আমার ধারণা, আজকের কবিতার সমাজ বিচ্ছিন্নতার (এখানে কি লেখক-পাঠকের সম্পর্কের কথা উঠছে) মূল খুঁজতে গেলে তা খুঁড়তে হয় আরও গভীরে – এই শ্রেণীসমাজে ব্যক্তির বিযুক্তিবোধে; আর, এ মুহূর্তে দায়ী করা হোক, উদাহরণত, এক ফাটকাবিলাসী ‘সাহিত্যের’ বাজার হাটের নিয়মের অমানুষিক অমানবিকতাকেই, – কারণ লেখক পাঠকের যোগ তো হওয়া উচিত মানবিক মূল্যবোধে। তা যদি উপার্জিত না হয়, লেখকদের অক্ষমতায় বা দায়িত্বহীনতায় বা দণ্ডমুণ্ডধারী বণিকদেবতাটির পায়ে করুণ আত্মসমর্পণে, কিংবা অপর পক্ষে, পাঠককুলের সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যের অভাবে – তবে তো উভয়তই ভরাডুবি হ’তে বসেছে। শিল্পীর সততাই, আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে তার একমাত্র রক্ষাকবচ হ’তে পারে।
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘কবিতা-পরিচয়’ পত্রিকার দ্বাদশ সংকলনে (বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৭) ছাপা হয়েছিল বাংলাভাষার ২০ জন প্রতিনিধিস্থানীয় কবির কবিতা-বিষয়ক পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর। ‘কবিতাভাবনা’ নামের গদ্যরচনাটি – যার অংশবিশেষ আমরা উদ্ধৃত করেছি উপরে – লেখা হয়েছিল ওই প্রশ্নমালারই উত্তর হিসেবে।
হ্যাঁ, এই কবিতাভাবনা সিদ্ধেশ্বর সেনের, বাংলাভাষার প্রধান এক কবির।
২
সিদ্ধেশ্বর সেনের চার-পর্বে-বিন্যস্ত দীর্ঘ কবিতা ‘আমার মা-কে’ বেরিয়েছিল অনিলকুমার সিংহ সম্পাদিত ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার প্রথম (বৈশাখ) সংখ্যায়, ১৯৫০ সালে। চারটি পর্বেরই শুরুতে ছিল পাবলো নেরুদার কবিতার উদ্ধৃতি। এই কবিতাটির জন্য – সারা জীবনে কেবল এই একটিমাত্র কবিতা লিখলেও – বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি চিরস্থায়ী আসন পেতে পারতেন। এই কবিতা রচনার সূচনা ১৯৪৯-এর শেষদিকে, কবির নিজের ভাষায়, ‘আটকাধীনের একাকিত্বে’ :
… ঐ সময়ে, একদিন প্রগতি লেখক সংঘের ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রীটের দপ্তর থেকে আমরা কয়েকজন হঠাৎ গ্রেপ্তার হই। আমাকে ও গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নিরঞ্জন সেনকে লকআপে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিনেই বাড়িতে দেখে এসেছি, ছোট বোনটি খুবই অসুস্থ এবং মা অসম্ভব ভেঙে পড়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তাই মা ও বোনের এই দুঃসহ অবস্থা এবং সে-সময়ে আমি যে তাঁদের পাশে থাকতে পারছি না – এমন এক অসহায়তা আমাকে গ্রাস করছিল। শেষে, রাত্তিরের দিকে, হঠাৎই এক তীব্র টানে, ভাঙা একটা চায়ের ভাঁড়ের টুকরো নিয়ে, আমি লকআপের মেঝেতেই এই কয়েকটি লাইন লিখে ফেলি :
‘মা, তোমার কান্নার মাঝরাতে
আমি সান্ত্বনা
মা, তোমার আকণ্ঠ তৃষ্ণায়
আমি জল
মা আমার …’এর কিছুদিন পরে, জামিন পেয়ে বাড়িতে এসে দেখি, আমার একমাত্র বোনটি শেষ শয্যায়। মায়ের অবস্থা চোখে দেখা যায় না। এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বোন চল যায়। মায়ের সে দিনগুলির বর্ণনাতীত যন্ত্রণাকে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না, ‘আমার মা-কে’ – এই পুরো কবিতাটি লিখে না ফেলা ছাড়া।
এই কবিতাটি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা মমত্ব আজও একটুও কম নয়। কবিতাটির পিছনের কথা মনে করলে আজও আমার বাক্রোধ হয়। এছাড়া, এর সম্পর্কে আরও স্মৃতি এই যে, ইংরেজি অনুবাদ সহ এটি রুশ ও দেশী-বিদেশী নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সাহিত্য সমালোচকেরা এর উপরে লিখেছেনও। চার-পর্বের এই দীর্ঘ কবিতাটিতে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও সমকালের এক বিরাট সামাজিক অভ্যুত্থান মিলে-মিশে যায়। এর বিন্যাসে কেউ কেউ (যেমন, অধ্যাপক অমরেন্দ্রনাথ মিত্র) এলিয়টীয় পদ্ধতির কথাও এনেছেন। আমার এখনও বেশ মনে আছে ইংরেজি ভাষান্তরের প্রসঙ্গটিও। সম্ভবত, পঞ্চাশের শেষেই জেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে এই কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন সুনীল জানা, এবং কবি সমর সেন তা দেখে দেন। পি. সি. যোশীর সম্পাদনায় এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় সেটি বের হয়।
৩
১৯৪৫-এর এপ্রিলে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘অরণি’-তে ছাপা হয় সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ‘প্রস্তুতি’; এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা। সে-সময়ে ওই পত্রিকার কবিতা-বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন অরুণ মিত্র। একই বছর অক্টোবরে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর ‘অনুরণন’ নামের একটি লিরিক। চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার নানা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কবিতা ছাপা হলেও ১৯৫০-এ ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় ‘আমার মা-কে’ কবিতাটির প্রকাশের মধ্য দিয়েই সিদ্ধেশ্বর সেন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। সে-সময়ে তাঁর বয়স চব্বিশ। অথচ এর বিশ বছর পরেও – আমাদের এই লেখার শুরুতেই উদ্ধৃত ‘কবিতাভাবনা’র প্রকাশকালেও – তিনি সম্পূর্ণতই ‘অগ্রন্থিত’ একজন কবি; তখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি তাঁর একটিও কাব্যগ্রন্থ!
