যখন কালের বর্জ্যস্রোতে ভেসে যায় মানুষ, পুরোদেশ যখন ডুবে যেতে থাকে ডুবন্ত কোনো জাহাজের মত তখন স্রোতের ভেতর ডুবে যাওয়াই যেন এদেশের সাহিত্যিকদেরও নিয়তি। তেমনি নিয়তিকেই বরণ করে নিয়েছে এ দেশীয় সাহিত্যিক সম্প্রদায়। এদেশের প্রত্যেক সাহিত্য সেবিরাই এখন সাহিত্যের শত্রু [..]

সাহিত্য এমন এক কাণ্ড যার কোনো সীমানা নাই। বলা ভাল সীমানা মানে না। কারণ সাহিত্য হচ্ছে সবচে মৌলিক প্রার্থনা। কোথাকার এক হোমার তাঁর প্রভাব আজও বিদ্যমান। ওমর খৈয়ম, হফিজ, কিটস, ইএটস, এলিয়ট, কভাফির কবিতার প্রভাব আজও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথে, জীবনানন্দে। কারণ সাহিত্যের ব্যাপ্তি জগতের সকল বস্তুর ভেতর বিদ্যমান। ভাবের হাত ধরে ভাব ছড়িয়ে পড়ে নিরন্তর অভাবের সীমানাহীনতায়। কিন্তু যখন কালের বর্জ্যস্রোতে ভেসে যায় মানুষ, পুরোদেশ যখন ডুবে যেতে থাকে ডুবন্ত কোনো জাহাজের মত তখন স্রোতের ভেতর ডুবে যাওয়াই যেন এদেশের সাহিত্যিকদেরও নিয়তি। তেমনি নিয়তিকেই বরণ করে নিয়েছে এ দেশীয় সাহিত্যিক সম্প্রদায়। এদেশের প্রত্যেক সাহিত্য সেবিরাই এখন সাহিত্যের শত্রু। তারা সকলে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে কীভাবে বাংলাদেশী সাহিত্যকে সংকীর্ণ থেকে আরো সংকীর্ণ, স্থূল থেকে আরো স্থূলত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। এ অবস্থার জন্য শুধু লেখককুলের ওপর দোষারোপ করলে একচোখে দেখা হবে। আরো দায়ী ভাগ পরবর্তী যোগ-বিয়োগ। এ ব্যাপার নিয়ে কোনো তর্কই হতে পারে না যে বাংলাদেশীরা পঁয়ত্রিশ বছরের এক মেরুদন্ডহীন জাতি। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর এই জাতির ভেতর এমন একজন মানুষও জন্মাননি যাকে ঐতিহাসিক অনুকরণীয় চরিত্র বলা যেতে পারে। তাদের বড়জোর গ্যাংস্টার ও বিদেশীদের এজেন্ট বলা যায়। এরা সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম সবকিছুকেই বিকৃত করেছে। এদের কোনো সংস্কৃতি ছিল না। এখনো নাই। তলাকার কালো রাজনীতির প্রভাব পড়েছে সবখানে দুরারোগ্য রোগের উপসর্গ হয়ে। সবখানে একটা অদৃশ্য ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার জাল টানা আছে। এদেশের সাহিত্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মত কোনো ছোট কাগজের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। যে কারণে তারা প্রতিষ্ঠিত ধনী প্রকাশনাগুলোকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মত স্বাধীন কাজ করে যেতে পারছে। ষাটের দশকের সাহিত্য পত্রিকা কন্ঠস্বর সম্পর্কে পত্রিকাটির সম্পাদক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ গর্ব করে বলেন তিনি এদেশের সাহিত্যে নতুন একটি যুগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ষাটের এই পত্রিকাটিতে যারা লিখত তারা সবাই আজ তারকা। এ কথাটি সত্য কন্ঠস্বরে যারাই লিখত সবাই আজ তারকা, কেউ লেখক হননি। সকলেই প্রায় মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেম নিবেদন করার বাণী লেখা অনেক সহজ করে দিয়েছেন। এদের উপর মূলত প্রভাব পড়েছিল কলকাতার পঞ্চাশের লেখক গোষ্ঠীর। তাদের ওপর ছিল আমেরিকান বিট জেনারেশনের। পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় বিট গোষ্ঠীর হোতা গীন্সবার্গ এলে তাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাটার প্রভাব পড়ে…

খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর! ‘সবজিও মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে’-দৈনিক আমার দেশ। সর্বদাই যে তা নিম্নবিত্তের আওতার বাইরে ছিল? তা খবর নয়, তা ‘বাস্তবতা’। ‘বাস্তবতা’ খবর হয় না। মিডিয়ায়, রাষ্ট্রের দরবারে, শপিং মলে আর টেলিভিশনে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আঙিনায়, মধ্যবিত্ত নিজেকে নিয়েই মত্ত। আত্মপ্রেম এর ‘ধর্ম’। অধিকারগুলো তার, নীতিগুলো তার, সুখ-দুঃখগুলোও তার [...]

