ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীতে, ১৯৫৩ সালে, শান্তিনিকেতনে দুই বাংলার সাহিত্যিকদের নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল সাহিত্যমেলা। কয়েকদিন-ব্যাপী ওই সাহিত্যমেলা আয়োজনের মধ্য দিয়েই প্রথম একুশে উদ্‌যাপিত হয়েছিল। প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি সহ তারই সানুপুঙ্খ বিবরণ।

নরেশ গুহ-র তাতার ঘেরা সমুদ্র (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থের ‘ফাল্গুন ১৩৫৯’ নামের কবিতাটি পড়ছিলাম। তার এক জায়গায় কবি লিখেছেন : কেমন, বলিনি? দ্যাখো, বসন্ত ফোটায় গাছে ফুল। (ধন্যবাদ গৌরী দত্ত, শ্রীনিমাই চট্টোপাধ্যায়।) তিপ্পান্ন সালেও আজো ফাল্গুন কী রঙ্গ দেখায় বিশ্বাস হ’তো না যদি না-দেখতুম জ্বলন্ত শিমুল বীরভূমে অজয়তীরে (সাক্ষী থাকে অম্লানকুসুম; -- সাক্ষী থাকে আরো এক অধ্যাপক, মাথাজোড়া টাক, সারা রাস্তা ভদ্রলোক, বাপরে বাপ, কী বকবকুম! কিন্তু এবে পরচর্চা থাক।) ৩ তাহলে ফাল্গুনে দেখছি – আরে, তাই তো, সত্যি যে পলাশ! এতো লাল? ওই কি রঙ্গন? পৌঁছলাম শান্তিনিকেতন। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে ১৯৫৩ সালের বসন্তে শান্তিনিকেতনে সাহিত্যমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। আর তার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্বভারতীর দুই শিক্ষার্থী -- নিমাই চট্টোপাধ্যায় আর গৌরী দত্ত; আবু সয়ীদ আইয়ুবের সহধর্মিণী হবার সুবাদে পরবর্তীকালে যিনি গৌরী আইয়ুব নামে পরিচিত হয়েছিলেন। বছর কয়েক আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন; তবে যতদূর জানি নিমাই চট্টোপাধ্যায় এখনো বেঁচে আছেন। কয়েকদিন-ব্যাপী সেই সাহিত্যমেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে যে প্রথমবারের মতো একুশে উদ্‌যাপিত হয়েছিল তা হয়তো সবার জানা নেই। বোলপুর থেকে প্রকাশিত 'পাক্ষিক ১৪০০ সাহিত্য' পত্রিকার '২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যা'য় (বৈশাখ ১৪০৬) ছাপা হয়েছিল নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার (১৫ মার্চ ১৯৯৯)। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-র ইতিহাস আজ দুনিয়ার কোনো বাঙালির কাছেই অজানা নেই। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্যে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের আমরা প্রতি বছরই ওই তারিখে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু যে-কথাটা আজ প্রায় কেউই মনে রাখেনি সেটা হল কি পরের বছর ১৯৫৩-র একুশে ফেব্রুয়ারি সেই ঘটনার প্রথম স্মরণ বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই শান্তিনিকেতনে; এমনকি শান্তিনিকেতনের বর্তমান কর্তৃপক্ষও সে-কথা জানেন না [...]। ১৯৫৩-র একুশে ফেব্রুয়ারি অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে গৌরী দত্ত ও আমি শান্তিকিকেতনে যে সাহিত্যমেলার আয়োজন করি সেটাই ছিল বিভাগোত্তর দুই বাংলার সাহিত্যিক সমাজের সর্বপ্রথম মিলনোৎসব; সেই অনুষ্ঠানেই, শান্তিনিকেতনের সংগীতভবন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজী মোতাহার হোসেন প্রথম বলেছিলেন : "আমাদের মুখের ভাষা যদি ওরা কেড়ে নেয় আমরা তাহলে পাকিস্তান ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করব না।" তার বেশ কয়েক বছর পরে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়, এবং একুশে ফেব্রুয়ারি অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জির…

দীর্ঘদিন পর, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নির্মাণ-এর পঞ্চম সংখ্যা। নির্মাণ ওয়েবজিন-এর সাইটটি চালু হলে ১৯৯৫ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে প্রকাশিত পাঁচটি সংখ্যাই আর্কাইভে তুলে দেয়া হবে। আপাতত এবারের সংখ্যার সম্পাদকীয়টি মুক্তাঙ্গন-এ তুলে দেয়া হলো। এ সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন মনসুর উল করিম, উৎসর্গপত্রে ব্যবহৃত সিদ্ধেশ্বর সেনের প্রতিকৃতি এঁকেছেন গৌতম পাল। সংখ্যাটি পড়ার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। nirman-coverpsd

