প্রায় নিঃশব্দেই আমাদের দেশের লোকজ চিন্তাতত্ত্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিকাশের সোপানশীর্ষে ওঠে। তখন একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন চলছে এবং ওই শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনও মুখোমুখি বিরোধিতায় না গিয়ে বাঙালির মনন আধুনিক করে তোলার কাজ করে চলেছেন রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭), ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রমুখ চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলা নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা। এর অন্যদিকে সাধারণ জনতার বিক্ষুব্ধ মনোজগত আপাতচোখে হঠাৎ হলেও মূলত দীর্ঘ বঞ্চণার পথ বেয়ে প্রকাশ পেয়েছিল সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট সর্বস্তর ছুঁয়ে যাওয়া ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে। সে-ঘটনার আঁচ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের এই চিন্তাবিদরাও দূরে ছিলেন না, কিন্তু সমাজ-মননকে তাঁরা উর্বর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিদ্রোহকে উৎসাহিত না করে বরং ভারতবর্ষের সামাজিক চিন্তার গতিধারা ভিন্নমুখী ও ইতিবাচক করে তুলতে।
কিন্তু এসবই ছিল শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তা-প্রচেষ্টা। আমাদের অন্ত্যজ বাঙালিরা ছিলেন এ-সব চিন্তা ও ভাবনার দোলাচল থেকে অনেক দূরে। এই অন্ত্যজ বাঙালির লোকজ চিন্তাধারা গঠন ও বিকাশের একটি তাত্ত্বিক রূপরেখা আমরা খুঁজে পাই অন্যতম সাহিত্যিক ও সমাজতাত্ত্বিক আবু জাফর শামসুদ্দিনের কয়েক প্রবন্ধে। যে-বাংলা ভাষাকে হাতের নাগালে নিয়ে ১৯৫২-এর পর বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হলো মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে গেল সেই বাংলা ভাষাকে-যে আরও অনেক আগে এই অন্ত্যজ বাঙালিরাই রক্ষা করেছিল ‘বনেদি’ ভাষা সংস্কৃত উর্দু, হিন্দি আর ফারসির দাপট থেকে তাও আবু জাফর শামসুদ্দিন আলোচনা করেছিলেন প্রসঙ্গক্রমে।
লোকজ চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক এই প্রবণতাকেই পরিণতভাবে সংরক্ষণ করেন সাধক-কবি লালন। দিন যত যাচ্ছে তাঁর চিন্তার দীপ্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির প্রভা আরও বিচ্ছুরিত হচ্ছে এবং তিনি ক্রমেই বন্দি হচ্ছেন এলিট শ্রেণীর গবেষণা ও আলোচনার বৃত্তের মধ্যে।
লালনের সেই সময়কে আমরা এখন আর খুঁজে পাব না। তিনি একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে স্বকীয় চিন্তা নিয়ে উঠে এসেছিলেন এবং তাঁর চিন্তা প্রকাশ পেয়েছিল বিভিন্ন গানের ভেতর দিয়ে। এখন ভিন্ন একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে কোনও মানসসাধনা ছাড়া কেবল লালনের সঙ্গীত চর্চার মধ্যে দিয়ে তাঁর অনুসারীরা আদৌ টিকে থাকতে পারবেন কি না তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তাঁর কুষ্টিয়ার মাজার ও বাউলঅনুসারীদের নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে যেসব ঘটনা ঘটে গেল স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন অব্দি, তাতে এ ব্যাপারে আশান্বিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু অনেক নিরাশার মধ্যেও আশার দিকটি হলো, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে লোকজ অন্ত্যজ বাঙালির ভাবজগত আর চিন্তাধারার গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে লালনের বিস্তৃতির মধ্যে দিয়ে। যদিও মধ্যবিত্ত শ্রেণি লালনের চিন্তাজগতকে ইতিবাচকভাবে ধারণ করে কতটুকু শ্রেণীচ্যুত হতে পারবেন সেই প্রশ্নের মীমাংসা এই বিস্তৃতির পক্ষে করা অসম্ভব।