‘‘Man first sees and recognizes himself in other men’. ............Karl Marx খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর! ‘সবজিও মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে’-দৈনিক আমার দেশ। সর্বদাই যে তা নিম্নবিত্তের আওতার বাইরে ছিল? তা খবর নয়, তা ‘বাস্তবতা’। ‘বাস্তবতা’ খবর হয় না। মিডিয়ায়, রাষ্ট্রের দরবারে, শপিং মলে আর টেলিভিশনে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আঙিনায়, মধ্যবিত্ত নিজেকে নিয়েই মত্ত। আত্মপ্রেম এর ‘ধর্ম’। অধিকারগুলো তার, নীতিগুলো তার, সুখ-দুঃখগুলোও তার। সে শাসক নয়, কিন্তু মেকানিক্যালি রিপ্রোডিউসড selfএর বাজারে, নানান ক্ষমতাচক্রের 'ডীপ পলিটিকসের' গণতন্ত্রে সে-ই আজ রাজা। মধ্যবিত্ত ‘জনগণ’ নামক অদেখা-অধরা জনসমষ্টিকে তার 'আমিত্বের' ধামার নীচে ফেলে জনগণ সেজে বসে গেছে। জনগণের মধ্যে শ্রেণী আছে, শ্রেণীসংহতির মধ্যে নারী-পুরুষের নিজস্ব শ্রেণী আছে, জাত-পাত-সম্প্রদায় আছে, আঞ্চলিকতা আছে। এসব সরিয়ে মধ্যবিত্তের খোদায়ী প্যানঅপটিকন-সবখানে নিজের ছায়া দেখে, নিজেকেই জাতি ভাবে। সে পুরুষ বলে কেবলই ‘নিজের’ নারীর অধিকার নিয়ে চিন্তিত হয়। তাকে কেবলই ‘যৌন’ করে দিয়ে মুক্ত করতে চায়। আর ক্ষমতার এপার ওপার ভেদ মুছে দিয়ে যে ভেদে 'আত্ম'র বাসনা খুশি হয় এমন সব ভেদ খাড়া করে। খালি বর্গ করে, বর্গের বর্গমূলে 'আমি’ নামক প্রত্যয় খুঁজে পায়। আদিতে ঈশ্বর ছিলেন, আর এখন আছেন সর্বভূতেসু ‘আমি’। তাই ‘আমরা’ কেবল ‘আমি'র কথাই বলি। এই ‘আমি’ ও ‘আমরা’র সীমার ওপারে বাস করে কোনো এক ‘রসু খাঁ’। আমি ও আমরা নিশ্চিত, কোনো মহতাদর্শ দিয়ে আমাদের বলয়ে সিরিয়াল খুনী ‘রসু খাঁ’-কে নেব না মানব না। সবজির আওতার বাইরের নিম্নবিত্তের মানবেতর জীবন এবং তাদের থেকে আসা খুনীর বিকারগ্রস্থতা তাহলে কোথায় জন্মালো? সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাসের বাইরে তো সে নয়। ‘এই গোকুলে শ্যামের প্রেমে, কে না মজেছে সখী!’ সবারে বধিল যে, সে কি আমাদের গোকুলেরই সন্তান নয়? এই প্রশ্নের সিবিল মীমাংসা নাই। তাই রসু খাঁ-কে আমরা ফুকো সাহেবের ক্ষমতার আকার-বিকারের ব্যকরণে আর সবজির দামকে মার্কসের সংগ্রামী দুনিয়ায় পাঠিয়ে পরস্পরের চোখে নিশ্চিন্তে তাকাব। কিন্তু অজস্র নারীদের খুন ও ধর্ষণের পর সে যে নারীকে বউ করেছে, তার দিকে তাকাতে পারবে কি আমাদের সর্বদ্রষ্টা চোখ? তা পারবো না বলেই বাস করবো সেইসব গডফাদার, নেতা, শিল্পপতি, মিডিয়াশেঠ ও জেনারেলদের রাজত্বে। মিডিয়ায় তারা নায়ক বা খলনায়ক কখনো হন বটে, তাঁদের মানবত্তোর ঊর্ধ্বতনের আরশ কদাচ টলে না। রসু খাঁ-র কাহিনী উপভোগ শেষে, মনের ধর্ষকাম-মর্ষকাম…

