১. আজকালকার মায়েরা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য ভীষন উদ্বিগ্ন থাকেন। কেবল মায়েদের কথা বলছি কারন উদ্বিগ্ন বাবা তেমন একটা দেখিনি। বাচ্চা যত ছোট উদ্বেগের মাত্রাও যেন তত ব্যাপক। তিন বছর বয়সী বাচ্চার মা আফসোস করে বলে, "আমার ছেলেটা কিছুই পারে না, অথচ মেজো আপার ছোট মেয়েটা পাঁচটা মহাদেশের নাম মুখস্থ বলতে পারে। কি যে করবো এই ছেলেকে নিয়ে?" শুনে প্রতিবেশী ভাবীও কম যান না, "আপনার ছেলে তো তবু সার্কের দেশগুলোর নাম জানে, আমারটা তো বাংলাদেশে কয়টা জেলা আছে তাও জানে না। কি করে মানুষ করি এটাকে?" বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে এইসব উদ্বিগ্ন কথোপকথন কিছুক্ষন শুনলে আপনার মনে হবে দেশে আর যত সমস্যা আছে সব নস্যি। শিশুদের বিদ্যাসাগর বানাবার উপর কোন কথা নাই। এইসব মায়েরা সাধারনতঃ বাচ্চাদের ইংরেজী স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়ানোর কথা ভাবতে পারেন না। অন্য জ্ঞান যাই হোক, বাচ্চার কচি মুখ দিয়ে যদি ফট ফট করে ইংরেজী কথা না বেরোয়, চলবে না। ফলে এরা ছোটেন শহরের নামকরা ইংরেজী স্কুলে। (ইদানীং খালি ইংরেজী স্কুলে পোষায় না, গ্রামার স্কুল লাগে) আমার এক অর্ধশিক্ষিতা আত্মীয়া তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে দেবার আগে থেকেই ইংরেজী জ্ঞানে পরিপক্ক করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। যাবতীয় ফল-মুল-পশু-পাখী সমস্ত কিছুর নাম বাংলার আগে ইংরেজীতেই শিখিয়ে দিতে পণ করেছেন তিনি। একদিন সাহেব বাজার থেকে মাছ এনেছেন। ভাবী তিন বছরের মেয়েকে ডেকে বলছে, "দেখো দেখো, এটা হলো পিশ.... পিশ"। অথবা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গরু দেখা গেল, "দেখো বাবু কাউ, কত সুন্দর কাউ।" আরেকদিন গাড়ীর সামনে ছাগল পড়লো, বলে, "দেখো ওগুলো গট গট"। যদিও নিজের বাংলা উচ্চারনই শুদ্ধ নয়, কিন্তু বাচ্চাকে ইংরেজীতে পারদর্শী করতে চিন্তার শেষ নেই। একদিন দুঃখ করে বলছে, এত কিছুর ইংরেজী নাম আছে আপেলের ইংরেজী নামটা পেলাম না কোথাও। আপেলের ইংরেজী না পেয়েও আমি অবাক হই না। কিন্তু অবাক হই এই প্রবনতাটা দেখে। এত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে কেন অত ইংরেজী শিখবে। কি এমন জরুরী দরকার? বাজারে যে জিনিসের চাহিদা বেশী সেই জিনিসের দাম বাড়ে তরতর করে। মায়েদের চাহিদার ফলে ইংরেজী স্কুলের দামও বেড়ে গেল হুড়োহুড়ি করে। স্কুল একটা ভালো ব্যবসা এখন। বিশেষতঃ ইংরেজী স্কুল। ২. স্বল্পপুঁজিতে মজার ব্যবসাটা আমিও…
ভ্রমণ ছিল কঠিন নেশা জীবদ্দশায়। বিশ্বজুড়ে ঘুরবো এবার, উল্টেপাল্টে দেখবো এবার জগতটাকে - 'কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্নিপাকে'। এলেবেলে পথের বাঁকে অনেকটা পথ হাঁটা হলেও, দীর্ঘ জীবন ৬০টি বছর বেঁচে থেকেও, বিশ্বজুড়ে হয়নি আমার দাপিয়ে বেড়ানো। সাধ-সাধ্যের দেখাদেখি হয়েছে কখনো, দীর্ঘ মোলাকাতের সুযোগ হয়নি একটি বারও। যখন আমি সদ্য তরুণ…... তখন আমর অঢেল সময়, অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। সমস্যাটা টাকা-কড়ির, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা বহুদুরের স্বপ্ন তখন, দেশ ভ্রমণে যাই কি করে। আরো একটু বড় হও, অপেক্ষাতে রইলাম আমি। যখন আমি মধ্যযুবা…... শক্তি তখন অফুরন্ত, অর্থেরও নেই সমস্যা। কিন্তু আমি ভীষণ ব্যস্ত প্রচুর প্রাচুর্যে। সময় কোথায় বিশ্ব ঘোরার? ওইবেলাতেও হয়নি যাওয়া। সময় যখন প্রৌঢ়ত্বে ...... তখন আমার প্রচুর সময়, ছিল অঢেল অর্থও। কিন্তু আমি ততদিনে বিত্ত দৌড়ে রিক্ত মানুষ, রোগ-ব্যাধিতে বিধ্বস্ত। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ হলো হাসপাতাল টু হাসপাতালে। বিশ্ব দেখা দুরেই থাক, এমনকি সেই হাসপাতালের বারান্দাতে, খেয়াল করে হয়নি দেখা, ম্যাগনোলিয়ার কুঁড়িটিও। বিশ্ব আমার শেষবেলাতেও থেকেই যে যায় অদেখাতেই। এই পারেতে আসার পরে শখটা যেন পুরন হলো। আত্মা আমার হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা পৃথিবীতে। নাই টিকেটে- নাই ভিসাতে- নাই পাসপোর্টে। বিশ্বজুড়ে অবারিত সীমান্ত তার, অবাধ যাতায়াত । তবু যেন আত্মা আমার অতৃপ্ত যে বড়ো। অসময়ে ভ্রমণ করার বিড়ম্বনা যার, মানব জনম কেটে গেছে দ্বিধায় দ্বিধায় দ্বিধায়.....। [কপচিত দর্শন - প্রত্যেক মানুষের শখ-সাধ-আহ্লাদ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল -- সময়, অর্থ, শক্তি। মানুষের জীবনে এই তিনটি জিনিস একই সময়ে এক সাথে থাকা ঘটনা অতি বিরল। দৈবাৎ যাদের একসাথে তিনটাই থাকে তারা অতি অসাধারণ অদ্ভুত ভাগ্যবান মানুষ]
টিভি তেমন দেখা হয় না। আন্দোলন, নির্বাচন, ঘটনা-দুর্ঘটনার গরম থাকলে টিভির সামনে বসি, নয়তো বসা হয় না। একই রকম খবর, একই রকম চিত্র, একই রকম সাক্ষাৎকার ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মুখ দিয়ে নির্গত হয় নানান নামে প্রতিটি চ্যানেলে। সবগুলো চ্যানেলকে জীবন্ত কপি-পেষ্ট মনে হয়, কপি-পেষ্টে আমার চির অরুচি। তবে হালকা বিনোদনের জন্য মাঝে মধ্যে দুটি সিরিজ দেখতাম একসময়। এনটিভির ‘হাউসফুল’ আর চ্যানেল আইয়ের ‘দৈনিক তোলপাড়’। এখন বিরক্ত হয়ে এগুলোও দেখি না। বিরক্ত হবার কারন নির্বিচার বিজ্ঞাপন অত্যাচার। আমি কোন সিরিয়াস দর্শক না। খুব সামান্য সুড়সুড়ি দিয়েই আমাকে আনন্দিত করা যায়। তোলপাড় বা হাউসফুলে যা দেখানো হয় তাতে সিরিয়াস কিছু থাকেও না। আমার দরকারও নাই। আমি সামান্যতেই তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের বাড়ন্ত উৎপাতে আমার নাটক দেখার রুচিই চলে গেছে। প্রথম প্রথম সহ্য করেছি, তারপর পালাতে হয়েছে টিভির সামনে থেকে। এক সময় বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিল না বাংলাদেশে। একটা নাটক শুরু হবার আগে বিটিভি আমাদের কমপক্ষে পনেরো মিনিট বিজ্ঞাপন গিলিয়ে তারপর এক ঘন্টার নাটক দেখাতো। আটটার খবর শেষ হতো সাড়ে আটটায়। তারপর পনের মিনিটে বিজ্ঞাপন। পৌনে নটায় নাটক শুরু হতো - পৌনে দশটায় শেষ হতো। মাঝখানে একবার দুবার বিজ্ঞাপন থাকতো যদি স্পনসরড নাটক হতো। সেই বিজ্ঞাপনের দৈর্ঘ্য দুই মিনিটের মতো। তাতেই আমরা কত বিরক্ত ছিলাম। একুশে টিভি চালু হবার পর বিজ্ঞাপনের একটু মার্জিত ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। একুশে যখন জোট সরকারের হাতে খুন হলো, তারপর বাংলাদেশে চ্যানেলের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু আর কেউ একুশকে ছুতে পারেনি। এখন আবার একুশে ফিরে এসেছে, খোলসটাই আছে কেবল, সেই একুশে আর নেই। আজকাল