ইকতিয়ার চৌধুরীর লেখা থেকে জানতে পেরেছিলাম, নভেরা আহমেদ বাংলায় কথা বলেন না, কথা বলেন ইংরেজিতে। কিন্তু আমি কী করব – ততক্ষণে আমি ইংরেজি ফরাসি যে একটু-আধটু পারতাম তাও ভুলে বসেছি। অগত্যা বাংলাতেই নভেরাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম… কিন্তু অপর পাশের অভিমান যে সুউচ্চ, পর্বতের মতোই অনড়। [. . .]

২০১২ সালের শেষদিকের কথা। ফেসবুকে একজনের ওয়ালে একটা ফটোগ্রাফ দেখি; ছবির সঙ্গে নাম না থাকলে হয়তো খেয়াল করতাম না ওটা কার প্রতিকৃতি। এ যে আমাদের অভিমানী শিল্পী নভেরা আহমেদ! তাঁর সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানতাম। যদিও বাংলাদেশের শিল্পজগতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই আমার অজানা। আমি শিল্পকলার ছাত্র নই, তার ওপর কয়েক বছর ধরে আছি দেশের বাইরে।

বিদেশে থাকি বলেই বাংলা বইপত্র নিয়ে কথা বলার সুযোগ খুঁজি। ফেসবুকে বইপড়ুয়াদের একটা বড়োসড়ো গ্রুপও ততদিনে গড়ে উঠেছে। নভেরার ফটোগ্রাফ যাঁর ওয়ালে দেখেছিলাম তাঁর সঙ্গেও আলাপ ওই বইয়েরই সূত্রে। আমার বিশেষভাবে আগ্রহ ছিল রুশ সাহিত্যের বইপত্র বিষয়ে; আর রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত অনুবাদক ননী ভৌমিককে নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে একটি লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা করবেন বলেও জেনেছিলাম। নভেরার ছবির সূত্রে নয়, বরং রুশ সাহিত্য নিয়ে আলাপের জন্যই ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে তাই বন্ধুত্ব করতে চাইছিলাম। প্রারম্ভিক এক আলাপের মাঝখানেই তিনি নিশ্চিত হতে চাইলেন যে আমি প্যারিসে থাকি কিনা, আর তারপর কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই উত্থাপন করলেন নভেরা আহমেদের কথা। জানতে চাইলেন, দীর্ঘদিন ফ্রান্স-প্রবাসী এই বাঙালি ভাস্কর সম্পর্কে আমার আগ্রহ আছে কিনা। আগ্রহ অবশ্যই আছে; কিন্তু তিনি যে ফ্রান্সেই আছেন, সে-কথা আমি জানতাম না। নিজের অজ্ঞতার কথা খোলাখুলিই স্বীকার করি।

আমার বন্ধু তখন মুক্তাঙ্গন ব্লগের একটা পোস্টের লিংক দেন আমাকে – তাঁরই লেখা, এবং পড়তে বলেন। বিশেষভাবে অনুরোধ করেন যেন আমি নভেরা আহমেদ সম্পর্কে এবং বিশেষ করে তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে সম্ভব হলে খোঁজ নিই।

