অরাজক অন্ধকারে আলোর ইশারা

রাজপথে স্তূপীকৃত গ্রন্থাবলী দিয়ে / সাজায়ে নারকী চিতা / সভ্যতার শবদাহ করে, ধ্বংস করে বিদ্যালয়, বিদ্যার্থীর / . . . কবি যারা শিল্পী যারা / জ্ঞানী যারা, অরাজক অন্ধকারে একমাত্র / আলোর ইশারা, / অত্যাচারে অপমানে নির্বাসনে / রক্তচক্ষু শাসনে ত্রাসনে / তাদের বিনাশ এর পৈশাচিক ব্রত।যদি বলি বুদ্ধদেব বসু এই কবিতার কবি, বিশ্বাস হয় কি খুব সহজে? কিন্তু এর নাম মৃত্যু... আর মৃত্যু কী ভীষণভাবে মানুষকে পাল্টে ফেলে, বদলে দেয় তার অনুভবের ভাষা, ভাষার প্রকাশ! তারই সামান্য আঁচ পাওয়া যায় এ কবিতার ভেতর দিয়ে। বুদ্ধদেব বসুর মতো রাজনীতিনিস্পৃহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবিও কবিতা নির্মাণে এরকম বিকল্প বাকপ্রতিমা বেছে নেন সোমেন চন্দের নির্মম মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে [...]

রাজপথে স্তূপীকৃত গ্রন্থাবলী দিয়ে
সাজায়ে নারকী চিতা
সভ্যতার শবদাহ করে,
ধ্বংস করে বিদ্যালয়, বিদ্যার্থীর
রক্তে করে ম্লান।
যারা প্রাতঃস্মরণীয়, যারা মহাপ্রাণ
কবি যারা শিল্পী যারা
জ্ঞানী যারা,
অরাজক অন্ধকারে একমাত্র
আলোর ইশারা,
অত্যাচারে অপমানে নির্বাসনে
রক্তচক্ষু শাসনে ত্রাসনে
তাদের বিনাশ এর পৈশাচিক ব্রত।
……… …….. ………
পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে
আজ হোক উদ্দীপিত
আমার কবিতা।

যদি বলি বুদ্ধদেব বসু এই কবিতার কবি, বিশ্বাস হয় কি খুব সহজে? কিন্তু এর নাম মৃত্যু… আর মৃত্যু কী ভীষণভাবে মানুষকে পাল্টে ফেলে, বদলে দেয় তার অনুভবের ভাষা, ভাষার প্রকাশ! তারই সামান্য আঁচ পাওয়া যায় এ কবিতার ভেতর দিয়ে। বুদ্ধদেব বসুর মতো রাজনীতিনিস্পৃহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবিও কবিতা নির্মাণে এরকম বিকল্প বাকপ্রতিমা বেছে নেন সোমেন চন্দের নির্মম মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে। সেটি পড়তে-পড়তে এতকাল বাদেও আমরা বুঝতে পারি সোমেনের মৃত্যুতে উপচানো ক্রোধ, শোক, দ্রোহ ও দাহ। যদিও সে-সময়কে গ্রাস করেছিল রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতা, রাজনৈতিক মৃত্যুও ছিল আপাত লক্ষ্যহীন, তবুও সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর অভিন্ন এক শোক, ক্রন্দন, ক্রোধ ও আকাঙক্ষায় একত্র হয়েছিলেন ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মী।

১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ কি তেমন দীর্ঘ সময়? জন্মমৃত্যুর এই সামান্যতর ঘোরের মধ্যেই তিনি কী রাজনীতিতে, কী সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলেন তাঁর একাগ্রতা দিয়ে। এই একাগ্রতার সঙ্গে কমিটমেন্টের দূরত্ব কতখানি তা মাপতে চুলচেরাবিদরা ব্যস্ত থাকুন; আমরা যা বলব তা হলো, কমিটমেন্ট হোক আর একাগ্রতাই হোক, সেটা তাঁর এই হ্রস্ব জীবনকেও এত দীপ্তিময় করে রেখেছে যেমনটি অনেকে তাঁদের অনেক দীর্ঘ জীবনেও করতে পারেন না। সোমেনের মৃত্যু এখনও কমিউনিস্ট আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তৎকালীন আত্মঘাতী সরলীকৃত রণকৌশলকে ধিক্কার দিয়ে বেড়ায়। এই মৃত্যুর প্রতীকী ভবিষ্য-ভাষ্যই যেন প্রতিফলিত হয় পরবর্তী সময়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনে, বামপন্থীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মাহুতিতে।

