সাহিত্য এমন এক কাণ্ড যার কোনো সীমানা নাই। বলা ভাল সীমানা মানে না। কারণ সাহিত্য হচ্ছে সবচে মৌলিক প্রার্থনা। কোথাকার এক হোমার তাঁর প্রভাব আজও বিদ্যমান। ওমর খৈয়ম, হফিজ, কিটস, ইএটস, এলিয়ট, কভাফির কবিতার প্রভাব আজও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথে, জীবনানন্দে। কারণ সাহিত্যের ব্যাপ্তি জগতের সকল বস্তুর ভেতর বিদ্যমান। ভাবের হাত ধরে ভাব ছড়িয়ে পড়ে নিরন্তর অভাবের সীমানাহীনতায়।
কিন্তু যখন কালের বর্জ্যস্রোতে ভেসে যায় মানুষ, পুরোদেশ যখন ডুবে যেতে থাকে ডুবন্ত কোনো জাহাজের মত তখন স্রোতের ভেতর ডুবে যাওয়াই যেন এদেশের সাহিত্যিকদেরও নিয়তি। তেমনি নিয়তিকেই বরণ করে নিয়েছে এ দেশীয় সাহিত্যিক সম্প্রদায়। এদেশের প্রত্যেক সাহিত্য সেবিরাই এখন সাহিত্যের শত্রু। তারা সকলে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে কীভাবে বাংলাদেশী সাহিত্যকে সংকীর্ণ থেকে আরো সংকীর্ণ, স্থূল থেকে আরো স্থূলত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। এ অবস্থার জন্য শুধু লেখককুলের ওপর দোষারোপ করলে একচোখে দেখা হবে। আরো দায়ী ভাগ পরবর্তী যোগ-বিয়োগ।
এ ব্যাপার নিয়ে কোনো তর্কই হতে পারে না যে বাংলাদেশীরা পঁয়ত্রিশ বছরের এক মেরুদন্ডহীন জাতি। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর এই জাতির ভেতর এমন একজন মানুষও জন্মাননি যাকে ঐতিহাসিক অনুকরণীয় চরিত্র বলা যেতে পারে। তাদের বড়জোর গ্যাংস্টার ও বিদেশীদের এজেন্ট বলা যায়। এরা সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম সবকিছুকেই বিকৃত করেছে। এদের কোনো সংস্কৃতি ছিল না। এখনো নাই। তলাকার কালো রাজনীতির প্রভাব পড়েছে সবখানে দুরারোগ্য রোগের উপসর্গ হয়ে। সবখানে একটা অদৃশ্য ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার জাল টানা আছে। এদেশের সাহিত্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মত কোনো ছোট কাগজের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। যে কারণে তারা প্রতিষ্ঠিত ধনী প্রকাশনাগুলোকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মত স্বাধীন কাজ করে যেতে পারছে। ষাটের দশকের সাহিত্য পত্রিকা কন্ঠস্বর সম্পর্কে পত্রিকাটির সম্পাদক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ গর্ব করে বলেন তিনি এদেশের সাহিত্যে নতুন একটি যুগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ষাটের এই পত্রিকাটিতে যারা লিখত তারা সবাই আজ তারকা। এ কথাটি সত্য কন্ঠস্বরে যারাই লিখত সবাই আজ তারকা, কেউ লেখক হননি। সকলেই প্রায় মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেম নিবেদন করার বাণী লেখা অনেক সহজ করে দিয়েছেন। এদের উপর মূলত প্রভাব পড়েছিল কলকাতার পঞ্চাশের লেখক গোষ্ঠীর। তাদের ওপর ছিল আমেরিকান বিট জেনারেশনের। পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় বিট গোষ্ঠীর হোতা গীন্সবার্গ এলে তাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাটার প্রভাব পড়ে পঞ্চাশের