জাতির বাংলা মেরুদণ্ড

১.
আজকালকার মায়েরা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য ভীষন উদ্বিগ্ন থাকেন। কেবল মায়েদের কথা বলছি কারন উদ্বিগ্ন বাবা তেমন একটা দেখিনি। বাচ্চা যত ছোট উদ্বেগের মাত্রাও যেন তত ব্যাপক।

তিন বছর বয়সী বাচ্চার মা আফসোস করে বলে, “আমার ছেলেটা কিছুই পারে না, অথচ মেজো আপার ছোট মেয়েটা পাঁচটা মহাদেশের নাম মুখস্থ বলতে পারে। কি যে করবো এই ছেলেকে নিয়ে?”

শুনে প্রতিবেশী ভাবীও কম যান না, “আপনার ছেলে তো তবু সার্কের দেশগুলোর নাম জানে, আমারটা তো বাংলাদেশে কয়টা জেলা আছে তাও জানে না। কি করে মানুষ করি এটাকে?”

বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে এইসব উদ্বিগ্ন কথোপকথন কিছুক্ষন শুনলে আপনার মনে হবে দেশে আর যত সমস্যা আছে সব নস্যি। শিশুদের বিদ্যাসাগর বানাবার উপর কোন কথা নাই। এইসব মায়েরা সাধারনতঃ বাচ্চাদের ইংরেজী স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়ানোর কথা ভাবতে পারেন না। অন্য জ্ঞান যাই হোক, বাচ্চার কচি মুখ দিয়ে যদি ফট ফট করে ইংরেজী কথা না বেরোয়, চলবে না। ফলে এরা ছোটেন শহরের নামকরা ইংরেজী স্কুলে। (ইদানীং খালি ইংরেজী স্কুলে পোষায় না, গ্রামার স্কুল লাগে)

আমার এক অর্ধশিক্ষিতা আত্মীয়া তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে দেবার আগে থেকেই ইংরেজী জ্ঞানে পরিপক্ক করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। যাবতীয় ফল-মুল-পশু-পাখী সমস্ত কিছুর নাম বাংলার আগে ইংরেজীতেই শিখিয়ে দিতে পণ করেছেন তিনি। একদিন সাহেব বাজার থেকে মাছ এনেছেন। ভাবী তিন বছরের মেয়েকে ডেকে বলছে, “দেখো দেখো, এটা হলো পিশ…. পিশ”। অথবা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গরু দেখা গেল, “দেখো বাবু কাউ, কত সুন্দর কাউ।” আরেকদিন গাড়ীর সামনে ছাগল পড়লো, বলে, “দেখো ওগুলো গট গট”। যদিও নিজের বাংলা উচ্চারনই শুদ্ধ নয়, কিন্তু বাচ্চাকে ইংরেজীতে পারদর্শী করতে চিন্তার শেষ নেই। একদিন দুঃখ করে বলছে, এত কিছুর ইংরেজী নাম আছে আপেলের ইংরেজী নামটা পেলাম না কোথাও। আপেলের ইংরেজী না পেয়েও আমি অবাক হই না। কিন্তু অবাক হই এই প্রবনতাটা দেখে। এত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে কেন অত ইংরেজী শিখবে। কি এমন জরুরী দরকার?

বাজারে যে জিনিসের চাহিদা বেশী সেই জিনিসের দাম বাড়ে তরতর করে। মায়েদের চাহিদার ফলে ইংরেজী স্কুলের দামও বেড়ে গেল হুড়োহুড়ি করে। স্কুল একটা ভালো ব্যবসা এখন। বিশেষতঃ ইংরেজী স্কুল।