এরও বছর দুই পরে, শঙ্খ ঘোষের আগ্রহে ও প্রকাশকের নিরন্তর তাড়নায় সিদ্ধেশ্বর সেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেও, শেষমেশ তাঁর আকস্মিক অজ্ঞাতবাসের কারণে সে-বই কখনোই আর আলোর মুখ দেখেনি! অবশেষে ১৯৭৯ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে লেখা মাত্র ৮টি কবিতা নিয়ে, মূলত অরুণ সেন ও দেবেশ রায়ের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় দেড় ফর্মা বা চব্বিশ পৃষ্ঠার একটি কবিতাপুস্তিকা – ‘ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড়’ – ১৯৮০ সালের ১৪ মার্চ তারিখে। এর বারো দিন পরেই সিদ্ধেশ্বর সেনের চুয়ান্ন বছর পূর্ণ হয়।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮১-তেই অভিন্ন অনুরাগীজনের উদ্যোগেই ‘পরিচয়’ থেকে প্রকাশিত হয় ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১’, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১১২ (১০+১০২) –পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থের বদলে তাঁর প্রথম কবিতা-সংগ্রহ। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দেবেশ রায় পরে লিখেছেন :
সে-বইটি ছাপা হয়েছিল দুর্লঙ্ঘ্য এক গোপনতার শর্তে। প্রেসের শর্ত ছিল – সিদ্ধেশ্বর সেনকে জানানো যাবে না যে তাঁরা ছাপছেন। আমি ‘কালান্তর’ প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। প্রুফ দেখে দিতাম বা ব্যাগে ভরে নিয়ে ‘পরিচয়’-এ এসে অরুণ সেন-কে দিতাম। দেখে, অরুণ আমাকে ফেরৎ দিতেন। আমি প্রেসে দিয়ে আসতাম। সিদ্ধেশ্বর সেন পুলিশের গোয়েন্দা-কুকুরের ঘ্রাণশক্তি সত্ত্বেও এই বিপ্লবী গোপনতার ঘের ভাঙতে পারেন নি। বিমর্ষ হয়ে থাকতেন।
তার আগে অনেক দিন ধরে অরুণ, সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি করে গেছেন। পরম আনন্দে। কারণ, তাঁর এত কবিতা পরপর বা একসঙ্গে পড়তে পারছেন। সিদ্ধেশ্বর সেনও সাহায্য করছেন। কারণ তিনি হয়তো নিজের পুনর্পাঠে আনন্দ পাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতেই পারেন নি – কবে, কখন, পাণ্ডুলিপি প্রেসে চলে গেছে। তিনি বস্তুত বিশ্বাসই করেন নি – সত্যি করেই বই ছাপা হবে।
…
১৯৪৫-এ সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা প্রথম বেরোয়। তখন তাঁর বয়স ১৯। তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১’ বেরচ্ছে ১৯৮১-তে। তখন তাঁর বয়স ৫৫। অন্তর্বর্তী এই ৩৫/৩৬ বছর ধরে তিনি অব্যাহত লিখে গেছেন কবিতা। সিদ্ধেশ্বর সেন আমাদের সময়ের তেমন বিরল কবি যাঁর কবিতা লেখায় কখনো খরাঋতু আসে নি। তাঁর কবিতার কখনো প্রয়োজন হয়নি মাঝে-মাঝে অনাবাদ, আবার তাঁর কবিতা কখনো হয়ে ওঠে নি চিরাচরিত শস্যক্ষেত্র। প্রথম কবিতা প্রকাশ ও গ্রন্থ প্রকাশের মাঝখানের ৩৫/৩৬ বছরে তাঁর অন্তত পাঁচ-ছটি বই বেরনোর কথা – সাত বছরে একটি এমন গড় ধরলেও। আমরা ঠিক করলাম – এই বইয়ের কবিতাগুলি সেই অপ্রকাশিত বইগুলির স্মৃতিতে – যা ঘটেই নি তার স্মৃতি কী করে থাকবে, বদলে বলা যায় – সেই অপ্রকাশিত বইগুলির স্মারক হিশেবে এক-একটি গুচ্ছে সাজানো হবে। সিদ্ধেশ্বরই গুচ্ছগুলির নাককরণকর্তা।
‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১’ প্রকাশের পর অরুণ সেন তাঁর ‘অজ্ঞাতবাস থেকে যাত্রা’ (১৯৮৩) প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতাসংগ্রহের প্রথম খণ্ডটি বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক কবিতার বাংলায় একটি দীর্ঘলালিত কিংবদন্তির অবসান ঘটল। এই কিংবদন্তি যে-কবিকে ঘিরে তিনি বন্ধুমহলে সুপরিচিত তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত, কুণ্ঠিত, অনিশ্চিত, সদাব্রিবত ও অতিবিনীত স্বভাবের জন্য – অথচ তিনিই