১. বারাক ওবামা, আপনাকে অভিনন্দন জনাব। গতকাল পর্যন্ত আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল সুপারপাওয়ারের মনোনীত সিজার হওয়া। নোবেল শান্তি পুরস্কার এর থেকে বড় অর্জন নয়, কারণ প্রেসিডেন্ট না হলে আপনি এ পুরস্কার পেতেন না। পাশাপাশি সাম্রাজ্যের ক্রান্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাকে বলবান করতেই হতো স্বঘোষিত বিশ্ববিবেক নোবেল কমিটিকে। আমেরিকার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন ছিল একজন বিনয়ী সম্রাট ও একটি নোবেল। দুটো আজ এক দেহে লীন হলো।
২. রাজনীতিতে আপনার মহত্তম অবদান আশার পুনর্জন্ম ঘটানো। আপনি আশার ফেরিওয়ালা হয়েও একে একে ফিরিয়ে নিয়েছেন সেইসব প্রতিশ্রুতি যা আশাকে জাগিয়েছিল। আপনি বুশের বেইল আউটকে আরো বাড়িয়ে ওয়ালস্ট্রীটের লুটেরাদের নবযৌবন দিয়েছেন। আপনি বুশের হেরে যাওয়া যুদ্ধকে জেতাতে আগে সতের হাজার এখন আরো চল্লিশ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে পাঠাতে বদ্ধপরিকর। আপনি গুয়ানতানামো বে-র দোজখ এখনো বন্ধ তো করেনইনি, বাড়তি তৃতীয় দুনিয়ার গোপন কারাগারে নির্যাতন চালাবার বন্দোবস্ত করেছেন। আপনি মার্কিন দেশে নতুন স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচিকে অবহেলায় পরাজিত হতে দিয়েছেন। আপনি বুশের দলের সব দাবি আপসে মেনে নিয়ে নেকড়ের গায়ে হরিণের ছাল জড়িয়েছেন। আপনাকে ও নোবেল কমিটিকে তাই অভিনন্দন।
৩. আপনার শান্তির সন্ত্রাসের সশস্ত্র আহ্বান না ইরান, না তালেবান, না উত্তর কোরিয়া গ্রহণ করেছে। রুশ ভালুক পুতিন আপনার বন্ধুত্ব নেননি। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনে জবরদখল বসতি স্থাপন ও হত্যা বন্ধ করেনি। আপনি তার উপহাসের পাত্র। আপনি ইরান-ভেনেজুয়েলা-হন্ডুরাস ও মেক্সিকোয় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে আপনার প্রশাসনের ভূমিকাকে থামাননি। আপনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পারমানবিক বোমা তৈরিকে বৈধ করেছেন, সহযোগিতার জন্য চুক্তি করেছেন। পাকিস্তান ও বার্মার সামরিক জান্তা আপনার কাছ থেকে ছাড় পেয়ে আসছে। যখন বিশ্বে সত্যিই আরো মেরু দাঁড়িয়ে গেছে, তখন আপনি মাল্টিপোলার বিশ্বের নেতা হতে লেগেছেন। নোবেল কমিটি আপনার যে যোগ্যতার তালিকা দিয়েছে, সেসব আপনার গুণ নয় পরাশক্তির ব্যর্থতাজাত আপাত আপসপন্থা। আপসের আড়ালে ছুরির শান আপনার অবদান।
৪. জনতার আশাকে আহত করলেও আপনি পতনমুখী সাম্রাজ্যের আশাকে চাঙ্গা করেছেন। আমেরিকার একাধিপত্য আবার আসবে বলে আপনাকে নেতা করেছে পাশ্চাত্য। আপনি তাদের দিয়েছেন বাস্তব ভরসা আর এশিয়-আফ্রিকীয়-ল্যাটিনো এবং আরব মুসলিমদের সামনে দিয়েছেন রংদার বক্তৃতা। আপনার হাসিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় মানুষের, আপনার হাত নাড়ায় তারা তবু অভয় পেতে চায়। কারণ, তারা সত্যিকার আশা করার সাহস ভুলে গেছে। তারা বিজ্ঞাপন ও রাজনীতির ভেদ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের চোখে এই শতাব্দীর প্রথম রাজনৈতিক বিশ্বনায়ক তো আপনিই! ধন্য আশা কুহকিনী!