অনেক চ্যানেল। অনেক বিজ্ঞাপন। অনেক নাটক। নাটকের বন্যা। নাট্যশিল্পীরা এখন পেশাজীবী। ভালো, খুব ভালো। কিন্তু সেই নাটকগুলো আমাদের কিভাবে গেলানো হয়। একটা নাটক কিভাবে গেলাতে হবে তার কোন নীতিমালা কি সরকারের আছে? নামী নাট্যকার নামী পরিচালক হলে ঠাসা ঠাসা বিজ্ঞাপন, কমদামী নাট্যকার হলে কম কম বিজ্ঞাপন। এরকম একটা অলিখিত নিজস্ব নিয়ম বোধহয় আছে চ্যানেলগুলোর। বিজ্ঞাপন ছাড়া ফ্রী কোন অনুষ্ঠান কী আছে? এমনকি সংবাদও তো বিজ্ঞাপন ছাড়া হয় না। তাও একজন নয়। কয়েকজন মিলে একটা সংবাদকে ভাগ করে নেয়। কোরবানীর ভাগা…
স্কুল পর্যায়ে বাংলাদেশে কত রকম শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে? আমার জানা মতে সাধারণ বাংলা স্কুল, সাধারণ মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, সাধারণ কিন্ডারগার্টেন, গ্রামার স্কুল ইত্যাদি নানান রকম শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে শ্রেণীভেদে এর মাঝ থেকে যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে হয় অভিভাবককে। স্কুল পছন্দ করতে গিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে আর্থিক কারণ ছাড়াও পছন্দ অপছন্দের বিভিন্ন কারণ কাজ করে থাকে। অনেকে ব্যাপক ভুল ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইংরেজি-স্কুল-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে দ্রুত ইংরেজিবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে, যাতে সহজে তার লন্ডন-আমেরিকা গমন ঘটে। মাদ্রাসা-পছন্দ অভিভাবক চায় বাচ্চাকে বেহেশতের চাবি হিসেবে তৈরি করতে, যাতে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সে বেহেশত দর্শনে যেতে পারে। ইত্যাকার কারণে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় একটা তোগলকি অবস্থা বিরাজ করছে। একেক স্কুল একেক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছে পূর্ণ গণতান্ত্রিক সুযোগ নিয়ে। কিন্তু একটা দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থায় এতটা 'গনতন্ত্র' কি সহনীয়? ইংরেজি শিক্ষার নামে ৪ বছর বয়সি একটা বাচ্চার হাতে ৫ কেজি ওজনের বই তুলে দেবার যুক্তিটা কী? ৪ বছরের একটা বাচ্চাকে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মের নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে পৃথিবী যাবতীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করার মানে কী? শিক্ষাকেই জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। অথচ সেই মেরুদণ্ডের যত্নের জন্য যা যা করা দরকার তা কি করেছে আমাদের কোনো সরকার? এদেশে ইংরেজি বা আরবি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? বিদ্যমান সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোকে কতকাল অবহেলিত ফেলে রাখা হবে? যে-অঙ্কের টাকা ইংরেজি বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করা হয় তা দিয়ে সাধারণ বাংলা স্কুলগুলোর মান উন্নয়ন করা যায় না কি? সাধারণ বাংলা স্কুলে পড়লে সন্তান মানুষ হবে না, এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ই-বা কী? বাংলাদেশের মানুষের জন্য আসলে কী রকম শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োজন?