আবার ভরপুর কবিত্বের নিশ্চয়তায় ও সাহসিকতায়। যিনি সাময়িকপত্রে কবিতা পাঠিয়েই ক্ষান্ত হন না, শেষ-প্রুফের পরেও একটি ‘কমা’ বা ‘ড্যাশ’ অদল-বদলের জন্য প্রথমে নিরুপায় সম্পাদক বা প্রুফ-রিডারকে, পরে প্রেসের হতবাক্ কর্মীকে কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। পরে পত্রিকাটি ছাপা হয়ে গেলে কিন্তু উধাও – মনে হয়, নিজের বা যে-কোনো কারো লেখা সম্পর্কেই যেন আর কোনো বিকার নেই। অথচ কবিত্বের তাড়না কখনোই শিথিল হয় না, নিরন্তর লিখে চলেন সময়ের দায় মেটাতে, শব্দের দায় মেটাতে। বিভিন্ন পথের ও কর্মের কবি বা কাব্যপ্রেমিকরা সমবেতভাবেই একমত হতে পারেন যাঁর কবিতার ভালোত্ব সম্পর্কে, কারণ কোনো ঝুঁকিই নেই, তিনি কারোই প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তাই তো চারদশকব্যাপী অজস্র কবিতা লিখেও, দু-আড়াই বছর আগে প্রকাশিত একটি ছোট পুস্তিকা ছাড়া, তাঁর কোনো পুরোদস্তুর কবিতার বই-ই বেরোয় না। আর কবি নিজেই তাতে ইন্ধন জোগান। অথচ এই প্রবল আত্মসঙ্কুচিত ব্যক্তিটিরই কবিতায় বাংলাদেশের গত চার দশকেরও বেশি সময়ের তাপ বিকীর্ণ হতে থাকে। শুধু পরোক্ষ নয়, কখনো কখনো অতিপ্রত্যক্ষে। সৃজনকর্ম ও সময়ের প্রতি দায়বোধে যিনি অতন্দ্র, সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্যের নানা উদ্যোগ নানা প্রয়াস নানা প্রগতিমূলক কাজেকর্মে যিনি সর্বদা সজাগ, তিনিই কিন্তু নিজের কবিত্বের প্রচারে বা সাধুবাদে প্রায় ভয়ার্ত। সময় যাঁর কবিতায় প্রতিনিয়ত স্পন্দিত, তিনিই আবার কবিতার একটি শব্দ বা একটি ‘কমা’ বা এক-‘এম্’ স্পেসের কাব্যিক যৌক্তিকতার ভাবনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন, ক্রমশই তাঁর পাণ্ডুলিপি হয়ে উঠতে পারে রেখা-কণ্টকিত – অথচ ততই বিষয়ের সঙ্গে, কবিতারও বাইরে যে-জীবনবোধ তার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে যায় কবিতার এই শরীর।
১৯৮১-র ফেব্রুয়ারিতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল এই স্বকল্পিত অজ্ঞাতবাস থেকে যাত্রা। বহুপোষিত কিংবদন্তি ভেদ করে বাস্তব হয়ে উঠল প্রকাশ্য। বাংলা কবিতার জগতে এ ঘটনা তো রীতিমতো একটা উৎসব।
৪
কাব্যগ্রন্থ ও কবিতা-সংকলন মিলিয়ে মোট আটটি কবিতা-বই বেরিয়েছে সিদ্ধেশ্বর সেনের : ‘ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড়’ (১৯৮০, সারস্বত), ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১’ (১৯৮১, পরিচয়), ‘তোমার শুধু মানুষ’ (১৯৮৩, সাহিত্য সমবায়), ‘দীর্ঘায়ু আর অমর তৃষ্ণায়’ (১৯৮৩, পরিচয়), ‘আয়না-আঁটা সপ্ততলা’ (১৯৮৩, নাভানা), ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ২’ (১৯৮৪, পরিচয়), ‘পুরাণকল্পে পুনর্বার’ (১৯৮৯, প্রতিক্ষণ) এবং ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা’ (২০০১)। তাঁর অনুবাদে দেশী-বিদেশী অনেক কবির কবিতার বঙ্গানুবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও গ্রন্থিত হয়েছে কেবল ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কির কয়েকটি কবিতা। দীর্ঘ কবিতা ‘ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’-এর অনুবাদটি একক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় সারস্বত লাইব্রেরী থেকে, ১৯৬৯ সালে। আর অন্য কয়েকটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে ‘মায়াকোভ্স্কির শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৮১, দে’জ) সংকলনে। এছাড়া সিদ্ধেশ্বর সেনের স্বকণ্ঠে পঠিত স্বনির্বাচিত ১৭টি কবিতার একটি ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে – বলাবাহুল্য, তাঁর কবিতা-বইগুলির মতো এই ক্যাসেটটিও এখন আর পাওয়া যায় না।
৫