২.
স্বল্পপুঁজিতে মজার ব্যবসাটা আমিও করবো কিনা ভাবছি।

আগে একটু হিসেব করে দেখি কতটা লাভজনক। ধরা যাক আমি একটা মোটামুটি মানের স্কুল খুলবো। স্কুলে প্লে, নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর, ফাইভ মোট সাতটা ক্লাস থাকবে। সুতরাং সাতটা ক্লাসরুম, এটা টিচার্চ রুম, একটা প্রিন্সিপাল রুম, একটা টাকা কড়ি গোনার রুম। মোটামুটি দশটা খুপড়ি ঘর হলেও চলে যায়। প্রতি ক্লাসে যদি গড়ে বিশজন করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হয় তাহলে মোট ছাত্রের সংখ্যা দাড়ায় ১৪০ জন। মাসিক বেতন ৫০০ টাকা করে ধরলে ৭০,০০০ টাকা আয়। সাত ক্লাসের জন্য পাঁচজন টিচার। মাসিক বেতন ১৫০০ করে ধরলে ৭৫০০ টাকা। ১৫০০টাকা বেতনটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য কম মনে হতে পারে, কিন্তু আমার পাড়ায় একটা স্কুলে শিক্ষকদের ৪০০ টাকা বেতন দিতেও দেখেছি। স্কুল চালানোর অন্যান্য খরচ বাবদ আরো ৫,০০০ টাকা। স্কুল ঘর ভাড়া মাসিক ১০,০০০ টাকা। মোট খরচ ২২৫০০ টাকা। দেখা যাচ্ছে ছোট একটা স্কুল দিয়ে মাসে মোটামুটি ৫০,০০০ টাকার কাছাকাছি আয় করা সম্ভব বড় কোন বিনিয়োগ ছাড়াই। একমাত্র বিনিয়োগ হলো স্কুলঘর ভাড়া। যদি স্কুলঘরটা নিজের হয়, কিংবা বাড়ীওয়ালাকে ফুসলিয়ে পার্টনার করে নেয়া যায় তাহলে তো লাভের অংকটা আরো পুষ্ট হয়। এই আয় নিশ্চিত আয়। কোন ধুনফুন নাই।

বাংলাদেশের বেশীরভাগ জায়গায় গড়ে ওঠা তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো এরকমই। অপ্রয়োজনীয় বইয়ে ভর্তি থাকে শিশুদের পড়ার টেবিল। ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটায় পাঁচ-সাত-দশ বছরের বাচ্চারা। আনন্দময় শৈশব জিনিসটা এদের কাছে অধরা।


এবার জাতির মেরুদণ্ড বিষয়ক কয়েকটা কথা বলি।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জাতীয় ইংরেজী স্কুল দিয়ে যেভাবে মেরুদণ্ড গড়ে তোলা হচ্ছে সেটা বইয়ের বোঝা বহন করতে গিয়েই কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, জাতির ভার বহন করার মতো শক্তি অবশিষ্ট কিছু থাকবে কি? এরকম ব্যাঙের ছাতার স্কুলের পাশাপাশি দেশে বেশ কিছু ভালো ইংরেজী স্কুলও আছে। তবে সারা দেশে যদ্দুর খবর নিয়েছি ইংরেজী স্কুলগুলোর সমতূল্য একটা বাংলা স্কুলের খবর পাইনি কোথাও। কেন ভালো বাংলা স্কুল নেই? যত মনোযোগ দিয়ে ভালো ইংরেজী বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেরকম যত্ন করে বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় না।

চট্টগ্রামের একটা উদাহরন দেই। চিটাগাং গ্রামার স্কুল(সিজিএস) এখানকার সবচেয়ে খান্দানী স্কুল বলে পরিচিত। এই ইংরেজী স্কুলটির পড়াশোনার মান যথেষ্ট ভালো। ক্যাম্পাসের পরিবেশ যে কোন উন্নত দেশের সমতূল্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওখানে মূলতঃ বাংলাদেশী উচ্চবিত্ত পরিবারে সন্তান এবং বিদেশীদের সন্তানরা পড়ে। আমার এক সামর্থ্যবান প্রতিবেশী বাংলায় পড়াতে চান তার সন্তানকে, তবে স্কুলের পরিবেশ চান সিজিএস-এর মতো। অনেক খুঁজেও সিজিএস এর মতো একটা বাংলা স্কুল খুঁজে পেলেন না। বাধ্য হয়ে তাকে ইংরেজী স্কুলকেই বেছে নিতে হলো। আমি বিশ্বাস করি আরো অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে ইংরেজী স্কুল বেছে নেয়।

