চলচ্চিত্র সমাজের কথা বলে। আসলে কোন চলচ্চিত্রই সমাজ ও সময়ের বাস্তবতাকে সচেতন বা অবচেতনভাবে উপেক্ষা করতে পারে না। বলা যায়, চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্প মাধ্যম যার সৃজনশীল বা বিনোদন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সময়ের ভাবনা, সংকট, দর্শন, ধর্ম, সীমাবদ্ধতা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট যেন অন্তর্নিহিত থাকে। আর তাই, এই আলোচনার প্রয়োজনীয়তা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপধ্যায় এর কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ এর সার্থক চলচ্চিত্রায়ন করেন সত্যজিৎ রায় ১৯৫৫ সালে। জানা মতে, উপন্যাসের সময়কাল ১৯৩০ এর দিকে এবং বিভূতি বাবু সেই সময়ের বাংলার প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জীবন-সংগ্রামের এক অনন্য চিত্রায়ন তুলে ধরেন তার উপন্যাসে; যা অনুধাবন পূর্বক সত্যজিৎ রায় সেই মানুষদের বিশ্ব দর্শক এর কাছে নিয়ে এলেন। ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা এই মুহূর্তে’র উদ্দেশ্য নয়। এমনকি বিভূতি বাবু’র উপন্যাস ও সত্যজিৎ বাবু’র চলচ্চিত্রায়নের কোনো তুলনামূলক উপস্থাপনা করাও লক্ষ্য নয়। এই চলচ্চিত্র আমাদের অনেকের দেখা এবং না’দেখা কারো প্রতি অনুরোধ – সত্বর বাংলা চলচ্চিত্রের এই অতি আবশ্যক শিল্পকর্মটি যেন দেখে নেবার সুযোগ হয়।
আমি সরাসরি চলে আসি চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে, যিনি আপাত অর্থে (যে সময়ের কথা সত্যজিৎ রায় তুলে এনেছেন সেই সময়ে) সমাজে অবহেলিত, মনোযোগহীন একজন মানুষ। ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের এই চরিত্রটি হলেন ‘ইন্দিরা ঠাকুরণ’। সম্পর্কে তিনি দুর্গা-অপু’র পিসী, অর্থাৎ হরিহরের বোন। সিনেমায় আমরা স্পষ্ট পাই না, তিনি কি হরিহরের আপন বোন নাকি দূর সম্পর্কীয়। তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি শেষ সময়ে নিজের ভিটে’তে মরতে এসেছেন তাতে আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি হরিহরের নিকট বোন-ই। উপন্যাসে বিষয়টি কিভাবে আছে তা ভাবতে চাইছিনা। আমরা মূল চলচ্চিত্রের সাথে ভাবনায় সম্পৃক্ত থাকতে চাই।
‘ইন্দিরা ঠাকুরণে’র অবস্থানটি একটু বুঝে নেই – অতিশয় বৃদ্ধা এই মহিলা বিধবা – স্বামী,সন্তানহীন। পিতৃপ্রদত্ত ভিটেতে একটি ঘরে ভাই-এর ইচ্ছায় তাঁর একমাত্র আশ্রয়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা থাকলে এই ভাইয়ের আশ্রয় ব্যতীত তাঁর খুব বেশী কোথাও যাবার উপায় নেই। ভাইয়ের সন্তানরা তাঁর কাছে নিজের সন্তানের তুল্য। তাঁর এই ভালবাসা থেকেই আমরা দেখি, বৃদ্ধা পিসীর জন্য ছোটবেলা থেকে দুর্গার দারুন দুর্বলতা। বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া ফল-ফলাদি এনে জমা করে পিসীর ভাঁড়ারে। একারণে পিসীও ভাইঝি’র কোনো দোষ মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু ভাইয়ের স্ত্রী সর্বজায়া তাঁকে মেনে নিতে পারেন না। ইন্দিরা ঠাকুরণ এর অনেক দোষও আছে। তিনি লোভী, আবার রান্নাঘর থেকে এটা-ওটা চুরিও করেন। সর্বজায়ার কাছে তিনি একজন স্বার্থপর ব্যক্তি। স্বার্থপর না হয়ে উপায় নেই; এই বৃদ্ধার সাধ আহ্লাদ পূরণে কেউ নেই, এমনকি তাঁর ভরণপোষণের দিকে কাউকে মনোযোগ দিতেও আমরা দেখি না। ভালমানুষ হরিহরকে একটি নূতন চাদর কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা গেলেও, দারিদ্রতার কারণে তা পূরণ হয় না। কিন্তু ঘরে আমার দেখি এই পিসীকে নানা কাজে লাগতে। যেমন শিশু অপু’কে ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে দোল দেয়া বা শিশু দুর্গা-অপু’কে ডাইনির গল্পবলা। এক কথায়, তিনি একজন পিসী না হয়ে একজন ঠাকু’মা হিসেবে অনেক বেশী মানাসই হতেন। কিন্তু তিনি পিসী, আর তাতেই হয়তো সর্বজায়া’র তাঁর প্রতি একটু বেশী অবহেলা ছিল। যে কোনো উপায়ে তাঁকে তিরস্কার করতে ছাড়তেন না তিনি। ভৎসনার একপর্যায়ে ইন্দিরা ঠাকুরণ প্রত্যুত্তর দিলে সর্বজায়া তাঁকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করতেন। যদিও কোথাও বেশীদিন ঠাই না পাওয়া এই বৃদ্ধা যেকোনো সুযোগে নিজ ভিটায় ফিরে আসতেন। ভাইয়ের স্ত্রীর শত বঞ্চনার মাঝেও তাঁর দুর্গা-অপু’র প্রতি ভালবাসা ছিল অসীম। অপু’র জন্মের সংবাদে তাই তিনি দুর্গাকে নিয়ে প্রবেশ করেন। অপু’র প্রথম মুখ দর্শনে তাঁর চোখ মোছার আড়ালে কি ভাইয়ের পুত্র সন্তান লাভের আনন্দ ছিল, নাকি নিজের সন্তান না থাকার বেদনাটি আবার মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল – আমরা জানতে পারি না। কেউ হয়তো ইন্দিরা ঠাকুরণের প্রতি সর্বজায়া’র বিতৃষ্ণা ও অবহেলাটি দরিদ্র পীড়িত মানুষের জীবন সমাজের নিত্যকার একটি বিষয় হিসেবে ধরে নিতে পারেন। আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করবো। শেষ দৃশ্যে শরীর খারাপ করার কারনে তিনি যখন তিনি ভিটে’তে এলেন, তখন ঘরে অপু, দুর্গা কিংবা হরিহর কেউই নেই। সর্বজায়া’র পরিবারে তখন অর্থনৈতিক সাচ্ছল্য বিরাজ করছে। তিনি নিজেও আহার করছিলেন রান্নাঘরে বসে। তিনি কোনোভাবে ইন্দিরা ঠাকুরণের পুনঃপ্রবেশকে মেনে নিচ্ছিলেন না। তাঁর কথায় তখন সরাসরি প্রত্যাখ্যান। স্পষ্টতই সর্বজায়ার অভিব্যক্তিতে তখন চাপা নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পাচ্ছিল। ইন্দিরা ঠাকুরণ শেষ চেষ্টা হিসেবে পানি পান করার কালে সর্বজায়ার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতি প্রত্যাশী হাসি দিয়েও ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেন, এই ঘরে তাঁর আর স্থান বা আশ্রয় নেই। সত্যজিৎ রায় গভীর মমতা দিয়ে ইন্দিরা ঠাকুরণের শেষ প্রস্থানের দৃশ্যটি চিত্রায়িত করেন। গৃহকর্ত্রী সর্বজায়ার উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যানের পর বৃদ্ধা পিসী তাঁর নিজের ঘরের সামনের গাছটিতে পানি দেন, অনেকক্ষণ নিজের ঘরটির পানে শেষ বারের মতো চেয়ে অনিশ্চিত স্থানে গমনের জন্য উঠে পড়েন। ইন্দিরা ঠাকুরণ দৃষ্টিপাত, তাঁর ঘরটি এবং দরজার কাছে একটি কুকুরের অবস্থান – সত্যজিৎ রায়ের কম্পোজিশন আমাদের হয়তো একটু ভাবাতে চায় যে ঘরে একটি কুকুরের আশ্রয় হতে পারে, সেখানে কেন একজন বৃদ্ধা’র আশ্রয় দিতে চান না সর্বজায়া।
ইন্দিরা ঠাকুরণ মারা গেলেন পাশের বাগানে ঝোপের পাশে। জীবনের কাছে আশ্রয়হীন এই বৃদ্ধা’র আকুতি যেন ঈশ্বর শুনলেন অতঃপর। শেষকৃত্যের আবহে আমরা শুনি তাঁর সেই আকুতিঃ
“হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে
তুমি পাড়ের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকি হে তোমারে
শুনি কড়ি নাই কো যার, তুমি তা’রে করো পার,
আমি দিন-ভিখারি নাই কো কড়ি, দেখো ঝুলি ঝেড়ে”