সিদ্ধেশ্বর সেনের মৃত্যুর পর একটিমাত্র ছোটপত্রিকাই তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা প্রকাশ করেছে – আর এ পত্রিকাটি কলকাতা থেকে নয়, প্রকাশিত হয় বর্ধমানের পানাগড় থেকে। ‘স্বকাল’-সম্পাদক প্রকাশ দাস ‘কবি সিদ্ধেশ্বর সেন সংখ্যা’র (নভেম্বর ২০০৮) সম্পাদকীয়তে (‘পূর্বকথা’) লিখেছেন :
তাঁর মৃত্যুর পর সাত মাস পর, এমন একটি সময়ে, তাঁক নিয়ে, ছোট পত্রিকার একটি গোটা সংখ্যা প্রকাশ পেলো, যখন মেজ-সেজ কবিদের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় ভরা বাজারে, মাথা খুঁড়েও এই কবির একটিও কাব্যগ্রন্থ আজ আর পাওয়া যায় না। আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্য কোথায় গিয়ে মুখ গুঁজেছে, বলা বাহুল্যই, এটিও একটি তার অনন্য দৃষ্টান্তই। সেই গুটিকয়েক সিদ্ধেশ্বর অনুরাগী-বন্ধু-পরিজনই, অতএব, শেষপর্যন্ত, হয়ে ওঠেন আমাদের নমস্য। যাঁদের সাহায্য-সহযোগিতায়, অবশেষে বিষয় হিসাবে সিদ্ধেশ্বর সেন গ্রন্থবদ্ধ হয়ে প্রকাশ পেল। মফস্বল থেকে প্রকাশিত একটি ছোট কাগজের মধ্য দিয়ে যদি একজন পাঠকও সিদ্ধেশ্বর সেনের সৃষ্টির আলোকে আলোকিত হয়ে, তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তাহলে মনে করবো আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা রাখবার জায়গা, হয়তোবা, একটুকুও পাওয়া গেল।
৬
এই লেখাটিতে আমরা এ পর্যন্ত যা-কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছি তার সবই পাওয়া যাবে ‘স্বকাল’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটিতে। নীচে সংকলিত শঙ্খ ঘোষের পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধটিও নেওয়া হয়েছে এ সংখ্যাটি থেকেই।
সিদ্ধেশ্বর সেনের ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়েই প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
৭
বটপাকুড়ের ফেনা
শঙ্খ ঘোষ
‘মানুষ/ কখন তার গহনে ফিরে যাবে’
বহুদিনের পুরোনো একটা দীর্ঘ শ্রমময় দুপুরের কথা মনে পড়ে। দুজনে মিলে সাজাইবাছাই করে একটি কবিতাবইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে তুলছি, আমি আর আমার অগ্রজ এক বিশিষ্ট কবি।
একজন প্রকাশক একটি কবিতার বই ছাপাতে চাইলে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম : ‘এতদিন ধরে কবিতা লিখছেন সিদ্ধেশ্বর সেন, তাঁর কোনো বই কেন ছাপছেন না আপনারা?’ আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সেই প্রকাশক – অরুণ প্রকাশনীর বিকাশ বাগচী – সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন: ‘পাণ্ডুলিপি কোথায়? এনে দিন, এক্ষুনি দেব ছেপে।’
সিদ্ধেশ্বর সেনের তখন ছেচল্লিশ বছর বয়স, তারও আগে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কবিতা লিখছেন তিনি। ‘আমার মা-কে’ নামের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে খ্যাতি পেয়েছেন প্রথম যৌবনেই, তাঁর কবিতার ভাষা আর ছন্দ নিজস্ব একটা কাঠামো পেয়ে গেছে বহুদিন আগে, স্বতঃপ্রকাশ তাঁর স্বতন্ত্র স্বর, কবিতাসমাজে অগোচর নন তিনি। নানা পত্রিকায় লেখা ছাপাও হয় নিয়মিত এবং প্রচুর। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর কোনো কবিতার বই নেই এই ছেচল্লিশ বছর বয়সেও। জিজ্ঞেস করলে অসহায় ভঙ্গিতে অপ্রস্তুত মুখে থম্কে থম্কে বলেন : ‘কবিতার বই – থাকা তো দরকারই ভাই। কিন্তু জানেন তো, প্রকাশক – কবিতার বইয়ের তো প্রকাশক – ছাপতে তো চায় না কেউ – কোথায় পাওয়া যাবে।’
তাই ওই বিকাশবাবুর কথা শুনে মনে হলো যেন বিশ্বজয় ঘটে গেছে। সানন্দে কবির কাছে পৌঁছে দিই খরটা, দাবি করি তাঁর পাণ্ডুলিপি। তিনিও বেশ খুশি হয়ে ওঠেন : ‘বেশ, তাহলে দুজনে মিলেই করে ফেলা যাবে, কাজটা?’