মূলত এই লালন সাঁইকে নিয়েই প্রকাশ পেয়েছে অতি সম্প্রতি আবুল আহসান চৌধুরীর বই লালন সাঁই : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ’। লালনকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন অনেক বছর ধরে। এমন অনেক দুষ্প্রাপ্য লেখাও তিনি উদ্ধার করেছেন যা লালনগবেষণায় অপরিহার্য। নিজেই বলেছেন তিনি, ‘লালন সাঁই আমার স্বারস্বত-সাধনার প্রধান প্রসঙ্গ।’ স্বারস্বত-সাধনার কারণেই লালনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে আর সেগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও ছাপা হয়েছে। কোনও কোনও লেখা এখনও বইভুক্তই হয় নি। ২০০৪-এর বইমেলায় প্রকাশিত এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বই ও পত্রিকা থেকে নির্বাচিত কিছু লেখা। লেখাগুলোর বিষয়বস্তু মূলত লালন ও বাউল সম্প্রদায়। আর লালন ও বাউল সম্প্রদায়কে নিয়ে আলোচনা আরও উর্বর করার লক্ষ্যেই তিনি আরও আলোচনা করেছেন আরও কয়েক ব্যক্তিত্ব কাঙাল হরিনাথ, রবীন্দ্রনাথ, পাগলা কানাই, মীর মশাররফ হোসেন, হাসন রাজা আর ফকির মহিন শাহকে নিয়ে। এর মধ্যে ফকির মহিন শাহের বিভিন্ন সঙ্গীতে আমরা পুনরায় পাই বাউলদের সমকালীন সামাজিক-রাজনীতিক মনস্তাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা, কিন্তু তা অন্তর্গত হতে পারে না শেষাবধি।
তবে লালন সাঁই তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতকে এত বেশি অন্তর্গত করে নিতে পেরেছিলেন যে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না, বাউলদের মধ্যে কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল চিন্তাচিন্তনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছানো যে-পর্যায়কে বলা যাবে বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়। আবুল আহসান চৌধুরী লালনের সমাজমনস্কতা তুলে ধরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর ‘লালন সাঁই : সমাজমনস্ক এক সাধক কবি’ শীর্ষক আলোচনায়, পাশাপাশি ‘লালন-বিরোধী সামাজিক প্রতিক্রিয়া’য় তুলে এনেছেন তাঁর চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমাদের প্রচল সামাজিকতার বিরোধ। এই সমাজমনস্কতার সঙ্গে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, লালন কত দূরের পথিক ছিলেন। লালনের সময়েই সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, যদিও এই বিদ্রোহে তিনি কীভাবে ও কতটুকু বা আদৌ যোগবদ্ধ ছিলেন কি-না তা আমাদের জানার উপায় নেই। লালনের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে এবং কুষ্টিয়ার সঙ্গে পাবনার যোগাযোগ ছিল খুবই নিবিড়, পদ্মার এপারওপার যাতায়াত ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার। কিন্তু লালনের জীবদ্দশাতেই সংঘটিত পাবনা-সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ লালনকে কতটুকু আলোড়িত করেছিল তা তাঁর সঙ্গীত বা অন্য কিছু থেকে ছেঁকে আনা যায় না। যদিও এ-রকম জানা যায়, লালন অনুসারীরা কুষ্টিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন নদী পেরিয়ে পাবনা জেলায়। কিন্তু তারা বিদ্রোহের ধারায় যুক্ত হয়েছেন, এমন কোনও লোকজ বিবরণও নেই। এই স্বাভাবিক অভিগমন ছাড়াও, বাউল সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নেমে এলে অনেকে ঠাঁই নেন পাবনা জেলায়। কিন্তু এসব ব্যাপারের কোনও বিবরণ পাওয়া না গেলেও, লালনের মতো দিব্যজ্ঞানের সন্ধানী-যে এসব ঘটনায় আলোড়িত হবেন তা লেখাই বাহুল্য। কাঙাল হরিনাথকে যখন জমিদার-সামন্ত শ্রেণী থেকে হুমকি দেয়া হয়, তখন তিনি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান, জমিদারের