তবুও সান্ত্বনা, চারপাশের রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতা সোমেনের কমিটমেন্টকে দুর্বল করে ফেলে নি। বরং লজ্জা পেয়েছে এসব লক্ষ্যহীনতার মধ্যেও নির্ধারিত রাজনৈতিক কর্মসূচি লালন-পালনে সোমেনের একাগ্রতা দেখে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়ার পাদটিকা হিসাবে তাঁর জন্মতারিখ কিংবা শৈশব-কৈশোরও অজানা সবার। ম্যাট্রিক পাশ করার পরে একদিকে অর্থাভাব, অন্যদিকে প্লুরিসি বা ব্রঙ্কাইটিস জাতীয় কঠিন অসুখে মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলের ডাক্তারি পড়াও বাদ দিতে হয় তাঁকে। শুধু ডাক্তারি পড়া নয়, যে কোনও একাডেমিক লেখাপড়াও। তাঁর বাবার ছিল অপত্য স্নেহ, ওই শরীরে ছেলেকে চাকরি করতে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু বাবার কষ্ট ছুঁয়েছিল সোমেনের মনকে। মৃত্যুর কদিন আগে তিনি বলেওছিলেন একজনের কাছে, ‘একটা কাজ ঠিক করে দিন, নয়ত মরাল ভেঙে যাবে।’ এ ছিল কষ্টের অর্থনৈতিক দিক। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরেক দুঃখবোধ, যা ছিল সাংস্কৃতিক। শ্রী সমীন্দ্রকুমার হোরের আত্মকথনে দেখি সেই বোধের আভাস, সোমেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘কোথায় আর পড়া হয় বলুন? বিদ্যে তো ম্যাট্রিক – ভাল ভাল ইংরেজী বই পড়ে বুঝি না। ইস্‌, কি বলবো কমরেড, যদি ইংরেজী ভাষাটা জানতাম?’

ঢাকা শহরের অনেক ছোটবড় রাজনৈতিক বিপ্লবী সংঘের কোনওটিই টানতে পারে নি তাঁকে। লিখতেন ঢাকার বিভিন্ন মাসিক ও সাপ্তাহিকে, শ্রীহট্টের একটি মাসিক পত্রে। এমনকি কলকাতাতেও, ‘দেশ’সহ কোনও কোনও সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায়। ওই সময়েই, বয়স যখন মাত্র সতেরো, সংস্পর্শে এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির। ঢাকায় তখন সতীশ পাকড়াশী এসেছেন। টেররিস্ট বিপ্লবী দলের আন্দামান ফেরতা এই নেতার কথায় আন্দোলিত হয়েছিলেন সোমেন,– সাহিত্য রচনার পথেও বিপ্লবের কাজ হতে পারে। বিপ্লবের পথে এভাবেই এসেছিলেন সোমেন।

দক্ষিণ মৈশন্ডি — যে পাড়ায় সোমেনের আবাস — এখানেই ১৯৩৮-এর শেষ ভাগে কমিউনিস্টদের অফিস গড়ে ওঠে। মার্কসীয় রাজনীতির দীক্ষা তাঁর ওইখানেই। ১৯৩৯-এর মাঝামাঝি তিনি এলাকাতে গড়ে তোলেন প্রগতি পাঠাগার। তিনি যে সাহিত্যচর্চা ছাড়াও বৃহত্তর পরিসরের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বেন সেটা বোঝা গিয়েছিল ১৯৩৯-এর প্রথম দিকেই। তখন তিনি প্রথম কলকাতা গেছেন। নির্মলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে থাকেন। প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন নির্মলচন্দ্রের কাছে সোমেন বলেছিলেন,