৫. আপনি কিছু করেছেন বলে নয়, করবেন বলে পুরস্কৃত হয়েছেন। নোবেল কমিটি বলেছে, আমরা পুরস্কার দিয়েছি: ‘ইট ওয়াজ বিকজ উই উড লাইক টু সাপোর্ট হোয়াট হি ইজ ট্রাইং টু অ্যাচিভ।…ইট ইজ এ ক্লিয়ার সিগনাল দ্যাট ইউ ওয়ান্ট টু অ্যাডভোকেট দা সেম অ্যাজ হি হ্যাজ ডান।’ আন্তর্জাতিক রীতিনীতির জয়গান আপনি, আর নোবেল কমিটি অতীতের জন্য নয়, পুরস্কার দিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। আপনি শপথ নিলেন ২০ জানুয়ারি আর নোবেলের মনোনয়ন জমা পড়ার শেষ তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি। মাত্র দুই সপ্তাহেই আপনি নোবেলের যোগ্য হয়েছেন কমিটির কাছে। সাবাশ নোবেল কমিটির তেলেসমাতি!
৬. আপনি এ মুহূর্তে সবচেয়ে অমূল্য বিনিয়োগ। পরের বছর যখন আপনার ব্যর্থতাগুলো স্পষ্ট হবে, তার আগেই ‘ওবামাকাল্ট’ কে তুমুল করতে আপনাকে পুরস্কার দেওয়া হলো, কেননা পরের বছর আপনাকে নোবেল দেওয়া সত্যিই কঠিন হবে। ঠিক যে মুহূর্তে হেলথ সিস্টেম বিতর্কে আপনি পরাজিত, যে মুহূর্তে মার্কিন মুলুকে অলিম্পিক আয়োজন আপনার হাতছাড়া হওয়ায় জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে, সেই মুহূর্তে নোবেল শান্তি পদক ইব্রাহিমের ঈশ্বরের অলৌকিক বর। আপনি দুর্ভাগা বিশ্বে সৌভাগ্যের বরপুত্র. আপনাকে কুর্ণিশ সম্রাট।
৭. আর আমরা আবিষ্কার করলাম, ইরানের কোনো ব্লগার নন, গাজা গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মিগুয়েল ব্রকমান, কিংবা তৃতীয় দুনিয়ার কোনো সংগ্রামী নন, নাইজেরিয়ার কোনো পরিবেশবাদী কিংবা বার্মার কোনো সংগ্রামী পুরোহিত নন, নন মেধা পাটেকার কিংবা ইউঘুর নেত্রী রাবিয়া কাদির। পুরস্কার পেলেন বিশ্বসম্রাট স্বয়ং। বিশ্বে কি সত্যিই শান্তির চেষ্টা ফুরিয়ে গেছে? সত্যিই শান্তি কেবল যুদ্ধবণিকেরই রক্ষিতা আজ!
আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তবুও কম। কিন্তু আপনি যে আশার সমাধির খাদেম হতে চলেছেন, সেই সমাধিতে ইরাক-ফিলিস্তিন-আফগানিস্তানসহ অনেক দুর্মর আশার জলপাই বৃক্ষ শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। বুশ-ব্লেয়ার তাদের কুড়ালে কেটেছে আর আপনি বুশের দেওয়া মুকুটে পরলেন সেই মরাবৃক্ষের একমাত্র সবুজ পাতাটি_ যার নাম ছিল আশা।
আশার ব্যাপারি, আমরা কি তবে আশার অধিকারও হারালাম?
চৌখুপি থেকে বেরিয়ে দিকের মানুষ খুঁজি দশদিকে।