দুজনে মিলে কেন? কেননা এর খানিকটা সন্ধানপর্ব আছে। তাঁর কিছু কিছু মুদ্রিত কবিতার হদিশ নেই নিজের কাছে, অথচ প্রথম কবিতার বইটিতে সেসব না থাকলেও নয়, খুদে পত্রিকা থেকে খুঁজে বার করতে হবে তাদের। শুরু হলো তাই খোঁজ, বেশ ফুর্তি নিয়েই শুরু হলো কাজ, তারপর এক দীর্ঘ দুপুর জুড়ে আমাদের একটা ঘরে বসে সাজাইবাছাই হলো সব লেখার। তৈরি হলো পাণ্ডুলপি।
প্রকাশক কদিন ধরে তাড়া দিচ্ছিলেন আমাকে, কেননা সিদ্ধেশ্বর সেনের সঙ্গে তাঁর তখনও দেখা হয়নি। আমিও তাঁকে ভরসা দিয়েছি যে অচিরেই তাঁর হাতে পৌঁছে যাবে সব। আজ এই বিকেলবেলায় মনে হলো যে সফল হতে চলেছে এতদিনকার চেষ্টা আর প্রতীক্ষা। বাড়ি ফিরবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন সিদ্ধেশ্বর সেন, বেশ তৃপ্ত তাঁর মুখ, গোছানো পাণ্ডুলিপিটি তাঁর হাতে।
জিজ্ঞেস করি : ‘ওটা তো এখন আমার কাছেই থাকবে? কাল তো দিয়ে দেব প্রকাশককে?’
‘হ্যাঁ, সে তো ঠিক, কিন্তু কী জানেন, দেবার আগে বাড়িতে বসে, আরেকবার সবটা দেখে নিলে হয় না? দেবার আগে একবার?’
কথাটা সংগত। যাঁর কবিতার বই, নিরালায় তাঁর নিজের একবার দেখে নেওয়াই উচিত। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটা উদ্বেগ থাকেই যে-কোনো কবির, তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে। হয়তো মনে হতে পারে পারম্পর্যে কোনো বিন্যাসবদলের কথা, হয়তো মনে হলো কোনো কবিতার বর্জন বা ভিন্ন কোনো লেখা গ্রহণেরও কথা। একটু তো নিশ্চয় হাতে রাখা চাই। তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে বলি : তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন কবে? পরশু? প্রকাশককে কী বলব?’
‘পরশু? হ্যাঁ, পরশু হতে পারে। আচ্ছা ভাই, বরং আরেকটা দিন হাতে থাক। আচ্ছা, পরশুর পরের দিন।’
‘আপনিই দিয়ে যাবেন?’
‘আমিই তো দেব। আর কে দেবে ভাই? আপনি চিন্তা করবেন না, আমি নিজেই দিয়ে যাব।’
চলে গেলেন সিদ্ধেশ্বর সেন। আমার ক্ষীণ আশঙ্কাকে প্রবল সত্য করে তুলে তার পরে তিনি উধাও হয়ে গেলেন একেবারে! বিকাশবাবু থেকে-থেকেই জিজ্ঞেস করেন : ‘কী হলো সেই পাণ্ডুলিপির?’ সংগত কোনো জবাব দিতে পারি না তার। প্রথমে দিনের পর দিন, তারপর মাসের পর মাস, তারপর বছরের পর বছর কেটে যায়, ‘গগনে গগনে পলাতক আলো-ছায়া’, পাণ্ডুলিপিটির ভরসা করি না আর, প্রকাশকও আর জিজ্ঞেস করেন না কিছু।
এমন সময়ে, বেশ কয়েক বছর পরে একদিন, তাঁর একটু বেশি-বয়সের-বিয়ের আসরে পত্রাহ্বান পেয়ে গিয়েছি যখন, বরসাজে তিনি এসে হাত ধরলেন আমার, বললেন : ‘ভাই, হলো কী, সেই যে পাণ্ডুলিপিটা, কী হলো জানেন –’
তাঁর কুণ্ঠাকে নিরস্ত করে বলি : ‘সে-কথা এখন থাক। আপাতত বিয়েটা অন্তত ঠিকমতো হয়ে যাওয়া ভালো।’
সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতার বই যে তার পরে আর বেরোয়নি কখনো, তা নয়। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সংশ্লিষ্ট তাঁর অনুগামীরা, প্রধানত অরুণ সেন, তাঁকে খানিকটা এড়িয়ে এড়িয়েই, ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন দেড় ফর্মার একখানা বই ‘ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড়’, চুয়ান্ন বছর বয়সে সেই তাঁর প্রথম কবিতার বই। তার পরের বইমেলায় ‘পরিচয়’-এরই চেষ্টায়, স্বাভাবিক মাপমতো একখানা বই বেরোল ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা ১’। মেলার স্টলের সামনে সে-বই হাতে নিয়ে তাঁর ঈষৎ-প্রসন্ন ঈষৎ-অপ্রস্তুত আর ঈষৎ-অনিশ্চিত মুখ – কখনো ভোলা যায় না সেই ছবি। যেন অন্য কারো বই ধরে আছেন তিনি, হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখছেন মুগ্ধভাবে।
এ-রকমও তো হয়। এই কলকাতা শহরেই, সিদ্ধেশ্বর সেনের মতো এমন আপনভোলা একজন কবিও তো ঘুরে বেড়ান। একবার লিখেছিলেন এই কবি : ‘আমি ঠিক নিশ্চিত করে জানি না/ মানুষ/ কখন তার গহনে ফিরে যাবে।’ সমস্ত দ্বন্দ্ব ক্ষোভের মাঝখানে সেই গহনে নিজের মনকে স্থির রাখেন সিদ্ধেশ্বর সেন আর দেখেন :
চলার যেমন ছন্দ
যতি ও গতিরবলার যেমন অনায়াস
স্পন্দশ্বাসের প্রশ্বাসের স্বাভাবিক মানুষের
জীবনেরআবার জীবনেরই ছন্দ ফিরিয়ে আনার
উৎক্রান্তিকবিপ্লবীরই ছন্দ, যা শিল্পীরও
স্রষ্টারও– লেনিনের বিপ্লবের যেমন বিজ্ঞান যেমন
আবার শিল্পও –রূপান্তরে সামাজিক দ্বন্দ্বের উত্তরণের
ছন্দ
উত্তরণের সেই ছন্দের জন্য অনেকদিন ধরে প্রতীক্ষা করে থাকতে পারেন সিদ্ধেশ্বর সেন, চুয়ান্ন বছর বয়সে তাই তাঁর দেড় ফর্মার প্রথম কবিতার বই বেরোয় ‘ঘন ছন্দ মুক্তির নিবিড়’।
কবি প্রয়াণ, দক্ষিণের জানালা
নীলরতন সরকার হাসপাতালের ছোটো একটা কেবিন, ছ’তলার এক কোনায়। দক্ষিণদিকের বড়ো জানালা দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। রোগশয্যায় শুয়ে আছেন সিদ্ধেশ্বর সেন। এতটাই জীর্ণ যে চিনতে পারা শক্ত। কিন্তু ডাক্তারেরা বলছেন কোনো বিপদের ভয় নেই এখন আর, কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়েও দিতে পারেন তাঁরা। কিন্তু ছাড়া উচিত হবে কি? জিজ্ঞেস করেন ওঁরা। ঠিকমতো দেখাশোনা করবার মতো আছেন কি কেউ কোথাও? তার চেয়ে কিছুদিন বরং এখানে হাসপাতালে থাকাই ভালো, আরোগ্যকালীন শুশ্রূষার জন্য।
ভেবেছিলাম কথা হবে না, বা হলেও তা কেবল চোখে চোখে। কিন্তু তা নয়, নির্জন ঘরে একজন কাউকে পেয়ে গেছেন বলে হাত জড়িয়ে নিয়ে কথা বলাতেই দেখা গেল ঝোঁক। কত-যে খুশি হয়েছেন সে-কথা জানাবার পর ঘোরের মধ্যে বললেন একবার – ‘পায়ের দিকের খোলা জানালায় তাকিয়ে – ‘ওই-যে একটা নদী না?’ ‘হ্যাঁ, নদীই তো, আকাশগঙ্গা।’ ‘এখানে বড়ো একা লাগে, জানেন।’ ‘একা কোথায়? এমন একখানা নদীই যখন সঙ্গী?’ হেসে বলেন, ‘তা ঠিক তা ঠিক।’
‘লিখতে ইচ্ছে করছে না কিছু?’
‘না, কিছু না।’
‘সে কী। এখন তো শুয়ে শুয়ে অনেকটাই লেখা হয়ে যাবে।’
‘কখনো একটা-দুটো শব্দ মনে আসে, জানেন? কিন্তু হারিয়ে যায় আবার। মনে করতে পারি না কিছু।’
‘দেখবেন, পরে আবার মনে পড়বে।’
‘না, আর কি তা হবে?’
‘পুরোনো লাইন মনে পড়ছে না?
মুক্ত
অন্তর-চেতনা
বন্ধ
আমার সমন্ত বহির্দেশ –
মনে পড়ছে?’
