তাই যখন নভেরা এখন আবার আমাদের ভাবনায় সচল হয়েছেন তখন এই আকাঙ্ক্ষা কি আমরা করতে পারি না যে, আমাদের এই পথিকৃৎ ভাস্করকে দেখবার জন্যে আমাদের এক জোড়া নতুন চোখ চাই? [. . .]

নভেরা আহমেদ (আনু. ১৯৩০–২০১৫)

নভেরা আহমেদ (আনু. ১৯৩০–২০১৫)

নভেরা আহমেদ আর নেই — এই কথাটি প্রচারিত হবার পরে নভেরা যেন আবার ফিরে এলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ, সব পাঠকের আলোচনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রচার মাধ্যম নভেরা বিষয়ে আবার একটু বিশেষভাবে সরগরম হয়েছে। আর এই পৃথিবীর আর এক প্রান্তে বসে সেই সরগরম দুনিয়াটায় আমি ঘুরছিলাম। খুঁজছিলাম কোথায় কী লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে নভেরাকে নিয়ে। কী রূপে ফিরছেন আমাদের পথিকৃৎ ভাস্কর তাঁর মৃত্যুর পরে? খুব অল্প কিছু সংখ্যক লেখা চোখে পড়েছে যেগুলোর শব্দের গাঁথুনিতে নভেরার শিল্পী-মূর্তি ধরা পড়েছে। বাকিরা ফিরে ফিরে দেখেছেন হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘নভেরা’ উপন্যাস থেকে উঠে আসা নায়িকাকে। আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যাঁকে বাদ দিলে, সেই নভেরার কেবল জীবনযাপনের গল্পই যখন তাঁকে সামনে নিয়ে আসার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভাবতেই হয় আমরা এখন নভেরার জন্মসাল ১৯৩০-এ দাঁড়িয়ে আছি। নভেরা আমাদের ছাড়িয়ে টাইম মেশিনে চেপে পেরিয়ে যাচ্ছেন একবিংশ শতক।

বিংশ শতকের মধ্যভাগে যে নারী ভাস্কর হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে লড়েছেন তাঁকে আমরা দেখছি ছানি-পড়া চোখে। যে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি তাঁর সৃষ্টিকে কাষ্ঠবৎ জড় বিবেচনায় অবহেলা করেছে, আর রক্তমাংসের মানুষটির জীবনাচারকেই তাঁর সমস্ত জীবনের মাপকাঠিতে রূপান্তরিত করেছে, সেই দৃষ্টি কি পারে সময় থেকে এগিয়ে থাকা মানুষটির প্রকৃত স্বরূপের মূল্যায়ন করতে? পারে না, পারে না বলে এই সব দৃষ্টির অধিকারীরা তাদের নিজের অবস্থানে টেনে নামাতে চায় তাঁর শিল্পীসত্তাকে।

নভেরার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেনি, ঘটবার কথাও ছিল কিনা বুঝতে পারি না। দীর্ঘকাল তো চলেছে আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস নভেরাকে বাদ দিয়ে কিংবা আড়াল করে। কিছু অনুসন্ধানী চোখ তাঁর শিল্পীসত্তা আর তাঁর সৃষ্টিকে নতুন করে ফিরিয়ে না আনলে নভেরা তো হারিয়েই গিয়েছিলেন। নভেরার নয়, বরং আমাদেরই সৌভাগ্য যে কেউ কেউ ফিরে দেখেছিলেন তাঁকে, নইলে ভুলভাল শিল্পের ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকতো আমাদের শিল্পকলার ইতিহাস।

