সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাজ ও উপনিবেশিক ভারতবর্ষ,- কোনও রাষ্ট্রকাঠামোই নজরুলকে স্বীকৃতি দেয়নি। নজরুলের সৃজনশীল শক্তির সামনে বিপণ্ন বোধ করেছে ওই রাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো নজরুলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা নজরুলের সৃজনশীল শক্তিকে আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করেছে সে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্র তার স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে কারও সৃজনশীল শক্তিকে কি আড়াল ও দুর্বল করতে পারে? এক কথায় বলতে গেলে পারে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্র যে-খণ্ডিত নজরুলকে তুলে ধরেছে, তা থেকেই দেখা যায়, নজরুলের সৃজনশীলতাকে খর্ব করার অপচেষ্টাই করা হয়েছে নানাভাবে। নজরুলের সৃজনশীলতা চায় আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে, সাম্যমনস্ক হতে; কিন্তু রাষ্ট্র তার সাহিত্যের এই অসামান্য শক্তিকে আড়াল করতে তৎপর নানাভাবে। এই অসামান্য শক্তি রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তির। এই নজরুল রাষ্ট্রের অপছন্দের। তার কাছে স্বস্তিকর খণ্ডিত নজরুল। কেননা তাতে সাপও মরে, লাঠিও বাঁচে।
অবশ্য বিপণ্ন ওই উপনিবেশিক রাষ্ট্রেও সংঘবদ্ধ এমন এক মুসলিম বাঙালি সমাজ ছিলো যাদের কাছে অস্বস্তি ও ঘৃণার পাত্র ছিলেন তিনি। ঘৃণায় নজরুলকে বার বার ‘কাফের’ বলেছে তারা। আর একটি অংশ ছিল যারা ‘দেখ আমিনা মাযের কোলে, দোলে শিশু ইসলাম দোলে’র সুরে দোলায়িত হয়ে কাফের বলতে দ্বিধা বোধ করেছে তাকে, কিন্তু ‘কালো মেয়ের পায়ের নিচে, দেখে যা মা আলোর নাচন’ শুনতে শুনতে অস্বস্তিতেও ভুগেছে ভীষণ। কিন্তু অনেক অস্বস্তি থাকলেও ভাসতে হয়েছে তাকে বাঙালি মুসলমানের জন্যে নজরুলের তৈরি করা সৃজনশীল জোয়ারে। ওই জোয়ারে না-ভাসা ছিল আরও বেশি অস্বস্তিকর, এমনই প্রবাহশক্তি ছিল সেই ধারাতে। অস্বস্তি ছিল, কিন্তু শক্তি ছিল না উপেক্ষা করবার, কেননা উপেক্ষার অর্থ ছিল নিজের মৃত্যুদণ্ডে সাক্ষর করার সমান।
এই অস্বস্তিময় মুসলমান বাঙালিদের বাঁচবার পথ করে দিল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি। অতএব নজরুলের মহাশশ্মানকে গোরস্থানে পরিণত করার কাজে নামতে দেরি হলো না রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের। অবশ্য এর ফলে, তাদেরই বরং গোরস্থানে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। অতএব তারা রণে ভঙ্গ দিলো, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকল এবং এক সময় সক্ষমও হলো ফের সেই গোরস্থান থেকে উঠে আসতে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে যেমন, তেমনি রাষ্ট্রে জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলমাকে সংযুক্ত করে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নজরুলের যে-অপব্যবহার শুরু হলো সেই কাজে এদেরও ভূমিকা আছে; যেমন রয়েছে সামরিক শাসনেরও।
ব্রিটিশরাজে রাষ্ট্র যতই প্রত্যাখ্যান করুক, নজরুল স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের। বিদ্রোহের ভাষা খুঁজে ফিরছিলো এই উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান। বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের কোলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজকে তরঙ্গিত করেছিলেন মাইকেল মধূসুদন দত্ত। কিন্তু বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে ছিল, রাজনৈতিক বিকাশের সহযোগী