কিছু কিছু গ্রামার স্কুলে করুণা করে একটা বাংলা বই রাখা হয়। দশটা ইংরেজী বইয়ের মাঝে একটা বাংলা যেন হংস মাঝে বক। বাস্তবতা হলো ইংরেজী বা গ্রামার স্কুলে সন্তানদের পড়ায় তারা সমাজের কর্তাশ্রেনীর সন্তান। তাদের লক্ষ্য থাকে সন্তান যেন বড় হয়ে পাশ্চাত্যের কোন দেশে গিয়ে মজবুত অবস্থান গড়ে নিতে পারে। সুতরাং ইংরেজী স্কুল চলুক। বাংলা স্কুলের যা ইচ্ছা হোক। বাংলা স্কুলের মধ্যে যে কয়টা ভালো স্কুল আছে সেগুলো নিজের গুনেই ভালো। স্কুল পরিচালনা কমিটি, শিক্ষকশ্রেনীর গুনেই ভালো। সরকারের কোন নীতির কারনে একটা স্কুলও ভাল হয়েছে তেমন নজীর পাওয়া কঠিন হবে।

৪.
আমাদের শিক্ষার হার মান সব বাড়াতে হলে স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে, শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিদ্যমান বাংলা স্কুলগুলোর মান উন্নত করতে হবে। যত্রতত্র ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় গজানো তথাকথিত ইংরেজী স্কুলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা কারিকুলাম রাখতে হবে। শিশুদের পাঠ্য তালিকা থেকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান বাদ দিতে হবে। যে জ্ঞানটা ১০ বছর বয়সে পেলেও চলে সেটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাকে ঠেসে কেন গেলাতে হবে। সবগুলো স্কুলের কারিকুলাম এক হতে হবে। এক দেশে নানা জাতের বিদ্যাসাগর বানাবার তামাশা বন্ধ করতে হবে। অন্ততঃ ৯৯% মানুষের বাংলায় সুশিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। তাই জাতির মেরুদন্ডটা বাংলায় তৈরী করা হলে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়।

[বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এর আগেও একটা অসম্পূর্ন লেখা লিখেছিলাম। চিন্তাটা মাথার ভেতর খচ খচ করে কিছুদিন পরপরই, তাই আরেকটি লেখা দিতে হলো ওই একই বিষয়ে]

নীড় সন্ধানী

অদেখা স্বপ্নের ব্যাপ্তিটা প্রতিদিন বিস্তৃত হতে থাকে.........

১৫ comments

  1. গৌতম - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৪:৩৫ অপরাহ্ণ)

    কিছু বিষয়ে একমত, কিছু বিষয়ে দ্বিমত। একটু চাপের মধ্যে আছি, তাই এখন সেগুলো বিস্তারিত বলতে পারলাম না। তবে দু-একদিনের মধ্যে সেগুলো বিশদ বলতে পারবো বলে আশা করছি।

    আপাতত শুধু এটুকু জানিয়ে যাই- এই আলোচনাগুলো হওয়া জরুরি, অনেক বেশি বেশি হওয়া দরকার। আলোচনাটা শুরু করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

    • নীড় সন্ধানী - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৬:২২ অপরাহ্ণ)

      শিক্ষা বিষয়ক ব্যাপারে আপনার লেখাগুলো বিশেষ মনোযোগ আকর্ষন করে আমার। বলা যায় অনুপ্রানিত হই খুব। তাই আপনার অংশগ্রহন বিতর্কটাকে জমাবে নিঃসন্দেহে।

  2. বিনয়ভূষণ ধর - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৫:৪৭ অপরাহ্ণ)