লেখকদের ওপর। গীন্সবার্গকে যথাযতভাবে গ্রহণ করতে পারলে না হয় কথা ছিল। সাহিত্যে এবং চালচলনে গীন্সবার্গের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চুড়ান্ত নাজেহাল করা। ধনতন্ত্রের পালিশ করা আত্মাহীন মার্কিন মুলুকের অহংকারী অন্তসারশূন্যতাকে খুলে দেখানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। তারা ছিল ভোগের বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে না পারা প্রজন্ম। কিন্তু কলকাতার সংকটসংকুল নিম্নমধ্যবিত্ত কবিরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিট জেনারেশনকে অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদেরকে লক্ষ্যহীন স্থুলতায় নিক্ষেপ করলো। বেশ্যাদের তিরিশেই গ্রহণ করেছিল আধুনিকেরা। পঞ্চাশীরা যে কোনো বয়সের যে কোনো নারীকে এমনকি মা মেয়েকেও একসাথে ভোগ করবার স্বপ্ন দেখতে থাকে সারাদিন। এবং এই গোষ্ঠীটি এতবেশি প্রচার পেয়েছিল যে পরবর্তী একযুগ এরা রাজত্ব করল শতশত রিম কাগজে। পুরো একযুগ মহান সাহিত্যের ধারেকাছেও যেতে পারলনা পাঠক। ঠিক এই গোষ্ঠীটির প্রভাব পড়েছিল এই কন্ঠস্বর পত্রিকায়। সেটা কন্ঠস্বর পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ইশতেহারটা পড়লে বুঝা যায়। এরা লিটল ম্যাগাজিন করবার ধারাটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে যায়।
এরপর থেকে এদেশে লিটল ম্যাগাজিন করে আত্মহারা, স্বমেহী লোকজন। তারা ছোট কাগজ করে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার সাংবাদিকদের অপাঠ্য না-কবিতা ছাপানোর জন্য। ঘনিষ্ঠতার সূত্রে যেন তার একটা কবিতা ঐসব পত্রিকার রঙ্গিণ বিজ্ঞাপনের পাশে ছাপানো হয়। আর অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কজনের টাকায় ওই ছোট কাগজ ছাপা হয় তাদের নিজেদের তোয়াজ তোষণে ভরা। এসব গ্রাম্য মানসিকতার অ্যামিবা লেখকেরা এত অল্পে তুষ্ট যে তারা মনে করে যেখানে কালোবাজারী কালোচশমাধারী পেশাদার খুনী ও উচ্চবিলাসী সিনেমা নাটুকে বেশ্যাদের ছবি ছাপা হয়, তার পাশে তার একটা লেখা ছাপানো মানে জীবন ধন্য হয়ে গেল। আর বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব মহাপণ্ডিতেরা সাহিত্য পাতাগুলোতে সাংবাদিকতা করে তাদের নামে কিছু লেখা সাহিত্যপরিপন্থী কাজ হবে। এদের সাহিত্যের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট নাই, দরকারও নাই তাদের। কারণ তাদের ছলনা সম্পর্কে তারা জ্ঞাত।
এক পত্রিকার এরকমই এক প্রাণীকে একবার বলতে শুনেছিলাম। রিলকের ‘সরলা ইরিন্দিরা’ (Innocent Eréndira) বইটা নাকি তার ভাল লেগেছিল। তাকে আর বইটার লেখকের নাম বলা হয়নি। আরেকজনকে দেখেছিলাম ভাগযোগ করে নবাগত এক কবিকে বোঝাচ্ছেন কবিতা হচ্ছে আসলে চার মাত্রার খেলা। প্রাণীগুলো আবার নিজেদের মনে করে এজরা পাউন্ড, এলিয়ট, বুদ্ধদেব, সুধীন ইত্যাদির মত সম্পাদক। কয় অক্ষরে অরবৃত্ত হয় এটাই হচ্ছে এদের কবিতা মাপার মাপকাঠি। গল্পকে তারা মনে করে মানিক, তারাশংকরের মত কিনা যেন পৃথিবীতে আর কোনো ইতালো কালভিনো, বোর্হেস, পিটার বিকসেল, রমানাথ রায় গল্প লিখেন নি। প্রত্যহ একটা দৈনিকের সাহিত্য পাতায় যা ছাপা হয় তার বৃহদাংশজুড়ে থাকে কপট সাহিত্য সম্পাদকের আত্মীয়-স্বজন,ভাই-বেরাদর, শ্যালক, তাদের নিয়মিত হাজিরা দেনাঅলা পা’চাটা সরীসৃপদের।
