অথচ একসময়ে রটে গিয়েছিল যে, নভেরা আহমেদ বোধহয় বেঁচে নেই। বেঁচে যদি-বা থাকেনও, সক্রিয় নেই — সৃষ্টিশীলতার বাইরে ছিটকে পড়েছেন, হারিয়ে গিয়েছেন অপরিচয়ের অন্ধকারে। [. . .]

এই এক সত্তা যে নিঃশর্তে এবং সম্পূর্ণভাবে তার শিল্পে নিবেদিত। শিল্প তাঁকে আবিষ্ট করে রেখেছে এবং এই সর্বগ্রাসী আবেগে সদা উত্তেজিত তাঁর অন্তর। তাঁর জীবন তিনি একাকী যাপন করছেন শিল্পের ভেতর এবং শিল্পের জন্যে। এই কথা ক’টি ১৯৬০ সালের। এর পরেও আরো পঞ্চান্ন বছর শিল্পের প্রতিই তিনি নিবেদিত থেকেছেন। একেবারে নিজের মতো করেই বাঁচতে চেয়েছেন; যাপন করেছেন তাঁর নিভৃত জীবন। সম্প্রতি অগ্রগণ্য এই শিল্পীর জীবনাবসান হলো পঁচাশি-উত্তীর্ণ বয়সে, দূর প্রবাসে। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মতো তিনি চিত্রকর নয়, হতে চেয়েছিলেন ভাস্কর। এই নির্বাচন তাঁর নিজের। দেশবিভাগোত্তর ঢাকার নতুন শিল্পবিদ্যালয়ে তখনও মেয়েদের শিল্পশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়নি, ভাস্কর্যও অন্তর্ভুক্ত হয়নি পাঠ্যক্রমে। তিনি পড়তে গিয়েছেন লন্ডনে, ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস-এ, নিজেরই আগ্রহে। ইয়োরোপীয় আধুনিক ভাস্কর্যের পরম্পরা প্রত্যক্ষ করেছেন, একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত। গিয়েছেন ফ্লোরেন্সে, ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির স্টুডিওতে। ইউরোপের শিল্পতীর্থগুলিতে — দোনাতেল্লো, মিকেলাঞ্জেলো, রোদ্যাঁর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীর একাগ্রতায়। এই সবই যেন তাঁর সুবিস্তৃত পাঠ্যক্রমের অংশ, তাঁর প্রস্তুতিপর্ব। দেশবিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে, বাংলাদেশে, আধুনিক ভাস্কর্যচর্চা সূচনা করবার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই অর্পিত হয়েছিল। অন্য কেউ তাঁকে দেয়নি এই দায়িত্ব, দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। আবগারি বিভাগের কর্মকর্তা, পিতা সৈয়দ আহমেদের কর্মসূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা শহর কলকাতায়; পড়েছেন কনভেন্টে — লরেটোয়। বোন আর ভাইদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন বাড়ির উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। দেশবিভাগের পর পিতার বদলির কারণে থেকেছেন কুমিল্লায়, তারপর কিছুকাল বাবা-মায়ের শহর চট্টগ্রামে। পরে, ইয়োরোপ থেকে ভাস্কর্যের পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে, তাঁর কাজের ক্ষেত্র হলো ঢাকা — পাকিস্তানের পুব অংশের রাজধানী, শিল্পচর্চারও প্রাণকেন্দ্র। তিনি ভেবেছিলেন, এখানে নগর পরিকল্পনায় স্থাপত্য আর ভাস্কর্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবে। ভেবেছিলেন, নগর-জীবনের দিগন্তসীমায় অধিষ্ঠান হবে শিল্পের। এই স্বপ্ন নিয়েই এ ভূখণ্ডের প্রথম আধুনিক ভাস্কর হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ১৯৬০ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে প্রায় পঁচাত্তরটি ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীর আগেই, ১৯৫৭ আর ’৫৮ সালে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন তিনি। প্রথমটি পাবলিক কমিশনের কাজ: মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য-নকশায় নির্মিত গণগ্রন্থাগারের নীচতলার দেয়ালে গ্রাম-বাংলার দৃশ্য নিয়ে একটি আধুনিক ফ্রিজ — দেয়াল-লগ্ন নতোন্নত ভাস্কর্য। আর দ্বিতীয়টি প্রাইভেট কমিশন: মণিপুরিপাড়ায় শিল্পপতি এম. আর. খানের নির্মীয়মাণ বাসভবনের উদ্যানে ফোয়ারা সমেত একটি পূর্ণায়তন মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য,…