কলকাতাকে জয় করতে হবে। … আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে অনিবার্যভাবে পচন ধরছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বুদ্ধিজীবী সমাজে — অর্থাৎ যারা প্রগতিপরায়ণ লেখক তারাও বাদ যান না,- সবার ভেতরেই পচন ধরেছে। এরা বলেন অনেক, জানি না, কিছুই বিশ্বাস করেন কি না। … কিন্তু জানেন না এই মধ্যবিত্ত সমাজেরই ভেতর একদল যাবে নিচে নেমে; তাদেরই ভেতর থেকে আগামী দিনের বিপ্লবের পুরোহিতরা বেরিয়ে আসবেন।

১৯৩৯-এই ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা স্থাপিত হয়। মূল উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন সোমেন চন্দ। তিনি ছিলেন সংঘের সহ-সম্পাদক। একই সময়ে তিনি রেলওয়ে ওয়ার্কাস ইউনিয়নেরও কাজ করতে থাকেন এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, যা তখন একদিকে বাহাদুরাবাদ ঘাট অন্যদিকে ভৈরব পর্যন্ত বিসতৃত, সে সংগঠনের সম্পাদকও নির্বাচিত হন।

এসবের মধ্যেও লিখতেন প্রায় নিয়মিত। অনেকে অবাক হতেন তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি দেখে। শ্রী অচ্যুত গোস্বামী নাকি একদিন অবাক হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, সারাদিন কাজ করার পরে আপনি এত লেখেন কখন, আপনি তো দেখছি অসাধারণ। সোমেন চন্দ তখন মিশে গেছেন শ্রমিক শ্রেণির ভেতর। আর আত্মপ্রচারবিরোধী স্বভাব তো ছিল আগে থেকেই। লাজুক-লাজুক কন্ঠে তাঁকে বলতে হয়েছিল, কিন্তু সারা দিন রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে না থাকলে আমি আজকাল লিখতেই পারি না।

সোমেন তাঁর সাহিত্যের জায়গাজমিন, পটভূমি কোথায় খুঁজে পেয়েছিলেন, তাঁর সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকই বা কী সেসবের একটি সাধারণ ধারণা এ কথা থেকেই টের পাওয়া যায়। তখন ঢাকার সাহিত্য আন্দোলন নানা কারণেই ভিন্নতর আকাঙক্ষা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে সবখানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের সাহিত্যবলয় থেকে বিষয়বস্তু ও ফর্মকে মুক্ত করার জন্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়াস শুরু হয়েছিল ১৯২৮-২৯ থেকে। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের সম্পাদনায় প্রগতি মাসিক পত্রিকা ঘিরে শুরু হয় এই প্রয়াস। প্রগতির লেখক তালিকায় জীবনানন্দ দাশও ছিলেন।

তারপর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। মাসিক প্রগতির অভিজ্ঞতায় ১৯৩৯ সালে লেখকেরা পেরেছিলেন ঢাকায় অত তাড়াতাড়ি প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তুলতে। অবিভক্ত ভারতে সেই সংঘের কেন্দ্রীয় কাঠামোয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাজ্জাদ জহির। খাপছাড়া মনে হলেও সত্যি যে, এ সংঘের লক্ষ্য, কর্মসূচি আর তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব, সুরেন গোস্বামী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকেরাও। এই লক্ষ্য ও কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল ফরাসি লেখক রোমাঁ রোলাঁ এবং আঁরি বারবুসের নেতৃত্বাধীন ‘লীগ এগেইনস্ট ইম্পেরিয়ালিজম এন্ড ওয়ার’ থেকে। উপমহাদেশে বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনমুখর সময়ে, কমিউনিস্ট পার্টির অপ্রতিহত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রেণি ঐক্যের স্বার্থে, শ্রেণি মেরুকরণের লক্ষ্যে মানুষের চৈতন্য বিকাশে প্রগতি লেখক সংঘ একটি অনিবার্য শর্ত পূরণ করে। ব্যাপক মানুষের সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগ স্থাপনের প্রয়াস দিয়ে সাহিত্যিকের সামাজিক কমিটমেন্ট পূরণের প্রচেষ্টা চালায় সংঘটি। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই উদ্যোগ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘১৯৩৯-এর দ্বিতীয়ার্ধে প্রাদেশিক প্রগতি লেখক সংঘের সংযুক্তি লাভ করে এই সংঘের জন্ম হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে সতীশ পাকড়াশী, জ্যোতির্ময় সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ প্রমুখের নাম করা দরকার। প্রথম প্রথম আমাদের কাজ শুধু রবিবাসরীয় আড্ডা জমানোতে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রগতিশীল সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাই আমাদের ধ্যান-জ্ঞান ছিল।’’ এদের মধ্যে সতীশ পাকড়াশী আন্দামান ফেরতা বিপ্লবী, বয়স তাঁরই সবচেয়ে বেশি। সোমেন চন্দ সর্বকনিষ্ঠ। কিরণ শংকর সেনগুপ্ত আধুনিক কবিতা লেখক, অমৃত কুমার দত্ত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার জনপ্রিয় শিক্ষক সুকুমার দত্তের পুত্র এবং বিখ্যাত ইতালিয়ান উপন্যাস ফন্টামারার বাংলা অনুবাদক। আর রণেশ দাশগুপ্তের বয়স তখন মাত্র সাতাশ।

ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৪০-এর মাঝামাঝি, গেণ্ডারিয়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কাজী আবদুল ওদুদ। সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে সংঘের কর্মতৎপরতায় সংযুক্ত হন ‘বাংলা উপন্যাসের ধারা’র লেখক ফরিদপুরের আদিবাসী শ্রী অচ্যুত গোস্বামী, তাঁর বড়ভাই দর্শন শাস্ত্রের তরুণ অধ্যাপক নিবন্ধকার নৃপেন গোস্বামী, চট্টগ্রামের বিপ্লবী পরবর্তীকালে সন্ন্যাসী সরলানন্দ স্বামী যিনি ওই সময়ে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়ে সন্ন্যাসব্রতই ত্যাগ করেন, নাম নেন সরলানন্দ সেন এবং ২৬/২৭ বছরের জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত — ১৯৩২ সালে ঢাকায় ট্রেন ডাকাতির রাজনৈতিক মামলায় ছয় বছর কারাভোগী কমিউনিস্ট। কারাগার জ্যোতির্ময়কে যক্ষা রোগী বানিয়ে ফেলে। কিন্তু ১৯৩৮ সালে ছাড়া পাওয়ার পরে ওই অবস্থাতেই সাংগঠনিক তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জার্মান বিপ্লবী কবি ও নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেখ্‌ট-এর সঙ্গে সর্বপ্রথম পরিচিত করান। তিনি লিখতেন বিজয় সেনগুপ্ত নামে। তা ছাড়া ঢাকায় রেল শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৪ সালে মারা যান তিনি।

ট্রেড ইউনিয়নের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সোমেন ছিলেন লেখক সংঘের একমাত্র নিয়মিত উপস্থিত সদস্য। নিজের লেখক সত্ত্বা নিয়ে বিব্রত বোধ করতেন, কাউকে এ পরিচয় দিতে চাইতেন না। স্মৃতি হাতড়ে সমীন্দ্রকুমার হোর লিখেছেন একবার তাঁর লেখা পড়তে নিলে সোমেন তা কেড়ে নেয়ার জন্যে চেষ্টা চালিয়েছিল। শ্রী অচ্যুত গোস্বামীও লিখেছেন যে সংঘের বৈঠকে তিনি লেখা পড়তেন খুবই কম, দু বছরের মতো সময়ে না কি মোটমাট তিন বা চারটা গল্প পাঠ করেছিলেন।

এমত স্বভাবের সোমেন খুব চাপে পড়েই লিখেছিলেন ‘বনস্পতি’। ১৯৩৯-এ সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কলকাতা শাখা প্রগতি লেখক সংঘ বের করে প্রগতি নামের একটি সংকলন। তখন রণেশ দাশগুপ্ত প্রস্তাব করেন ঢাকা থেকেও অমন একটি সংকলন বের করবার। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত; এমনকি কে কি লিখবে তাও ঠিক করা হয়। কথা হয় লেখাগুলো সংঘের বৈঠকে মনোনিত হতে হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে সোমেন চন্দ বাধ্য হন সর্বপ্রথম সংঘের বৈঠকে সবার সামনে লেখা পড়তে। সংঘের সেই সংকলন ক্রান্ত্রিতেই ছাপা হয় সোমেনের লেখা বনস্পতি। এই ক্রান্ত্রির প্রকাশক ছিলেন সোমেন নিজেই। তাতে লেখা ছিল শুধু ঢাকার তরুণ লেখকদের। আর এসব লেখার ভেতর দিয়েই সেসময়ের বাংলাভাষাভাষী অন্য সব লেখক ও পাঠকরা জানতে পারেন ঢাকার তরুণদের প্রগতিশীল সাহিত্যচিন্তা। ঢাকার লেখকদের সঙ্গে কলকাতার লেখকদের যোগসূত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্রান্ত্রি রাখে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা। এর কিছুদিন পর এই পত্রিকার সূত্রেই ঢাকায় আসেন কলকাতা থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষসহ আরো অনেকে।