দৈনিক পত্রিকা হচ্ছে দৈনিক পত্রিকা। সারাদিনের খুন ধর্ষণ ও যাবতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে ভরা। সে সাহিত্যের কাছে দায়বদ্ধ নয়। ব্যবসাই তার লক্ষ্য। যেটা এদেশের প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলোর অন্যান্য ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারের তোড়জোড় দেখলে বুঝা যায়। কিংবা সুক্ষমাথার দূর্ণীতিবাজ ব্যবসায়ীরা নিজেদের কালোটাকা সাদা করবার জন্য এই সব পত্রিকা করেছ। যেনতেনভাবে পৃষ্ঠা ভরানোই হচ্ছে তার কাজ। দেশের সাহিত্যের মেরুদণ্ড কীরকম নড়বড়ে হলে, কী রকম প্রতিশ্রুতিশীলতার অভাব হলে একটা দেশের সকল লেখকরাই এই দৈনিকের পাতাগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ এক বিরাট প্রশ্ন।
পুঁজির ক্ষমতা আছে সে মুহ’র্তেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যেতে পারে। তাই এই স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, মূর্খামির জঘন্য প্রভাব পড়ে মফস্বলে। যেখানে ভাল বই পৌছেনা। আর এসব সাহিত্য পাতায় লেখাটেকা দেখে লোকজন ভাবে যে এগুলোই বুঝি সাহিত্য। এবং নামগুলোর দিকে তাকিয়ে তারা ভাবে এরাই বুঝি সাহিত্যিক। ঢাকায় যাদের লেখা ছাপা হয় তারা ছাড়া এসব লেখা অন্য কেউ দেখে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করি।
পাকিস্তান আমল হতে এদেশে এমন পনেরটা বইও ছাপা হয় নাই যেগুলো পড়ে শেলফে সংরক্ষণ করা যায় পরবর্তীতে পড়ার জন্য । একাত্তর পরবর্তী এদেশে যারাই ক্ষমতা পেয়েছে গণগ্রন্থাগার গুলোকে ব্যবহার করেছে অশিতি আমলা ও প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী পদবাচ্যের আত্মীয়-স্বজনদের অপাঠ্য হজ্বে যাবার স্মৃতি, জিয়ার দর্শন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন জাতীয় আবর্জনা রাখবার ডাষ্টবিন হিসাবে। আর এসব বই সরকারী টাকায় ছাপানো সরকারী টাকায় কেনা।
কবিতার অবস্থা সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে কবিতাহীন দানোয় পাওয়া এক ঘোরের ভেতর তাদের বাস। তাদের কবিতার ভেতর কবিতা ছাড়া সব আছে। আর যে গল্পগুলো এখন এখানে ছাপা হচ্ছে তাদের ফর্ম হচ্ছে মান্ধাত্বার মায়ের আমলের। তাদের অভিজ্ঞতা একটা কুনোব্যাঙের চাইতেও কম। তবু হরদম মেলা আসলে অন্ধ দানবের মত রিমরিম কাগজে এসব … ছেপে বেচঁতে আসে বটতলার বাজারে। দৈনিক পত্রিকাগুলো সের দরে তারকা বানায় ও বেঁচে। এটা তাদের একধরনের পত্রিকা কাটতি ব্যবসায়। আর এসব প্রাণীগুলো তারকা হবার আশায় সবকিছু জলাঞ্জলি দিতে পারে মায় আত্মা পর্যন্ত। আদর্শহীনতাই এখানে আদর্শে পরিণত হয়েছে।
