টিভি তেমন দেখা হয় না। আন্দোলন, নির্বাচন, ঘটনা-দুর্ঘটনার গরম থাকলে টিভির সামনে বসি, নয়তো বসা হয় না। একই রকম খবর, একই রকম চিত্র, একই রকম সাক্ষাৎকার ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মুখ দিয়ে নির্গত হয় নানান নামে প্রতিটি চ্যানেলে। সবগুলো চ্যানেলকে জীবন্ত কপি-পেষ্ট মনে হয়, কপি-পেষ্টে আমার চির অরুচি। তবে হালকা বিনোদনের জন্য মাঝে মধ্যে দুটি সিরিজ দেখতাম একসময়। এনটিভির ‘হাউসফুল’ আর চ্যানেল আইয়ের ‘দৈনিক তোলপাড়’। এখন বিরক্ত হয়ে এগুলোও দেখি না। বিরক্ত হবার কারন নির্বিচার বিজ্ঞাপন অত্যাচার। আমি কোন সিরিয়াস দর্শক না। খুব সামান্য সুড়সুড়ি দিয়েই আমাকে আনন্দিত করা যায়। তোলপাড় বা হাউসফুলে যা দেখানো হয় তাতে সিরিয়াস কিছু থাকেও না। আমার দরকারও নাই। আমি সামান্যতেই তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের বাড়ন্ত উৎপাতে আমার নাটক দেখার রুচিই চলে গেছে। প্রথম প্রথম সহ্য করেছি, তারপর পালাতে হয়েছে টিভির সামনে থেকে।
এক সময় বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিল না বাংলাদেশে। একটা নাটক শুরু হবার আগে বিটিভি আমাদের কমপক্ষে পনেরো মিনিট বিজ্ঞাপন গিলিয়ে তারপর এক ঘন্টার নাটক দেখাতো। আটটার খবর শেষ হতো সাড়ে আটটায়। তারপর পনের মিনিটে বিজ্ঞাপন। পৌনে নটায় নাটক শুরু হতো – পৌনে দশটায় শেষ হতো। মাঝখানে একবার দুবার বিজ্ঞাপন থাকতো যদি স্পনসরড নাটক হতো। সেই বিজ্ঞাপনের দৈর্ঘ্য দুই মিনিটের মতো। তাতেই আমরা কত বিরক্ত ছিলাম। একুশে টিভি চালু হবার পর বিজ্ঞাপনের একটু মার্জিত ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। একুশে যখন জোট সরকারের হাতে খুন হলো, তারপর বাংলাদেশে চ্যানেলের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু আর কেউ একুশকে ছুতে পারেনি। এখন আবার একুশে ফিরে এসেছে, খোলসটাই আছে কেবল, সেই একুশে আর নেই।
আজকাল অনেক চ্যানেল। অনেক বিজ্ঞাপন। অনেক নাটক। নাটকের বন্যা। নাট্যশিল্পীরা এখন পেশাজীবী। ভালো, খুব ভালো। কিন্তু সেই নাটকগুলো আমাদের কিভাবে গেলানো হয়। একটা নাটক কিভাবে গেলাতে হবে তার কোন নীতিমালা কি সরকারের আছে? নামী নাট্যকার নামী পরিচালক হলে ঠাসা ঠাসা বিজ্ঞাপন, কমদামী নাট্যকার হলে কম কম বিজ্ঞাপন। এরকম একটা অলিখিত নিজস্ব নিয়ম বোধহয় আছে চ্যানেলগুলোর। বিজ্ঞাপন ছাড়া ফ্রী কোন অনুষ্ঠান কী আছে? এমনকি সংবাদও তো বিজ্ঞাপন ছাড়া হয় না। তাও একজন নয়। কয়েকজন মিলে একটা সংবাদকে ভাগ করে নেয়। কোরবানীর ভাগা কিংবা সিগারেট-গাঁজা-বেশ্যা ভাগের মতো। কে আগা খাবে কে গোড়া খাবে এভাবে ভাগ হয়। কেউ প্রধান শিরোনাম, কেউ মাঝখানের অংশ, কেউবা নীচের হেড লাইন, কেউ শেষের শিরোনাম, কেউ বিরতি। আবার কোথাও কোথাও দুটো হেডলাইনও চালু থাকতে দেখেছি নীচের অংশে। ‘আমরা এখন একটা ইষ্টার্ন ব্যাংক বিরতি নিচ্ছি, তার আগে জানিয়ে দিচ্ছি প্রাইম ব্যাংক সংবাদ শিরোনাম’ এরকম ডায়লগ অহরহ। বিজ্ঞাপন বানিজ্য এমন পর্যায়ে পৌছেছে তাকে বেশ্যাবৃত্তি বলতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। এত এত বিজ্ঞাপন তারপরও নাকি কর্মীদের বেতন বাকী থাকে, কী অবিশ্বাস্য!
বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি, বাচ্চাদের ভাত খাওয়াতেই টিভিটা ব্যবহার হয়। তবু সেদিন এনটিভিতে ‘হাউসফুল’ শুরু হচ্ছে দেখে কৌতুহল বশত ছোট্ট একটা গবেষনা চালালাম নাটক ও বিজ্ঞাপনের উপর। আসলেই কী বিজ্ঞাপন অতিমাত্রায় অসহনীয় হয়েছে? নাকি আমিই অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। দেখা যাক আমার পর্যবেক্ষণে কী দেখা গেল।
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.২৩-৮.৩৪) শুরু
৬ মিনিট নাটক(৮.৩৫-৮.৪০)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৮.৪১-৮.৫২)
৬ মিনিট নাটক (৮.৫৩-৮.৫৯)
১২ মিনিট বিজ্ঞাপন (৯.০০-৯.১২)
৬ মিনিট নাটক (৯.১৩-৯.১৮) শেষ
বিজ্ঞাপন এবং নাটক মিলিয়ে মোট সময় লেগেছে ৫৪ মিনিট। তার মধ্যে নাটক ১৮ মিনিট, বিজ্ঞাপন ৩৬ মিনিট। মানে কী দাড়ালো? আমরা কী নাটকের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন দেখলাম, নাকি বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে নাটক? এটাকে নাট্য প্রতারনা বললে খুব দোষের হবে? প্রতারনা কে করলো, নাট্যকার নাকি চ্যানেল? ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে দয়া করে ওনারা নাটক বানাচ্ছেন, দয়া করে চ্যানেলওয়ালারা দেখাচ্ছেন, তাতেই যেন আমরা ধন্য হয়ে যাই। আমাদের কোন রা নেই। তাই কী? এটা একটা মাত্র উদাহরন। জনপ্রিয় নাট্যকারদের দিয়েই এ ধরনের প্রতারনা করানো হয় বেশী। এক ঘন্টার একটা নাটককে টেনে ছয় পর্বের সিরিজ বানানো হয়। সংশপ্তকের কথা মনে আছে? ওটা এই যুগে তৈরী হলে নিশ্চয় ৫০০ পর্বের মেগা সিরিয়াল হতো। মেগা সিরিয়াল কী?
উপরে যে নাট্যদর্শনের পরিসংখ্যান দিয়েছি সেই নাটকে ৫৪ মিনিট বসে থেকে কী দেখেছি সেটা বলি। নাটকে একটা মেয়ের শরীর খারাপ, ডাক্তার টেষ্ট দিল, টেষ্টের রিপোর্ট নিল, তার মা তাকে ভাত খাইয়ে দিল, তার ভাইও এক লোকমা খেল, মেয়েটার মামা ফোন করে অসুখের খোঁজ নিল, তাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী দাড়ি শেভ করলো, একটা বাচ্চা তাকে পেছন থেকে ভেঙালো। ব্যস এক পর্ব শেষ। চুয়ান্ন মিনিট বসে যদি আপনি কোন নাটকের এইটুকু ঘটনা দেখেন, তখন সেই নাট্যকার বা নাট্যপ্রদর্শক সংস্থাকে সারমেয় কা বাচ্চা বলতে ইচ্ছে হবে না?
এই সব টিভি প্রতারনা/ নাট্য প্রতারনা/বিজ্ঞাপন প্রতারনা দমনের জন্য সরকারের কোন আইন আছে কি? আমি যদি এইসব প্রতারনার বিরূদ্ধে নাগরিক হিসেবে মামলা করতে চাই, আমার পক্ষে কোন উকিল পাওয়া যাবে কী? সদাশয় সরকারের কাছে প্রশ্ন, আপনার কী টিভি চ্যানেলগুলোকে ‘যেমন খুশী তেমন সাজো’র লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন নাকি নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? যদি কোন নীতিমালা থাকে তাহলে নীতিমালাগুলো মানা হচ্ছে কী না সেটা দেখার টাইম কি আছে মন্ত্রনালয়ের? আপনাদের টাইম না থাকলে নীতিমালাগুলো আমাদেরকে দিন, আমরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সরকারকে রিপোর্ট দেবো এক মাসের মধ্যে।
টিভি চ্যানেলগুলোকে বলছি – আপনারা দয়া করে ডিজিটাল প্রতারনা থেকে বিরত থাকুন। অর্থলোভী কর্পোরেট বানিজ্যের মধ্যে ডুব দিয়ে আমাদের ভুলে যাবেন না। আমরা দর্শক, আমরা কিন্তু জেগে আছি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
কল্পতরু - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
এই পোষ্টটি আজই (ফেব্রুয়ারি ১৫) প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো ব্লগে। দেখুন এখানে (http://prothom-aloblog.com/users/base/uniresources/60)
নীড় সন্ধানী কি এই ব্লগের নীতিমালা বিষয়ে অবগত নন? এই ব্লগে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত (যেমন জরুরী মানবিক আবেদন) অন্য ব্লগে প্রকাশিত লেখা পোষ্ট করতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
মডারেটর মহোদয় কি বলেন?
