ভার্চুয়াল কমিউনিটির সত্তা অন্বেষণ

আজকাল চেনা পরিচয়ের পরিধিটা মুখোমুখি ও লৌকিক না হয়ে ভার্চুয়াল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে মানবিক সম্পর্কবোধের স্পর্শ প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও তার প্রত্যক্ষ স্পর্শটা ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত। শহুরে জীবন ধারাকে “ইটের পর ইট, মাঝে শুধু মানুষের কীট” বলে সংজ্ঞায়িত করে এর নৈর্বক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করার চেস্টা বিফল হয়েছে। পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু তাকে অস্বীকার করার জো নেই। এখন ভার্চুয়াল কমিউনিটি গড়ে উঠছে অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের আশীর্বাদে। কিন্তু ভার্চুয়াল কমিউনিটির স্বত্বা অন্বেষণ ও এর পরিসীমা নির্ণয় গবেষণাযোগ্য বিষয় হলেও তার মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথেস্ট অস্পস্ট।

অস্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থায় যে গুণগত ও পরিমাণগত বিপ্লব এনেছিল তার সমান্তরালে একবিংশ শতাব্দীর তথ্য ও প্রাযুক্তিক বিপ্লব চলমান সমাজের চরিত্র ও সম্পর্কের মধ্যে যে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এনেছে তার চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ এই ভার্চুয়াল কমিউনিটির ধারায়। আপনি চেনেন না, জানেন না, হয়তো কখনো মানুষটির সাথে আপনার মুখোমুখি দেখাও হবে না, তারপর মনে হয় ব্যক্তিটি আপনার খুব কাছের। আপনি মানুষটিকে চেনেন অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের পাতায় তার লেখার অক্ষরে ও প্রকাশে। আমাদের ভাবনাগত সাযুজ্যতার সন্ধান হঠাৎ করে গুগলের সার্চ ইঞ্জিনভিত্তিক হয়ে উঠল। ফেইসবুক, মাইস্পেস আর হাইফাইভের সুবাদে আসল মানুষটি হঠাৎ করে ভার্চুয়াল মানুষে পরিণত হলো। তাকে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করেন। তার চলাচল ও গতিবিধি আপনার নখদর্পণে, অন্তত: আপনার ব্রাউজারের পর্দায় ভেসে উঠছে। ভাল লাগা, খারাপ লাগা, কস্ট পাওয়া, আনন্দ পাওয়া-সবই কীবোর্ডের অক্ষরের স্পর্শে প্রকাশিত ও প্রতিফলিত হচ্ছে।

ভার্চুয়াল কমিউনিটির এই বিস্ফোরণের ফলাফল শিল্প বিপ্লবের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই পরিবর্তিত ধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। হঠাৎ করে আমাদের চেনা-শোনা-জানার পরিধি ভিন্ন মাত্রায় নির্ণিত হচ্ছে। এর সুফল বা কুফল নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু এই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ঠেকানো যাবে না। সমাজের ফেব্রিক সত্যি সত্যি বদলাচ্ছে। ছাপার অক্ষর জায়গা করে নিচ্ছে অন্তর্জালের অক্ষর। কাছের মানুষের অবয়ব বিবর্তিত হচ্ছে কম্পিউটার জেনারেটেড আভাটারের যান্ত্রিক প্রকাশে। সময় আর দুরত্বের ব্যবধান একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে। টোকা দিলেই হচ্ছে কথা। সুখ-দু:খের ভাগাভাগি চলছে। আনন্দ-বেদনার কথা কীবোর্ডের হরফে জমে উঠছে। এধরণের ভার্চুয়াল কমিউনিটি কি মানবিক স্বত্বা হারাচ্ছে? মানুষের যূথবদ্ধতা হয়ে উঠছে কি পুরোপুরি রোবটিক  বা যান্ত্রিকতায় অন্তরীণ ?

রোবটিক বা যান্ত্রিক মানুষ সত্যি কি নেতিবাচক? মানবিক গুণবোধ বিসর্জিত? আবেগহীন? নিরাসক্ত? নৈর্বক্তিক? আপাতত দৃস্টিতে তাই মনে হয়। কিন্তু আমরা একটা কথা বারবারই ভুলে যাই আমাদের বেড়ে উঠার গল্প। মায়ের কোলে, বাবার স্নেহে, দাদা-দাদী, নানা-নানীর মমতায়। স্নেহের আবেশে। শ্রদ্ধা, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা, দয়া, দাক্ষিণ্য-এগুলো কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমরা ধারণ করেছি? দরজায় কড়া নাড়ছে ভিখিরী। মা ছেলের হাতে এক কাপ চাল দিয়ে দরিদ্র ভিখিরীকে দিতে বলছেন। অসুস্থ প্রতিবেশীকে দেখার জন্য পথ্য নিয়ে বাবার সাথে পাশের বাড়ীতে যাওয়া। দাদুর কাছে বসে ডাইনী বুড়ীর গল্প শুনতে শুনতে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। এগুলো সবই আমাদের বেড়ে উঠার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাদের সামাজিকীকরণের এই চিরায়ত ধারায় একটা ছন্দপতন ঘটছে, এখানে একটা লৌহদেয়াল উঠে দাঁড়াচ্ছে- প্রযুক্তিগত ব্যবধানের আশীর্বাদে।