আমাদের এই আলাপ হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর রাতে। সে-রাতেই লেখাটি পড়তে শুরু করি। ‘নভেরা আহমেদ : মৃত ও জীবিত’ – ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে রেজাউল করিম সুমনের একটি অনুসন্ধানী লেখা। শিল্পীকে নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কথা জানতে পারি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তাঁর কয়েকটি কাজ কীরকম অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে তারও ছবি ছিল ওই লেখার সঙ্গে। ততক্ষণে আমার বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে – সত্যিই কি নভেরা মারা গেছেন? এরপর মূল লেখার নীচে নানা জনের মন্তব্যগুলি পড়তে থাকি, ক্রমশ জট খুলতে থাকে। সুমন ভাইয়ের ব্লগপোস্ট আর তার নীচে বিভিন্ন জনের মন্তব্য থেকে শেষপর্যন্ত যা জানা গেল তা হলো – নভেরা আহমেদ এখনো জীবিত, তবে বন্ধুদের কারো সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই, এমনকী কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও না। সুদীর্ঘকাল ধরে তাঁর শিল্পকর্ম বিষয়ে তিনি নিস্পৃহ রয়েছেন, বসবাস করছেন তাঁর রুশ বন্ধু Gregoire de Brouhns-এর সঙ্গে ফ্রান্সেই। প্যারিসের Rue Pierre  le Grand-এ তাঁদের একটি দোকান আছে; দোকানটির নাম ছিল Librairie de Sialsky, যেখানে একসময় রুশ বইপত্র বিক্রি হত। এখন সেখানে নভেরা আহমেদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম রাখা আছে প্রদর্শনের জন্য…

রেজাউল করিম সুমনের ওই পোস্ট আর তার নীচে মূল লেখক সহ নানা জনের সবগুলি মন্তব্য পড়ার পর আমি অস্থির হয়ে পড়ি। কখন Rue Pierre le Grand-এ যাব, এবং জানতে পারব আমাদের নভেরার সাম্প্রতিক খবরাখবর। ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করতে চেষ্টা করি নভেরা বিষয়ে আরো কিছু জানা যায় কিনা, এবং পেয়েও যাই। ফেসবুকে Novera Ahmed নামে একটি পেজ আছে! সেখানে পাওয়া গেল মেহবুব আহমেদের লেখা ‘নভেরা – নতুন পথের দিশারী’ নামে তথ্যমূলক একটি প্রবন্ধের লিংক, যেটি ছাপা হয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘শিল্প ও শিল্পী’ পত্রিকায়। বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা; নভেরার শিল্পীজীবনের প্রথম পর্ব, শিল্পশিক্ষার জন্য প্রথমে বিলেত ও পরে ইতালি যাত্রার প্রসঙ্গ, তাঁর সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্পীর কথা এবং বিভিন্নজনের ভাষ্যে তাঁর মূল্যায়নও পাওয়া গেল এখানে। হামিদুর রাহমান ও নভেরা আহমেদ এই দুজন শিল্পী শহীদ মিনারের নকশাকার হওয়া সত্ত্বেও নভেরা আহমেদ যথাযথ স্বীকৃতি যে পাননি, সে প্রসঙ্গও এসেছে লেখাটিতে।

সারা রাত শুধু নিজ দেশ, নিজ ভাষা থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত একজন শিল্পীর কথাই ঘুরেফিরে ভাবতে লাগলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন রাত পোহাবে, কখন আমি গিয়ে পৌঁছাব Rue Pierre le Grand-এর সেই দুই নম্বর বাড়িতে, যার নীচের দোকানটিতে আমাদের নীচতা আর অবহেলা থেকে মুক্ত হয়ে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এই বিদেশে শোভা পাচ্ছে নভেরা আহমেদের অমূল্য সব ভাস্কর্য।

শুনেছি ‘অপেক্ষার রাত পোহায় না’; সেদিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তার আতিশয্যে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই রাত কাটিয়ে দিলাম। অবশেষে সকাল হলো। ৫ নভেম্বর ২০১২। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে ক্যামেরা সমেত হাসানুল হাসান ভাইকে নিয়ে সকাল নয়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম Rue Pierre le Grand-এর উদ্দেশে।