    একেবারে সময়োপযোগী একটি লেখা…লেখককে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি বিষয় লেখার মাধ্যমে সবার সামনে নিয়ে আসার জন্যে…আমাদের সবারই কম বেশী অভিজ্ঞতা আছে এ জাতীয় স্কুলগুলোর ব্যাপারে…আশা করি সামনে আরও অনেক পাঠক এ বিষয় নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষনধর্মী মন্তব্য করবেন…

  3. বিপ্লব রহমান - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (৭:২১ অপরাহ্ণ)

    হায় রে অভাগা দেশ! আমরা এতোদিনেও একটি বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতিই পেলাম না!! 🙁

    • গৌতম - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১১:৩২ পূর্বাহ্ণ)

      বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতিটা আসলে কী একটু বুঝায়া বলবেন বিপ্লবদা?

      • বিপ্লব রহমান - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (৩:০৭ অপরাহ্ণ)

        যে শিক্ষানীতি বাস্তবকে সমর্থন করে, তেমন শিক্ষানীতির কথা বলেছি। সাধারণ জ্ঞান-বিচারে বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষানীতিটিই তো বাস্তবতাকে সমর্থন করে তাই না?

        আমি নিশ্চিত জানি, এ বিষয়ে আপনার গুরুতর প্রজ্ঞার কথা। …তাই এ নিয়ে একটি আলাদা লেখায় আপনার ভাবনাগুলো জানতে ইচ্ছে করছে। ধন্যবাদ।

        • গৌতম - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (৩:৩২ অপরাহ্ণ)

          শিক্ষানীতি বা এসব ক্ষেত্রে যে শব্দগুলো বহুল ব্যবহৃত, তার মধ্যে বাস্তবভিত্তিক, সর্বজনীন, প্রগতিশীল, আদর্শিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এই শব্দগুলো দিয়ে যা বুঝানো হয়, তার রূপরেখা কোথাও পাওয়া যায় না, জাস্ট একটা ধারণা দেয় মাত্র যে বক্তা শিক্ষানীতিটাকে কী পর্যায়ে দেখতে চান। যারা এসব শব্দ ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কারও উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি নি (আমার ব্যর্থতা)। সমাজবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের শব্দ দিয়ে কাজ চলে যায়, কিন্তু যেখানে বাস্তবায়ন, অর্থ, সময় ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেখানে এই শব্দগুলো নির্দিষ্ট করে কী অর্জন করতে চায়, সেটা বুঝা মুশকিল। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি- শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হয়, সেগুলোর কাজ ঠিক কী তা ঠাহর করা যায় না। ‘মানুষকে সামাজিক করা’ যদি শিক্ষার লক্ষ্য হয়, তাহলে ‘সামাজিক’ দিয়ে কী বুঝানো হচ্ছে তা পরিষ্কার হয় না। কিন্তু যদি শিশুদের ‘উপযুক্ত নাগরিক’ বানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়, তাহলে এর একটা অর্থ দাড়ায়- কারণ নাগরিকের কিছু সূচক রয়েছে।

          ঠিক এই কারণেই আপনাকে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করা। আমার ব্যর্থতা হলো- এতো এতো মানুষের কাছ থেকে শুনেও বাস্তবভিত্তিক, সর্বজনীন, প্রগতিশীল ইত্যাদি শব্দগুলো (শিক্ষার ক্ষেত্রে) বুঝে উঠতে পারলাম না। আপনি কি বিষয়টা আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন বিপ্লবদা?

          • বিপ্লব রহমান - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১০:০০ অপরাহ্ণ)

            ভাইরে, আপনি আটার কলের কাছে আখের রস চাইছেন। এর চেয়ে আমি বরং কোনো শিক্ষানীতি না চাই, কী বলেন? হা হা হা … 😀

            আপনি এ নিয়ে কিছু লিখছেন কী না, সেটা কিন্তু বলেননি।

          • রায়হান রশিদ - ৮ জানুয়ারি ২০১০ (৭:২৩ অপরাহ্ণ)