হাসলেন একটু। ধরাই আছে হাতটা।
ঘরে ঢুকলেন একজন। হাতে তাঁর ছোটো একটা মিষ্টির কৌটা। জিজ্ঞেস করলেন : ‘খাবেন একটু?’
ভাবছি নীরব প্রত্যাখ্যানই করবেন হয়তো-বা। কিন্তু না, বেশ আগ্রহেই চেয়ে নিলেন সেটা, খেয়ে নিলেন সহজে।
আবারও আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘণ্টাখানেক পরে বেরিয়ে এসেছি পথে। ডাক্তারেরা বলেছেন ভয়ের কারণ নেই। কথা শুনেও তো মনে হলো সেইরকমই। নিশ্চিন্ত লাগছে একটু।
একুশে এপ্রিল রাত এগারোটায় ফোন করে জানালেন একজন : অল্প আগে চলে গেছেন সিদ্ধেশ্বর সেন। সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রথম যৌবন থেকে অবিরতই কবিতা লিখেছেন যিনি, কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে যাবার পরও যিনি তাঁর নিজের পছন্দমতো কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে উঠতে পারেননি; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, প্রবীণ কবির অগোচরেই যাঁর দু-চারজন অনুজ সুহৃদ প্রকাশ করে দিয়েছেন তাঁর বই; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, যিনি অনেক অনুনয় করে মধ্যরাতে প্রেসের দরজা খুলিয়েছেন কবিতার একটা-কোনো কমা ঠিক করে দেবার জন্য; সেই সিদ্ধেশ্বর সেন, যিনি বালকোচিত উদ্বেগে বঙ্গসংস্কৃতি-সম্মেলনের অন্ধকার কোনো কোণে বিলাপ করছেন যে তাঁর তৈরি একটা ইমেজ ব্যবহার করে দিয়েছেন অন্য এক তরুণ, তাহলে তাঁর কী হবে? কোনো কথাই কখনো সম্পূর্ণ করে উঠতে পারতেন না যিনি, নির্দিষ্ট কোনো সময়ে কোথাও যিনি পৌঁছতে পারতেন না কখনো, কিছু একটা করে ফেলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেবার পর তার অমোঘ ব্যর্থতায় সরল অপ্রতিভ মুখে যিনি বলতে পারতেন, ‘এবারে আর হয়ে উঠল না, জানেন’ – বিভোর সেই আপনভোলা কবি-মানুষটির শারীরিক অবসান হলো হাসপাতালের কেবিনে, অন্য কোনো বস্ত্রাভাবে হাসপাতালেরই সবুজ চাদরে মুড়ে দেওয়া। রাত্রিবেলার খোলা জানালায় তখন – ‘যেখানে তোমার আমার সাযুজ্য, সত্তা’ – সেইখানে
তারা
কত তারা তব আকাশে
আকাশের খচিতপ্রান্তর জুড়ে জুড়ে কত যুগ
নির্নিমেষ, তারা …
কিংবা ধরা যাক কোনো প্রতীক্ষার গান, ‘প্রলয়ের আগে পরে’, যেখানে আছে :
আমার সর্বস্ব খুইয়ে গ্রাস করে নিতে পারত
যে
প্রবল বিগলিত টান
আমার সমস্ত ইচ্ছা, তীব্রতা রক্ত-কোলাহল
যখন
তার শীতল নখাগ্রে, শূন্যতায় থেমে যেতে
চেয়েছিল,
নিশ্চিহ্ন হয়ে উপরে যেতে, তলিয়ে
গেল না স্থিতি কেন
ধরে রাখলে
তার নাগাল পাওয়া গেল না যদি, পাওয়া
যাবে না কি কোনো কালে
— জানা নেই
সেই কবি সিদ্ধেশ্বর সেনের প্রয়াণ হলো একুশে এপ্রিল, রাত্রিবেলায়, হাসপাতালের নিঃসঙ্গ কেবিনে, পায়ের কাছে দক্ষিণ দিকের খোলা জানালার ধারে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
ইয়াসমিন জাহান নূপুর - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ)
দীর্ঘদিন পর একটা চমৎকার লেখা পড়লাম।
কবি সিদ্ধেশ্বর সেনের স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
তাঁর “আমার মা-কে” কবিতাটি পড়তে চাই, কোথায় পাব জানাবেন।
রেজাউল করিম সুমন - ২২ এপ্রিল ২০০৯ (১১:২৩ অপরাহ্ণ)
শঙ্খ ঘোষের ‘বটপাকুড়ের ফেনা’ লেখাটা সত্যিই চমৎকার।
“আমার মা-কে” তোমার জন্য ফটোকপি করে রাখব।
মুয়িন পার্ভেজ - ২১ এপ্রিল ২০০৯ (৩:৫৮ অপরাহ্ণ)
রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ, জ্যেষ্ঠ কবির প্রতি নান্দনিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে । দেবেশ রায় ও শঙ্খ ঘোষের পুনর্মুদ্রিত কিন্তু প্রাসঙ্গিক রচনায় ফুটে উঠেছে কবি সিদ্ধেশ্বর সেনের হিমাদ্রিপ্রতিম একাগ্রতার পরিচয় । বই ছাপানোয় সিদ্ধেশ্বর সেনের আন্তর অনাগ্রহ মূলত সিদ্ধি অর্জনেরই এক পন্থা – কবি রবার্ট ফ্রস্টের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় – যা বহু নগদমূল্যকামী তরুণ কবির বিপরীতে এক ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত। প্রকৃত কবিরই তো থাকে জীবনানন্দ-কথিত ‘একা একা পথ হাঁটার’ স্বস্থ আবেগ ।