আমার কোনো খেদ নেই, আমার কোনো অভিমান নেই – আপনাদেরও যা আছে ঝেড়ে ফেলুন। আমার কাজ যদি কোনো আগ্রহ তৈরি করে আপনাদের মধ্যে চেষ্টা করুন দেখুন আমার কাজ, আর যদি না করে অন্য কোনো আগ্রহের জায়গায় সময় দিন [...]

জীবনেরও দেয়ার সীমাবদ্ধতা আছে, আমি জানি। জন্ম না হলে হয়তো জানা হত না, কিন্তু জন্ম হয়ে যা জানা হল তাতে আমি প্রতিটি দিন কালো থেকেছি – মৃত্যু আমি বয়ে বেড়িয়েছি, বুদ্ধের চোখের মতো : প্রণত পাপড়ির রেখার মাঝে, তারা, যা ধ্যান খচিত – সংখ্যা মনে রাখতে হয় শুধু, চারটি পাপড়ি, দুটি তারা, কে আনত কেউ জানে না, সবাই জানে আমরা দেখছি দুটি চোখ, আর সবার মতো, বুদ্ধেরও। আমাকে কাজ করতে না দেয়ার অনেক যুক্তি থাকতে পারে, আমাকে অবজ্ঞা করার অনেক উপায় থাকতে পারে, আমাকে বসবাস করতে না দেয়ার অনেক উপলক্ষ থাকতে পারে, আমাকে অপ্রাসঙ্গিক ভাবার অনেক প্রকল্প থাকতে পারে, আমাকে যৌনবস্তু ভাবার অনেক প্রস্তাব থাকতে পারে, আমাকে অবাংলাদেশ ভাবার অনেক প্রগতিঅপ্রগতিশীল থাকতে পারে, আমাকে চামুচমুখেদেয়া বৈভবখোর ভাবার অনেক সংগ্রামঅসংগ্রামশীল থাকতে পারে – কিন্তু সবকিছুর বিপরীতে কথা হল আমি নিরন্তর কাজ করেছি। আর কাজের জন্য আমি স্থান বদল করেছি বা স্থান নির্বাচন করেছি। এবং ইতিহাসের পাতা জুড়ে আপনি দেখবেন অনেকেই তাই করেছেন – কিন্তু আমি কেন আলাদা হয়ে গেলাম? –আপনাদের দেখার ভুলেই নিশ্চয়। আপনারা কেন আমাকে এভাবে দেখলেন? – এটা আমার কোনো প্রশ্ন বা অভিমান নয়, এটা আমার বোধ, এটা এমন নয় স্থানকালের কিছু পাত্রের পরিবর্তন হলেই আপনাদের দেখার ভুল ঘটত না – সব ঠিকঠাক চলত, তা কিন্তু নয়। মন খুলে বলুন তো কত জন ভাস্কর আছে বাংলাদেশে? কত জন ভাস্কর কাজ করে বাংলাদেশে? কতটা ভাস্কর্যপ্রবণ বাংলাদেশ? তাহলে বলুন কোথায় দাঁড়িয়ে আপনাদের ভুল দেখা ঠিক হয়ে যেত? শেষ পর্যন্ত কাজে থাকতে আমাদের অনেক কিছু করতে হয়ই, যেমন কাজ শিখতেও আমাদের অনেক কিছু না করে থাকতে হয়। যেজীবন বেছে নিয়েছিলাম তার আদ্যোপান্ত আমাকেই ছিবড়ে নেবে তা জেনেই আমি জীবন শুরু করেছিলাম – আমার কোনো খেদ নেই, আমার কোনো অভিমান নেই – আপনাদেরও যা আছে ঝেড়ে ফেলুন। আমার কাজ যদি কোনো আগ্রহ তৈরি করে আপনাদের মধ্যে চেষ্টা করুন দেখুন আমার কাজ, আর যদি না করে অন্য কোনো আগ্রহের জায়গায় সময় দিন, আমার জীবন যদি কোনো আগ্রহ তৈরি করে আপনাদের মধ্যে আমার জীবনটাকে উদঘাটন করার চেষ্টা করুন, আর যদি না করে অন্য কোনো আগ্রহের…

তাই যখন নভেরা এখন আবার আমাদের ভাবনায় সচল হয়েছেন তখন এই আকাঙ্ক্ষা কি আমরা করতে পারি না যে, আমাদের এই পথিকৃৎ ভাস্করকে দেখবার জন্যে আমাদের এক জোড়া নতুন চোখ চাই? [. . .]

নভেরা আহমেদ আর নেই — এই কথাটি প্রচারিত হবার পরে নভেরা যেন আবার ফিরে এলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ, সব পাঠকের আলোচনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রচার মাধ্যম নভেরা বিষয়ে আবার একটু বিশেষভাবে সরগরম হয়েছে। আর এই পৃথিবীর আর এক প্রান্তে বসে সেই সরগরম দুনিয়াটায় আমি ঘুরছিলাম। খুঁজছিলাম কোথায় কী লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে নভেরাকে নিয়ে। কী রূপে ফিরছেন আমাদের পথিকৃৎ ভাস্কর তাঁর মৃত্যুর পরে? খুব অল্প কিছু সংখ্যক লেখা চোখে পড়েছে যেগুলোর শব্দের গাঁথুনিতে নভেরার শিল্পী-মূর্তি ধরা পড়েছে। বাকিরা ফিরে ফিরে দেখেছেন হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘নভেরা’ উপন্যাস থেকে উঠে আসা নায়িকাকে। আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যাঁকে বাদ দিলে, সেই নভেরার কেবল জীবনযাপনের গল্পই যখন তাঁকে সামনে নিয়ে আসার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভাবতেই হয় আমরা এখন নভেরার জন্মসাল ১৯৩০-এ দাঁড়িয়ে আছি। নভেরা আমাদের ছাড়িয়ে টাইম মেশিনে চেপে পেরিয়ে যাচ্ছেন একবিংশ শতক। বিংশ শতকের মধ্যভাগে যে নারী ভাস্কর হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে লড়েছেন তাঁকে আমরা দেখছি ছানি-পড়া চোখে। যে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি তাঁর সৃষ্টিকে কাষ্ঠবৎ জড় বিবেচনায় অবহেলা করেছে, আর রক্তমাংসের মানুষটির জীবনাচারকেই তাঁর সমস্ত জীবনের মাপকাঠিতে রূপান্তরিত করেছে, সেই দৃষ্টি কি পারে সময় থেকে এগিয়ে থাকা মানুষটির প্রকৃত স্বরূপের মূল্যায়ন করতে? পারে না, পারে না বলে এই সব দৃষ্টির অধিকারীরা তাদের নিজের অবস্থানে টেনে নামাতে চায় তাঁর শিল্পীসত্তাকে। নভেরার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেনি, ঘটবার কথাও ছিল কিনা বুঝতে পারি না। দীর্ঘকাল তো চলেছে আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস নভেরাকে বাদ দিয়ে কিংবা আড়াল করে। কিছু অনুসন্ধানী চোখ তাঁর শিল্পীসত্তা আর তাঁর সৃষ্টিকে নতুন করে ফিরিয়ে না আনলে নভেরা তো হারিয়েই গিয়েছিলেন। নভেরার নয়, বরং আমাদেরই সৌভাগ্য যে কেউ কেউ ফিরে দেখেছিলেন তাঁকে, নইলে ভুলভাল শিল্পের ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকতো আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস। কিন্তু এর পরেও কথা থেকে যায়, কেননা শিল্পের ইতিহাস সাধারণ অর্থে শিল্পকলার মানুষেরই। সর্বসাধারণের কাছে তবে কী করে পৌঁছাবেন আমাদের শিল্পের ইতিহাসের প্রথম এবং প্রধানতম ভাস্কর? তাঁকে সাধারণের কাছে প্রথমবারের মতো নিয়ে এলেন হাসনাত আবদুল হাই। ১৯৯৪ সালের হাসনাত সাহেব ‘নভেরা’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই নভেরাকে সাধারণ শিল্পানুরাগী বা কৌতূহলী পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন। এর পরেও এই উপন্যাস বহুবার…