সাংস্কৃতিক ভাষা খুঁজে ফিরছিলো তাদের সবাই। নজরুল এদের বিদ্রোহের ভাষা জুগিয়েছিলেন, এক অর্থে সেক্যুলারিজমের ভিত্তিও গড়ে তুলেছিলেন নিজের অজান্তেই। যে-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাম্প্রদায়িক ভেদ তৈরি করে চেয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন অব্যাহত রাখতে, তাদের জন্যে নজরুলের এই সেক্যুলার ভিত্তি আক্রমণাত্মকই ছিল বটে। ‘ভগবানবুকে’ পদচিহ্ন ফেলতে চেয়েছেন কাজী নজরুল; ব্যাপারটা হিন্দু সমাজের জন্যে সুখকর ছিলো না মোটেও; মুসলমান সমাজের জন্যেও সুখকর কিছু ছিল না, কেননা ‘খোদার আরশ আসন ছেদিয়া’ও মাথা তুলতে চেয়েছেন তিনি। আর এই প্রচল সৃষ্টিকর্তা বিনাশী সেক্যুলারবোধের কারণেই তিনি বরং প্রিয় হয়ে ওঠেন সাধারণ জনতার মধ্যে, মুক্তিসংগ্রামীদের, সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামীদের, নেতাজী সুভাষ বোসদের মধ্যে। ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব’,- বলেছিলেন সুভাষ। এবং সত্যিই তাই, আমরা তাঁর গান গেয়েছি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েও।
আঠারো শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথমাবস্থা পর্যন্ত আমরা ভারতবর্ষের যে-চালচিত্র দেখি, আহমদ শরীফের ভাষা ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে বলা যায়, ক্রমশই সেসময় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, হিন্দুর প্রতি ‘কৃপা বিলানোর সামর্থ্য’ ব্রিটিশ সরকারের কমে আসছে। আই সি এস সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর পদচ্যুতি, আই সি এস পরীক্ষার্থীর বয়সীমা উনিশে বেঁধে দেয়া, ইলবার্ট বিল প্রভৃতি ছিল এরই ইঙ্গিত,- বলেছেন আহমদ শরীফ। এসব কারণই হিন্দু শিক্ষিত সমাজে জাগিয়ে তুলতে থাকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাজাত্যবোধ। বিশেষত ‘বেসরকারি শিক্ষিতদের মধ্যে ধীরে হলেও তখন সঞ্চারিত হতে থাকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি অনুরাগ ও চেতনা।
কিন্তু শিক্ষিত হিন্দু সমাজের এই ব্রিটিশবিদ্বেষী অবস্থানের বিপরীতে, আহমদ শরীফ জানাচ্ছেন আমাদের, মুসলমান সমাজ বেছে নিয়েছিল ব্রিটিশ তোষণ নীতি। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যুক্ত হতে হলে মুসলমানকে কাঠখড় পোড়াতে হতো অনেক; মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’-এ জানান,- এর জন্যেও দায়ী ছিল তখনকার মুসলমান সমাজের ব্রিটিশ তোষণ চরিত্র। সাংগঠনিক কাজ চালানোর ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখত মুক্তিকামীরা, যাদের পরিচিত করানোর চেষ্টা চলেছিল সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। ব্রিটিশ তোষণকারী মুসলমানদের দলে টানতে তাই অনেক সময় নিতো তারা। মূলত বিক্ষুব্ধ হিন্দুদের একটি সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ে এসে ব্রিটিশ স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশেই ১৮৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে জাতীয় কংগ্রেস। এরপর মাত্র দুই যুগের মধ্যেই বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করে মুসলমান বাঙালিকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে সক্ষম হয় ব্রিটিশ রাজ। রাজনৈতিক দূরত্ব স্পষ্ট আকার নেয় হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে। গঠিত হয় মুসলিম লীগ। কিন্তু তোষণ নীতি তারপরও ছিল। এই তোষণের রাজনৈতিক ধর্মীয় ব্যাখ্যাই দেখা যায় মওলানা মওদুদীর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বের লেখালেখিতে।