দীর্ঘদিন পর, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নির্মাণ-এর পঞ্চম সংখ্যা। নির্মাণ ওয়েবজিন-এর সাইটটি চালু হলে ১৯৯৫ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে প্রকাশিত পাঁচটি সংখ্যাই আর্কাইভে তুলে দেয়া হবে। আপাতত এবারের সংখ্যার সম্পাদকীয়টি মুক্তাঙ্গন-এ তুলে দেয়া হলো। এ সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন মনসুর উল করিম, উৎসর্গপত্রে ব্যবহৃত সিদ্ধেশ্বর সেনের প্রতিকৃতি এঁকেছেন গৌতম পাল। সংখ্যাটি পড়ার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। . . . স ম্পা দ কী য় কয়েক মাস আগে সুযোগ হয়েছিল মোহাম্মদ রফিকের অনেকগুলি নতুন কবিতা একসঙ্গে পড়ার। পড়ার নয় কেবল, শোনারও। শুধু কবিতা নিয়ে একটি ছোট সংখ্যা করার কথা তখনই প্রথম ভেবেছিলাম। তারপর থেকে তাঁর প্রতিটি সদ্য-লেখা কবিতাই দূরভাষে শোনার বা পত্রযোগে পড়ার এক দুর্লভ সুযোগ তৈরি হয়ে গেল। সংখ্যাটির পরিকল্পনা আরো একটু পাকা হবার পর যোগাযোগ করা গেল শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে। প্রায় একযুগ আগে নির্মাণ-এর তৃতীয় সংখ্যার জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমরা। এবারে তাঁর সাম্প্রতিক কয়েকটি ও সেই সঙ্গে অগ্রন্থিত আরো কয়েকটি কবিতা পাওয়া গেল! শেষের গুচ্ছটি পেয়েছি সুতপা ভট্টাচার্যের সংগ্রহ থেকে; সঙ্গে রইল তাঁরই লেখা একটি ছোট্ট ভূমিকা। আমাদের জন্য সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি নিয়ে একটি প্রবন্ধও তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। শঙ্খ ঘোষের লেখা বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে গাঢ় শঙ্খের খোঁজে বইতে। আর মোহাম্মদ রফিকের নোনাঝাউ নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লিখেছেন সনৎকুমার সাহা। এ চারজনের লেখা নিয়েই, পূর্বঘোষিত অনুবাদ সংখ্যা ও ননী ভৌমিক সংখ্যার আগেই, প্রকাশিত হচ্ছে নির্মাণ-এর এবারের সংখ্যাটি। এবারের নির্মাণ আমাদের অন্যতম প্রিয় কবি সিদ্ধেশ্বর সেনের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত হলো। এ পত্রিকার একটি সংখ্যা তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁকে উৎসর্গ করার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেল। ঠিক তিন বছর আগে কলকাতা বইমেলায় প্রতিক্ষণ-এর স্টলে তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি এবং পরে তাঁর বেচুলাল রোডের সরকারি আবাসনে বেশ কিছুটা সময় কাটানোর স্মৃতি আজ বারে বারে মনে পড়ছে। ননী ভৌমিক সংখ্যার জন্য তাঁর যে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তার পুরোটা ধারকযন্ত্রে ধরে রাখা যায়নি। কলকাতায় গিয়ে সে-সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ করে নেওয়ারও সুযোগ রইল না আর। সিদ্ধেশ্বর সেন তাঁর বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘আমার মা-কে’ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে বর্ণনা করেছিলেন কবিতাটির বিস্তৃত পটভূমি। তাঁর সেই মন্থর মন্দ্রিত কণ্ঠস্বর আজও কানে বাজে। আর মনে পড়ে…

এই বিশ্লেষণমূলক তথ্যবহুল পোস্টটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা, নুরেমবার্গ ট্রায়াল, টোকিও ট্রায়াল, আইকম্যানের বিচার, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মিলোসেভিচের যুদ্ধাপরাধের বিচার, রুয়ান্ডা ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সে সবের আলোকে বর্তমানের আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আনুষঙ্গিক পূর্ব ইতিহাস এবং বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটের মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে এই লেখাটিতে।