আদর্শ বলতে এখানে কোনো দার্শনিক বা ধর্মীয় চিন্তাধারাকে বুঝানো হচ্ছে না। সাহিত্যের একটা নিজস্ব আদর্শবোধ আছে। যা জগতের তাবত মতবাদের ঊর্ধ্বে ও তাবত মতবাদের চাইতে সত্য। কারণ সত্য উচ্চারণ ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো কাজ নাই। সাহিত্যের আদর্শ জগতের শ্রেয় আদর্শ। একজন সৎ সাহিত্যিক ত্রিকালদর্শী। যে কারণে লু স্যুন ডাক্তারী ছেড়ে লিখতে আসে। যে কোনো ধর্মপ্রণেতার চাইতেও তিনি মহৎ।
এ বড় আজব দেশ। গ্রামদেশ থেকে কবিতা লিখতে আসা একটা শাদা ছেলে চক্রে পড়ে পরিণত হয় হাস্যকর ভাঁড়ে অথবা আত্মাহীন বেশ্যার দালালে। এসব হতে চেয়েছিলাম লেখকদের সবসময় দেখা মিলবে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতার সাংবাদিকদের পশ্চাতে।
কিছুদিন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদকে তারকা বানিয়ে খুব বিক্রি করেছে দৈনিক পত্রিকাগুলো। সন্দেহ নাই একসময় ভাল কয়েকটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন শামসুর রাহমান। কিন্তু শেষের দিকে শামসুর রাহমানের ভিমরতি হয়েছিল। বাজারের ফর্দ, ঔষধের স্লিপ থেকে শুরু করে যা-তা কবিতার নামে চালিয়ে অচিরেই একটা নিকৃষ্ট ভাঁড় ও বিরক্তিকর চরিত্রে পরিণত করেন নিজেকে। তাঁর শত্রুরা আর তোশামোদ কারীরা হয়তো তাঁকে এসব পরামর্শ দিয়ে থাকবে। এই শামসুর রাহমান মরার পরও ভূতের মত প্রত্যহ উদয় হয় এইসব আবর্জনাময় দৈনিকের সাহিত্যপাতায়। এদের অধিকাংশই শামসুরের দ্বারা পত্রিকায় সাংবাদিকতা প্রাপ্ত। সাহিত্যপাতার এসব কেঁচো সম্প্রদায় বাস করে গর্তে। শামসুর রাহমান খুব রুচিহীন ট্রাডিশনাল লোক ছিলেন। রবার্ট ফ্রস্টের মত মহৎ কবিকে তিনি বাংলাভাষায় একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। সেটা রবার্ট ফ্রস্টের মুল কবিতাগুলোর সাথে শামসুরের অনুদিত কবিতাগুলো মিলিয়ে পড়লে বুঝতে পারা যায়। তার অনুদিত ফ্রস্টের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় এদেশীয় চতুর্থ শ্রেণীর কবিরাও ফ্রস্টের চাইতে ভাল লেখে। তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় আধুনিকদের অনুকরণে এসব করেছিলেন।
আর আল মাহমুদকে তো রীতিমত ভণ্ডপীর উপাধি দেয়া যেতে পারে। আত্মার গরিমাহীন যৌন উপোসী এই লোক কবিতার দোহাই দিয়ে জীবন সুদ্ধ চালিয়াতি করেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক গুণ্ডাপাণ্ডা, আর্মি স্বৈরাচার সরকারের পা-চাটা সে। তার কবিতা- গল্প- উপন্যাস পদবাচ্য পড়লে মনে হয় আদি রসাত্মক লেখক শ্রী রসময়গুপ্তই একমাত্র তার সমকক্ষ লেখক। নারীদেহকে তার মত এত নোংরা ও বিকৃতভাবে অন্য কোনো কলমধারী ব্যবহার করে নাই। ঐতিহ্য প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারের বইয়ে তিনি বলেছেন এখন নাকি কবিদের ধর্ষণ করার সময় এসেছে। এই বিকৃত মানুষটাই আবার ইসলামী সংস্কৃতির জিগির তোলে আর আত্মপ্রচারকালে রসিয়ে রসিয়ে বলে তারা নাকি আরব থেকে এসেছে। এদেশীয় মুসলমানদের ভেতর অনেক হীনম্মন্যতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তারা অধিকাংশই মনে করে যে তারা মহম্মদের বংশধর, তারা এসেছে আরব থেকে। কিন্তু যে কেউ নৃবিজ্ঞান না ঘেটেই চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে মাহমুদ মঙ্গোলিয়ান প্রজাতির লোক। তার চেহারায় মঙ্গোলিয়ানদের ছাপ স্পষ্ট।