            @ গৌতম রায়,
            পুরোপুরি একমত আপনার সাথে। কিছু শব্দ/ধারণা লিফলেট কিংবা সভা সমিতিতে ব্যবহারের জন্য হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় সে সবের নিখুঁত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অর্থ স্থির না করলে সেগুলো আসলেই কোন অর্থ বহন করে না। শিক্ষা সেক্টর নিয়ে আলোচনা-আন্দোলনে এই অতিব্যবহৃত শব্দগুলোর ব্যবচ্ছেদ আসলেই জরুরী। সেখানে আকাঙ্খাগত সর্বোচ্চ মানদন্ডের বিষয়টি অবশ্যই থাকবে, কিন্তু পাশাপাশি কৌশলগত বা স্ট্র্যাটেজিক কিছু benchmark স্থির করাও জরুরী। এই বেঞ্চমার্কগুলোকে হতে হবে পরিমাপযোগ্য, তা নাহলে অগ্রগতি হচ্ছে কি হচ্ছে না তা আমরা বুঝবো কিভাবে? vague, বায়বীয়, ফুলেল, rhetorical ভঙ্গিতে আলাপ আলোচনা তো কম হল না! এই শব্দগুলোর অর্থ, সে ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে কর্মী-বাস্তবায়ক- নীতিনির্ধারকদের perception গুলো সুনির্দিষ্টভাবে এক আলোচনায় তুলে আনা গেলে খুব ভাল হতো; তাহলে অন্তত স্পষ্ট হয়ে যেতো আসলে আমরা কে কত ধরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিরাজ করছি অবস্থানের দিক থেকে।
            ব্লগের পরিসরে সে ধরণের চিন্তাঝড় কি প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ করা যায় জানি না। আপনার কোন পরামর্শ বা আইডিয়া আছে?

            @ নীড় সন্ধানী,
            অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার লেখাটি পড়বার পর ইংরেজী নিয়ে আশে পাশের অনেক ঘটনাই আমারও এখন মনে পড়ছে। যেমন: সেই অধ্যাপকটির কথা, যিনি বিলেতে মাত্র তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় (অনেকটা সিরাজউদ্দৌলা নাটকের লর্ড ক্লাইভের মতো) কথা বলা শুরু করে দিলেন। চোখে পড়ছে সেই সব ব্লগারদেরও, যারা বাংলায় লিখবার সময় ইচ্ছেমতো গালিগালাজ খিস্তি করে বেড়ান (যেন যাবতীয় নোংরামীর ভাষা হল বাংলা!), কিন্তু ইংরেজী কোনো ব্লগে লিখতে গেলে অনেকটা যেন ওজু করে স্যুট টাই পরে কিবোর্ডের সামনে বসেন। কারণ ভদ্দরনোকের ভাষা ইংরেজীতে কি আর অভব্যতা করা যায়! কেউ কেউ তো এমনও আছেন যাদের বাংলা কোন প্লাটফর্মের লিন্ক পাঠালে বা কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে বললে একরকম সাফ জানিয়ে দেন যে “বাংলাটা তাদের ঠিক আসে না, ইংরেজীতে হলে চেষ্টা করে দেখা যেতো”!! আর অনেকে তো ব্যক্তিগত পিসিতে বাংলা অক্ষরের সেটাপ করা নেই (এবং তিনি সেটা এতো বছরেও সমাধান করার চেষ্টা করেননি) সেটা জানাতেও বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না। মজার ব্যাপার হল, এদের বেশীরভাগেরই ইংরেজীর মান যে খুব ভাল তাও কিন্তু না!