চলচ্চিত্রে ইন্দিরা ঠাকুরণের মৃত্যুর পর যেন সর্বজায়ার পরিবারে দুঃখ নেমে আনল। হরিহর নিরুদ্দেশ রইলেন অনেকদিন। সংসারের টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত সর্বজায়া শেষ পর্যন্ত দুর্গাকে হারালেন। সংসার ভেঙ্গে গেলে, শেষ পর্যন্ত সেই ভিটে মাটি ছেড়ে নিজেরাও দেশান্তরী হলেন। এ যেন ইন্দিরা ঠাকুরণের অভিশাপ- যা তাঁর শেষ চাওয়া ছিল নিজের ভিটেই মৃত্যু, সেই মাটি যেন আর কারো কপালে সইলো না।
ইন্দিরা ঠাকুরণের চরিত্রটি অনেকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আজ থেকে আশি-নব্বই বছর আগের এই সামাজিক চিত্র আমাদের উপলব্ধি করিয়ে দেয়, স্বামী-সন্তানহীন একজন দরিদ্র বিধবা মহিলার একমাত্র আশ্রয় তাঁর ভাইয়ের সংসার। যদিও এই ঘর তাঁর পিতৃপ্রদত্ত, কিন্তু এতে তাঁর কোন অধিকার নেই। স্বামী মরে গেলেও সন্তানহীন অবস্থায়, স্বামী’র কোন সহায়-সম্পদের মালিক হবার অধিকার বা সুযোগ তাঁর নেই। ভাই-এর আগ্রহ বা নিগ্রহে এবং ভাইয়ের স্ত্রীর যাবতীয় তিরস্কার-অপমানের মাঝেও একটু মাথাগুঁজার ঠাই খুঁজে পাওয়াটা একমাত্র চাওয়া। উপরন্তু ভাইয়ের সন্তান-সন্তাদির দেখাশুনা ও ঘরের কাজ কর্ম করে দেয়া তো আছেই। পরিবারে এই মানুষটির অবস্থান যেন ছায়া’র মতো । দিন শেষে তাঁর পরিনতি চিতার আগুনের ধোঁয়ার মতই সমাজে হারিয়ে যায় । একজন অপু-দুর্গা’র মনে হয়তো সেই পিসী কিছুদিন বেঁচে থাকেন, কিন্তু সমাজে তাঁদের নিয়ে কোন প্রয়োজন নেই। স্বামী-সন্তানহীন একজন ইন্দিরা ঠাকুরণ যেন সমাজ পরিত্যক্ত, তাঁর অধিকার বিষয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। একজন দরিদ্র হিন্দু নারী জীবনের অবস্থান প্রতিটি স্তরে যেন পরিবারের কোন না কোন পুরুষের ( পিতা, ভাই, স্বামী ও সন্তান) হাতে আশ্রিত ও নিয়ন্ত্রিত।
এবার আমরা চলচ্চিত্র থেকে বের হই। আপাত অর্থে এই সমস্যাটি হিন্দু বিধবা বা স্বামী-সন্তান পরিত্যক্ত মহিলার হিসেবে চিহ্নিত হলেও, আসলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন সময় থেকেই, (ধর্ম-জাতি–বর্ণ নির্বিশেষে) নারীর প্রতি অধিকার নিশ্চিতকরন বিষয়ে অবহেলা লক্ষ্যনীয়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি সাধিত হলেও, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পরে বিশেষ করে ভারতে নানা সামাজিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের বিভিন্ন অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই তুলনায়, পাকিস্তান ও বাংলদেশের মধ্যে ‘বাংলাদেশ’ একটি প্রগতিশীল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আপামর নারী উন্নয়নকল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও, হিন্দু নারীদের অধিকার নিশ্চিত কল্পে খুব বেশী অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। এর কারন খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল হিন্দু নারীদের বাস্তবিক অবস্থা – এই ২০১২ সালের সময়ে।
বাংলাদেশে নারী হিসেবে একজন হিন্দু যে প্রধান অধিকার সমূহ থেকে বঞ্চিত তা হল – উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তি হতে কোন প্রকার অধিকার ( পিতার মৃত্যু’র পর) ; আইনগত সূত্রে স্বামীর সম্পত্তি হতে কোন প্রকার অধিকার (স্বামীর মৃত্যু’র পর), এমনকি স্বামী না চাইলে জীবিত অবস্থায় স্বামী’র কোন সম্পদের উপর তাঁর আইনগত অধিকার নেই। এবং যা নিয়ে বর্তমানে ব্যপক সমালোচনা তা হল, হিন্দু নারীদের বিবাহ ও ডিভোর্স সংক্রান্ত অধিকার। স্বামী যতই খারাপ হউক, মারধর করুক, বা অন্য নারী আসক্ত হউক – একজন হিন্দু নারী’র পক্ষে ডিভোর্স করার করার সাধারণভাবে কোন আইনগত অধিকার নেই।
বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক আইনবিদ নীনা গোস্বামী জানান, “ একজন হিন্দু পুরুষ যখন বিবাহের শর্ত থেকে সরে আসেন, তখন একজন হিন্দু নারীর পক্ষে ঐ স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত ভাবে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ থাকে না। বিবাহ সংক্রান্ত কোন আইনি কাগজপত্র না থাকার কারনে প্রমান করাও সম্ভব হয় না, তারা আদৌ বিবাহিত কিনা”।
শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু পরিবার সমূহে বিষয়টি পারিবারিক বা সামাজিকভাবে অনেক সহনীয় এবং নিয়মতান্ত্রিক হলেও নিম্ন বর্গের নারীদের অবস্থা শোচনীয়, যাদের রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ব্যতীত আর কোন উপায় নেই। এএফপি সংবাদের বরাতে বলা যায় ‘তরুলতা রানী’র অভিজ্ঞতার কথা; যিনি আফসোস করলেন- কেন তিনি তাঁর অন্যান্য মুসলিম সহকর্মীদের মতো স্বামীর অবর্তমানে (জীবিত অবস্থায়) কোন ভরনপোষণ পাবেন না, এমনকি স্বামীকে ডিভোর্সও দিতে পারবেন না ? ২২ বছর বয়সী রানী জানতে চায়, হিন্দু হয়ে জন্মানো কি তবে পাপ ?
নীনা গোস্বামী বলেন, “প্রতি হাজারে দশ জন হিন্দু পুরুষের একাধিক স্ত্রী আছে, যারা জানে যে আইনগত ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই”। তিনি জানান, অধিকারহীনতা হিন্দু নারীদের কর্মহীন এবং চরম দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেয়, যখন এই মহিলারা তাঁদের স্বামী কর্তৃক পরিত্যাজ্য হন।
রাষ্ট্রের কাছে এই হিন্দু নারীদের কোন অস্তিত্ব নেই, যাদের আর্তি গিয়ে পৌঁছুবে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কানে। রাজনীতিবিদদের কাছে হিন্দু সম্প্রদায় একটি বিশাল ভোট ব্যাঙ্ক যা হিন্দু পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোন রাজনৈতিক দলই কোন সংস্কার করে হিন্দু সম্প্রদায় কর্তৃক সমালোচিত হতে চান না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাদের উৎসাহে ২০১২ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার হিন্দু নারীদের অধিকার সংরক্ষনে বিবাহ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রনয়ন করে। যদিও সমালোচকদের কাছে এই নতুন বিধিমালা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁদের মতে, আওয়ামীলীগ সরকার কখনো হিন্দু রক্ষণশীলদের সাথে সংঘাতপূর্ণ কোন আইন তৈরি করবে না, যারা এ ধরনের নীতিমালাকে হিন্দু ধর্মের উপর আঘাত হিসেবে মনে করে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, “আমরা হিন্দু পারিবারিক আইনকে সংশোধিত করতে পারছিনা হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল লোকজনের কারনে। এদের মধ্যে অনেকে শিক্ষিত শ্রেণী থেকে এসেছেন। চরমপন্থিরা তো হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশান পদ্ধতির একেবারেই বিপক্ষে”।