বারাক ওবামা, আপনাকে অভিনন্দন জনাব। গতকাল পর্যন্ত আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল সুপারপাওয়ারের মনোনীত সিজার হওয়া। নোবেল শান্তি পুরস্কার এর থেকে বড় অর্জন নয়, কারণ প্রেসিডেন্ট না হলে আপনি এ পুরস্কার পেতেন না। পাশাপাশি সাম্রাজ্যের ক্রান্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাকে বলবান করতেই হতো স্বঘোষিত বিশ্ববিবেক নোবেল কমিটিকে [...]

১. বারাক ওবামা, আপনাকে অভিনন্দন জনাব। গতকাল পর্যন্ত আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল সুপারপাওয়ারের মনোনীত সিজার হওয়া। নোবেল শান্তি পুরস্কার এর থেকে বড় অর্জন নয়, কারণ প্রেসিডেন্ট না হলে আপনি এ পুরস্কার পেতেন না। পাশাপাশি সাম্রাজ্যের ক্রান্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাকে বলবান করতেই হতো স্বঘোষিত বিশ্ববিবেক নোবেল কমিটিকে। আমেরিকার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন ছিল একজন বিনয়ী সম্রাট ও একটি নোবেল। দুটো আজ এক দেহে লীন হলো। ২. রাজনীতিতে আপনার মহত্তম অবদান আশার পুনর্জন্ম ঘটানো। আপনি আশার ফেরিওয়ালা হয়েও একে একে ফিরিয়ে নিয়েছেন সেইসব প্রতিশ্রুতি যা আশাকে জাগিয়েছিল। আপনি বুশের বেইল আউটকে আরো বাড়িয়ে ওয়ালস্ট্রীটের লুটেরাদের নবযৌবন দিয়েছেন। আপনি বুশের হেরে যাওয়া যুদ্ধকে জেতাতে আগে সতের হাজার এখন আরো চল্লিশ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে পাঠাতে বদ্ধপরিকর। আপনি গুয়ানতানামো বে-র দোজখ এখনো বন্ধ তো করেনইনি, বাড়তি তৃতীয় দুনিয়ার গোপন কারাগারে নির্যাতন চালাবার বন্দোবস্ত করেছেন। আপনি মার্কিন দেশে নতুন স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচিকে অবহেলায় পরাজিত হতে দিয়েছেন। আপনি বুশের দলের সব দাবি আপসে মেনে নিয়ে নেকড়ের গায়ে হরিণের ছাল জড়িয়েছেন। আপনাকে ও নোবেল কমিটিকে তাই অভিনন্দন। ৩. আপনার শান্তির সন্ত্রাসের সশস্ত্র আহ্বান না ইরান, না তালেবান, না উত্তর কোরিয়া গ্রহণ করেছে। রুশ ভালুক পুতিন আপনার বন্ধুত্ব নেননি। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনে জবরদখল বসতি স্থাপন ও হত্যা বন্ধ করেনি। আপনি তার উপহাসের পাত্র। আপনি ইরান-ভেনেজুয়েলা-হন্ডুরাস ও মেক্সিকোয় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে আপনার প্রশাসনের ভূমিকাকে থামাননি। আপনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পারমানবিক বোমা তৈরিকে বৈধ করেছেন, সহযোগিতার জন্য চুক্তি করেছেন। পাকিস্তান ও বার্মার সামরিক জান্তা আপনার কাছ থেকে ছাড় পেয়ে আসছে। যখন বিশ্বে সত্যিই আরো মেরু দাঁড়িয়ে গেছে, তখন আপনি মাল্টিপোলার বিশ্বের নেতা হতে লেগেছেন। নোবেল কমিটি আপনার যে যোগ্যতার তালিকা দিয়েছে, সেসব আপনার গুণ নয় পরাশক্তির ব্যর্থতাজাত আপাত আপসপন্থা। আপসের আড়ালে ছুরির শান আপনার অবদান। ৪. জনতার আশাকে আহত করলেও আপনি পতনমুখী সাম্রাজ্যের আশাকে চাঙ্গা করেছেন। আমেরিকার একাধিপত্য আবার আসবে বলে আপনাকে নেতা করেছে পাশ্চাত্য। আপনি তাদের দিয়েছেন বাস্তব ভরসা আর এশিয়-আফ্রিকীয়-ল্যাটিনো এবং আরব মুসলিমদের সামনে দিয়েছেন রংদার বক্তৃতা। আপনার হাসিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় মানুষের, আপনার হাত নাড়ায় তারা তবু অভয় পেতে চায়। কারণ, তারা সত্যিকার আশা করার সাহস ভুলে গেছে। তারা…

ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত [...]