লাঠিয়ালদের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয় লালনঅনুসারীরা। তাই মহাবিদ্রোহ আর সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহও নিশ্চয়ই লালনের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। যদিও এসব ঘটনা আমরা তাঁর গানের বা ভাবের বহিরাঙ্গে খুঁজে পাই না। রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেয়েও সামাজিক পরিবর্তনকে তিনি জরুরি করে দেখেন এবং তাঁর গান খুঁজে নেয় এমন সব বিষয়আশয় যা কেবল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মীমাংসিত হয় না, অনেক সময়ে বরং পটপরিবর্তন তাকে আরও জটিল করে তোলে,- সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে, অন্তরের অন্তরতর উদ্বোধন ঘটিয়েই কেবল যার সমাধান হতে পারে।
আবুল আহসান চৌধুরী লালনের এই সমাজমনস্কতাকে সঙ্গতকারণেই অনেক বড় করে দেখেছেন। লালন যে ধর্ম-সমন্বয়, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গের প্রতি ঘৃণা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা’র মধ্যে দিয়ে লোকজসমাজকে প্রস্তুত করেন সমতার বোধে, তা বোঝানোর জন্যে তিনি লালনের বিভিন্ন গানের পংক্তি তুলে ধরেছেন। লালনের এই মনোভঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাই তাঁরা লালনের সময় থেকেই অবিরাম তাঁর বিরোধিতা করে আসছে। তিনি কোনও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, বিদ্রোহের সংগঠক ছিলেন না, কিন্তু তাঁকে নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা মানুষেরা। কেননা এ-সব সাম্প্রদায়িক শক্তির জানা ছিল, লালনের ভাবাদর্শ সম্প্রসারিত হলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চর্চার ও সমাজনিয়ন্ত্রণের কোনও অবকাশই পাবে না তাঁরা। লালনকে যেতে হয় তাই এক বিরুদ্ধ সামাজিক স্রোতের মধ্যে দিয়ে। সমকাল ছাপিয়ে এত গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার পরও সেই বিরুদ্ধ স্রোত ঠেলে যেতে হচ্ছে তাঁকে।
লালনবিরোধিতার ধারা সৃষ্টি হয় মূলত তাঁর জাতপাতধর্মবিরোধী বক্তব্যের কারণে। আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার-নিগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউলসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে। হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮০-১৮৪৯), তীতুমীর (১৭৮২-১৮৩১), কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩), দুদ্দু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী (১৮৬৭-১৯২৩) প্রমুখ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের উদ্যোগ-প্রচেষ্টায় বাউলমতের প্রভাব-প্রসার খর্ব-ক্ষুণ্ন হয়।’ তবে এঁদের ভূমিকার সঙ্গে লালনের বিরোধিতার দিক নিয়ে লেখাটিতে তিনি বিস্তারিত কোনও আলোচনা করেন নি। কেবলমাত্র ‘ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন’ই যদি লালনের বিরোধিতা করে তবে বলতেই হয়, লালনের ভক্তিবাদী, সাধনমার্গীয় জীবনচর্চ্চা ও সমাজগঠনের প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ইসলামী পুনর্জাগরণবাদীদের। বিভিন্ন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদীদের লেখায় এর সাক্ষ্যও পাওয়া যায়, আমরা তা জানতে পারছি আবুল আহসানের আলোচনা থেকে। অন্যদিকে লালনের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মসমন্বয়ের প্রচেষ্টা থাকার পরও তাঁর ওপর যে ঠাকুরবাড়ির প্রচ্ছন্ন অনুরাগ ছিল এ ব্যাপারেও ইঙ্গিত দেন লেখক : ‘তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের সানুরাগ কৌতূহল তাঁর পরিচয়ের ভূগোলকে আরো প্রসারিত করে।’