কিন্তু এর পরেও কথা থেকে যায়, কেননা শিল্পের ইতিহাস সাধারণ অর্থে শিল্পকলার মানুষেরই। সর্বসাধারণের কাছে তবে কী করে পৌঁছাবেন আমাদের শিল্পের ইতিহাসের প্রথম এবং প্রধানতম ভাস্কর? তাঁকে সাধারণের কাছে প্রথমবারের মতো নিয়ে এলেন হাসনাত আবদুল হাই। ১৯৯৪ সালের হাসনাত সাহেব ‘নভেরা’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই নভেরাকে সাধারণ শিল্পানুরাগী বা কৌতূহলী পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন। এর পরেও এই উপন্যাস বহুবার পড়া হয়েছে এবং অনেকের কাছেই এটি নভেরাকে জানার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। হাসনাত সাহেব যে-নভেরাকে সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁকে বাংলাদেশের পথিকৃৎ ভাস্কর হিসেবে না দেখে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে যদি দেখা যায় তাহলে হয়তো শিল্পী নভেরাকে দেখা সহজ হবে। কারণ ‘নভেরা’ উপন্যাসকে যদি ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস হিসেবে দেখি তবে সে-উপন্যাসের তথ্যগত বিষয়ের ক্ষেত্রে যতটা সর্তকতার দরকার ছিল, বা লেখকের কল্পনার মিশ্রণের ক্ষেত্রেও যে সাবধানতার প্রয়োজন ছিল, পুরো উপন্যাস জুড়ে তার খামতি চোখে পড়ে। ফলে, বলা বাহুল্য, শিল্পী নভেরার অবস্থান এখানে গৌণ। তারপরেও পেরিয়ে গেছে ২১ বছর; এই দীর্ঘ সময়ে আরো কিছু গবেষণাধর্মী, কিছু কৌতূহল-উদ্দীপক লেখা প্রকাশিত হয়েছে নভেরাকে নিয়ে। গবেষণাধর্মী লেখার পাঠক খুব বেশি না হলেও কৌতূহল-জাগানো লেখার পাঠকের অভাব হয়নি। ফলে আজ যখন সত্যি নভেরা একেবারেই নেই হয়ে গেলেন আমাদের জাতীয় জীবন থেকে তখন নভেরাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেই পুনরায় আলোচনায় নিয়ে আসছেন। অথবা এমনভাবে তাঁকে উপস্থাপন করছেন যাতে করে তাঁর শিল্পীসত্তাটি ঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না। মূল্যায়িত হতে পারছে না তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার ইতিহাস।

নভেরার অসাধারণ সব সৃষ্টির মূল্যায়ন আমার ক্ষমতার বাইরে। আমি বরং আমরা তাঁকে যে অতি সাধারণ চোখে দেখেই খানিকটা মনগড়া, বেশ অনেকটা মুখোরোচক এবং আংশিক সত্য মিলিয়ে শব্দে-লেখায় তাঁর যে প্রতিকৃতি আকছি, সেখানটাতে আমার যে-মতভেদ তা-ই জানাতে চাই।

একটু পেছন থেকে শুরু করি। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্যারিসে নভেরার রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আনা ইসলামের এক লেখার শুরুতে পত্রিকার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে যে, ‘প্যারিসে আত্মগোপন করে ছিলেন শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার ও বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত নভেরা আহমেদ। কিন্তু প্যারিসপ্রবাসী শিল্প-সমালোচক আনা ইসলামের সঙ্গে তাঁর গোপন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের।’ প্রশ্ন উঠতে পারে এই ‘আত্মগোপন’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে। আর কারো সাথে শিল্পীর ‘গোপন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক’ কথাটি কি সাধারণ পাঠকের অসভ্য কৌতূহলে সুড়সুড়ি দেয় না? নভেরা খুনি, চোর, ডাকাত কিংবা জঙ্গিবাদী তো নন, তাহলে কেন এই ‘আত্মগোপন’ শব্দটির প্রয়োগ করা হলো? তিনি সিনেমা-থিয়েটারের নায়িকাও নন যে তাঁর সাথে কারো যোগাযোগের কথা বলে সর্বসাধারণের কৌতূহলকে উশকে দিতে হবে। আমার তো মনে হয়, এই সব পাঠকপ্রিয় লেখার জন্যেই আমাদের নভেরাকে দেখার চোখ তৈরি হতে পারছে না। অবন ঠাকুরের ক্লাসের ছাত্রদের গোলদিঘি দেখার মতো কেবল তাকিয়ে দেখার চোখ দিয়েই নভেরার জীবনযাপনকেই আমরা কেবল তাকিয়ে দেখছি। গবেষণাধর্মী লেখা গুলোকে বাদ দিলে আর প্রায় সব লেখায় নভেরা কৌতূহল-উদ্রেককারী হিসেবেই ঘুরেফিরে এসেছেন। আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাসের পথিকৃৎ শিল্পীকে যখন আমরা এভাবে উপস্থাপন করছি তখন তাঁর সৃষ্টিশীলতা, মেধা, স্বপ্ন, তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার লড়াই, এই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপনই মুখ্য হয়ে উঠছে। মুখ্য হয়ে উঠছে তাঁর বেশবাস, তাঁকে নিয়ে মুখরোচক স্মৃতিচারণ।