ভূমিকা একাত্তর সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকেরা একটি অন্যায় যুদ্ধ এ ভূখন্ডের বাঙ্গালীদের ওপর চাপিয়ে দেন। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করে তা ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে সমগ্র ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙ্গাঁলী জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য হানাদার বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ সমগ্র বাংলাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। সেনাবাহিনীর সকল কর্মকান্ডে, যা কিনা ছিল মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ, জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের মত কর্মকান্ডে সমর্থন দিয়েই তারা বসে থাকেনি, মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে জামাতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আলশামস ইত্যাদি বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এসব সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে পাকিস্তানের সেনা সদস্যদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঙ্গাঁলী জনগোষ্ঠীর ওপর যে হিংস্রতা ও বর্বরতা করেছে সেটি ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে পাক সেনাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গঁবন্ধু সরকার এব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিলেও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, কুটনৈতিক চাপ ও সর্বোপরি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গাঁলীদের কথা চিন্তা করে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের বিচার সম্ভব হয়নি। তবুও যে ১৯৫ জন সেনা সদস্যকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের বিচার করে শাস্তি দেয়া গেলে সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি প্রতীকী আবেদন তৈরি করত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গঁনে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে আরও একটি উত্তম দৃষ্টান্ত হত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭২ সালের ২৯ আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ-এ তিনটি সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে এ আদেশের অধীনে ৩৭ হাজার ৪ শ ৯১ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গঁবন্ধু সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। যেসকল মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার…

সাহিত্যে স্বাধীন দেশের আবাহন আমরা শুনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরে সেই আবাহন আর কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে বাঙালির কথাসাহিত্যও সুস্পষ্ট এক আদল পেয়েছিল। তার আগেও গদ্য ছিল, কিন্তু সেই গদ্যে ছিল না বাঙালির সামাজিক-অসামাজিক জীবনের স্বাদ ও গড়ন ছিল না নিরীক্ষণ ছিল না যাকে এখন বলি ‘বিটুয়িন দ্য লাইনস সেসবের অস্তিত্ব। বঙ্কিম হয়ে উঠেছিলেন একইসঙ্গে আমাদের কথাসাহিত্যের জনক ও আত্মজ। তবে কেবল কথাসাহিত্যেরই আদল দেন নি তিনি, তৈরি করেছিলেন সাহিত্যে মৌলবাদের গড়ন; যদিও কথাটা শুনতে খুবই লাগে, কেবল কানে নয়, কান ছাড়িয়ে হৃদয়েরও মধ্যে। সাহিত্য তো শুধু বাস্তবতা নয়, সাহিত্য বাস্তবতাকে আত্মস্থ করে, অতিক্রমও করে। আত্তীকরণ ও অতিক্রমণের মধ্যে দিয়েই সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিম তাঁর আশেপাশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি। আত্মস্থ করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেন নি হজম করে ফেলতে এবং প্রচণ্ড বিবমিষায় উগড়ে ফেলেছেন ভেতর থেকে। উল্টেপাল্টে ফেরত আসা সাম্প্রদায়িক বাস্তবতার সে গন্ধ তাই ভয়াবহ উৎকট। সাম্প্রদায়িকতাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি অনতিক্রান্ত এক বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছেন এবং সম্প্রদায়কেই মনে করেছেন মুক্তির কাণ্ডারী। এসব কথা মানতে কষ্ট হয়, বিশেষত সেই বঙ্কিমের কথা মনে হলে,- যে-বঙ্কিমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ’। এত যে সুকৃতি তাঁর, সাম্প্রদায়িকতা সেসবের মধ্যে একেবারেই বিসদৃশ, চৌবাচ্চাভর্তি খাঁটি দুধে একফোঁটা প্রস্রাব পড়ার মতো। মাত্র একটি ফোঁটা, কিন্তু স্বাদ ও পবিত্রতা নষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট ওইটুকুই। অনেকে দুর্বোধ্যতাকে হালআমলের গদ্যের প্রধান দুর্বলতা বলেন; কিন্তু বঙ্কিম পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা অনুভব করতে পারি, দুর্বোধ্যতা নয়- যুগে যুগে কথাসাহিত্যের প্রধান সংকট হলো গতিহীনতা। এই গতিহীনতা লেখকের ভাষাকে মৃত করে তোলে। কিন্তু গতিময়তা ছিল বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাক্যগঠন ও শব্দব্যবহার অত দুর্বোধ্য হওয়ার পরও শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে একেবারে মুদির দোকানদার পর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আহমদ শরীফ অবশ্য আমৃত্য দাবি করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও জাতীয়তাবাদী। বলেছেন, দেশকে প্রথম মাতৃরূপে জেনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিই প্রথম তাত্ত্বিক অর্থে একটি ভৌগলিক স্বদেশ ও স্বজাতির অনুসন্ধানে নামেন। সুবা-ই-বাঙ্গলা বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে স্বদেশ হিসেবে মূর্ত করে তোলেন তাঁর লেখায়। এর অধিবাসীদেরও তিনি তাঁর স্বজাতির করে নেন। এ অঞ্চলের জনতার জন্যে বাঙালি অভিধা তিনিই ফিরিয়ে আনেন এবং তাঁর সেই বাঙালি কেবল…