  4. মুয়িন পার্ভেজ - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (১০:৩২ অপরাহ্ণ)

    ধন্যবাদ, নীড় সন্ধানী। ‘মেরুদন্ড’ বানানটিতে কিঞ্চিৎ আপত্তি থাকলেও বিষয়মাহাত্ম্যে লেখাটি অনবদ্য। ইতিপূর্বে আপনার লেখা ‘একজন রাখাল শিক্ষকের জীবনযাপন’ প’ড়ে জানতে পেরেছি আত্মবিশ্বাসপূর্ণ এক মহামহিম শিক্ষকের কথা — এই আত্মবিশ্বাসের জায়গাগুলো আসলে আমরা হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ। শুধু আপনার ‘অর্ধশিক্ষিতা আত্মীয়া’ নন, খোঁজ নিলে পাওয়া যাবে এমন অসংখ্য নগরবাসিনী ইংরেজি-উদ্বিগ্না মায়ের দেখা, উচ্চশিক্ষিতাও থাকবেন এ-তালিকায়। এ তো ঠিক গড্ডলপ্রবাহ নয়, শিক্ষাযুদ্ধের মাঠে রীতিমতো প্রাণপণ প্রতিযোগিতা।

    ‘জাতির বাংলা মেরুদন্ড’ পড়তে পড়তে মনে এল প্রতিভা বসুর লেখা জীবনের জলছবি বইয়ের একটি প্রসঙ্গ। বিবাহপরবর্তী জীবনে তিনি বাচ্চাদের জন্য একটি ইস্কুল খুলেছিলেন, জীবনানন্দ-কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশকেও নিয়েছিলেন সঙ্গে, এমনকী রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদও। হয়তো রোজগার বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই বিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠা, কিন্তু চালাতে পারেননি বেশিদিন। বিদ্যালয়ের পঞ্চত্বপ্রাপ্তির কারণসমূহের মধ্যে প্রতিভা অনুমান করেছেন এটির বাংলা নামের কথাও। হাতের কাছে বইটি নেই ব’লে উদ্ধৃতি দিতে পারছি না।

    বাঙালিদের ইংরেজিপ্রীতির শিকড় নিহিত আছে ব্রিটিশ-ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে; ‘আই অ্যাম ক্যালকাটা গোয়িং’ — ‘লেটো’র দলের কিশোর নজরুলের লেখা এই বিখ্যাত ব্যঙ্গসঙ্গীতের কথা মনে পড়ছে এ-মুহূর্তে।

    শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জাতীয় ইংরেজী স্কুল দিয়ে যেভাবে মেরুদন্ড গড়ে তোলা হচ্ছে সেটা বইয়ের বোঝা বহন করতে গিয়েই কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, জাতির ভার বহন করার মতো শক্তি অবশিষ্ট কিছু থাকবে কি?

    আমার এক আত্মীয়ার দুই ছেলেমেয়েকেও দেখেছি বিরসবদনে গ্রন্থইষ্টকের বোঝা বইতে। তাদের তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের তালিকায় ছিল বাংলা ব্যাকরণেরই দু’টি বই — লেখকনাম ও প্রচ্ছদপার্থক্য ছাড়া অন্য কোনো বিষয়বৈরিতা চোখে পড়েনি। এই বইগুলো (লেখার খাতাও) তফসিলভুক্ত হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা কিনতে বাধ্য। কেউ-কেউ বলেন, এ-ব্যবস্থার নেপথ্যে আছে এক শ্রেণির লেখকের বৈশ্যবুদ্ধি ও কিন্ডারগার্টেনের ‘অধ্যক্ষ/অধ্যক্ষা’দের বিশেষ আনুকূল্য।

    • নীড় সন্ধানী - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১:১৫ অপরাহ্ণ)

      শব্দটা ‘মেরুদণ্ড’ ও ‘মেরুদন্ড’ দুভাবেই দেখেছি সাংসদ অভিধানে।
      অমেরু-দন্ডী [ amēru-danḍī ] (-ন্ডিন্) বিণ. মেরুদন্ড নেই এমন (অমেরুদন্ডী প্রাণী), invertebrate (বি. প.)। [সং. ন + মেরুদন্ডী]।
      তবু সংশোধনীর জন্য ধন্যবাদ।

      বাঙালিদের ইংরেজিপ্রীতির শিকড় নিহিত আছে ব্রিটিশ-ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে

      এই ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসার সাহস আমরা এখনো অর্জন করতে পারলাম না কেন সেটি এক রহস্য। এই প্রসঙ্গে ভিন্ন একটা বিষয়ের উল্লেখ করি এখানে। কোর্টকাচারীতে বিচারক বা আইনজীবিদের যে কালো পোষাক পরতে দেখা যায় সেটা যেন প্রাচীন নাটকের কোন একটা সেট। জৈষ্ঠ্যের প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যেও দেখা যায় ভদ্রলোকগন নিজেকে গর্বিতভাবে টাই কোটে আবদ্ধ করে উপর কালো গাউন চাপিয়ে আগুনে সেদ্ধ হতে হতে মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা করছেন। কেন? এটা নিদারুন মানসিক দৈন্যতা না? আমরা আমাদের আদালতে নিজেদের ড্রেসকোড নিজেরা বানাবার মতো শিক্ষিত হতে পারিনি? নাকি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আছে। ওই পোষাকগুলো ২০০ বছরের বৃটিশ শাসনের ‘স্নেহ ভালোবাসার’ স্মৃতিচারনের নজির কিনা জানি না, কিন্তু ভীষন পীড়াদায়ক।

      বদলে যাবার শ্লোগানটা জনপ্রিয় হয়েছে ইদানীং। কিন্তু যেটুকু বদলাবার ক্ষমতা আমাদের আছেই, সেটুকুও বদলাতে চাই কিনা আমরা, সেটা এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

  5. মোহাম্মদ মুনিম - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১১:০৩ পূর্বাহ্ণ)

    শিশুদের অতি চৌকস করে গড়ে তোলার এই প্রবণতাটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতে, কোরিয়াতে, সিঙ্গাপুরে এবং অন্যান্য এশীয় দেশেও আছে। আমার মাস্টার্স এর ক্লাসে কিছু কোরীয় বন্ধু ছিল, বাবা মাদের নিদারুণ চাপে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা তারা বেশ দুঃখ করেই বলতো। কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুতে পারলেই অনেক টাকা বেতন, এই লোভে কোরীয় বাবা মারা দুবছর বয়স থেকেই বাচ্চাদের পড়তে শেখান। একটু বড় হলেই পড়াশুনা, ইংরেজী শেখার ক্লাস, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, এই করে করে তাদের খেলাধুলা আর বিনোদনের কোন সময়ই থাকে না।

    কোরিয়াতে আর যাই হোক, মানসম্মত শিক্ষা আছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে মোজার্ট আর বিঠোভেন শিখে, আমাদের দেশেতো ইংরেজী ভাবটাই আছে, বাচ্চারা বাংলা না শিখুক, ইংরেজীটাও ভালভাবে শিখলে হতো, সেটাও নেই। পথের পাঁচালীর অপু যেমন স্কুলের শিক্ষকদের উৎসাহে অল্প বয়সেই ভালো ভালো ইংরেজী বই পরে ফেলে, তেমন ছাত্র তো ইংরেজী মাধ্যমেও তৈরী হয় না।

    আমার এক ভাগনে সম্প্রতি ঢাকার মোটামুটি নামকরা ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল থেকে এ লেভেল শেষ করেছে। সেই স্কুলের নিয়ম ছিল কোন ছাত্র ক্লাসে বাংলায় কথা বললে তাকে শাস্তি হিসাবে ‘I will never speak Bangla in school’ এ জাতীয় একটি লেখা ১০ কি ২০ বার লিখতে হতো। আমার সেই ভাগনে (তখন সে ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ে) একবার হোমওয়ার্কের খাতায় এক পর্বতারোহীর ছবি আঁকলো, সে পর্বতারোহী পর্বতের চুড়ায় উঠে জাতীয় পতাকা ঊড়াচ্ছে, তবে সে পতাকা বাংলাদেশের নয়, ভারতের। আমার ভাগনেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই ছবি সে কোত্থেকে এঁকেছে, সে তার ভারত থেকে প্রকাশিত ড্রইংয়ের বই দেখালো।

    বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন তো বাদই দিলাম, কটা সরকারি স্কুলে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উড়ে? কটা স্কুলে প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়? খুব বেশি স্কুলে নিশ্চয় নয়। দশ বছরের বাচ্চা, রাইম জানে, উটপাখির ইংরেজী কি তা জানে, হ্যারি পটার জানে, জানে না কেবল নিজের দেশের পতাকা দেখতে কেমন, এমন আজব শিক্ষা ব্যবস্থা সম্ভবত পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

  6. পৃথিবী শামস্ - ১৯ জানুয়ারি ২০১০ (৮:১০ অপরাহ্ণ)

    আমার ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম, দু’টোতে পড়ারই অভিজ্ঞতা রয়েছে। ক্লিয়ারেন্স পেলে এ নিয়ে একটা পোষ্ট দিব। তবে একটা বিষয় আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ভাষা্র মাধ্যম ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি বাদ দিলে ইংরেজী মাধ্যমের কারিকুলাম আমাদের জাতীয় কারিকুলাম থেকে বেশ ভাল।

  7. তানবীরা - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    নীড়দা, আমি শুধু এক জায়গায় সামান্য দ্বিমত পোষন করছি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের বাচ্চাদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ভালো ভালো বই, সিনেমা বোঝার বা জানার জন্য, নিজেদের ভবিষ্যতের প্রস্তূতির জন্য ইংরেজি একটি জরুরী মাধ্যম।
    ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ানদের ইংরেজি না জানলেও হয়তো চলে কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের লোকদের চলে না
    ধন্যবাদ দাদাকে।

  8. সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ১২ এপ্রিল ২০১০ (১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ)

    পৃথিবী শামস, “ভাষা্র মাধ্যম ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি বাদ দিলে” – এই বিতর্কই রদ হয়ে যায় না কি? আমার দেশের শিশু আমার ভাষা-আমার সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে বড় হলে আমাদের এত কষ্টের দেশের কী দরকার ছিল, কী দরকার ছিল কারফিউ ভেঙে মিছিলের, শহীদমিনারের? কী দরকার ছিল বৃটিশ খেদানোর?
    একটা কথা সত্য, ঢাকাশহরের বাংলা স্কুলগুলির শিক্ষার মান দিন কে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা না শেখে বাংলা, না শেখে ইংরেজী।‘গোলীয় অপেরণ’ মার্কা পরিশব্দ শিখে উচ্চশিক্ষার বই হাতে পেয়ে ইউনিভার্সিটিতে খাবি খায়।
    ইংরেজী স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা একেবারেই শেখেনা, শেখে ইংরেজী বোলচাল, ইংরেজী ভাষা বা সাহিত্যের রস আস্বাদন নয়। স্কুলের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক গ্রীষ্মের ছুটিতে পড়বার জন্যে ছাত্ররা ঠিকই পি জি উডহাউস কেনে, বিয়েট্রিক্স পটার কেনে, ব্রন্টি সিস্টার্স কেনে, কিন্তু সেসব ছুঁয়েও দ্যাখেনা (ভাষার রস-ভাষার প্রতি ভালবাসা কোনো সীমানা মানেনা, একটি ভাষাকে ভালবাসলেই সব ভাষার প্রতি ভালবাসা ভেতরে চারিয়ে যায়।কিন্তু এইসব ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকের উদ্দেশ্য তো ভাষা নয়, ভাষাজাত উচ্চমন্যতা-ভাষাকে সামনে রেখে সামাজিক পংক্তিবিভাজন।)এবং একারণে এইসব ছেলেমেয়েরা বাংলামাধ্যমের ছেলেমেয়েদের শূদ্রবৎ ঘৃণা করে, ফেইসবুকে গ্রুপ বানায় ‘উই হেইট…’। যদিও তার নিজের স্মৃতি সংরক্ষণের আদিভাষা বাংলা, তার স্বপ্ন দেখবার ভাষা বাংলা, এবং ডি এল রায়ের ভাষায়- সেও ‘বিপদেতে দ্যায় বাঙালীরই মত চম্পট পরিপাটি’।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.