সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশিক,- কোনও রাষ্ট্রকাঠামোই নজরুলকে স্বীকৃতি দেয়নি। নজরুলের সৃজনশীল শক্তির সামনে বিপণ্ন বোধ করেছে সে। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো নজরুলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা নজরুলের সৃজনশীল শক্তিকে আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করেছে সে। [...]

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাজ ও উপনিবেশিক ভারতবর্ষ,- কোনও রাষ্ট্রকাঠামোই নজরুলকে স্বীকৃতি দেয়নি। নজরুলের সৃজনশীল শক্তির সামনে বিপণ্ন বোধ করেছে ওই রাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো নজরুলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা নজরুলের সৃজনশীল শক্তিকে আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করেছে সে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্র তার স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে কারও সৃজনশীল শক্তিকে কি আড়াল ও দুর্বল করতে পারে? এক কথায় বলতে গেলে পারে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্র যে-খণ্ডিত নজরুলকে তুলে ধরেছে, তা থেকেই দেখা যায়, নজরুলের সৃজনশীলতাকে খর্ব করার অপচেষ্টাই করা হয়েছে নানাভাবে। নজরুলের সৃজনশীলতা চায় আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে, সাম্যমনস্ক হতে; কিন্তু রাষ্ট্র তার সাহিত্যের এই অসামান্য শক্তিকে আড়াল করতে তৎপর নানাভাবে। এই অসামান্য শক্তি রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তির। এই নজরুল রাষ্ট্রের অপছন্দের। তার কাছে স্বস্তিকর খণ্ডিত নজরুল। কেননা তাতে সাপও মরে, লাঠিও বাঁচে। অবশ্য বিপণ্ন ওই উপনিবেশিক রাষ্ট্রেও সংঘবদ্ধ এমন এক মুসলিম বাঙালি সমাজ ছিলো যাদের কাছে অস্বস্তি ও ঘৃণার পাত্র ছিলেন তিনি। ঘৃণায় নজরুলকে বার বার ‘কাফের’ বলেছে তারা। আর একটি অংশ ছিল যারা ‘দেখ আমিনা মাযের কোলে, দোলে শিশু ইসলাম দোলে’র সুরে দোলায়িত হয়ে কাফের বলতে দ্বিধা বোধ করেছে তাকে, কিন্তু ‘কালো মেয়ের পায়ের নিচে, দেখে যা মা আলোর নাচন’ শুনতে শুনতে অস্বস্তিতেও ভুগেছে ভীষণ। কিন্তু অনেক অস্বস্তি থাকলেও ভাসতে হয়েছে তাকে বাঙালি মুসলমানের জন্যে নজরুলের তৈরি করা সৃজনশীল জোয়ারে। ওই জোয়ারে না-ভাসা ছিল আরও বেশি অস্বস্তিকর, এমনই প্রবাহশক্তি ছিল সেই ধারাতে। অস্বস্তি ছিল, কিন্তু শক্তি ছিল না উপেক্ষা করবার, কেননা উপেক্ষার অর্থ ছিল নিজের মৃত্যুদণ্ডে সাক্ষর করার সমান। এই অস্বস্তিময় মুসলমান বাঙালিদের বাঁচবার পথ করে দিল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি। অতএব নজরুলের মহাশশ্মানকে গোরস্থানে পরিণত করার কাজে নামতে দেরি হলো না রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের। অবশ্য এর ফলে, তাদেরই বরং গোরস্থানে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। অতএব তারা রণে ভঙ্গ দিলো, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকল এবং এক সময় সক্ষমও হলো ফের সেই গোরস্থান থেকে উঠে আসতে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে যেমন, তেমনি রাষ্ট্রে জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলমাকে সংযুক্ত করে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নজরুলের যে-অপব্যবহার শুরু হলো সেই কাজে এদেরও ভূমিকা আছে; যেমন রয়েছে সামরিক শাসনেরও। ব্রিটিশরাজে রাষ্ট্র যতই প্রত্যাখ্যান করুক,…

প্রকৃতির মধ্যে পরিভ্রমণের পথে শিল্পী রশীদ আমিনের রং-ক্যানভাস প্রথম আমাদের চোখে ধরা দেয় আলাদা হয়ে। সেটি ছিল ২০০০ সাল; আ জার্নি থ্রু নেচার প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে রশীদ আমিন ঘোষণা করেন তাঁর পৃথক অস্তিত্ব ও অবয়ব। পৃথক,- কেননা এর আগেও প্রদর্শনী করেছেন রশীদ আমিন, প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর বাংলাদেশেই, প্রদর্শনী হয়েছে দেশের বাইরেও চীন (বাংলাদেশ দূতাবাস গ্যালারি; ১৯৯২) আর হংকং (ক্লাব ৬৪; ১৯৯২)-এ। কিন্তু ওইসব প্রদর্শনীকে বলা ভালো তাঁর প্রস্তুতিপর্ব, ধ্যানপর্ব, অনুসন্ধানপর্ব [...]