ওই ‘বনস্পতি’তেই সোমেন দেখান নিজের ত্রিকালজ্ঞ সৃজনশীলতা। সমাজ-সময়ের ক্রমবিবর্তনকে কেন্দ্র করে এ ছোটগল্পে উঠে আসে একটি বিশাল প্রেক্ষাপট। যদিও শ্রী অচ্যুত গোস্বামী উল্লেখ করেছেন যে ‘দাঙ্গা’ গল্পটিই সংঘের বৈঠকে সোমেনের প্রথম গল্প এবং সেসময় ঢাকায় সামপ্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল, কিন্তু বিভিন্ন তথ্য থেকে মনে হয় ‘বনস্পতি’ই তাঁর সংঘের বৈঠকে পড়া প্রথম লেখা। কেননা ‘বনস্পতি’র প্রকাশকাল ১৯৪০। আর ঢাকা শহর ও রায়পুর থানায় ভয়াবহ সামপ্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪১ সালের এপ্রিলে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয় ১৯৪০ সালে। তখন সক্রিয় হয়ে ওঠেন কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত বিভিন্ন প্রকাশ্য সংগঠনের সদস্যরা। ঢাকায় সামপ্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে যারা সক্রিয় ছিলেন সোমেন তাদেরই একজন। ‘দাঙ্গা’য় তাঁর আত্মজৈবনিকতার যে প্রভাব পাওয়া যায় তাতে এটাই বেশি সঙ্গত যে তিনি ‘দাঙ্গা’ লিখেছিলেন ১৯৪১-এ, কোনক্রমেই ক্রান্ত্রিতে প্রকাশিত ‘বনস্পতি’র আগে নয়। গল্পটির এক জায়গাতেও লেখা আছে, ‘নবাব বাড়ী সার্চ হয়ে গেছে।’ লেখা বাহুল্য, ১৯৪১-এর এই দাঙ্গায় মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষক নবাব বাড়ী সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।

ওই ‘দাঙ্গা’তেই আমরা খুঁজে পাই সোমেনের পৃথক গাঠনিক ও বাচনিক ভঙ্গী। পুরো গল্প তিনি লিখে যান অথবা বলতে থাকেন সাবলীলতা নিয়ে, অত্যন্ত নিচুকন্ঠে যেন রাত্রির নিঃসঙ্গতা তাঁর গল্পের আধার। দাঙ্গার অমানবিকতা কিংবা অশুভ দিক নিয়ে তিনি ভয়াবহ নির্লিপ্ত। মূলত গল্পটি সাবজেকটিভ এবং ছোট ছোট চিত্রের মধ্যে দিয়ে দাঙ্গার একটি সামপ্রদায়িক রূপায়ণ। সেখানে বাবা মা বিভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন; ছোটভাই ভুল আদর্শের বিষবাষ্পে সংক্রমিত আর কমিউনিস্ট চিন্তার ধারক বড়ভাই ‘অর্থহীন মানবিক ট্রাজেডি’ দেখে ক্রমাগত উত্তেজিত। দাঙ্গা নিয়ে তো অনেক গল্পই লেখা হয়েছে, সমরেশ বসুর একটি গল্প নিয়ে সফল চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু নির্লিপ্তির দিক থেকে সোমেনের ‘দাঙ্গা’ সেসব থেকে ভিন্নতর। নির্লিপ্ত না হলে দাঙ্গার ভয়াবহ আর্দশিক নগ্নতা, — যা মানুষের নৈতিকতাকে হত্যা করে চলেছে, তা অত কদর্য বাস্তবভাবে উপস্থাপন করা সোমেনের পক্ষে সম্ভব হতো না। দেখা যেত কদর্য বাস্তবতার শিল্পরূপ তৈরি করার আগে তিনি নিজেই উত্তেজিত না হয় হতাশ্বাস হয়ে পড়েছেন।