রাষ্ট্র যখন তার জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করছে, সাম্প্রদায়িকতাকে বাতাস দিচ্ছে, তখন কেবল বাঙালি মুসলমানই নয়, বাঙালি হিন্দুও অপেক্ষা করছিলেন সৃজনশীল এক বিদ্রোহী বার্তার,- এমন এক বিদ্রোহী বার্তার, যা তাদের অতীতের অপেক্ষাকৃত মসৃন ঐক্য ও সহাবস্থানকে তুলে ধরতে পারবে, শাণিত করতে পারবে। এই সৃজনশীল বিদ্রোহী বার্তা নিয়ে এলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯১৯ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেন তিনি এবং অচিরেই হয়ে ওঠেন নতুন এক পথিকৃৎ। লিখেছেন তিনি, ‘‘বাঙলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দুদের দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী, তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দুদের দেবীর নাম নিই। অবশ্য এজন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানী হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।’’
নজরুলের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই স্বীকারোক্তির অর্থ, মানুষকেই বড় করে জেনেছিলেন তিনি। এবং সম্প্রদায়সমূহের সহাবস্থানের ব্যাপারে তাঁর এই অনুভব সেক্যুলারিজমেরই দুর্বল এক সংস্করণ,- কেননা এই ভাষ্য সাক্ষী দিচ্ছে যে, হিন্দু ধর্মকে উৎসাহিত করার জন্যে তিনি ‘কালো মেয়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন’ দেখেননি, যেমন ইসলাম ধর্মকে উৎসাহিত করার জন্যে দেখেননি ‘আমিনা মায়ের কোলে কচি শিশু ইসলাম।’ তিনি তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক থেকে শুরু করে যাবতীয় সহাবস্থান ও সঞ্চরণ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন এবং সে কারণে অবিরাম ধর্মীয় উপাদানসমূহের সৃজনশীলতাগুলি উদ্ঘাটন করে গেছেন। তা ছাড়া সেইসব সৃজনশীলতাই তাঁর আরাধ্য ছিল, যা এ দুই সম্প্রদায়ের কাছে সহিষ্ণুতাকে সহজাত করে তুলবে।
নজরুল-যে ‘লাঙল’ পত্রিকা সম্পাদনা করলেন, সম্পাদনা করলেন ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা,- তাও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে লাঙলের ঘোষণা ছিল খুবই সুস্পষ্ট। ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ’ দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল পত্রিকাটি। পত্রিকাটির মাধ্যমেই ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাসূচক স্বরাজ্য লাভ এ দলের উদ্দেশ্য।’ বলা হয়েছিল, ‘আধুনিক কলকারখানা, খনি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ট্রামওয়ে, স্টীমার প্রভৃতি সাধারণের হিতকারী জিনিষ লাভের জন্যে ব্যবহৃত না হইয়া দেশের উপকারের জন্যে ব্যবহৃত হইবে এবং এতৎসংক্রান্ত কর্মিগণের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সম্পত্তিরূপে পরিচালিত হইবে।… ভূমির চরমস্বত্ব, আত্মঅভাব-পূরণ-ক্ষম স্বায়ত্তশাসন-বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের উপর বর্তিবে- এই পল্লীতন্ত্র ভদ্র-শূদ্র সকল শ্রেণীর শ্রম-জীবীর হাতে থাকিবে।’’
এরকম সব ঘোষণাকে সঙ্গী করার কারণেই নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মুসলমানের জাগরণের সৃজনশীল সূত্র, পাশাপাশি পেরেছিলেন পুরো বাঙালি জাতির সৃজনশীল মিলনসুত্রও হয়ে উঠতে। রাজবিরোধী বিবেচনায় উনিশ শতকে কোনও কোনও লেখকের লেখা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, কিন্তু রাজদ্রোহের জন্যে প্রথম কারাবাস কাজী নজরুলকেই করতে হয়েছিল। এইসব অভিজ্ঞতার কারণে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সেই তিনি লিখতে পেরেছেন, ‘‘সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষ- সকলের ওপর বিদ্রোহ করেই তো জীবন কাটল।’