বাইরে বেরোনোর পর দেখা গেল – বিচ্ছিরি আবহাওয়া… গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইছে দমকা হাওয়া। প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের একটুকরো বাংলাদেশের দিকে। (হ্যাঁ, নভেরা আহমেদের শিল্পকর্মগুলো তো প্যারিসের বুকে একটুকরো বাংলাদেশই!) ২ নম্বর মেট্রো ধরে Courcelles-এ নেমে একজনকে Rue Pierre le Grand-এর কথা জিজ্ঞেস করতেই সহাস্যে দেখিয়ে দিল কোন দিকে যেতে হবে। অল্প একটু হাঁটার পরই আমরা পেয়ে গেলাম Rue Pierre le Grand; এই রাস্তাটি তৈরি হয় ১৮৮০ সালে এবং ১৮৮৪ সালে রুশ জার Pierre le Grand (‘পিটার দ্য গ্রেট’)-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। মূল রাস্তা থেকে এই রাস্তার দিকে মোড় নিলেই সবার আগে চোখে পড়ে রুশীদের চার্চ সেন্ট আলেক্সান্দর নেভস্কি ক্যাথিড্রাল। এই চার্চের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৬১ সালে এবং এই চার্চেই ইভান তুর্গ্যেনেফ, ফিওদর শালিয়াপিন, ভাসিলি কান্দিনস্কি, জর্জ ইভানোভিচ গার্দিয়েফ, ইভান বুনিন প্রমুখ বাঘা বাঘা রুশ শিল্পী-সাহিত্যিক-মনীষীদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

অবশেষে বহু-প্রতীক্ষিত Rue Pierre le Grand-এর ২ নম্বর বাড়িটিতে পৌঁছানো গেল। কিন্তু হায় – Gregoire de Brouhns-এর দোকানটি যে বন্ধ! সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল, দোকানের উপর আগে যে নামফলক ছিল (Libraire de Sialsky), সেখানে নিরেট সবুজ রং মেরে দেওয়া হয়েছে! তাহলে কি গ্রেগোয়া দোকানটি ছেড়ে দিয়েছেন? নানা দুশ্চিন্তা এসে মনে ভিড় জমাল। পাশের রেস্তোরাঁটিও দেখছি বন্ধ। তাহলে পথই এখন ভরসা… দোকানের সামনে দিয়ে গির্জা-অভিমুখী যাকে দেখলাম তাকেই দোকানটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম: গ্রেগোয়াকে চেনো নাকি? না, গ্রেগোয়াকে কেউই চেনে না, মোবাইল থেকে গ্রেগোয়ার ফটো (মুক্তাঙ্গনের পোস্টেই লিংক দেয়া ছিল) বের করে প্রতিবেশী বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের দেখিয়ে  নিজের সর্বোচ্চ বিনীত ভাবটি এনে জিজ্ঞেস করলাম: এই দোকানের মালিক গ্রেগোয়াকে চেনো কি? দোকানটি কবে কখন খোলে, কিছু বলতে পারো? দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারাও কিছু জানে না। গ্রেগোয়ার দোকানটির পাশের রেস্তোরাঁ থেকে এক রুশ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, তাঁকে প্রশ্ন করতেই তিনি হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি ফরাসি বা ইংরেজি কোনোটাই বোঝেন না।

এদিকে গির্জায় প্রার্থনা করতে আসা অনেকেই আমাদের উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। বেলা গড়িয়ে ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা; তারপরও গ্রেগোয়ার কোনো হদিস মিলল না। অবশেষে গির্জার ভিতরে গেলাম, যদি গির্জার ফাদার গ্রেগোয়ার কোনো খবর দিতে পারেন। কিন্তু আজ যে রবিবার – পুরো গির্জা লোকে লোকারণ্য, পা ফেলার জায়গাটিও নেই। ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখলাম ফাদার যিশুর প্রতি স্তুতি পাঠ করছেন। স্তুতিপাঠ শেষ হলে অনেকটা চোরের মতো ফাদারের কক্ষে প্রবেশ করলাম, গ্রেগোয়ার ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ওঁকে চেনো নাকি? ফাদার তাঁর মুখে পবিত্রতার ভাবটি অক্ষুণ্ণ রেখে জানালেন, গ্রেগোয়া প্রতি রবিবার ও সোমবার তাঁর দোকানটি খোলেন। আমার মন খুশিতে ভরে উঠল। তাহলে আমি ঠিক দিনেই এসেছি। ফাদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে গির্জা থেকে বের হতেই দেখলাম গ্রেগোয়া তাঁর দোকানটি খুলছেন! নভেরা আহমেদ বিষয়ে জানতে পারব, তাঁর শিল্পকর্মগুলোয় হাত বুলিয়ে দেখতে পারব – এই খুশিতে পথচারীদের চোখের সামনেই বলতে গেলে দৌড়ই দিলাম দোকানের দিকে।

গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্‌স্-এর সঙ্গে

গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন্‌স্-এর সঙ্গে

ভিতরে ঢুকেই গ্রেগোয়াকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম। জানালাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, নভেরা আহমেদ বিষয়ে তোমার কাছে জানতে এসেছি। গ্রেগোয়াও আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, নভেরা তেমন ভালো নেই, খুব অসুস্থ। হাঁটতে পারেন না, হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতে হয়। নভেরার অসুস্থতার খবরে বেশ দমে গেলাম। মায়ের কাছে ছেলেবেলায় মেলায় যাওয়ার আগে যেভাবে কাকুতি মিনতি করে টাকা চাইতাম ঠিক সেভাবেই গ্রেগোয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি একটু নভেরার সঙ্গে দেখা করতে চাই। গ্রেগোয়া যেন আকাশ থেকে পড়লেন। একটু অপ্রসন্নভাবে আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন – নভেরা কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। আমার খুব অপ্রস্তুত বোধ হলো।

অগত্যা কথার মোড় ঘোরালাম, জিজ্ঞেস করলাম নভেরা আহমেদের বর্তমান শিল্পীজীবনের কথা। গ্রেগোয়া জানালেন, নভেরা যদিও অসুস্থ, তারপরও ছবি আঁকেন। অনেকগুলো পেইন্টিংয়ের ভিতর থেকে একটি বের করে তিনি আমাকে দেখালেন; বললেন, এটা মাত্র তিন মাস আগে করা। নভেরার ঢাকায় ও ব্যাংককে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর ব্যাপারে জানতে চাইলাম তাঁর কাছে; টেবিলের উপর রাখা ব্যাগ থেকে গ্রেগোয়া আমাকে বের করে দিলেন Sculptures by Novera (১৯৭০ সালের অক্টোবরে ব্যাংককের ২৯ থানন সাথর্ন-এ অনুষ্ঠিত) এবং Inner Gaze (১৯৬০ সালের আগস্টে ঢাকার সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত) – নভেরা আহমেদের দুটি প্রদর্শনীর ক্যাটালগ। মনে মনে ভাবলাম, বেশ হলো, সুমন ভাই এই ক্যাটালগগুলোর কথাই আমাকে বলেছিলেন।

আমাদের কথার মাঝখানেই গ্রেগোয়া ব্যস্তভাবে কাকে যেন ফোন করতে গেলেন। কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল গ্রেগোয়া নভেরার সঙ্গেই কথা বলছেন! গ্রেগোয়া এতক্ষণ আমার সঙ্গে ফরাসি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই কথা বলছিলেন। এখন দেখলাম, নভেরা আহমেদের সঙ্গে কথা বলছেন কেবল ইংরেজিতে। বুঝলাম, তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলেন, ফরাসিতে না। ভাবলাম, এত কাছে এসেও কি একটু কথা বলতে পারব না আমাদের মহান শিল্পীর সঙ্গে! সৌজন্য চুলোয় যাক, তাঁদের কথার মাঝখানেই গ্রেগোয়াকে মিনতি করে বসলাম, দাও না, নভেরার সঙ্গে একটু কথা বলি। কী জানি কী হলো – আমাকে দেখে হয়তো তাঁর মায়া হলো – নভেরাকে বলে আমার দিকে রিসিভারটি এগিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আমার বুকের ভিতর কারা যেন হাতুড়ি পিটতে শুরু করেছে; সেই শব্দ আমি নিজ কানে শুনতে পেলাম। কী বলব আমি নভেরার সঙ্গে? আমাদের দেশ ও দশের  অবহেলার কারণেই তো একজন নভেরা আহমেদকে পরদেশে এসে থিতু হতে হয়েছে। কে মনে রেখেছে এই অসম্ভব মেধাবী ভাস্করের কথা? কেউই মনে রাখেনি – না তাঁকে মনে রেখেছে, না তাঁর অবদানকে।

‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত (মুক্তাঙ্গনে উদ্ধৃত) ইকতিয়ার চৌধুরীর লেখা থেকে জানতে পেরেছিলাম, নভেরা আহমেদ বাংলায় কথা বলেন না, কথা বলেন ইংরেজিতে। কিন্তু আমি কী করব – ততক্ষণে আমি ইংরেজি ফরাসি যে একটু-আধটু পারতাম তাও ভুলে বসেছি। অগত্যা বাংলাতেই নভেরাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম… কিন্তু অপর পাশের অভিমান যে সুউচ্চ, পর্বতের মতোই অনড়। অভিমানী নভেরা বাংলা বললেন না! আমার চোখে জল এসে  গেল। এই মানুষটিই নাকি হামিদুর রাহমানের সঙ্গে ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন! একজন বড়ো মাপের শিল্পীর সঙ্গে কত বড় অন্যায় আমরা করেছি, তার গভীরতা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করলাম। অগত্যা আমাকেও এবার ইংরেজি বলতে হলো; কোনোরকমে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? ওপাশ থেকে বয়সোচিত, শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে নভেরা জানালেন, তিনি ভালো নেই। খুবই অসুস্থ। জানালাম, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম আপনার কাজ নিয়ে খুবই গর্বিত। ওপাশে গভীর নীরবতা। আবার বললাম, আমরা আপনাকে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যা করতে চাই। ওপাশ থেকে দ্বিধাহীন কণ্ঠে উত্তর এল, তার কোনো প্রয়োজন নেই। ফের জিজ্ঞেস করলাম, দেশের কথা আপনার মনে পড়ে না? কিন্তু ওপাশে পূর্ববৎ গভীর নীরবতা…

অনেকক্ষণ পর উত্তর এল, সুস্থ হলে একবার দেশে যেতে চাই। আমার বুকের ভিতরটা অনেক হালকা লাগল। বললাম, আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। কিন্তু ওপাশ থেকে নভেরা হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছেন; মনে হলো নেটওয়ার্কে কোনো সমস্যা হয়েছে। গ্রেগোয়ার দিকে রিসিভার বাড়িয়ে দিলাম। গ্রেগোয়াও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বললেন, তারপর রেখে দিলেন। নিজেকে প্রবোধ দিলাম, সামান্যই নাহয় কথা হয়েছে, তারপরও তো কথা হয়েছে আমাদের নভেরার সঙ্গে। এতটুকু এই জীবনে জানি না আর ক’জন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলতে পারব; তারপরও বলি, নভেরা আহমেদের সঙ্গে এই স্বল্পক্ষণ কথা বলার স্মৃতি আজীবন এই অভাজনকে গর্বিত করবে।

নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম

নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম

এরপর নভেরার অমূল্য সব শিল্পকীর্তি দেখতে শুরু করলাম। গ্রেগোয়ার দোকানটি এখন অনেকটাই যেন নভেরা আহমেদের প্রদর্শনীশালা; যদিও এলোমেলো করে রাখা বইপুস্তক এবং কাটিংয়ের জিনিসপত্র তাতে সামান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এখানে, এই প্রদর্শনীশালায়, শোভা পাচ্ছে কমবেশি পঁচিশটির মতো পেইন্টিং, ছোটবড়ো ১০টির মতো ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। গ্রেগোয়া  প্রতিটি শিল্পকর্মই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখালেন; বললেন, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি ফটো তুলে নিতে পারো। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি শিল্পকর্ম দেখতে শুরু করলাম। এ যেন কোনো এক ভিখিরির হঠাৎ রাজপ্রাসাদে প্রবেশ… চারুকলার ছাত্র নই আমি, ওই বিদ্যায় সেভাবে হাতেখড়িও হয়নি কখনো, কিন্তু তাতে কী! সাধারণ দর্শক হিসেবেও তো আমার একটা অনুভূতি আছে।

