪৪ অপরাহ্ণ)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে পাঁচ কিশোরের বিমান ছিনতাই পরিকল্পনা। এখানে।
ইমতিয়ার শামীম - ২ জানুয়ারি ২০১৬ (৪:০৫ অপরাহ্ণ)
জাঁ কাই সম্পর্কে আরো কিছু বিষয় জানা গেল আজ প্রথম আলো থেকে।
এতে লেখা হয়েছে :
এ এক অনন্য অবদান।
মাসুদ করিম - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ)