এই তো এ মাসের গোড়াতেই কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের খ্যাতিমান এক শিল্প-সমালোচকের সঙ্গে; নানা কথার মধ্যে এও জানা গেল যে, নভেরা আহমেদ না কি মারা গেছেন! মারা গেছেন? হ্যাঁ, সেরকমই তিনি শুনেছেন। কবে মারা গেছেন? ২০০৩ সালে।
এদিকে, ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ লেখক সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নারী চরিতাভিধান’-এর ৮৪ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার সাঈদা জামান আমাদের জানিয়েছেন, ‘১৯৮৯ সালে নভেরা আহমেদ মারা যান।’
এই বইটি বিষয়গত গুরুত্বের কারণে বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষণযোগ্য বলে বিবেচিত হবার কথা। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারেও এর একটি কপি আছে। এই এশিয়াটিক সোসাইটি থেকেই ২০০৭-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা’-র অষ্টম খণ্ডে (‘চারু ও কারু কলা’) নভেরা আহমেদকে নিয়ে আলোচনার অন্তিম অনুচ্ছেদে (পৃষ্ঠা ৩৫৮) লালা রুখ সেলিম জানাচ্ছেন :
১৯৬০-এর দশকের পর নভেরা আর বাংলাদেশে ফেরেন নি এবং তাঁর বন্ধু বা আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখেন নি। তাঁর নীরবতার পাল্টা জবাবে যেন তাঁর নাম বিস্মৃতিতে হারিয়ে গেল, তাঁর কাজ অবহেলায় এবং অযত্নে ধ্বংস হয়ে গেল। ১৯৬০ সালে নভেরার প্রদর্শনীর ক্যাটালগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন লিখেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প জগতে একটা ক্ষুদ্র বিপ্লব ঘটে যায় যখন নভেরা আহমেদ নগরের কেন্দ্রীয় গণ গ্রন্থাগারের দেয়ালে উচ্চাবচ ভাস্কর্য গড়েন ১৯৫৭ সালে এবং প্রথম প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য গড়েন ১৯৫৮ সালে। এ শিল্পকর্মগুলি নিয়ে ঢাকার নাগরিকরা গত কয়েক বছর বাস করছে। তবে তিনি মনে করেন আমাদের শিল্প জীবনে এ দুটি কাজের অভিঘাত মূল্যায়ন করতে বহু প্রজন্মের প্রয়োজন হবে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাস্কর্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নভেরা আহমেদকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।
‘বেগম নভেরা আহমেদ’কে একুশে পদকে সম্মানিত করার সরকারি ঘোষণাটির কথা আমাদের মনে আছে; আর এও মনে আছে যে, সবার প্রত্যাশার মুখে ছাই দিয়ে সেই সম্মাননা গ্রহণের জন্যও নভেরা দেশে আসেননি!
১৯৯৪ সালে ‘বিচিত্রা’-র ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত ও পরের বছর গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা জীবনী-উপন্যাস ‘নভেরা’-র কথাও আমরা ভুলে যাইনি, যার অন্তিম অধ্যায়ে শিল্পীর মামাতো ভাই রাশেদ বলছেন, ‘আই ওয়ান্টেড হার টু ফেড অ্যাওয়ে উইদ ডিগ্নিটি।’ ১৯৮৭ সালে, অনেক বছর খোঁজাখুঁজির পর প্যারিসে সন্ধান লাভের পরও, রাশেদ নভেরার দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি, বরং তিনি নভেরাকে ‘সসম্মানে মিলিয়ে যাবার’ সুযোগ করে দিয়েছেন!
২
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ১৩ মে (১–৩০ চৈত্র ১৪০৫) পর্যন্ত নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের মাসব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। দীর্ঘদিন অনাদরে-অবহেলায় পড়ে-থাকা ভাস্কর্যগুলোকে ((উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম এম. আর. খানের পরিবারের সৌজন্যে প্রাপ্ত ‘পরিবার’ (১৯৫৮–৫৯) নামের শাদা সিমেন্টে তৈরি মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্যটি, যার উল্লেখ রয়েছে লালা রুখ সেলিমের লেখায় ব্যবহৃত জয়নুল আবেদিনের পরোক্ষ উদ্ধৃতিতে।)) একত্র করে প্রদর্শনের ও পরবর্তী পর্যায়ে সংরক্ষণের এই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। জাদুঘরের সামনের উদ্যানে এবং তৃতীয় তলায় সমকালীন শিল্পকলা গ্যালারিতে নভেরার ভাস্কর্যগুলো অনেকেই দেখেছেন, নতুন নতুন দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই নিশ্চয়ই দেখছেন। কিন্তু অনেকের পক্ষেই জানা সম্ভব নয় যে, জাদুঘরের ভিতরের চত্বরে অরক্ষিত পড়ে আছে নভেরার একটি ভাঙা ভাস্কর্য, দিনের পর দিন; আর আরো একটু এগিয়ে বাঁ-দিকে গেলে কর্মচারীদের টিফিন করার স্থানে দেখতে পাবার কথা নীচের এই দৃশ্য –
নোংরা আবর্জনার স্তূপের পাশে শুশ্রূষার অপেক্ষায় দিন গুনছে নভেরার সিমেন্টে তৈরি কয়েকটি জীর্ণ ভাস্কর্য!
আর বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর নভেরা আহমেদ (জন্ম আনুমানিক ১৯৩০) আছেন প্যারিসের ‘অজ্ঞাতবাসে’, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো যাঁকে একদিন ‘মরিয়া’ প্রমাণ করতে হবে যে, নভেরা ‘মরে নাই’!
(ছবি : বাঁধন)