নজরুলের অন্তর্গত শক্তি, কেবল ব্রিটিশ রাজবিরোধী সংগ্রামেই নয়, মুক্তিযুদ্ধেও তীব্রভাবে অনুভব করেছে বাংলাদেশ। নাগরিকত্ব দিয়ে নজরুলকে যখন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো, তখন আমরা অবশ্য আমরা কেবল নজরুলের সেই শক্তিই অনুভব করিনি, প্রকাশ ঘটতে দেখেছি রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তিরও বটে। নজরুলের বাঙালিত্বের অপরিমেয়ে শক্তি তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের কাছে। রাষ্ট্র তার সার্বভৌম শক্তির প্রকাশ ঘটায়, এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কাছে নজরুলকে উপঢৌকন চেয়ে, প্রতিত্তরে সেই রাষ্ট্র নজরুলকে অপর রাষ্ট্রকে উপঢৌকন দিয়ে। ব্যক্তি হিসেবে নজরুল অনেক আগেই অসুস্থ হয়েছিলেন, অচল হয়েছিলেন, তাই আমাদের জানার অবকাশ নেই দু’টি রাষ্ট্রের এই দেয়া-নেয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি কীভাবে নিতেন। কিন্তু অনুপস্থিত নজরুলকে ঘিরে পাকিস্তান রাষ্ট্র যে অপতৎপরতায় মেতে উঠেছিল, বাংলাদেশে নজরুলের শারিরীক উপস্থিতি তাদের অনুসারীদের সেই অপতৎপরতাকে আরও জোরদার করেছে। কখনও তাঁকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলেছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে, কখনও রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শক্তিমান হিসেবে এবং শেষমেষ ধর্মবাদী রাজনীতির পরিপূরক সাংস্কৃতিক ধারাভাষ্যের অগ্রণী হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় এই রাষ্ট্র যেমন রাষ্ট্রধর্ম খুঁজে পেয়েছে, তেমনি খুঁজে পেয়েছে একজন জাতীয় কবি! স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিকতন্ত্রকে বাহন বানিয়ে রাষ্ট্র নিজের স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিল জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শক্তিগুলি আত্তীভূত করে নিতে। এই প্রক্রিয়ায় সামরিক জান্তা এরশাদ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দু’জনকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালান। একদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের আসর বসান তিনি, অন্যদিকে নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করেন; আবার শহীদ মিনারকেও মিলাদ মাহফলি মঞ্চে পরিণত করার জন্যে ছুটোছুটি করেন। এরশাদের আগে জিয়াউর রহমানও অনুভব করেছিলেন, নজরুলকে রেখে দিতে হবে বাংলাদেশে। তাই সন্তান কাজী সব্যসাচীর পক্ষ থেকে নজরুলের লাশ নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হলেও সে অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তিনি এসে জানতে পেরেছেন, তাঁর লাশ দাফন করা হয়ে গেছে। এইভাবে রাষ্ট্র তাঁর স্বার্থের সংস্কৃতি সৃষ্টির জন্যে নজরুলকে রেখে দিয়েছে; কেননা রাষ্ট্র অতীত থেকে এই শিক্ষা নিতে ভুলে গেছে যে, প্রগতিবাদীদের সঙ্গে দাঁড়ানোর শক্তি নজরুলের সাহিত্যে নিরবধি প্রবহমান।
দুই.
কিন্তু রাষ্ট্র যতই ব্যবহারের-অপব্যবহারের চেষ্টা করুক, নজরুলকেই আমরা কাছে টেনে নেই রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে বিবিধ অবস্থান নিতে গিয়ে। কেননা তাঁর মতো রাজদ্রোহী হতে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আর কোন সাহিত্যিককেই বা দেখেছে বাংলা সাহিত্য?
তারপরও প্রশ্ন জাগে, কতটুকু সচেতনভাবে এই বিদ্রোহ করেছেন তিনি? মননশীলতা কি এতই তীব্র ছিল যে তিনি রাজনীতি ও সংস্কৃতির নিরিখে বিশ্লেষণ করে সচেতনভাবে অবস্থান নিয়েছেন রাষ্ট্রের বিপরীতে? কী সেই অপ্রতিরোধ্য প্রেরণা, যা কাজী নজরুলকে সাহায্য করে এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে? তা কি তাঁর অন্তর্গত ও জীবন থেকে আহরিত সাম্যের চেতনা? সাহিত্যে তাঁর সাম্যের এক রূপ আমরা দেখি বটে, দেখি শোষণহীন ও প্রেমময় চেতনার প্রভূত বিচ্ছুরণ; কিন্তু তারপরও কি বলা যায় যে সাম্য ও মুক্তির রাজনৈতিক চেতনাই লালন করেছেন তিনি?
রাষ্ট্রের ফৌজ হয়ে তিনি রণক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন, যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রপক্ষ হয়ে, তাও জীবনের সবচেয়ে তরুণতম সময়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের সংঘবদ্ধ ও আইনসম্মত সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতাই তাঁকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্রস্তুত করেছে, সেটা ভাবাও ঠিক হবে না। সৈনিক জীবনও ছিল তাঁর খুব কম সময়ের। এ বিষয়ে বরং আমাদের কিছুটা চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফের ভাষ্য।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আহমদ শরীফের সমালোচনা নিয়ে আলোচনায় সবাই যত আগ্রহ দেখান, ঠিক ততটাই অজ্ঞতা ও অনাগ্রহ দেখান নজরুল সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা সম্পর্কে। ফলে, কাজী নজরুলকে নিয়ে আহমদ শরীফের এই সমালোচনা অনেক প্রয়োজনীয় হওয়ার পরেও এখনও ততটা আলোচিত নয়।
আহমদ শরীফ তাঁর সমালোচনা শুরু করেছেন নজরুলের জন্ম তারিখ দিয়ে। তিনি বার বার সংশয় দেখিয়েছেন ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্ম তারিখের ব্যাপারে। স্কুলের রেজিস্ট্রেশন খাতায় থাকা এ জন্মতারিখটি আদৌ সত্যি কি না, তা নিয়ে হয়তো নজরুল নিজেও সন্দিহান ছিলেন আগাগোড়া। এ কথাটিই আহমদ শরীফ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সুফী জুলফিকার হায়দারের স্মৃতিতে পাওয়া একটি বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। শরীফ জানাচ্ছেন, হায়দার কাজী নজরুলকে বলতে শুনেছেন, ‘বিশ্বকবির জন্ম ২৫শে বৈশাখ আর আমার জন্ম তারও ১৪ দিন পূর্বে অর্থাৎ ১১ই বৈশাখ।’
আহমদ শরীফ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সম্রাট শাহ আলমের আমলে এ পরিবার কোথা থেকে চুরুলিয়ায় এলেন? এঁরা কোন্ কাজীর বংশধর? শাহ আলমের আমলে বাঙলা দেশে বসতি করা দু-তিন পুরুষের মধ্যে বাঙালি হয়ে উঠেছে, তেমন ভদ্র পরিবারে নজির বিরল। বিশেষত পলাশীর যুদ্ধোত্তরকালে অবাঙালিরা উত্তর ভারতের দিকেই হিজরত করছিল। সেখানে থেকে তখন এদেশে লোক আসার সাক্ষ্য বিরল।’
এবং আহমদ শরীফের এসব প্রশ্নও ফেলে দেয়ার মতো নয় যে, ‘‘দশ-এগারো বছর বয়সেই লেটোর দলের গান বাঁধার যোগ্যতা অর্জন স্বাভাবিক নয়। কচি বালকের প্রতিভার এমন বিকাশের তথ্য কোন্ সূত্রে সংগৃহীত?’’… কিংবা ‘‘চুরুলিয়ায় যখন ছিলেন, তখন নজরুল নিতান্ত বালক। সে বালকই ইমামতি করেছেন, আর মুসলমানেরা সেই বালকের মুবতদী হয়ে নামায পড়ছে- যোগ্যতা ও বৈধতার কোনো প্রশ্নই উঠল না?’’
আহমদ শরীফের এইসব প্রশ্নও খুবই গুরুতর, ‘‘রুটির দোকানে নজরুল যে-কাজে নিযুক্ত [ময়দামাখা, রুটি-তৈরি ও বিক্রি] তাতে গান গাইবার অবকাশ ছিল কী? হারমোনিয়ামই বা সেকালের রুটির দোকানে যোগাড় হলো কী করে?… নজরুলের যদি ইসলামেই আস্থা থাকে, তাহলে কালী-সাধনার প্রেরণা পেলেন কী করে? আর ঘরোয়া জীবনে যদি তিনি কুসংস্কারপ্রবণ ও ভূত-ভীরু হন, তাহলে তাঁর বিপ্লব-বিদ্রোহ মূলক কবিতা কিংবা আচারিক ধর্মবিরোধী বাণী কৃত্রিম ফরমায়েশী রচনা হয়ে যায় না কী? … তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলেই প্রচার করা হয়। পাকিস্তান ও মুসলিম জাতীয়তা সম্বন্ধে তাঁর পরিব্যক্ত অভিমত নবযুগের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও কবিতার আলোকে আলোচিত হয় না কেন?’’
এইসব প্রশ্ন আমাদের যে-সিদ্ধান্তের দিকে এগুতে সাহায্য করে, সেটি হলো, পাকিস্তান রাষ্ট্রে যদিও নজরুল শারীরিকভাবে অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র ও মুসলমান বাঙালি চেয়েছে তাঁকে অবলম্বন করে ‘ইসলামী সংস্কৃতি’র একটি এ দেশীয় সংস্করণ সৃষ্টি করতে। এবং এইসব সংযুক্তির মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়েছে যাবতীয় প্রতিকুলতা সত্বেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্য। সেই অপব্যাখ্যাগুলি দাঁড় করানো তাদের পক্ষে সহজও বটে,- কেননা নজরুল তাঁর সহজাত ভঙ্গিমায় ধর্মকেও আত্তীভূত করেছেন লেখাতে।
আবার, আহমদ শরীফের মতো করেই বলা যায়, ‘‘আসলে নজরুল ইসলাম আবাল্য অসহ্য দারিদ্র্যের শিকার ছিলেন বলে চিরকালই শোষিত-নির্যাতিত দীন-দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু নিজকে সে-শ্রেণীর একজন ভাবতে ও রাখতে চাননি এবং সাম্যবাদেও তাঁর ছিল না কোন আন্তরিক আগ্রহ। তিনি চেয়েছেন নিজকে কোলকাতা শহরের ধনী-মানী অভিজাতদের একজনরূপে দেখতে ও দেখাতে। তাই টাকা উপার্জনের একটা প্রায়-নিশ্চিত সম্ভাবনা অনুভব করেই অধৈর্য হয়ে গাড়ি-বাড়ি নয় শুধু, ফটকে দ্বারবান রাখার মতো হাস্যকর বিলাসেও ছিল তাঁর আগ্রহ। দরিদ্র মানুষকে যে তিনি স্বশ্রেণীর বলে ভাবতে লজ্জাবোধ করতেন, সাম্যবাদ তাঁর মুখে উচ্চারিত হলেও যে বুকের সত্য ছিল না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’’
তাই, যা নজরুলকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা তাঁর সচেতন যুক্তিবাদী মানস নয়, সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সচেতনতাও নয় কিংবা ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যও নয়। তা হলে কী কারণে রাষ্ট্র তাঁকে প্রতিপক্ষ মনে করেছে? তিনিই বা কেন বার বার রাষ্ট্রের সঙ্গে অসহযোগিতার পথে এগিয়ে গেছেন?