লেখাই বাহুল্য, আবুল আহসান চৌধুরী কোথাও কোথাও পাঠকের আগ্রহ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন, এখানে লালন সম্পর্কে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার আলোচনায় ঠাকুরবাড়ির ব্যাপারটি আরও সম্প্রসারণ করার প্রয়োজন ছিল। লালনের যে-ছবিটি আমরা অহরহ ব্যবহার করি, যে ছবিটি তাঁর চেহারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার একমাত্র উৎস সেটি রবীন্দ্রনাথেরই ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা; লালনের গান ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর চোখে পড়ে, সে কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, তাঁর গানের খাতাগুলোও অবিকৃতভাবে পাওয়া গেছে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে- এ সব তথ্য তিনি ছড়িয়েছিটিয়ে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করলেও শিরোনামের দাবি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় হলেও এ লেখাটিতে সেসব ব্যবহার করেন নি। এ লেখাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করার জন্যে এক জমিদারবাহিনীর বিরুদ্ধে লালন ও লালনঅনুসারীদের প্রতিরোধপ্রস্তুতি কথা- কিন্তু লেখেন নি তখন শিলাইদহে জমিদারী ছিল ঠাকুর পরিবারের। অথচ ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে লালন আর কাঙাল হরিনাথের দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা থেকেই উঠে আসতে পারে তখনকার সমাজক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চ্চার তথা সামাজিক প্রতিক্রিয়ার নতুন এক দিক। তিনি এ লেখাটিতে জানিয়েছেন, ‘এই সংস্কার-আন্দোলনের প্রভাবে মীর মশাররফ হোসেনও বাউলদের সম্পর্কে অক্লেশে বলেছেন, ‘এরা আসল শয়তান, কাফের, বেঈমান/ তা কি তোমরা জান না (সঙ্গীতলহরী)।’ অথচ তাঁর ‘মীর মশাররফ হোসেন : অন্তর্গত বাউল’ লেখায় মশাররফের এ মন্তব্য সম্পর্কে কোনও কিছুই লেখেন নি।
এটি ঠিক যে, লালনঅনুসারীদের ওপর ইসলাম ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে নিগ্রহনির্যাতন নেমে আসে, যে-সম্পর্কে কোনও ধারাবাহিক তথ্য পাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু যেসব তথ্য আবুল আহসান চৌধুরী নিজেই পেয়েছেন, সেগুলোও সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তিনি অধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন, ‘সঙ্গীতলহরী’ থেকে উদ্ধৃত মীর মশাররফের উক্তিকে তিনি মুনীর চৌধুরী থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতির আগে জুড়ে দিলে আমরা বরং পেতাম মশাররফের চিন্তাজগতের এক অনালোচিত বিবর্তনের ধারা। মুনীর চৌধুরীর যে-উদ্ধৃতি তিনি ব্যবহার করেছেন সেটি হলো : ‘স্পষ্টতই মনে হচ্ছিল যে কাঙাল হরিনাথের জীবন-চেতনা বরাবর এক তালে চলেনি, লালন ফকির এসে তার মূলে মোচড় দিয়ে গেছেন। মীর সাহেব উভয়স্তরেই কাঙালের সুহৃদ ছিলেন।’ ‘সঙ্গীতলহরী’র আর মুনীর চৌধুরীর এই উদ্ধৃতি মিলে নির্মিত হয় অখণ্ড মীর মশাররফ হোসেন এবং আমরাও পাই এমন এক সামাজিক স্রোত যা বিরোধিতার মধ্যে দিয়েও শেষমেষ অর্জন করে লালনের সিদ্ধি। একইভাবে তিনি উল্লেখ করেন নি সেই জেলা প্রশাসকের নাম, যিনি ১৯৬৫ সালে লালনের নামানুসারে কুষ্টিয়া জেলার নাম পরিবর্তনের জন্যে প্রশাসনিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে লালনবিরোধীদের রোষানলে পড়েন।