নভেরার কয়েকটি পেইন্টিংয়ে আছে নারী শরীরের উন্মুক্ত চিত্রায়ণ। তাঁর নারীরা বেশ সুঠাম শরীরের অধিকারিণী। এবং প্রায় প্রতিটি ছবিতে প্রকৃতি এসেছে অনিবার্যরূপে, প্রকৃতি আর নিরাবরণ নারী – এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয়েছে আমাদের জীবনের অনন্য আর নান্দনিক এক জগৎ। কোনো ছবিরই কোনো শিরোনাম নেই।

নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের সঙ্গে

নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের সঙ্গে

এবার দেখতে শুরু করলাম নভেরা আহমেদের ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যগুলো। যেন মহাকালের সীমানা অতিক্রম করে এগুলো এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে গ্রেগোয়ার দোকানটিতে। নভেরার প্রতিটি ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যই চোখ কেড়ে নেয়, কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে ফণা তোলা সাপের ভাস্কর্যটি (A serpent named Desire)। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ ফুট। এমনকি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাগলের ভাস্কর্যটিও (The Goat of Chantemesle) চোখ-জুড়ানো। এক-একটা শিল্পকর্ম দেখছিলাম আর মনে মনে আক্ষেপ করছিলাম, কোন্ দেশের শিল্পীর কাজ কোন্ দেশে পড়ে রয়েছে? ভাস্কর্যগুলো দেখার ফাঁকে ফাঁকে কখনো-বা গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম সেগুলোর গায়ে।

তারপর ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় একটি বছর Rue Pierre le Grand নামক ওই রাস্তার একটুকরো বাংলাদেশের কাছে আমি অনেকবার গিয়েছি। বলতে গেলে প্রায় প্রতি রবিবারের বিকেলটুকু গ্রেগোয়ার ওখানেই কাটিয়েছি। যতবারই গিয়েছি গ্রেগোয়া আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। কতদিন নভেরা আহমেদ বিষয়ক আমার আবদারের কাগজপত্র আনতে ভুলে গেলে বিনীত ভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। আমারও অনেকবার অভিমান হয়েছে যখন একই কাগজ বারবার চেয়েও শেষে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয়েছে।

কত বিষয়ে যে গ্রেগোয়ার পড়াশোনা তা তাঁর সঙ্গে আড্ডা না দিলে বুঝতে পারতাম না। কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে অনেকবার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। আর সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি তাঁর অনুরাগ আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে। মূলত বাঙালি জাতির প্রতি সব সময়ই একটা টান দেখেছি তাঁর মধ্যে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে অনেকবার আমার কাছে জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নভেরা আহমেদের কাজ কীভাবে দেখে কিংবা নভেরা আহমেদ বিষয়ে তারা কতটুকু আগ্রহী। তাঁর শিশুর মতো চাহনির দিকে তাকিয়ে আমি সত্যি কথাটি বলতে পারিনি। বলতে পারিনি যে, অন্তত আমার জানামতে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই নভেরা আহমেদকে চেনে না বললেই চলে। বলতে পারিনি, নভেরা আহমেদের অনেকগুলো অমূল্য ভাস্কর্য একটি দেশের জাতীয় জাদুঘরের উন্মুক্ত চত্বরে জীর্ণ দশায় বৃষ্টিতে ভেজে আর রোদে শুকায়। না, এইসব কিছুই বলতে পারিনি। তার বদলে জানিয়েছি: বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নভেরা আহমেদ বিষয়ে তুমুল আগ্রহী, অনেকেই নভেরা আহমেদের সাম্প্রতিক কাজকর্ম নিয়ে জানতে চায়। শুনে গ্রেগোয়াকে আশস্ত হতে দেখেছি। তারপর আমি হয়তো বায়না ধরেছি নভেরা আহমেদ বিষয়ক নতুন কোন কাগজপত্রের। বলতে গেলে প্রাথমিক পরিচয়ের দু’ তিন মাসের মাঝেই তাঁর কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিলাম নভেরা আহমেদের দুষ্প্রাপ্য দুটি ক্যাটালগ। সত্যি কথা বলতে কি, এই ঘটনা আমাকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল।