নীড় সন্ধানী - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (১:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
কর্পোরেট মিডিয়ার অপবানিজ্যের বিরুদ্ধে এটি একটা প্রতিবাদ পোষ্ট এবং এই বিষয়ে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। তাই নীতিমালা বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও পোষ্টটি অন্যান্য ব্লগের পাশাপাশি এখানেও পাঠিয়েছিলাম। কতৃপক্ষ চাইলে পোষ্টটি মুছে দিতে পারেন। আমার কোন আপত্তি নেই।
মুক্তাঙ্গন - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (৩:১৩ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ কল্পতরু, বিষয়টি তুলে ধরার জন্য।
ধন্যবাদ নীড় সন্ধানী, আপনার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য।
এ সংক্রান্ত নীতিটি হল:
নীতিটি প্রণয়নে মুক্তাঙ্গনের ওয়ার্কগ্রুপের আর প্রতিটি নিয়মিত সদস্যের মতো নীড় সন্ধানীও সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। এখানকার সব নিয়ম ব্লগারদের তৈরী, এবং তার বাস্তবায়নের জন্যও ব্লগারদের উপরই ভরসা রাখতে চাই আমরা। লাঠি-গাজর পদ্ধতিতে নিয়মের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তো সর্বত্রই চলছে। তাতে যাদের জন্য নিয়মের সৃষ্টি, কোথায় যেন তাদের প্রতি কিছুটা অশ্রদ্ধাও লুকিয়ে থাকে (বিশেষত তাদের দায়িত্ববোধের প্রতি)। কিন্তু আমরা আমাদের লেখকদের নিজস্ব বিচার বিবেচনাবোধের ওপর ভরসা করতে চাই। তাই একদিকে যেমন আমরা কেউই চাইবো না যান্ত্রিকভাবে সব নিয়মের চর্চা হোক এখানে, তেমনিভাবে এও আশা করবো যে লেখকরা এখানকার নিয়ম এবং সে নিয়মের ব্যতিক্রমগুলো প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করবেন। Self regulation (self censorship নয়) এর এটাই মোদ্দা কথা। আর কোন বিষয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলে ওয়ার্কগ্রুপ তো রয়েছেই প্রশ্ন করে সমাধানে পৌঁছার জন্য।
অনেক ব্লগেই লেখা অনুমোদনের আগে মডারেটররা গুগল সার্চ করে জেনে নেয়ার চেষ্টা করেন লেখাটি অন্য কোথাও ছাপানো হয়েছে কিনা। আমরা এই গোয়েন্দাগিরিটুকু করতে চাইনা। সেটি মডারেটর লেখক দু’পক্ষের জন্যই বিব্রতকর, উপরে উল্লেখ করা কারণে।
আশা করি ডুয়েল পোস্টিং বিষয়ে মুক্তাঙ্গনের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা হলেও স্পষ্ট করা গেছে। আমাদের বিশ্বাস, সময়ের বিচারে এই অবস্থান ভুল প্রমাণিত হবেনা। যদি হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
কল্পতরু - ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ (৫:০৫ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ, মুক্তাঙ্গনকে। লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং আস্থা দৃষ্টান্তমূলক, অতুলনীয়। আশা করি এটা বজায় থাকবে।
নীড় সন্ধানীকেও ধন্যবাদ, তার চমৎকার ব্যাখ্যার জন্য।
মোহাম্মদ মুনিম - ২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৫:২৪ পূর্বাহ্ণ)
সেদিন বাংলাভিশনে একটি অনুষ্ঠানের নাম দেখে হেসেই ফে্ললাম, PHP কোরআনের আলো। কোরআন কি php এর সৌজন্যে নাজিল হয়েছিল কি না, সেটা বোঝা গেলো না।
সবুজ পাহাড়ের রাজা - ৭ অক্টোবর ২০১২ (১:৩১ পূর্বাহ্ণ)
২০০৯ সালের লেখা।
এখন ২০১২ সালে এসেও এই রীতি থেকে বেরুতে পারেনি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বরং অবস্থা আরো খারাপ।
আমরা এখন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে টিভি চ্যানেলের অনুষ্টান দেখি।