প্রকৃতির মধ্যে পরিভ্রমণের পথে শিল্পী রশীদ আমিনের রং-ক্যানভাস প্রথম আমাদের চোখে ধরা দেয় আলাদা হয়ে। সেটি ছিল ২০০০ সাল; আ জার্নি থ্রু নেচার প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে রশীদ আমিন ঘোষণা করেন তাঁর পৃথক অস্তিত্ব ও অবয়ব। পৃথক,- কেননা এর আগেও প্রদর্শনী করেছেন রশীদ আমিন, প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর বাংলাদেশেই, প্রদর্শনী হয়েছে দেশের বাইরেও চীন (বাংলাদেশ দূতাবাস গ্যালারি; ১৯৯২) আর হংকং (ক্লাব ৬৪; ১৯৯২)-এ। কিন্তু ওইসব প্রদর্শনীকে বলা ভালো তাঁর প্রস্তুতিপর্ব, ধ্যানপর্ব, অনুসন্ধানপর্ব। তিনি তাঁর নিয়তিকে আঁকড়ে ধরেন আ জার্নি থ্রু নেচার-এর মাধ্যমে। এর আগে তিনি তাঁর নিয়তির খোঁজ করেছেন, চিন্তাকে সংবদ্ধ করার জন্যে বারবার নানা পথে হেঁটেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর গন্তব্যে পৌঁছানোর নির্ধারিত পথে হাঁটতে থাকেন ২০০০ সালে এসে। http://www.flickr.com//photos/84513436@N05/sets/72157631038915334/show/ এই নিয়তির, এই গন্তব্যের চালচিত্র খুব সামান্য কথায় চিহ্নিত করেছিলেন আরেক শক্তিমান শিল্পী নিসার হোসেন, রশীদ আমিনের চতুর্থ প্রদর্শনী আ জার্নি থ্রু নেচার-এর দৃশ্যমানতা লিখতে গিয়ে। নিসার হোসেনের চোখ আটকে গেছে রশীদ আমিনের নিষ্ঠুর ও বিশৃঙ্খল পারিপার্শ্বিকতায়। তিনি দেখেছেন কী এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহে ওঁ চেষ্টা করছেন প্রকৃতির অন্বিষ্ট অনুসন্ধান করতে। পারিপার্শ্বিকতা,- কী রাজনৈতিক অর্থে, কী সামাজিক-আর্থনীতিক অর্থে, কী সাংস্কৃতিক অর্থে,- রশীদ আমিনকে প্রলুব্ধ করেছে অভিজাত রুচির যোগান দিতে, জনপ্রিয় রুচির যোগান দিতে; কিন্তু রশীদ আমিন প্রত্যাখ্যান করেছেন এইসব প্রলোভন, প্রত্যাখ্যান করেছেন জনপ্রিয়তা অর্জনের সহজ সরল পথ। অভিজাত রুচির যোগান দিতে পারলে তাঁর শিল্পের পণ্যমান তৈরি হতো, কিন্তু তিনি হারাতেন তাঁর নিজস্ব রেখা-বর্ণ। জনপ্রিয় রুচির যোগান দিতে পারলে তাঁর শিল্পের সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো, কিন্তু তাঁর ক্যানভাস হয়ে পড়ত উৎকট ও গতানুগতিক। আর এসবের মধ্যে দিয়ে রশীদ আমিন সীমাবদ্ধ হতেন, শিল্প ও সময়ের মেলবন্ধন উপলব্ধির চোখ হারাতেন। সীমাবদ্ধতা তাঁকে শিল্পের নিরীক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিতো। সমসময়ের কাছে মানুষ ও শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে নিতো উপলব্ধির চক্ষুহীনতা। তিনি এই সহজ সুখের শিল্পময়তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রত্যাখ্যানের এই পথে তিনি সবরকম উৎসাহ হারান আকৃতি বা রূপের বিন্যাসকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে মূল ভাবের কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রচলিত সবরকম প্রক্রিয়ার ওপর থেকে। আকৃতি বা রূপের প্রচল বিন্যাস প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে রশীদ আমিন মূলত অভিজাত ও জনপ্রিয় রুচিকেই প্রত্যাখ্যান করেন, প্রত্যাখ্যান করেন সহজ সুখের শিল্পময়তা। কী অর্জন…

রাজপথে স্তূপীকৃত গ্রন্থাবলী দিয়ে / সাজায়ে নারকী চিতা / সভ্যতার শবদাহ করে, ধ্বংস করে বিদ্যালয়, বিদ্যার্থীর / . . . কবি যারা শিল্পী যারা / জ্ঞানী যারা, অরাজক অন্ধকারে একমাত্র / আলোর ইশারা, / অত্যাচারে অপমানে নির্বাসনে / রক্তচক্ষু শাসনে ত্রাসনে / তাদের বিনাশ এর পৈশাচিক ব্রত।যদি বলি বুদ্ধদেব বসু এই কবিতার কবি, বিশ্বাস হয় কি খুব সহজে? কিন্তু এর নাম মৃত্যু... আর মৃত্যু কী ভীষণভাবে মানুষকে পাল্টে ফেলে, বদলে দেয় তার অনুভবের ভাষা, ভাষার প্রকাশ! তারই সামান্য আঁচ পাওয়া যায় এ কবিতার ভেতর দিয়ে। বুদ্ধদেব বসুর মতো রাজনীতিনিস্পৃহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবিও কবিতা নির্মাণে এরকম বিকল্প বাকপ্রতিমা বেছে নেন সোমেন চন্দের নির্মম মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে [...]

রাজপথে স্তূপীকৃত গ্রন্থাবলী দিয়ে সাজায়ে নারকী চিতা সভ্যতার শবদাহ করে, ধ্বংস করে বিদ্যালয়, বিদ্যার্থীর রক্তে করে ম্লান। যারা প্রাতঃস্মরণীয়, যারা মহাপ্রাণ কবি যারা শিল্পী যারা জ্ঞানী যারা, অরাজক অন্ধকারে একমাত্র আলোর ইশারা, অত্যাচারে অপমানে নির্বাসনে রক্তচক্ষু শাসনে ত্রাসনে তাদের বিনাশ এর পৈশাচিক ব্রত। ......... ........ ......... পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে আজ হোক উদ্দীপিত আমার কবিতা। যদি বলি বুদ্ধদেব বসু এই কবিতার কবি, বিশ্বাস হয় কি খুব সহজে? কিন্তু এর নাম মৃত্যু... আর মৃত্যু কী ভীষণভাবে মানুষকে পাল্টে ফেলে, বদলে দেয় তার অনুভবের ভাষা, ভাষার প্রকাশ! তারই সামান্য আঁচ পাওয়া যায় এ কবিতার ভেতর দিয়ে। বুদ্ধদেব বসুর মতো রাজনীতিনিস্পৃহ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবিও কবিতা নির্মাণে এরকম বিকল্প বাকপ্রতিমা বেছে নেন সোমেন চন্দের নির্মম মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে। সেটি পড়তে-পড়তে এতকাল বাদেও আমরা বুঝতে পারি সোমেনের মৃত্যুতে উপচানো ক্রোধ, শোক, দ্রোহ ও দাহ। যদিও সে-সময়কে গ্রাস করেছিল রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতা, রাজনৈতিক মৃত্যুও ছিল আপাত লক্ষ্যহীন, তবুও সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর অভিন্ন এক শোক, ক্রন্দন, ক্রোধ ও আকাঙক্ষায় একত্র হয়েছিলেন ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মী। ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ কি তেমন দীর্ঘ সময়? জন্মমৃত্যুর এই সামান্যতর ঘোরের মধ্যেই তিনি কী রাজনীতিতে, কী সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলেন তাঁর একাগ্রতা দিয়ে। এই একাগ্রতার সঙ্গে কমিটমেন্টের দূরত্ব কতখানি তা মাপতে চুলচেরাবিদরা ব্যস্ত থাকুন; আমরা যা বলব তা হলো, কমিটমেন্ট হোক আর একাগ্রতাই হোক, সেটা তাঁর এই হ্রস্ব জীবনকেও এত দীপ্তিময় করে রেখেছে যেমনটি অনেকে তাঁদের অনেক দীর্ঘ জীবনেও করতে পারেন না। সোমেনের মৃত্যু এখনও কমিউনিস্ট আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তৎকালীন আত্মঘাতী সরলীকৃত রণকৌশলকে ধিক্কার দিয়ে বেড়ায়। এই মৃত্যুর প্রতীকী ভবিষ্য-ভাষ্যই যেন প্রতিফলিত হয় পরবর্তী সময়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনে, বামপন্থীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মাহুতিতে। তবুও সান্ত্বনা, চারপাশের রাজনৈতিক লক্ষ্যহীনতা সোমেনের কমিটমেন্টকে দুর্বল করে ফেলে নি। বরং লজ্জা পেয়েছে এসব লক্ষ্যহীনতার মধ্যেও নির্ধারিত রাজনৈতিক কর্মসূচি লালন-পালনে সোমেনের একাগ্রতা দেখে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়ার পাদটিকা হিসাবে তাঁর জন্মতারিখ কিংবা শৈশব-কৈশোরও অজানা সবার। ম্যাট্রিক পাশ করার পরে একদিকে অর্থাভাব, অন্যদিকে প্লুরিসি বা ব্রঙ্কাইটিস জাতীয় কঠিন অসুখে মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলের ডাক্তারি পড়াও বাদ দিতে হয় তাঁকে। শুধু ডাক্তারি পড়া নয়, যে কোনও একাডেমিক লেখাপড়াও। তাঁর…