এমনকি আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ, রাজনৈতিক বক্তব্যহীন গান ‘গল্প’ থেকেও বোঝা যায়, সোমেন পরিণত সাহিত্যিকের জায়গায় উঠে আসছেন। মধ্যবিত্ত একটি গ্রামীণ সংসারকে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে দেখেন বটে, কিন্তু তাঁর দেখা সেই জীবনের মাধুর্য, স্বাভাবিক প্রাপ্তিবোধ, মানবিক আকাঙক্ষাই কাহিনীকে সমগ্রতা দেয়। এইসব লেখা তাঁর সাহিত্যজীবনের দ্বিতীয় পর্বে লেখা। কিন্তু এই দ্বিতীয় পর্বের পরিণত গল্প দিয়েও তাঁর বিভূতিপ্রভাবিত প্রথম পর্বের সাহিত্যকর্মকে নাকচ করে ফেলা যায় না। শ্রী অচ্যুত গোস্বামী তো খোলাখুলিই লিখেছেন, ‘…গল্পগুলি যদি বাংলাদেশের কোন বিখ্যাত লেখকের প্রথম বয়সের রচনা হত তাহলে তিনিও এগুলির জন্য লজ্জিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেতেন না।’’

সোমেনের শেষ লেখা ‘ইঁদুর’ বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখা একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এটি লেখেন তিনি। সংঘের বৈঠকে তিনি এ লেখাটি নিজে পড়তে পারেন নি শরীর ভাল না থাকায়। বারবার থেমে যাচ্ছিলেন। গল্পটি শেষ পর্যন্ত পড়ে শোনান সেদিনকার বৈঠকে উপস্থিত ঢাকা রেডিওর একজন ঘোষক। শ্রী অচ্যুত গোস্বামী পরে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, গল্পটি শোনার পরে সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। শোনার পরে প্রথমেই তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি নিজে এরকম গল্প লিখতে পারতেন না।

সোমেনকে নিয়ে যে কোনও আলোচনায় সঙ্গতকারণেই এই ‘ইঁদুর’ প্রসঙ্গ উঠে আসে। খুব সাধারণ দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছে এর কাহিনী, অন্য কথায় এ কাহিনী সোমেনেরই নিজের। সংসারের নির্বিকল্প আনন্দহীনতা দারিদ্র্যের সান্নিধ্যে আরো বেশি নিরানন্দময়, সেখানে ইঁদুর এত বেশি বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। ইঁদুর আর দারিদ্র্যের নির্বিরোধ অবস্থানের প্রতিতুলনা দাঁড় করিয়ে সোমেন তর্জনী তুলে আমাদের মধ্যবিত্তের তথাকথিত গৌরবময়তার আসল চেহারা দেখান। মধ্যবিত্তের এই অবস্থান এতই পলকা যে প্রতিনিয়ত সন্ত্রস্ত থাকতে হয় সেই শ্রেণির প্রতিটি মানুষকে। সেখানে সামান্য ইঁদুর এসে অনেক সখ করে কেনা দুধ ফেলে দেয়। মা’র চোখ ‘গরুর চোখের মতো করুণ’ হয়ে যায় এইসব ঘটনায়, আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পরে বাবা স্তরে স্তরে উত্তেজিত হন, যে উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে বউকে ‘শয়তান মাগী’ বলে সম্বোধন করার মধ্যে দিয়ে। অপমানিত ও প্রত্যাখ্যাত মা যখন ছেলের ঘরে রাতে ঘুমাতে আসতে বাধ্য হয় এবং বাষ্পাচ্ছন্ন স্বরে ছেলেকে ডাকেন তখন এত কিছুর পর ছেলেরও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে লজ্জা লাগে।

এরপর সোমেন চন্দ লিখেছেন,

‘মধ্যরাত্রির ইতিহাস আরো বিস্ময়কর।’

এক অনুচ্চ কন্ঠের শব্দে হঠাৎ জেগে উঠলাম। শুনতে পেলাম বাবা অতি নিচুস্বরে ডাকছে।
‘কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?’