গনতন্ত্রে ফিরে যাচ্ছি আবার। ২০০৯ সাল শুরু হচ্ছে নতুন আশা নিয়ে। এই গনতন্ত্রে ফিরে যাওয়া ১৯৯১ সালের মতো নয়, কিংবা ১৯৭২ সালের নব্য স্বাধীন দেশের মতোও নয়। আমরা গত ৩৮ বছরে অনেক তন্ত্র দেখেছি, কিন্তু ১/১১ এর পর আমরা যা দেখেছি তার সাথে কোন কিছুর তুলনা হবে না। আমরা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য অনেক কিছু দেখেছি গত দুবছরে। অনেক পরাক্রমশালী উজির নাজিরকে পরাভুত হতে দেখেছি গত দুবছরে। হয়তো তারা আবার উঠে দাড়াবেন। কিন্তু আগের মতো করে কী? মনে হয় না। আমরা কী শিখলাম গত দুবছরে? আমরা শিখলাম টাকা, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি সবকিছুরই একটা শেষ আছে। অসীমতার কোন ধারনা এখানে বাতুলতা মাত্র। যারা অসীম ক্ষমতাবান বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্ঠা করেছে একসময়, তাদের পরিনতি আমরা দেখেছি, দেখে আমরা কিছু শিক্ষা নিয়েছি। আমরা আর সে পথে যাবো না। আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিরল জয় পেয়েছে নির্বাচনে। কেন পেয়েছে সেটা ব্যাপক গবেষনার বিষয়, কোটি মানুষের মনস্তত্বের বিষয়। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে মানুষ বিরক্ত হলে কাউকেই ছাড়ে না। জনগন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ৬৩ আসনে নামিয়ে দিয়েছিল বলে আমরা চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই জনতা ২০০৮ সালে আবার বিএনপিকে আছাড় দিয়ে ২৯ আসনে ছুড়ে ফেলেছে। আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। গণ রায় কখনো কখনো এমন নিষ্ঠুরও হতে পারে!! কিন্তু এমন আছাড় দেয়ার কারন আমরা প্রায় সবাই জানি। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সিগন্যাল পেয়ে গেছে এর মাধ্যমেই। আশা করা যায় তারা ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে। আমরা কখনো ভুল করিনি, করতে পারি না - এধরনের বাকোয়াজি কথা জনগন গ্রহন করে না। যারা আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়েছে তারাও না। বরং বিজয়ীদের বিনয় পছন্দ করে জনগন। আমরা সে বিনয় আশা করবো আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। আর আশা করবো নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতিগুলি একে একে বাস্তবায়ন করবে। কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেবে না। কোন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে সেটার জন্য যথাযথ ব্যাখ্যা দেবে, কিন্তু বাজে অজুহাতে এড়িয়ে যাবে না কিংবা ঠাট্টার সুরে উড়িয়ে দেবে না। বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের হতদরিদ্র দেশগুলোর একটা হলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের কোন সমস্যা নেই। যেটা আছে ভারতে, পাকিস্তানে, শ্রীলংকায়, বার্মায়, নেপালে। প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যাগুলো অনেক কম সহিংস। একটু…