ইকতিয়ার চৌধুরীর লেখা থেকে জানতে পেরেছিলাম, নভেরা আহমেদ বাংলায় কথা বলেন না, কথা বলেন ইংরেজিতে। কিন্তু আমি কী করব – ততক্ষণে আমি ইংরেজি ফরাসি যে একটু-আধটু পারতাম তাও ভুলে বসেছি। অগত্যা বাংলাতেই নভেরাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম… কিন্তু অপর পাশের অভিমান যে সুউচ্চ, পর্বতের মতোই অনড়। [. . .]

২০১২ সালের শেষদিকের কথা। ফেসবুকে একজনের ওয়ালে একটা ফটোগ্রাফ দেখি; ছবির সঙ্গে নাম না থাকলে হয়তো খেয়াল করতাম না ওটা কার প্রতিকৃতি। এ যে আমাদের অভিমানী শিল্পী নভেরা আহমেদ! তাঁর সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানতাম। যদিও বাংলাদেশের শিল্পজগতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই আমার অজানা। আমি শিল্পকলার ছাত্র নই, তার ওপর কয়েক বছর ধরে আছি দেশের বাইরে। বিদেশে থাকি বলেই বাংলা বইপত্র নিয়ে কথা বলার সুযোগ খুঁজি। ফেসবুকে বইপড়ুয়াদের একটা বড়োসড়ো গ্রুপও ততদিনে গড়ে উঠেছে। নভেরার ফটোগ্রাফ যাঁর ওয়ালে দেখেছিলাম তাঁর সঙ্গেও আলাপ ওই বইয়েরই সূত্রে। আমার বিশেষভাবে আগ্রহ ছিল রুশ সাহিত্যের বইপত্র বিষয়ে; আর রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত অনুবাদক ননী ভৌমিককে নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে একটি লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা করবেন বলেও জেনেছিলাম। নভেরার ছবির সূত্রে নয়, বরং রুশ সাহিত্য নিয়ে আলাপের জন্যই ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে তাই বন্ধুত্ব করতে চাইছিলাম। প্রারম্ভিক এক আলাপের মাঝখানেই তিনি নিশ্চিত হতে চাইলেন যে আমি প্যারিসে থাকি কিনা, আর তারপর কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই উত্থাপন করলেন নভেরা আহমেদের কথা। জানতে চাইলেন, দীর্ঘদিন ফ্রান্স-প্রবাসী এই বাঙালি ভাস্কর সম্পর্কে আমার আগ্রহ আছে কিনা। আগ্রহ অবশ্যই আছে; কিন্তু তিনি যে ফ্রান্সেই আছেন, সে-কথা আমি জানতাম না। নিজের অজ্ঞতার কথা খোলাখুলিই স্বীকার করি। আমার বন্ধু তখন মুক্তাঙ্গন ব্লগের একটা পোস্টের লিংক দেন আমাকে – তাঁরই লেখা, এবং পড়তে বলেন। বিশেষভাবে অনুরোধ করেন যেন আমি নভেরা আহমেদ সম্পর্কে এবং বিশেষ করে তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে সম্ভব হলে খোঁজ নিই। আমাদের এই আলাপ হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর রাতে। সে-রাতেই লেখাটি পড়তে শুরু করি। ‘নভেরা আহমেদ : মৃত ও জীবিত’ – ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে রেজাউল করিম সুমনের একটি অনুসন্ধানী লেখা। শিল্পীকে নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কথা জানতে পারি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তাঁর কয়েকটি কাজ কীরকম অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে তারও ছবি ছিল ওই লেখার সঙ্গে। ততক্ষণে আমার বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে – সত্যিই কি নভেরা মারা গেছেন? এরপর মূল লেখার নীচে নানা জনের মন্তব্যগুলি পড়তে থাকি, ক্রমশ জট খুলতে থাকে। সুমন ভাইয়ের ব্লগপোস্ট আর তার নীচে বিভিন্ন জনের মন্তব্য থেকে শেষপর্যন্ত যা জানা গেল তা হলো – নভেরা আহমেদ এখনো জীবিত, তবে বন্ধুদের কারো…