এর কোনও ঋজু একক কারণ নেই। একটি কারণ তো অবশ্যই এই যে,- তাঁর নিজের আকাঙ্ক্ষা যাই থাকুক না কেন, যে-পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে সেই পথে পাওয়া দুঃখ ও ক্ষোভকে তিনি সাহিত্যের পাঠকদের সঙ্গে একাকার করে দিতে পেরেছেন, সঙ্গীতের শ্রোতাদের মধ্যে লীন করে দিতে পেরেছেন। সাহিত্য ও সঙ্গীতে তাঁর এই কণ্ঠস্বরের জন্যেই তখন অপেক্ষা করছিল গোটা বাঙালি জাতি। তিনি তা পেরেছেন, কেননা তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন, তিনি নিজেকে শোষিত মনে করতেন, তিনি জেদী ছিলেন এবং সর্বোপরি এসব কারণে খুব সংগোপনে বিচ্ছিন্নও ছিলেন। সংঘবদ্ধতার ও সংগঠনের দায় ছিল না তাঁর। তাই ভয় ছিল না অবদমনেরও। আরেকটি কারণ, সমকালীনতাকে তিনি এত বেশি নিবিড় করে হিন্দু পুরান আর মুসলিম ঐতিহ্যের নিবিড়তায়, ভাষার বৈচিত্র্যে ও মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার পথগামী নিপীড়িত মানুষের বেদনায় উৎসারিত করেছেন যে তা সমকালের ও মধ্যবিত্তের দূরযাত্রার অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। আরও একটি কারণ, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণকর অনুভব ছিল বলে তা হয়ে ওঠে মুক্তি ও স্বাধীনতাকামীদেরও মননের ছন্দ। এবং এই কি মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষ, কি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হয়ে উঠতে মরিয়া শ্রেণি, সবই তো রাষ্ট্রেরই প্রতিপক্ষ তখন। অতএব তাদের মননের প্রতীক নজরুলও হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ।
তিন.
সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কি সৃজনশীলতাকে নিরাপদ করে? রাষ্ট্র একজন সৃজনশীল মানুষকে কতটুকু নিরাপদ করতে পারে?
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নজরুলের যে-বিদ্রোহ, রাষ্ট্র কি তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে নজরুলকে বরং গ্রহণ করে তাঁর ধারণার অপব্যাখ্যাসমূহ পৃষ্ঠপোষকতা করার মধ্যে দিয়ে? আবেগের যে-উচ্ছ্বাস এবং প্রত্যাখ্যানের যে-শক্তি নজরুলের সাহিত্যে আমরা অনুভব করি, তাতে মনে হয় না রাষ্ট্রের এই টানাহেঁচড়াকে তিনি ভালো চোখে দেখতেন। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ লিখেছিলেন তিনি, কেননা চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের আত্মিক ও সামাজিক বন্ধন, চেয়েছিলেন একই ভূখণ্ডের বন্ধন; ১৯৪৭-এর বাংলা ভাঙন নিশ্চয়ই আহত করতো কাজী নজরুল ইসলামকে। এবং এ-ও বলা যায়, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অন্তত নজরুল ইসলামের মতো সৃজনশীল মানুষকে স্বস্তি দিতো না, তুষ্ট করতো না,- তাকে তিনি যত প্রাপ্যই মনে করুন না কেন।
কেন স্বস্তি পাবেন তিনি, কেন তুষ্ট হবে তিনি, যে-রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছতে তাঁকে পাড়ি দিতে হবে বাংলা ভাঙন? যে-রাষ্ট্রে পৌঁছে তিনি পরিণত হবেন মৌলবাদী ধর্মবাদী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অপব্যাখ্যার নতুন পরিসর?
প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নজরুলকে আরও নিরাপত্তাহীন করেছে। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি তাঁর সৃজনশীলতাকে সৃজনশীল উপায়ে উদ্ঘাটনের ও প্রয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
এবং এই প্রতিবন্ধকতা আমরা নিশ্চিহ্ন করতে পারি কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে, রাজপথে আমাদের পাশে তাঁকে আবারও দাঁড় করিয়ে।
তথ্যসূত্র:
আহমদ শরীফ : বাঙলার মনীষা, অনন্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।