তবে আবুল আহসান চৌধুরীর কৃতিত্ব যে, তিনি এই সামাজিক বিরুদ্ধতার দিকে বেশ গুরুত্ব নিয়েই নজর দিয়েছেন এবং আলোচনা করেছেন- যা আগে আমাদের চোখে পড়ে নি। লেখাগুলোর নিচে রচনার তারিখ থাকলে তাঁর এই নিরীক্ষণের মৌলিকত্ব সম্পর্কে পাঠক আরও নিঃসন্দেহ হতো। তাঁর আরও এক কৃতিত্ব, লালনের জীবনী রচনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তিনি সংগ্রহ ও ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে পাক্ষিক ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ১২৯৭ সনের বৈশাখে বা ১৮৯০ সালের এপ্রিলে অর্থাৎ লালনের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘মহাত্মা লালন ফকীর ’ লেখাটিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ লেখাটি থেকে স্পষ্টভাবেই আমরা বুঝতে পারি, অন্ত্যজ বাঙালির চিন্তাবিদ হলেও লালন সমসময়েই আলোড়ন তুলেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিচর্চ্চায় নিয়ত মানুষদের। ১৫ কার্তিক ১২৯৭/ ৩১ অক্টোবর ১৮৯০-এ প্রকাশিত এ লেখা পড়ে মনে হয়, জীবদ্দশাতেই লালন পরিণত হয়েছিলেন এক কিংবদন্তিতে, যাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মৃত্যুর পরপরও তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায় নি (‘ইহাঁর জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন।’- লিখেছেন ‘হিতকরী’র লেখক)। তবে তাঁর জীবনচর্চ্চার ধারা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। এবং তাই অনেক বিতর্কিত এ-মানুষ সম্পর্কে সমসময়ের ‘হিতকরী’তে লেখা হয়েছে : ‘নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাঁহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধহয়। তিনি কোন শাস্ত্রই পড়েন নাই ; কিন্তু ধর্মালাপে তাঁহাকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত। বাস্তবিক ধর্ম সাধনে তাঁহার অন্তদৃষ্টি খুলিয়া যাওয়ার সারসত্ত্ব তাঁহার জানিবার অবশিষ্ট ছিল না। লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না; অথচ সকল ধর্ম্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।’
লালনের সঙ্গে অনেক সামাজিক বিরোধের পরও ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা কেন লালনকে নিয়ে সবিশেষ কৌতূহলী ছিলেন আর ইসলামী পুর্নজাগরণবাদীরাই বা কেন তাঁর ওপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত ছিল সে সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় আবুল আহসান চৌধুরী সংগৃহীত ‘হিতকরী’র এ লেখাটি থেকে : ‘‘মুসলমানদিগের সহিত তাঁহার আচার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাঁহাকে মুসলমান মনে করিত ; বৈষ্ণবধর্ম্মের মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। জাতিভেদ মানিতেন না, নিরাকার পরমেশ্বরে বিশ্বাস দেখিয়া ব্রাক্ষ্মদিগের মনে ইঁহাকে ব্রাক্ষ্মধর্মাবলম্বী বলিয়া ভ্রম হওয়া আশ্চর্য্য নহে, কিন্তু ইঁহাকে ব্রাক্ষ্ম বলিবার উপায় নাই : ইনি গুরুবাদ পোষণ করিতেন। অধিক কি ইঁহার শিষ্যগণ ইঁহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। সর্ব্বদা ‘‘সাঞ’’ এই কথা তাহাদের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায় ? তবে জাতিভেদহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে ; বৈষ্ণবধর্ম্মের দিকে ইঁহার অধিক টান। শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু সময় সময় যে উচ্চ-সাধনের কথা ইঁহার মুখে শুনা যাইত, তাহাতে তাঁহার মত ও সাধন সম্বন্ধে অনেক সন্দেহ উপস্থিত হইত।’’