অনলাইনেই পড়ছিলাম নভেরাকে নিয়ে একসময়ের অভিনেত্রী লুতফুর নাহার লতার একটা ছোট লেখা। সেই লেখায় ফিরে এলেন হাই সাহেবের নভেরাই! নভেরার সাহসী জীবন যাপনের কথায় ফিরে এলো স্লিভলেস ব্লাউজ, তাঁর লিভটুগেদারের জীবন। বোকা বনে যাই সত্যিই। যিনি লিখছেন তিনি নিজেও একজন শিল্পী, অথচ বড় সাধারণ চোখে দেখছেন নভেরাকে। আমাদের ব্লাউজের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদানন্দিনী মেম সাহেবদের টপসের কায়দায় শাড়ির সাথে পরবার জন্যে ব্লাউজের প্রচলন করেন। তার আগে পর্যন্ত মহিলারা ব্লাউজের ব্যবহার জানতেন না। তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে যাঁরা ব্লাউজ পরতেন না তাঁরা নভেরার চাইতেও বেশি সাহসী? রইল লিভটুগেদার, গান্ধর্ব বিবাহে পুরুত মন্ত্র কাগজ কলম সই সাবুদ সাক্ষী প্রমাণের দরকার ছিল না। এই রীতি প্রাচ্যের ধর্মব্যবস্থায় স্বীকৃত। তাহলে কারো সাথে নিজের ইচ্ছেয় বসবাস করতে গিয়ে নভেরা কোনো বড় বিপ্লব তো ঘটাননি। তিনি যা করেছেন সেটি আমাদের নিত্যকার চেনা ছকের মধ্যে পড়ে না। আর তিনি ছকের বাইরে জীবনযাপন করতেন — এইটুকুই কি তাঁর সাহসিকতা, তাঁর সময় থেকে এগিয়ে থাকার মাপকাঠি?

নিজে শিল্পকলার ছাত্রী ছিলাম বলেই নভেরাকে যখন দেখি তখন আমি সেই শিল্পীকে দেখি যিনি তাঁর সময়কে অতিক্রম করে গেছেন তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। পাশ্চাত্যের শিল্পশিক্ষার সাথে প্রাচ্যের দর্শন আর শিল্প ভাবনাকে মিলিয়ে তিনি যে অনন্য সৃষ্টিগুলো করেছেন সেগুলোই আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার ভিত্তি। নগরকেন্দ্রিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর ভাবনা যে নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে সেখানেই তিনি আধুনিক। আর নানান প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যে তিনি শিল্পী হয়ে উঠবার নিরন্তর সাধনায় রত ছিলেন সেখানটাতেই আমি তাঁর সাহসী মুখটিকে দেখি। তাই যখন নভেরা এখন আবার আমাদের ভাবনায় সচল হয়েছেন তখন এই আকাঙ্ক্ষা কি আমরা করতে পারি না যে, আমাদের এই পথিকৃৎ ভাস্করকে দেখবার জন্যে আমাদের এক জোড়া নতুন চোখ চাই?