গ্রেগোয়া কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর দোকানেই নভেরার একটা বড়ো প্রদর্শনী হবে। আসলে, বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি এই প্রদর্শনী আয়োজনের চেষ্টা করে আসছিলেন। এবার সত্যিই কি হবে নভেরার প্রদর্শনী? বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে গ্রেগোয়া জানিয়েছিলেন, ২০১৪-র ১৪ জানুয়ারি শুরু হবে এই বহু-প্রতীক্ষিত রেট্রোস্পেকটিভ এক্সিবিশন। আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। ১৬ জানুয়ারি শুরু হলো প্রদর্শনী, কিন্তু আমি তখন ফ্রান্সের বাইরে। খবর পেলাম মেইলে, সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে। প্যারিসে ফিরেই চলে গেলাম Rue Pierre le Grand-এর নামফলকবিহীন Libraire de Sialsky-তে।

সর্বশেষ প্রদর্শনীর ক্যাটালগের প্রচ্ছদ

সর্বশেষ প্রদর্শনীর ক্যাটালগের প্রচ্ছদ

প্রদর্শনী উপলক্ষে সুদৃশ্য রঙিন ক্যাটালগ ছাপা হয়েছে। উপরে লেখা: ‘Novera/ Retrospective 1969–2014’। Patrick Amine নামে একজন নভেরা আহমেদের এই প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন। সব মিলিয়ে ৫১টি শিল্পকর্ম – ৯টি ভাস্কর্য আর ৪২টি পেইন্টিং। ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যগুলো আমার আগেই দেখা, অনেকগুলি পেইন্টিংও অনেকদিন ধরে এখানেই ছিল, সেগুলোও আমার কাছে নতুন নয়। (এখন অবশ্য ছবিগুলোর নামকরণ হয়েছে।) তবু এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন করে প্রকাশের আলোয় এলেন নভেরা। এবার হয়তো আমাদের টনক নড়বে। এবার হয়তো শুরু হবে তাঁর শিল্পকর্মের নতুন মূল্যায়ন। বাংলাদেশের শিল্পজগতে নভেরা ফিরে আসবেন স্বমহিমায়।

৩ comments

  1. Pingback: নভেরা-বৃত্তান্ত » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল

  2. rahat - ৭ মে ২০১৫ (৩:২১ পূর্বাহ্ণ)

    Please read the novel call “Novera” by Hasn’t Abdul HYe.
    Written in the early 90s if I’m not wrong.
    I am pleased to read your blog. I am joyace for you.

  3. মাসুদ করিম - ১৭ মে ২০১৫ (৬:০৩ অপরাহ্ণ)

    আমাদের উচিত ছিল ২০১৪ সালের ‘Novera/ Retrospective 1969–2014’বাংলাদেশে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া – কিন্তু যেহেতু তা হয়নি এবং এখন নভেরা মারা গেছেন কাজেই গ্রেগরির সাথে আমাদের যোগাযোগ সুদৃঢ় করা উচিত, তার কাছে নভেরার যত কাজ আছে সেসব থেকে ও বাংলাদেশে পাকিস্তানে থাইল্যান্ডে নভেরার যত কাজ আছে সেগুলো বিবেচনা করে নভেরার শিল্পী জীবনের একটা পূর্ণবিস্তারের রেট্রোসপেকটিভের আয়োজন করা – কারণ শুধুমাত্র এভাবেই আমরা শিল্পী নভেরাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.