সাহিত্যে স্বাধীন দেশের আবাহন আমরা শুনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরে সেই আবাহন আর কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে বাঙালির কথাসাহিত্যও সুস্পষ্ট এক আদল পেয়েছিল। তার আগেও গদ্য ছিল, কিন্তু সেই গদ্যে ছিল না বাঙালির সামাজিক-অসামাজিক জীবনের স্বাদ ও গড়ন ছিল না নিরীক্ষণ ছিল না যাকে এখন বলি ‘বিটুয়িন দ্য লাইনস সেসবের অস্তিত্ব। বঙ্কিম হয়ে উঠেছিলেন একইসঙ্গে আমাদের কথাসাহিত্যের জনক ও আত্মজ। তবে কেবল কথাসাহিত্যেরই আদল দেন নি তিনি, তৈরি করেছিলেন সাহিত্যে মৌলবাদের গড়ন; যদিও কথাটা শুনতে খুবই লাগে, কেবল কানে নয়, কান ছাড়িয়ে হৃদয়েরও মধ্যে। সাহিত্য তো শুধু বাস্তবতা নয়, সাহিত্য বাস্তবতাকে আত্মস্থ করে, অতিক্রমও করে। আত্তীকরণ ও অতিক্রমণের মধ্যে দিয়েই সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিম তাঁর আশেপাশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি। আত্মস্থ করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেন নি হজম করে ফেলতে এবং প্রচণ্ড বিবমিষায় উগড়ে ফেলেছেন ভেতর থেকে। উল্টেপাল্টে ফেরত আসা সাম্প্রদায়িক বাস্তবতার সে গন্ধ তাই ভয়াবহ উৎকট। সাম্প্রদায়িকতাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি অনতিক্রান্ত এক বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছেন এবং সম্প্রদায়কেই মনে করেছেন মুক্তির কাণ্ডারী। এসব কথা মানতে কষ্ট হয়, বিশেষত সেই বঙ্কিমের কথা মনে হলে,- যে-বঙ্কিমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ’। এত যে সুকৃতি তাঁর, সাম্প্রদায়িকতা সেসবের মধ্যে একেবারেই বিসদৃশ, চৌবাচ্চাভর্তি খাঁটি দুধে একফোঁটা প্রস্রাব পড়ার মতো। মাত্র একটি ফোঁটা, কিন্তু স্বাদ ও পবিত্রতা নষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট ওইটুকুই। অনেকে দুর্বোধ্যতাকে হালআমলের গদ্যের প্রধান দুর্বলতা বলেন; কিন্তু বঙ্কিম পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা অনুভব করতে পারি, দুর্বোধ্যতা নয়- যুগে যুগে কথাসাহিত্যের প্রধান সংকট হলো গতিহীনতা। এই গতিহীনতা লেখকের ভাষাকে মৃত করে তোলে। কিন্তু গতিময়তা ছিল বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাক্যগঠন ও শব্দব্যবহার অত দুর্বোধ্য হওয়ার পরও শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে একেবারে মুদির দোকানদার পর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আহমদ শরীফ অবশ্য আমৃত্য দাবি করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও জাতীয়তাবাদী। বলেছেন, দেশকে প্রথম মাতৃরূপে জেনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিই প্রথম তাত্ত্বিক অর্থে একটি ভৌগলিক স্বদেশ ও স্বজাতির অনুসন্ধানে নামেন। সুবা-ই-বাঙ্গলা বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে স্বদেশ হিসেবে মূর্ত করে তোলেন তাঁর লেখায়। এর অধিবাসীদেরও তিনি তাঁর স্বজাতির করে নেন। এ অঞ্চলের জনতার জন্যে বাঙালি অভিধা তিনিই ফিরিয়ে আনেন এবং তাঁর সেই বাঙালি কেবল…

প্রায় নিঃশব্দেই আমাদের দেশের লোকজ চিন্তাতত্ত্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিকাশের সোপানশীর্ষে ওঠে। তখন একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন চলছে এবং ওই শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনও মুখোমুখি বিরোধিতায় না গিয়ে বাঙালির মনন আধুনিক করে তোলার কাজ করে চলেছেন রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭), ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রমুখ চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলা নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা। এর অন্যদিকে সাধারণ জনতার বিক্ষুব্ধ মনোজগত আপাতচোখে হঠাৎ হলেও মূলত দীর্ঘ বঞ্চণার পথ বেয়ে প্রকাশ পেয়েছিল সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট সর্বস্তর ছুঁয়ে যাওয়া ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে। (more…)

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.