বাংলাদেশের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদের মূল্যায়ন করা হয় মূলত তাঁর ১৯৫৭–১৯৬০ সালের ভাস্কর্য দিয়ে। এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে তাঁর ১৯৬০–১৯৭০ কালপর্বের ভাস্কর্যসৃষ্টির পরিচয়। [...]

[প্যারিসে নভেরা আহমেদের প্রায় একশো দিন ব্যাপী (১৬ জানুয়ারি—২৬ এপ্রিল ২০১৪) পূর্বাপর প্রদর্শনীর আজ শেষদিন। এতে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর ১৯৬৯–২০১৪ কালপর্বের ৫১টি শিল্পকর্ম (৯টি ভাস্কর্য ও ৪২টি চিত্রকর্ম)। নীচের প্রবন্ধটির উপজীব্য নভেরার এই কালপর্বের অব্যবহিত আগের এক দশক অর্থাৎ ১৯৬০–১৯৭০ সালের ভাস্কর্যসৃষ্টির পটভূমি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই লেখার আদিপাঠ মুদ্রিত হয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত শিল্প ও শিল্পী  ত্রৈমাসিকের তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (কার্তিক ১৪২০, নভেম্বর ২০১৩)। মুক্তাঙ্গনে প্রকাশের সময়ে দু-এক জায়গায় সামান্য পরিমার্জনা করা হয়েছে।] . ১৯৬০ সালে ঢাকায় নভেরা আহমেদের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে সে-প্রদর্শনীর প্রায় চল্লিশটি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে একত্রে মাসাধিককালব্যাপী প্রদর্শিত হয়। পরে শিল্পপতি এম আর খানের বাড়ির উদ্যানে নির্মিত মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য ‘পরিবার’ও (১৯৫৮) ফোয়ারা-সহ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পুনঃস্থাপিত হয়। বাংলাদেশে ভাস্কর হিসেবে নভেরার মূল্যায়ন মূলত তাঁর ১৯৫৭–৬০ কালপর্বের শিল্পকর্মগুলির আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরবর্তীকালে যথাক্রমে ব্যাংককে ও প্যারিসে আয়োজিত শিল্পীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় একক প্রদর্শনী সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে তাঁর পরিণত পর্যায়ের শিল্পকৃতি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি। বিগত প্রায় পাঁচ দশক তাঁর নিভৃত প্রবাস-যাপনের ফলে এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই, তাঁর শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা সম্পর্কেও আমরা অনবহিত। শিল্পীজীবনের উন্মেষপর্বে, ১৯৬১ সালে, ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি; পরে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচিত হয়েছে (নভেরা, হাসনাত আবদুল হাই, ১৯৯৪, গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৯৫), নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র (নহন্যতে, এন রাশেদ চৌধুরী, ১৯৯৯)। বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে ভাস্কর ও নারীশিল্পীদের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও নভেরা আহমেদের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনো পর্যন্ত হয়নি। ১৯৫০ দশকের প্রথমার্ধে লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে চেক ভাস্কর কারেল ফোগেলের (১৮৯৭–১৯৬১) তত্ত্বাবধানে নভেরার শিল্পশিক্ষা-পর্ব মেহবুব আহমেদের একাধিক প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। আমিনুল ইসলামের স্মৃতিকথার (বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর : প্রথম পর্ব ১৯৪৭–১৯৫৬, ২০০৩) কল্যাণে বিখ্যাত ইতালীয় ভাস্কর ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির (১৯১৮–২০০২) ফ্লোরেন্সের স্টুডিওতে নভেরার প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথাও আমাদের অবিদিত নয়। তাঁর ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যের আঙ্গিক, করণকৌশল ইত্যাদি নিয়ে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.