এখন যান্ত্রিকতায় বেড়ে উঠা ভার্চুয়াল কমিউনিটিতে এধরণের সামাজিকীকরণের সমূহ সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকলেও প্রযুক্তিগত ও প্রজন্মগত ব্যবধান তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের এই নতুন ফেব্রিক বা বুনন হঠাৎ করে আটকে আছে প্রাচূর্য আর প্রাপ্তির নতুন সংজ্ঞায়। ডিএস আর পিএস হঠাৎ করে নবীনদের হাতের গেজেট হয়ে উঠছে। এতেই নেশার মতো বুঁদ হয়ে আছে। অন্তর্জাল আর টিভি শো এখন সামাজিকীকরণের অঘোষিত অথচ স্বীকৃত অভিভাবক। নিজেরাই নিজেদেরকে অন্তরীণ করছি। যে প্রযুক্তি আশীর্বাদ আনতে পারতো তা হঠাৎ করে আমাদের মানবিক সম্পর্কবোধকে গ্রাস করছে। বাবা-মা, দাদা-দাদী-নানা-নানীর সাহচর্য এখন অতোটা কাছে টানে না। এখানে বিদ্যাসাগর, রোকেয়া, তিতুমীর, নজরুল, রবি ঠাকুরকে আর মানায় না। বড্ডো সেকেলে লাগে। রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, ভাঁওয়াইয়া, লোকগীতি বড্ডো অচল মনে হয়। এর আবেদনও হারিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু খোয়াতে বসে আজকের আমাদের এই ভার্চুয়াল কমিউনিটির অবয়ব নিয়ে ভাবার খুব প্রয়োজন। রোগ নির্ণয় না করতে পারলে চিকিৎসা হবে কিভাবে? সমাজ বদলায় ভাবনার হাত ধরে, সেই নতুন ভাবনাকে নিজস্ব ছকে আঁকার বড্ডো প্রয়োজন।

রায়হান আহমদ

থাকি আমেরিকার ডিসি মেট্রোতে পটোম্যাক নদীর খুব কাছে। অবসরে পড়ি ও লিখি। কর্মস্থল ওয়াশিংটন ডিসি'তে। মনিটরিং, মূল্যায়ন ও তথ্য বিশ্লেষণে জড়িত পেশাগত কারণে। প্রিয় বিষয় হচ্ছে সামাজিক উন্নয়ন, শিশু কল্যাণ, সমাজ, রাজনীতি ও মানবাধিকার।

১ comment

  1. রায়হান রশিদ - ১৮ এপ্রিল ২০০৯ (৩:২৮ অপরাহ্ণ)

    দুঃখিত একটু দেরী হয়ে গেল লিখতে। এই বিষয়ে ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে বেশ কিছু দিন আগে ক্রিস্টিন রোজেন এর একটা মজার লেখা পড়েছিলাম। এখানে। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃত করছি:

    it’s an easy way to set oneself apart. Pharaohs and kings once celebrated themselves by erecting towering statues or, like the emperor Augustus, placing their own visages on coins.
    . . .
    The Delphic Oracle’s guidance was, “Know thyself.” Today, in the world of online social networks, the Oracle’s advice might be, “Show thyself.”

    কথাটি বলা হয়েছে নিয়ত মশগুল কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত সৌধ নির্মাণের আত্মপ্রেমী (narcissistic) এবং প্রদর্শনপ্রিয় (exhibitionistic) প্রবণতার কথা বলতে গিয়ে। সোশাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলো সমাজের বুকে আমাদের অবস্থান/ভূমিকা নিরূপন করার ক্ষমতাকে কোনভাবে প্রভাবিত (কিংবা রহিত) করে কিনা, লেখক সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে লিখেছেন:

    But does this technology, with its constant demands to collect and manage our friends and to relentlessly market ourselves, in some ways undermine our ability to achieve what it so boldly promises to give us – a surer sense of who we are and where we belong?

    ফেসবুক কিংবা মাইস্পেস এর মতো কমিউনিটিগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত “ইগোকেন্দ্রিক বন্ধুতা” কিংবা মানবিক সম্পর্কবোধ বিষয়ে লিখেছেন:

    Social networking sites encourage a [kind of] of egocentric single-mindedness about friendship. Friendship in that world has become an online instant opinion poll – immediate gratification for the person casting his vote, perhaps, but discouraging of reflection beyond that initial snap judgment. This has already spawned a culture where many people have more “friends” than real friendships. The impulse to accumulate as many “friends” as possible on a MySpace page does not stem from a desire for connection, but instead is an expression of another deeply felt human need: the need for status.

    আরও লিখেছেন:

    With the advent of online social networking sites, we have embraced a medium to create status, not merely to commemorate the achievement of it. By creating a profile and gathering thousands of “friends,” we signal to others our importance.

    আমাদের সবারই মনে হয় লেখাটা পড়া দরকার।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.