শিল্পকলার শিক্ষার্থী হলেই বা শিল্পানুরাগ থাকলেই কেবল এমন চোখ তৈরি হবে তা নয়। আর তার প্রমাণও মিলল মুক্তমনায় নভেরাকে নিয়ে আসমা সুলতানা মিতার লেখা ‘নির্বাসিতের নির্বাসন’ পড়তে গিয়ে। মিতা আসলে কী বলতে চাইলেন সমস্ত লেখটা জুড়ে, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। লেখাটা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি নভেরার ছবি দেখেছেন, শিল্পকর্ম নয়! নভেরা কেন চলে গেলেন, কেন ফিরলেন না — এই নিয়ে আক্ষেপ করেছেন শিল্পী। নভেরার শিল্পী হয়ে ওঠার পথটা তিনি যত সুগম ভেবে উপস্থাপন করেছেন তাতে মনে হতে পারে অর্থবিত্ত আর পারিবারিক সাপোর্ট থাকলে যে কেউই নভেরা হয়ে উঠতে পারেন। আমাদের দেশে কিছু লোকজন আছেন যাঁরা নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের চাইতে বড় করে তুলতে গিয়ে এই রকমের তরল যুক্তির উপস্থাপন করেন — যে-সুযোগ রবীন্দ্রনাথ জমিদার-নন্দন হয়ে পেয়েছেন তার এক কণা পেলেও নজরুল দেখিয়ে দিতেন। আমার তো মনে হয় যাঁরা এই রকমের কথা বলেন তাঁরা আসলে দু’জনের কারো সৃষ্টির সাথেই সেভাবে পরচিত নন।

মিতা লিখেছেন, নভেরাকে আমরা কি বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে দাবি করতে পারি? ৪০ বছর আগে দেশ ছেড়ে যিনি চলে গেছেন, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে কখনোই পা রাখেননি, তাঁকে আমাদের শিল্পী বলতে তাঁর মনে হলো জোরালো আপত্তি আছে। নভেরা ১৯৬৩ সালের পরে আর দেশে আসেননি সে ক্ষেত্রে তার প্রবাসজীবন ৫২ বছরের। এর আগেও একটানা খুব বেশিদিন তিনি আসলে দেশে ছিলেন না। তারপরও যে অল্প সময় তিনি দেশে থেকে কাজ করেছেন — হোক সে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান — সে-সময়ে তিনি আমাদের একমাত্র ভাস্কর যিনি তাঁর পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে প্রাচ্যের সাথে যুক্ত করে একটি নতুন ধারার সন্ধান দিয়েছিলেন। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের পরিপূরক সম্পর্ক বিষয়ে যে নতুন ভাবনা তিনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন, সেই পথ ধরেই আমাদের ভাস্কর্যশিল্প আজকের অবস্থানে পৌঁছুতে পেরেছে। সমকাল পত্রিকায় ইমতিয়ার শামীম ‘নভেরার মৃত্যুশিল্প’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন; সেখানে ভাস্কর্য বিষয়ে নভেরার একটা মন্তব্য তিনি উল্লেখ করেছেন। সেই কথাগুলো আবার এখানে যুক্ত করে দিচ্ছি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটিকে অনুধাবনের জন্য। নভেরা বলেছেন, ‘নগর পরিকল্পনায় প্রতিটি স্থাপনার উপযুক্ত পরিসরে ভাস্করদের ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন জড়িয়ে পড়ে শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ ও ইতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে।’ তিনি চেয়েছিলেন নতুন নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে পৃথিবীর মহীয়ান নগরগুলোর পরিকল্পনা ও উদ্দীপনার কাছে ফিরে যেতে। তিনি বলেছিলেন, শিল্পীদের কর্তব্য হলো মানুষের জীবনের সত্য, অর্থ ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতি কৌতূহলের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং কেবল তখনই তা সম্ভব হতে পারে যখন নগরজীবনের পরিধিতে শিল্পের জায়গা করে দেওয়া যাবে। নভেরা যে ভাবনা গত শতকের মধ্যভাগে বসে ভেবেছেন আজকে এই সময়ে এসেও আমরা তাকে কতটা রূপান্তরিত করতে পেরেছি?