সমসময়ের ধারণায় এই হলো লালনের ধর্মবিশ্বাস। একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত ‘ছাত্রসভা’র এক অধিবেশনে ১৩১৬ সনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘লালন ফকির কুষ্টিয়ার নিকটে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ- এরূপ শোনা যায় যে তাঁহার বাপ মা তীর্থযাত্রাকালে পথিমধ্যে তাঁহার বসন্তরোগ হওয়াতে তাঁহাকে রাস্তায় ফেলিয়া চলিয়া যান। সেই সময় একজন মুসলমান ফকির দ্বারা তিনি পালিত ও দীক্ষিত হন। এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান হিন্দু জৈন মত-সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিষ তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ বিষয়ে সকলেরই মন দেওয়া উচিত।’’ রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই অংশ পাওয়া গেছে সেসময়ের ‘বঙ্গদর্শন’ (নবপর্যায়)-এর পৌষ ১৩১৫ সংখ্যায়। বাঙালীর সাংস্কৃতিক প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখাসাক্ষাৎ না-ও হতে পারে, কিন্তু লালনের দর্শনগত আবেদন যে তাঁর হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিল এ বক্তব্য তারই বহিঃপ্রকাশ।
লালন ছাড়াও কাঙাল হরিনাথ, গগণ হরকরা, পাগলা কানাই, হাসন রাজা, ফকির মহিন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল সমপ্রদায় নিয়ে এ বইতে আলোচনা করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। এ ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের বাউলদের নিয়ে একটি আলোচনা আর লালন-গবেষক ক্যারল সলোমনের সাক্ষাৎকার। এ সব আলোচনাই লালন সাঁইয়ের দর্শন ও ভাবগত আবেদনের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের যোগান দিতে পারে এবং একটি অখণ্ড ধারাবাহিক পূর্ণাঙ্গ ধারণার উৎস হতে পারে। কেননা একটি কথা আমরা প্রায়শঃই ভুলে যাই, লালনের সময়টিও ছিল ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা যেমন রাজনৈতিক অর্থে তেমনি সামাজিক সংস্কারগত অর্থেও। তিনি এমন এক দর্শনগত সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দেন যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণীকে অন্ত্যজ বাঙালির ভাবজগতের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষ্যে আবুল আহসান চৌধুরী আমাদের জানান যে, ‘লালন বাঙালির নবজাগরণে বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে রামমোহনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’ বাঙালির আরও এক মনীষা আহমদ শরীফের ভাষ্যটিও উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেছেন, ‘‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তাঁর গান লোকসাহিত্য মাত্র নয়, বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর।”
লালনের ভবিষ্যৎ কি? এ প্রসঙ্গে চোখ আটকে যাচ্ছে বাউলদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে লেখা আবদুল ওদুদের কয়েকটি বাক্যের ওপরে। লালনবিরোধী আলেম সমাজের সমালোচনা করতে গিয়েও তিনি জানাতে ভোলেন নি, ‘…একযুগ যে সাধনাকে মূর্ত করে তুলল, অন্য যুগের ক্ষুধা তাতে নাও মিটতে পারে।’’ এ বইয়ে লালনচর্চ্চার ভবিষ্যত নিয়েও একটি আলোচনা হতে পারত এবং বইটি তা হলে পূর্ণাঙ্গ হতো। কেননা এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে অনেক ঘটনা ঘটেছে, গড়াই নদী দিয়ে অনেক পানিই গড়িয়ে গেছে এবং লালন একাডেমীর কার্যক্রম ও ভবন নির্মাণ নিয়েও দেখা দিয়েছে অনেক বিতর্ক- যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরাও। আমরা কি প্রকৃতার্থেই অন্য কোনও যুগের প্রান্তে আসতে পেরেছি যাতে লালনের রূপ-অরূপের সাধনা এখনই মনে হবে অপ্রয়োজনীয়? তা ছাড়া তিনি তাঁর বইয়ের কোনও ভবিষ্যত-সংস্করণে সব ক‘টি লেখাকে সমন্বিত করতে পারে এমন একটি ভূমিকা লিখলে বইটি আরও ঋদ্ধ হবে।
বিভিন্ন অসম্পূর্ণতা অবশ্য বইটিকে ম্রিয়মান করতে পারে নি। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখে আবুল আহসান চৌধুরী যেমন লালন, অন্যান্য বাউল ও বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর ধারণা তুলে ধরেছেন, তেমনি আমাদেরও সে ধারণা পাওয়ার বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