কবিতা হচ্ছে একই জীবনের অন্যরকম উৎসার এটা গভীরভাবে অনুভব করবার সময় এদের কারো হয়েছে বলে মনে হয় না। উনিশ শতক, পশ্চিমবঙ্গের দলিত গোষ্ঠী ও এদেশীয় গুটিকয় সাহিত্যিকদের বাদ দিলে এদেশীয় সাহিত্য এখনো শিশুসাহিত্য। একটা পয়ত্রিশ বছর বয়সী স্বাধীন দেশের সাহিত্যে যে পরিমাণ অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল তা তো হলইনা। একাত্তরের মত একটা এপিক ওয়ার যার শেকড় বায়ান্ন পর্যন্ত বিস্তৃত তা নিয়ে একটা মহৎ উপন্যাস পর্যন্ত লেখা হলনা। একাত্তর সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের একমাত্র সহায় মেজর(অব:)দের অপাঠ্য স্মৃতি কথা।
এদেশে সাহিত্য এখনো ফটকাবাজ তালিবাজ ও বটতলায় সীমাবদ্ধ। সন্দেহ নাই এ সাহিত্যকে উপরতলায় তথা আর্ন্তজাতিক মহৎ সাহিত্যের কাতারে নিয়ে যাওয়া সাহিত্যিকদের আরেকটি দায়িত্ব। যার কারণে বৈদেশিক ভাষা থেকে প্রচুর অনুবাদ হওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ অনুবাদকই ছোটলোক। অনুবাদ ক্ষেত্রে তাদের জালিয়াতি আতংকিত হবার মত। তাদের অনূদিত বইটি হাতে নিলে লজ্জা হয়। দেখা যায় বইটির সামনে পিছনে ফ্ল্যাপে অনুবাদকের নাম, ছবি, জীবনী ইত্যাদি ময়লা আবর্জনায় ভরপুর। অনেক সময় অনুবাদকদের এসব অপকর্মের দুর্গন্ধে মূল লেখককে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
কবীর চৌধুরীর মত অশীতিপর বৃদ্ধ অনুবাদকও এইসব অপকর্ম করেন নিয়মিত। আত্মপ্রচারের হীনমন্যতাবোধ, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার শিশুসুলভ যৌনবাসনা এখনো আমরা পরিহার করতে পারি নাই। যেন মূল লেখকরা আমাদের বোন জামাই অথবা কাকা লাগে। ফলে হাতে নেয়ার পর মনে হয় এইরকম হীনমন্য এক লোকের অনুবাদ আর কী পড়ব। পড়ার রুচিটাই নষ্ট হয়ে যায়। আর কিছু অনুবাদক আছে আরো অসৎ ও দুর্নীতিবাজ। অর্ধেক লেখা বাদ দিয়ে বইটি ছেপে দেয়। যেন তাড়াহুড়ো করে ইতিহাসে স্থান করে নেয়া যায়। আর এসব ’হতে চেয়েছিলাম’ লেখকদের আবর্জনার স্তুপ ছেপে চলে বাংলাবাজার ও শাহবাগের প্রকাশকদল। অধিকাংশ প্রকাশকরা অশিক্ষিত। প্রকাশকদের মধ্যে শিক্ষিত মার্জিত লোক নাই বললেই চলে। কারণ এরা চাকরী করতো প্রেসে, বাইণ্ডিংখানায়। সহজে দুইপয়সা কামানোই হচ্ছে এসব জীবদের জীবনের ব্রত। একবার বাংলাবাজারের এক নামকরা প্রকাশকের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করছিলেন বড় পত্রিকার সাংবাদিক নয়, কলেজে পড়ায় না সে কী করে লেখক হতে পারে। তার ধারণা এ দুই পেশার লোক ছাড়া অন্য কেউ লেখক হতে পারে না। এরা আবার বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত। তারা ছাপে অন্য পেশার কন্ট্রাকটরের শালার বউয়ের ছোট ভাইদের কবিতার বই।
সুবিধা পেলে সাহিত্য সুদ্ধ পাইকারি বিক্রি করতেও তাদের বাধবে না। এইরকম একটা গুমোট হত্যাচক্রের ভেতর কখনোই মহৎ কবি সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