বাবা মাকে ডাকছেন নাম ধরে। ভারী চমৎকার মনে হলো। মনে মনে বাবাকে আমার বয়েস ফিরিয়ে দিলাম; আমার প্রতি ভালোবাসা কামনা করতে লাগলাম তার কাছ থেকে। যুবক সুকুমার একদিন তার বৌকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চীৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে।’’

পরদিন বাবা হাসেন। মা’ও হাসেন। প্রাণখোলা হাসি। ব্যাপার দেখে প্রায় দৌড়ে গেল, দু’জনের দিকে দুইবার চেয়ে তারপর মাকে মুচকে হাসতে দেখে বললে,‘মাগো কী হয়েছে? অমন করে হাসছো কেন? বাবা তোমায় কাতুকুতু দিয়েছে?

আরো ক’দিন বাদে রাস্তায় বাবা বোকার মতো হাসতে লাগলেন।
‘‘ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।’’

মধ্যবিত্তের ইতিকথা এরকমই হয়। ইঁদুরের মতো তুচ্ছ শ্রেণিটি জীবনের মাধুর্যের খোঁজে কদর্য হয়, বুঝতে পারে না নিজের কদর্যতা, বুঝলে আত্মপীড়ন জাগে, কিন্তু বেরুতে পারে না বৃত্ত ছেড়ে। এই আত্মনিমগ্নতায় নিজেকে উন্মোচন করেন সোমেন,

স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়াই, জীবন আমাদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করি, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম গাই, অথবা ঊর্ধবাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করি। এসব দেখে আমি একদিন সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। … বন্ধুকে এক ধোঁয়াটে রহস্যময় ভাষায় চিঠি লিখলাম : ‘এরা কে জানো? এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি। পেটের ভিতর সুঁচ বিঁধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষাপাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!

‘ইঁদুর’ লেখার মধ্যে দিয়ে সোমেন, লেখা একটুও অসঙ্গত হবে না যে বাংলাভাষায় প্রথম বামধারার ছোটগল্প লেখার মৌলিক ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। সোমেনের লেখায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব রয়েছে, এরকম দাবি করেছিলেন শ্রী কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত। কিন্তু এ দাবি ধোপে টেকে না একারণেই যে সোমেনের ‘সংকেত’, ‘দাঙ্গা’, ‘ইঁদুর’ সহ যাবতীয় গল্প কিন্তু মানিকের যেসব গল্পকে আমরা দ্বিতীয় পর্বের অর্থাৎ মার্কসবাদী পর্বের গল্প বলে থাকি,- যেমন, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’, ‘হারানের নাতজামাই’, ‘শিল্পী’ ইত্যাদি অর্থাৎ ‘আজকাল পরশুর গল্প’ ইত্যাদির আগেই লেখা। কাজেই কে কাকে প্রভাবিত করেছে তা মন্তব্য করা মুশকিল। বরং বামধারার সাহিত্য সৃষ্টিতে সোমেন চন্দের ভূমিকাকেই মুখ্য মনে হয়।

আগেই লেখা হয়েছে, এ মৃত্যু ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, অনাকাঙিক্ষত। এই মৃত্যুর পঞ্চাশেরও বেশি বছর পরে নিরাসক্তভাবে আরো বলা যায়, এ মৃত্যু ছিল তাঁর পার্টি-সংগঠনের রাজনৈতিক ভ্রান্তির ফল। ১৯৩৯-এ সংঘটিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের ভাগবাটোয়ারার লড়াই। এই যুদ্ধের বিরোধিতা করে কমিউনিস্ট পার্টি সংঘবদ্ধ হয়, সেসময়ের শ্রমিক কৃষক ছাত্র আন্দোলনের বিকাশ ও ইতিহাস তারই প্রমাণ। ১৯৪০-এ কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই লড়াইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মিত্র ছিল কংগ্রেস এবং ফরোয়ার্ড ব্লক এমনকি আর এস পি। কিন্তু ১৯৪১-এর ২২ জুন হিটলার বাহিনী সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধের ভ্রান্ত তত্ত্ব হাজির করে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টি তখন আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের রাজনৈতিক সহযোগী জর্জ দিমিট্রভের আন্তর্জাতিক ফ্যাসিস্ট শক্তি ও স্ব স্ব দেশের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তত্ত্ব প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়। আর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দোদুল্যমান মিত্র শক্তি ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি-কে দূরে ঠেলে দিয়ে সমর্থন দেয় মিত্রপক্ষের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে। শ্রী জ্ঞান চক্রবর্তী এই রণকৌশল নিয়ে পরে মন্তব্য করেছিলেন যে, এ ধরণের লেজুড়বৃত্তি করেও তখন কমিউনিস্টরা বৃটিশ সরকারকে খুশি করতে পারেনি।