রেজাউল করিম সুমন - ২২ এপ্রিল ২০০৯ (১১:৫৭ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ, মুয়িন।
সিদ্ধেশ্বর সেনের বই প্রকাশে যেমন উদ্যোগী হয়েছেন বারবার, তেমনি তাঁর কবিতা নিয়ে ক্ষান্তিহীনভাবে আলোচনাও করেছেন অরুণ সেন। ‘পুরাণকল্পে পুনর্বার’ পড়ার পর তাঁর মাধ্যমেই সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতার স্বতন্ত্র স্বরের সঙ্গে এবং পরে কবির সঙ্গেও পরিচিত হতে পেরেছিলাম। ‘স্বকাল’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটির খোঁজও তাঁর কাছ থেকেই পাই। পত্রিকাটি বাংলাদেশে সুলভ না হতে পারে, এই বিবেচনায় এর একটি কপিও তিনি আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন! এই সুযোগে অরুণবাবুর প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
রাজীব দত্ত - ১৩ অক্টোবর ২০১৪ (১:৩৯ অপরাহ্ণ)
কোন প্রকৃত কবির জীবন প্রকৃতই ব্যর্থ হয় না। সমসাময়িক কালের আধাঁরিমা হয়তো তাকে ঢেকে রাখে, হয়তো কোলাহলের বিভীষিকায় তিনি গোপনে, নিভৃত অন্তরালে চলে যান। চুপিচুপি। কাওকে না জানিয়ে।নীরব অভিমানে। তারপর একদিন এইসব কোলাহল, আতসবাজির আলোর কারসাজি ফুরিয়ে গেলে তাঁর কাজ স্বমহিমায় আমাদের কাছে প্রকাশ পায়। যেমন পেয়েছেন ইংরাজ কবি ব্লেক, আমাদের জীবনানন্দ। সারা পৃথিবী জুড়ে এমন উদাহরণ অনেক আছে, এ তো আমরা অল্প বিস্তর সকলেই জানি। আমাদের বিশ্বাস, কবি সিদ্ধেশ্বর সেনও তেমনই একজন শক্তিমান কবি। অনেক সমস্যার মধ্যে তাঁকে নিয়ে আমরা এই সংখ্যা করেছিলাম এক ব্যক্তিগত দায় অনুভব করে। বিশ্বাস ছিল একদিন সিদ্ধেশ্বর সেন প্রাসঙ্গিক হবেনই বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে। সুদূর ওপার বাংলায় তাঁকে নিয়ে আপনাদের আগ্রহ আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় করল, স্বকালের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আর যাঁর নানান অবদানের জন্য এই কবিকে নিয়ে কাজটি আমরা প্রায় সম্পূর্ণ করতে পেরেছি, আমাদের কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষ অরুণদাকে প্রণাম, এক্ষেত্রেও তিনি পশ্চিমবাংলার মফস্বল গ্রামের এই পত্রিকাকে ওপার বাংলার প্রকৃত সাহিত্য রসিকদের কাছে পৌঁছেদিলেন। স্বকাল পত্রিকার সিদ্ধেশ্বর সেন সংখ্যাটির প্রতি যদি কারও আগ্রহ থাকে তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আপনাদের কেউ এসে থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমন্ত্রণ রইল।
রেজাউল করিম সুমন - ২০ অক্টোবর ২০১৪ (১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ)
ভাই রাজীব দত্ত,
কবি সিদ্ধেশ্বর সেন আমাদেরও প্রিয় কবি। ক’দিন আগেই আমাদের এক বন্ধু তাঁর বইয়ের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু খোঁজাখুঁজিই সার, একটা বইয়েরও হদিস মিলল না। বেশ ক’ বছর আগে প্রতিক্ষণ থেকে বেরোনো ‘সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতা’ই আমার দেখা তাঁর শেষ কবিতার বই (সংকলন)। এর পরেও কোনো বই বেরিয়ে থাকতে পারে নিশ্চয়ই। শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায় ও অরুণ সেন বিভিন্ন সময়ে তাঁর বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। এখন দরকার তাঁর একটা কবিতা-সমগ্র। অবশ্য সেইসঙ্গে তাঁর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গদ্যরচনাগুলিকেও দুই মলাটের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার।
আপনাদের ‘স্বকাল’ পত্রিকার সিদ্ধেশ্বর সেন সংখ্যাটির আরো একটি কপি সংগ্রহ করতে চাই। ওই গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাটি নিশ্চয়ই কবিতাপ্রেমীদের হাতে পৌঁছেছে।