সাহিত্যে ছড়ার অবদান কী, বা এর অবস্থান কোথায় ? এ রকম বালখিল্য প্রশ্ন শুনে আঁতেল ব্যক্তিরা হয়তো এক চিমটি মুচকি হাসি দুলিয়ে চলে যাবেন প্রসঙ্গান্তরে। আর আমার মতো মোটাবুদ্ধির লোকেরা ? হয়তো চেয়ে থাকবেন হতভম্ব হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন, হাজার বছরের শ্রুতি-পরিক্রমায় এসেও সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন আর মাটিবর্তী লোকায়ত এ মাধ্যমটিকে নিয়ে এরকম প্রশ্নের সংযোগ সূত্রটি কোথায় লুক্কায়িত ? [...]

সাহিত্যে ছড়ার অবদান কী, বা এর অবস্থান কোথায় ? এ রকম বালখিল্য প্রশ্ন শুনে আঁতেল ব্যক্তিরা হয়তো এক চিমটি মুচকি হাসি দুলিয়ে চলে যাবেন প্রসঙ্গান্তরে। আর আমার মতো মোটাবুদ্ধির লোকেরা ? হয়তো চেয়ে থাকবেন হতভম্ব হয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন, হাজার বছরের শ্রুতি-পরিক্রমায় এসেও সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন আর মাটিবর্তী লোকায়ত এ মাধ্যমটিকে নিয়ে এরকম প্রশ্নের সংযোগ সূত্রটি কোথায় লুক্কায়িত ? মাটিলগ্ন গণমানুষের জনভাষ্যের প্রতীকী বিন্যাসে উপস্থাপিত জ্যান্ত ছড়াকে নিয়ে এরকম ধোয়াশা সাহিত্যের কুলীন অঙ্গনে যতোই অস্পষ্টতা ছড়াক না কেন, ব্রাত্যজনের প্রাণের সম্পদ টিকে থাকার চাবিকাঠিটা যে ব্রাত্যজনগোষ্ঠীর হাতেই চিরকাল থেকে যায়, এটা আমরা অনেকেই ভুলে যাই। কিন্তু মহাকাল ভুলে না ঠিকই। আর ভুলে না বলেই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে মেনে নিতেই হয় যে, সাহিত্যের পালকিটাকে সম্মুখবর্তী হতে হলে ওই ব্রাত্যজনের কাঁধে চড়েই এগুতে হয় তাকে। কাসুন্দি ছড়া সাহিত্যের সম্প্রতি প্রকাশিত দু’পাতার একটা প্রকাশনা ‘নিব’ ওল্টেপাল্টে দেখছিলাম। এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেলো। চার লাইনের ছোট্ট একটা ছড়া। ‘ভাতের বদলে আলু / বাবার বদলে খালু / এর চেয়ে তো ভালোই ছিলো / তারেক জিয়া, ফালু।’ একবার পড়েই গেঁথে গেলো মনে। ছড়াটা ছোট্ট, কিন্তু এর ইফেক্টটা কি ছোট্ট রইলো ? মাথার ভেতরে ঢুকে রিনিরিনি বাজাতে লাগলো। দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় আমাদের বহুমাত্রিক নিষ্পেষণের চিত্রগুলোর একটা লিঙ্ক কী চমৎকার ইঙ্গিতময় দক্ষতায় জুড়ে দেয়া হলো ! যেগুলো আনন্দচিত্র নয়, কষ্টচিত্র। ভুক্তভোগী মানুষের বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টক্ষত। সামান্য ক’টা অক্ষরের যাদুতে ছবির পর ছবি হয়ে যেন ভেসে ওঠতে লাগলো। কৌতুহলী হয়ে মনে করতে চেষ্টা করলাম, মুহিববুল্লাহ জামী নামের এই লেখক বা ছড়াকারের অন্য কোন লেখা আগে পড়েছি কি না। মনে করতে পারলাম না। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই ছড়াকারের নাম আগে কোথাও শুনেছি বলেও মনে হলো না। হতে পারে আমার সীমাবদ্ধতা এটা। কিন্তু বিষয়টা উত্থাপিত হলো ক’দিন যাবৎ সাহিত্যে ছড়ার অবস্থান বা অবদান নিয়ে ভাবনার সূত্র ধরে। বিকেলের এক চায়ের আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমেই ছড়াটা আউড়ালাম আবার। এবং উপস্থিত যারা ছিলো, লুফে নিলো সবাই ! যদিও এরা সাহিত্য জগতের কেউ নন বা সাহিত্য রসিকও বলা যাবে না, তবু ছড়াটার প্রতি তাদের আগ্রহে একটুও কমতি দেখলাম…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.