আমার ধারণা, আজকের কবিতার সমাজ বিচ্ছিন্নতার (এখানে কি লেখক-পাঠকের সম্পর্কের কথা উঠছে) মূল খুঁজতে গেলে তা খুঁড়তে হয় আরও গভীরে – এই শ্রেণীসমাজে ব্যক্তির বিযুক্তিবোধে; আর, এ মুহূর্তে দায়ী করা হোক, উদাহরণত, এক ফাটকাবিলাসী ‘সাহিত্যের’ বাজার হাটের নিয়মের অমানুষিক অমানবিকতাকেই, – কারণ লেখক পাঠকের যোগ তো হওয়া উচিত মানবিক মূল্যবোধে। তা যদি উপার্জিত না হয়, লেখকদের অক্ষমতায় বা দায়িত্বহীনতায় বা দণ্ডমুণ্ডধারী বণিকদেবতাটির পায়ে করুণ আত্মসমর্পণে, কিংবা অপর পক্ষে, পাঠককুলের সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যের অভাবে – তবে তো উভয়তই ভরাডুবি হ’তে বসেছে। শিল্পীর সততাই, আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে তার একমাত্র রক্ষাকবচ হ’তে পারে। অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘কবিতা-পরিচয়’ পত্রিকার দ্বাদশ সংকলনে (বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৭) ছাপা হয়েছিল বাংলাভাষার ২০ জন প্রতিনিধিস্থানীয় কবির কবিতা-বিষয়ক পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর। ‘কবিতাভাবনা’ নামের গদ্যরচনাটি – যার অংশবিশেষ আমরা উদ্ধৃত করেছি উপরে – লেখা হয়েছিল ওই প্রশ্নমালারই উত্তর হিসেবে। হ্যাঁ, এই কবিতাভাবনা সিদ্ধেশ্বর সেনের, বাংলাভাষার প্রধান এক কবির। ২ সিদ্ধেশ্বর সেনের চার-পর্বে-বিন্যস্ত দীর্ঘ কবিতা ‘আমার মা-কে’ বেরিয়েছিল অনিলকুমার সিংহ সম্পাদিত ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার প্রথম (বৈশাখ) সংখ্যায়, ১৯৫০ সালে। চারটি পর্বেরই শুরুতে ছিল পাবলো নেরুদার কবিতার উদ্ধৃতি। এই কবিতাটির জন্য – সারা জীবনে কেবল এই একটিমাত্র কবিতা লিখলেও – বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি চিরস্থায়ী আসন পেতে পারতেন। এই কবিতা রচনার সূচনা ১৯৪৯-এর শেষদিকে, কবির নিজের ভাষায়, ‘আটকাধীনের একাকিত্বে’ : ... ঐ সময়ে, একদিন প্রগতি লেখক সংঘের ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রীটের দপ্তর থেকে আমরা কয়েকজন হঠাৎ গ্রেপ্তার হই। আমাকে ও গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নিরঞ্জন সেনকে লকআপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনেই বাড়িতে দেখে এসেছি, ছোট বোনটি খুবই অসুস্থ এবং মা অসম্ভব ভেঙে পড়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তাই মা ও বোনের এই দুঃসহ অবস্থা এবং সে-সময়ে আমি যে তাঁদের পাশে থাকতে পারছি না – এমন এক অসহায়তা আমাকে গ্রাস করছিল। শেষে, রাত্তিরের দিকে, হঠাৎই এক তীব্র টানে, ভাঙা একটা চায়ের ভাঁড়ের টুকরো নিয়ে, আমি লকআপের মেঝেতেই এই কয়েকটি লাইন লিখে ফেলি : ‘মা, তোমার কান্নার মাঝরাতে আমি সান্ত্বনা মা, তোমার আকণ্ঠ তৃষ্ণায় আমি জল মা আমার ...’ এর কিছুদিন পরে, জামিন পেয়ে বাড়িতে এসে দেখি, আমার একমাত্র বোনটি শেষ শয্যায়। মায়ের অবস্থা চোখে দেখা…
"একুশে এপ্রিল রাত এগারোটায় ফোন করে জানালেন একজন : অল্প আগে চলে গেছেন সিদ্ধেশ্বর সেন। সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রথম যৌবন থেকে অবিরতই কবিতা লিখেছেন যিনি, কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে যাবার পরও যিনি তাঁর নিজের পছন্দমতো কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে উঠতে পারেননি; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রবীণ কবির অগোচরেই যাঁর দু-চারজন অনুজ সুহৃদ প্রকাশ করে দিয়েছেন তাঁর বই; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, যিনি অনেক অনুনয় করে মধ্যরাতে প্রেসের দরজা খুলিয়েছেন কবিতার একটা-কোনো কমা ঠিক করে দেবার জন্য ... ।" -- শঙ্খ ঘোষ