নারীশিল্পী হিসেবেই যদি দেখি তবে বলতে হবে শিল্পচর্চার মতো একটি ব্যতিক্রমী ধারায় আজকের নারীশিল্পীদের পথপ্রদর্শক নভেরা। এই যে এতগুলো শক্ত ভিত্তি নভেরা তাঁর শিল্পচর্চার ভেতর দিয়ে আমাদের দিয়ে গেলেন সেই অধিকার কি যথেষ্ট নয় তাঁকে আমাদের বলে দাবি করবার জন্যে? যদি না হয় তবে মিতার জন্যে একটি সরল যুক্তি রাখি, যাতে করে নভেরা যে আমাদের শিল্পী সেটা মেনে নিতে তাঁর বাধা না থাকে। ৫২ বছরের এই প্রবাস-জীবনে নভেরা বিদেশি পাসপোর্ট ব্যাবহার করেছেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়মিত নবায়ন করেছেন।

চারুশিল্প অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের চাইতে খানিকটা আলাদা; এখানে শিল্প যতটা আলোচিত হয় শিল্পী ততটা নয়। ফলে মিতা যে বলেছেন নভেরা জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন, সেটি ঠিক নয়। আর নভেরাকে নিয়ে ব্যাপক ও অযাচিত কৌতূহলের আকরগ্রন্থ ‘নভেরা’ উপন্যাসই তাঁকে খানিকটা সাধারণের আলোচনার তুঙ্গে নিয়ে এসেছিল অল্প সময়ের জন্যে। কিন্তু একে ঠিক জনপ্রিয়তা বলা চলে কিনা আমি জানি না। ফ্রান্সের মাটিকেই তিনি আপন করে নিয়েছেন — এমন কথাই বা মিতা এত দৃঢ়ভাবে কী করে বলেছেন আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় তিনি নভেরার সাম্প্রতিক সময়ের কাজগুলোকে কেবল তাকিয়ে দেখেছেন আর একডেমির শিক্ষার মাপকাঠি দিয়ে মেপেছেন, তাই নভেরার সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর কাজগুলোর নামকরন, বিষয় নির্বাচন তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে।

বিদেশে শিল্পীদের আর্থিক সুবিধা সুলভ — এমন একটা মনগড়া কথাও তিনি লিখেছেন নভেরার শিল্পচর্চার প্রসঙ্গে। অত সহজ হলে দলে দলে শিল্পীরা কমিশনের কাজ বাদ দিয়ে কেবল শিল্প চর্চাই করতেন। নভেরার শারীরিক অসুস্থতার খবর মিতা অবগত, অথচ নভেরার শিল্পচর্চার খবর তিনি জানেন না জেনে অবাক হলাম। শারীরিক অসুবিধার কারণেই তিনি তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে যে কাজগুলো উপস্থাপন করেছেন তার অধিকাংশই পেইন্টিং। শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রের কথা আমার ঠিক চোখে পড়েনি। যেটা হয়েছে সেটি হলো এই : দুই মুখ্য স্থপতির একজনের উল্লেখ পাওয়া যায়নি সরকারি নথিপত্রে। কিন্তু নভেরার ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন। সমসাময়িক কবি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামে লিখেছিলেন, ‘মনে পড়ে গেল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যে দু’জন তাঁদের একজনের কথা আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রথমত আমরা একেবারেই জানি না এই মিনারের নকশা কারা করেছিলেন, যদিও বা কেউ জানি তো জানি শুধু শিল্পী হামিদুর রাহমানের নাম, খুব কম লোকে চট করে মনে করতে পারে যে হামিদের সঙ্গে আরো একজন ছিলেন – হামিদের সঙ্গে ছিলেন বলাটা ভুল, বলা উচিত দু’জনে একসঙ্গে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রূপটি রচনা করেছিলেন। অপর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন নভেরা আহমেদ।’

শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে ‘টানাহেঁচড়া’র কথা লিখেছেন মিতা; কিন্তু টানাহেঁচড়ার জন্যে তো প্রতিপক্ষের প্রয়োজন, সে-প্রতিপক্ষটি এখানে অনুপস্থিত। আর ইতিহাস কেবল কেউ জানালেই জানতে হবে — সেই দিন বোধহয় গত হয়েছে, কারণ জেনে নেবার দরজাগুলো এখন অবারিত। আর নতুন স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন সেটা এই লেখার জন্যে বাহুল্য নয় কি? এমন আরো সব অবান্তর আলোচনার ভেতর ঘুরোঘুরি করতে গিয়ে মিতা যে মূল বিষয়টি থেকে বার বার সরে গেছেন সেটি হলো শিল্পী নভেরা। সমসাময়িকতাকে যিনি অতিক্রম করে যেতে পারেন তিনি আধুনিক। শিল্পকর্মের বিচারে নভেরা সেই আধুনিকতার প্রতিভূ। তাঁর সময়ে আমাদের এই ভূখণ্ডে আর কোনো ভাস্করকে আমরা পাই না যিনি এতোটা এগিয়ে। আলোচনায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন যে, তিনি উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পের জনক। এটা তথ্য বিভ্রাট — কিংবা শিল্পাচার্যকে বড় করে দেখাতে গিয়ে নিজেরই অজান্তে তিনি ছোট করে ফেলেছেন।

নভেরাকে নিয়ে এই রকম আরো অনেক তরল মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও হয়েছে। হবেও আগামীতে। মিডিয়াতেও আসবে এই রকমের আরো অনেক আলোচনা। বারবার তো তর্জনী উঁচু করে বলা যায় না — আপনি ভুল কিংবা অসত্য বলছেন। কেবল এই কামনা করা চলে, শারীরিক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে ফিরে আসা নভেরাকে যেন আমরা আমাদের সমস্ত ভ্রান্তি কাটিয়ে নতুন আলোয় দেখি, যে আলোতে নভেরা তাঁর সৃজনশীলতার ভেতর দিয়েই মুখ্য হয়ে ওঠেন।

অভিমান থেকে হোক বা আত্মসম্মান বোধের প্রাবল্যেই হোক, হোক নিজেকে রক্ষার তাগিদ থেকে, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন নভেরা। ‘রহস্যাবৃত’ জীবন যাপন করেছেন তাঁর নিজের ইচ্ছেতেই। সেই জীবনে তিনি কেমন করে দিন কাটাতেন — এ জাতীয় নানা কৌতূহলের জবাব হয়তো আমরা খুব দ্রুতই পেয়ে যাব। কিন্তু শিল্পী নভেরার কাজের মূল্যায়ন করে তাঁকে এই সব অহেতুক কৌতূহলের আবর্ত থেকে বাইরে নিয়ে আসবার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে আরো আগেই। লালা রুখ সেলিম, মেহবুব আহমেদ, রেজাউল করিম সুমনের মতো শিল্প-সমালোচকের হাত ধরে আমরা আমাদের পথিকৃৎ শিল্পী নভেরা আহমেদকে ফিরে পাবো। নতুন করে যত্নের সাথে তাঁর রেখে যাওয়া সমস্ত কাজ সংরক্ষিত হবে। শহরের নানা প্রান্তে নভেরার কাজের রেপ্লিকা বসিয়ে তাঁর শিল্পের সাথে সাধারণের সম্পর্ক স্থাপনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা হবে। এমন আশাবাদ শিল্পকলার শিক্ষার্থী হিসেবে তো করতেই পারি। কিন্তু এ সবের আগে যে আকাঙ্ক্ষাটি জানাতে চাই সেটা হলো — আমরা যারা শিল্প সংস্কৃতির মানুষ, যারা মনের দিক থেকে আধুনিক, কিংবা যারা শিল্পের সমঝদার, তারা যখন নভেরাকে উপস্থাপন করবো তখন তাঁর আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তিনি যেন শিল্পী হিসেবেই আমাদের আদরটুকু পান, তাঁর কাজের ভেতর দিয়েই যেন আমরা তাঁকে দেখি। তা না হলে আমরা নভেরাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে ব্যর্থ হব।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

12 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
12
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.