কয়েকটি সভার উদ্যোক্তা ও বক্তাদের গ্রেফতার করিয়া দীর্ঘকালের জন্য হাজতবাস করান হয়। জনসাধারণের চাপে সোভিয়েটের সঙ্গে মৈত্রী জোটে মিলিত হইতে বাধ্য হইলেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন যে পরাধীন ভারতের জনসাধারণের মনে সোভিয়েটের প্রতি সমর্থনের মনোভাব গড়িয়া উঠাকে কতখানি ভয় করে এই ঘটনাগুলো হইতে তাহারই প্রমাণ পাওয়া যায়।

অথচ এরপরও কমিউনিস্ট পার্টি তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে মৌলিক শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেনি। অন্যদিকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির মতো শক্তিশালী মিত্র হারিয়ে সাধারণ জনতার কাছাকাছি যাওয়ার দলীয় সীমাবদ্ধতায় ফরোয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-ও হয়ে উঠেছিল উন্মত্ত।

এইরকম পরিস্থিতিতে আটই মার্চ, ১৯৪২ বিকেল তিনটার দিকে সুত্রাপুরে সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্যোগে ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলনে সোমেন চন্দ রেল শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে আসার পথে ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি-র হামলার মুখে পড়েন। সোমেনকে হত্যা করা হয় অত্যন্ত নৃশংসভাবে। খোলা রাস্তায় তাঁর চোখ তুলে নেয়া হয়, জিহ্বা বের করে ফেলা হয়, সারা শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয় আর পেট চিরে ফেলা হয় ভোজালি দিয়ে। তবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর হাত থেকে লাল পতাকাটি কেড়ে নেয়া সম্ভব হয় নি।

এ সত্য এখন ইতিহাসের অন্তর্গত, সোমেনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই সম্ভব হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম লেখকদের ফ্যাসিবাদবিরোধী ইতিবাচক মেরুকরণ। ঢাকায় মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ নূরুদ্দিন, সানাউল হক, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর উত্তরসূরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মৃত্যুর পরে ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’ (ডিসেম্বর, ১৯৪২) এবং ‘বনস্পতি’ (১৩৫১) নামে তাঁর দুটি গল্পের বই ছাপা হয়। সোমেনের এখন পর্যন্ত ২৫টি গল্প, একটি উপন্যাস, দু’টি একাঙ্ক নাটিকা, একটি কবিতা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রচণ্ড অযত্নে রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় ১৭টি গল্প নিয়ে ‘সোমেন চন্দের গল্পগুচ্ছ’ (অক্টোবর, ১৯৭৩) বের হয়। কিন্তু এটি এখন দুষপ্রাপ্য। পরে বাংলা একাডেমী সোমেন চন্দের রচনাবলী বের করলেও বিপণন ব্যবস্থার কারণে এখনও তা পাঠকের নাগালের বাইরে।

অতএব, সোমেন এখন বিস্মৃতপ্রায়। সাহিত্যিক সোমেন চন্দ জীবনের সিংহভাগ ব্যয় করেছিলেন রাজনীতিতে এবং তাঁর মৃত্যুও ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। যে উপদ্রুত জীবন থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন, শুধু সাহিত্য আন্দোলনে সেই মুক্তি পাওয়া যায় না বলে ঈর্ষণীয় সাহিত্যপ্রজ্ঞা থাকার পরও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। অথচ সেই রাজনীতিও এখন তাঁকে স্মরণ করতে রীতিমতো কুন্ঠিত। তাঁকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে অনেক কষ্টে রাজনীতির ফাঁক গলিয়ে লেখা তাঁর গল্পগুলোই।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

8 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
8
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.