ত্রিশ-দশকে আবির্ভূত একদল শিক্ষিত মেধাবী কবির হাতে ‘স্থূলতা, মেকিত্ব ও প্রাকৃত আবেগ ছেড়ে বাঙলা কবিতা আলিঙ্গন করলো সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা ও রুচিশীলতাকে’ ((প্রসঙ্গ বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) ; মহাপরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের বাইরে প্রবাহিত হতে শুরু করলো বাংলা কাব্য-নন্দনের এক নবস্বাদধারা। যেখান থেকে বাংলা কবিতায় ‘আধুনিক’ যুগের ব্যাপকায়তন যাত্রাপাত। ক্ষুদ্রায়তনে ‘আধুনিক’ শব্দটির প্রয়োগ এর আগে মাত্র একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিল। সে ‘আধুনিকতা’ এবং ত্রিশের সূক্ষ্মতা, স্বাভাবিকতা আর রুচিশীলতাসূচক ‘আধুনিকতা’ এক নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি বাহিত হয়ে এখনো অবধি প্রবহমান যে ‘আধুনিকতা (উত্তর-আধুনিকতার কথা মনে রেখেই), তা মধুসূদনের নয়, ত্রিশের। ত্রিশের পাণ্ডবগণের জীবনবাদিতা ছিল ভিন্নরকম। ‘তাঁরা রাজনীতিনিরপেক্ষ, সমাজবিমুখ, ব্যক্তিবাদী কিন্তু জীবনবাদীও এ-অর্থে যে তাঁদের হাতেই বাঙলা কবিতা এই প্রথম স্বপ্নীল ভাবলোকের নিকুঞ্জ ছেড়ে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল জনজীবনের আনাচে-কানাচে, গৃহিণীর হেঁসেলে, গেঁদু মোড়লের সালিশী বৈঠক থেকে নগরীর ফুটপাত, অলিগলি এমনকি পতিতালয়ের নিষিদ্ধ প্রকোষ্ঠে। কিন্তু এত জীবনলগ্ন হয়েও এসব কবিতার অধিকাংশ নির্গত হয়েছে ব্যক্তিমানসের নিঃসঙ্গ অন্তর্লোক থেকে। এই নিঃসঙ্গতা আধুনিক বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে জাত; এই চেতনা যত না কবির স্বসৃষ্ট তারও চেয়ে বেশি বিনষ্ট সময় ও সমাজের দান।’ ((মধ্যদিনের জানালা, আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন, ১৯৯৭, ঢাকা)) --এই যে অস্থিরতার সাথে কবিতাকর্মীদের আত্যন্তিক সাক্ষাৎ ত্রিশ-দশকীয় গবাক্ষপথে; একটিমাত্র দশকান্তরে সেই অস্থির পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অস্থিরতর। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের পাশাপাশি ভারতভূমিতেও এ সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমনসব ঘটনাবলি সমুপস্থিত হয়েছে যে চল্লিশদশক আধুনিক ভারতবর্ষের সবচেয়ে কম্পমান, অনিশ্চয়তামণ্ডিত দুর্দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এর প্রতিক্রিয়া স্পর্শ করেছে লেখককুলকেও। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিঃসঙ্গ হয়েও বাইরে তাঁরা হয়ে উঠেছেন সঙ্গপরিবেষ্টিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কবিই যুক্ত হয়ে পড়েছেন বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনে। কবিতার বিষয় হিসেবে সময়, সমাজ, মানুষ, মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিক নৈসঃঙ্গ্যের চেয়েও বড়ো। লিখিত হয়েছে প্রচুর উচ্চকণ্ঠ স্লোগানও। আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) এই উত্তুঙ্গ আন্দোলনমুখর বিনষ্ট সময়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭)-এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবি আহসান হাবীব হিসেবে স্বয়ম্প্রকাশিত। সুতরাং ‘রাত্রিশেষ’-এর মূল্যায়নপ্রয়াস পুরোটাই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে, যদি না তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি সামনে নিয়ে আসা হয়। সেটা হবে অসঙ্গত এবং অযৌক্তিকও। এখানে কাজেই রাত্রিশেষের গান…

‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি পড়তে শুরু করার পর যখন কিছুদূর এগিয়ে গেলাম তখন এ উপন্যাসটিকে ঘিরে একটি সমালোচনা দাঁড় করানোর সাড়া জাগল মনে... এবং মনের মাঝে একখানি বাক্য গড়ে উঠল ধীরে, সাহিত্যের বিবেচনাতে – “এর আগে আর কোনো বাংলা উপন্যাস পড়তে গিয়ে এমন করে ভালো লাগেনি।” কিন্তু সংকোচে যেন আর এগিয়ে যেতে পারছি না, এই ভালো লাগা সে তো হলো, তারপর বক্তব্যের আয়োজনের সাধ নিয়েও কাজটি আর হয়ে উঠছে না। কাজটি থেমে আছে কেন? — উপন্যাসের প্রাসঙ্গিক বোধের বিকাশ নিয়োজন পায়নি কি আমার পাঠাভ্যাসে? এ উপন্যাসের যে মেয়েটি কুমুদিনী, সে মেয়েটির সত্তার যে বিশেষত্ব, তার চরিত্রের যে কোমলতা ভক্তি ও বেদনা, এবং পারিপার্শ্বিকতার বলয়ে যে নিস্তাপ ও প্রবলতাহীন জীবনপ্রসঙ্গ, যে বৈরাগ্যবিধুরতা, সময়ের যে নির্জনতা, নীতিসৌন্দর্যের সাধনার প্রত্যয় ও প্রাণময়তা — উত্তাল বিবেচনাময় ও শক্তিমান মানসিক প্রয়োগে অস্তিত্বের আবেদন উৎকণ্ঠিত ও উজ্জীবিত প্রেরণায় খোদাই করা হয়নি, (একটি পাতে তার অস্তিত্বের গোপনীয়তাকে দাগ টেনে বিধৃত কার হয়নি), এখানে একজন গুনী কবি তার গুনের চ্ছটায় একটি মানবিক সম্পর্ককে, সমাজের একটি বহু পুরাতন মৈত্রীর নারীপুরুষের বিবাহ

প্রসঙ্গের পরিচয় দিতে দিতে, তামার পাতের উপর আঙ্গুলে আঁকা তার গোপন দাগ—সম্পর্কের সাধনা ও বেদনাকে উপস্থাপন করেছেন — আর এভাবে ধরা পড়েছে সামাজিক ও আত্মিক নিযুক্ততার ও সম্পর্কের “যোগাযোগ”। কাহিনীর যে চরিত্রটি ঘটনার বেগ-ও-অনুসন্ধানকে সচলতা স্পন্দন ও স্থাপত্য দান করে, সে হলো : মধুসূদন, যার শক্তি-ও-ঐশ্বর্যের প্রতিভা একটি অতি নিবিড় মানসিক আন্দোলনে বিস্ময় ও বিস্তার পেয়ে, সম্পর্কের ঐশ্বর্যের জগতে ধীরে ধীরে নিজের অধিকারের বাসনার প্রবলতাকে আচরিত করতে থাকে, তার ঈর্ষা তার জীবনের মানসিক দুর্বলতার ও বুদ্ধি-বিষয়-ও-দায়িত্ব-গত সকল সবলতার দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করে। ‘তার সেই দাদা’ — কুমুদিনীর দাদা, যা “যোগাযোগ” উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যধন্য চরিত্র : এই বিপ্রদাস, যার আত্মনিবেদনে কুমুদিনীর মানসিক স্বচ্ছতা পারষ্পরিক আলাপে ও সম্পর্কের বেদনায় উদবোধিত এবং তার আত্মার নিবেদনের তপস্যা প্রতি মুহূর্তে দায়িত্ববান; তাকে উপন্যাসটির মনোগত কর্মপন্থার, কুমুদিনী ও মধুসূদন দুজনের জন্যই, কেন্দ্র বিবেচনা করা যায় — এ ক্ষেত্রে মধুসূদনের সত্তার উৎকেন্দ্রিকতা এবং কুমুদিনীর সত্তার কেন্দ্রমুখী মানসিক ভাবনা-বেদনা উপন্যাসের বিকাশ-ও-বন্ধনকে নিগূঢ় ও বিবৃত করেছে। তিনটি চরিত্রকে বিশেষ একটি পরিবেশে প্রত্যয় ও প্রসঙ্গের সাথে উপস্থাপিত যখন করা গেল তখন…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.