রক্ষণশীলরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তারা কোন প্রকার সংশোধন মানবে না, যা তাঁদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ও ঐতিহ্য পরিপন্থী। এমনকি ডিভোর্সের বিধান হিন্দু পারিবারিক ভিত্তি সমূহকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে সমাজ সংস্কার পরিষদ এর সভাপতি হিরেন বিশ্বাস বলেন, “ মাঝে মাঝে ভ্রমণকালে হিন্দু নারী পুরুষের বিয়ের কাগজপত্র প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে সাময়িক এই রেজিস্ট্রেশান আমরা মেনে নিব। কিন্তু বাধ্যতামূলক বিবাহ রেজিস্ট্রেশান, ডিভোর্সের অধিকার বা উত্তরাধিকার অধিকার বিষয়ে কোন আইন আমরা মেনে নিব না। কারন তা আমাদের ধর্ম গ্রন্থ ও ঐতিহ্য তা সমর্থন করে না।“ তিনি এও মনে করেন, এই সব বিদেশীদের অর্থায়নে তৈরি করা আইন, যা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে একইরকম সরকারের উপর চাপ তৈরি করে থাকে ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়। রাষ্ট্র কর্তৃক যে কোন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেয়া হলে তা সম্প্রদায় ও ধর্মের উপর আঘাত হিসেবে নেয়া হয়। ষড়যন্ত্র অভিহিত করে ছড়িয়ে দেয়া হয় উন্মাদনা। ফলে ভারতীয় মুসলিম নারীরা বাংলদেশের হিন্দু নারীদের মতই নানা সুবিধা বঞ্চিত এবং পুরুষদের দ্বারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত।
এটা ঠিক যে ধর্মীয় কোন দিক নির্দেশনা থাক বা না থাক, সমাজের নিজস্ব গতিতে সমাজ থেকেই উঠে আসে নানাবিধ সামাজিক ও সংস্কারমূলক আন্দোলন। ব্রিটিশ আমলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর সামাজিক আন্দোলনের কারণে বিধবা বিবাহ চালু ও সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়। আমাদের দেশের মুসলিম নারীরা যেটুকু স্বাধীনতা ও অধিকারের সুফল পাচ্ছে, তার পেছনে নানা আন্দোলন কাজ করেছে। ধর্মীয়ভাবে মেয়ে সন্তানের পিতার সম্পদের উপর উত্তরাধিকার, স্বামী বা সন্তানের সম্পদের উপর অধিকার, বিয়ের রেজিস্ট্রেশান বা তালাক বিষয়ে অনেক নির্দেশনা থাকার পরেও, এ বিষয়ে সামাজিকভাবে আইনকে প্রয়োগ করতে নানা সময়ে অনেক আন্দোলন ও উদ্যোগ নিতে হয়েছে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে । এরপরও সমস্ত মুসলিম নারী যে সর্ব অধিকার ভোগ করতে পারছেন তা বলা যায় না, স্বামী-শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক নির্যাতন, সালিশ-সামাজিক ভাবে নারীদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা বা অত্যাচার একেবারে মুছে যায় নি। কিন্তু তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোতে মামলা করার সুযোগ আছে।
আমরা লক্ষ্য করলেই দেখি, আমাদের চার পাশে অধিকার বঞ্চিত ইন্দিরা ঠাকুরণ’রা কি নিদারুন অসহায় জীবন যাপন করছে। স্বামী-সন্তানের আনন্দময় পরিবেশ থেকে (স্বামী বা স্বামীর পরিবারের যেকোনো দুরভিসন্ধি/খেয়ালের কারনে) মুহূর্তে নিঃসঙ্গ ও মনবেতর জীবনের কোলে গিয়ে পড়ছে একজন নারী। পিতার বাড়ি থেকে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে গেলে পিতার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় অধিকার ছিন্ন হয় । এরপর অধিকারের নতুন পাঠ শুরু করেন স্বামীকে কেন্দ্র করে। যারা উচ্চ বর্ণের, শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী – তারা হয়তো নিজেদের অবস্থানকে শক্ত রাখতে পারেন। কিন্তু যারা এর বাইরে দরিদ্র-অশিক্ষিত- নিম্ন শ্রেণী, তাঁদের তো পিতা-পুত্র, ভাই ও স্বামী ছাড়া উপায় নেই। তাই একজন সর্বজায়া হয়তো স্বামী উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত সম্পদের পুরোটাই নিজের আয়ত্তে রাখতে চান, ইন্দিরা ঠাকুরণকে আশ্রয় না দিয়ে। কিন্তু তাতেও কি লাভ আছে ? কোন কারনে স্বামী যদি বের করে দেয় ঘর থেকে, তিনিও বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন শেষ অবধি ? সমস্ত অসহায় ইন্দিরা ঠাকুরণের বৃদ্ধা বয়সের করুন পরিনতি কি তবে সেই বাঁশ ঝাড়ের পাশে ? ভারতীয় সমাজের ননদ-ভাবি’র মনস্তাত্ত্বিক টানা পোড়েনের ঐতিহাসিক কারন হয়তো ভাই-স্বামীর সম্পদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্যে নিহিত। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার কারণে তা আধুনিকতা পেলেও মনোজাগতিক প্রভাব থেকে তা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে না।
বাংলাদেশে হিন্দু তরুন বা আধুনিক সমাজের এই বিষয়ে ভাবনা কি বোঝা যায় না। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁদের বিরামহীন ভূমিকা থাকলেও, ধর্মীয় সংস্কারের এই বিষয়গুলোতে তাঁদের খুব বেশী সরব দেখা যায় না। বরংচ তরুণ সমাজের একটি সুবিধাবাদী অংশ রাজনৈতিক-সামাজিক কারনে (মুসলিম অংশটির পাশাপাশি) ধর্মীয়ভাবে অনেক বেশি রক্ষণশীল হয়ে পড়ছে দিন দিন। ধনবান বা শিক্ষিত পরিবারের অনেকে হয়তো পারিবারিক চর্চার কারনে এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত নয়। আর নিম্ন বর্গের লোকজন এই বিষয়ে খুব বেশী সোচ্চার হবে না, এটাই স্বাভাবিক। যদিও তরুন সমাজের পক্ষ থেকে এই আন্দোলন একটি রূপরেখা পাওয়া অতীব জরুরী। শিক্ষিত সংগ্রামী তরুন সমাজই কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী জাতিকে পিছিয়ে রাখা’র আদিম ফর্মুলাকে ভেঙ্গে দিতে পারেন। যদিও অনেক সংস্কারপন্থীরা বলার চেষ্টা করেন – হিন্দু নারী অধিকার নিশ্চিতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু হিসেবে সামগ্রিক ভাবে হিন্দুদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। অন্তত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কথাটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য বটে। কিন্তু আভ্যন্তরীণ ধর্মীয় অনুশাসনের যেসকল প্রতিবন্ধকতা সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য নারী অংশকে সামাজিক ও মানবিকভাবে অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছে, সেই অধিকার নিশ্চিত করাটাই কি সামগ্রিক অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ হতে পারে না ?
তথ্যসূত্র –
১. Bangladesh’s Hindu women fight for divorce rights By Shafiq Alam (AFP) – Jun 27, 2012 (http://www.google.com/hostednews/afp/article/ALeqM5jVhjsJgpE5w-s1pbMM_HkwTlMk4w?docId=CNG.bb487499dac21d59a8847fcd2f13b1ec.41)
২. Comparative Study on Women’s Right in Bangladesh under Hindu and Muslim Personal Laws ( http://bdlaws24.blogspot.com/2013/02/a-comparative-study-on-womens-right-in_8893.html )
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
কিশোর কান্তি ভট্টাচার্য্য - ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (৯:০৩ অপরাহ্ণ)
খুবই ভাল লেখা । সমকালের প্রেক্ষাপটে ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রের বিশ্লেষন যথোপযুক্ত । বাংলাদেশে হিন্দু নাগরিক আইনের অবস্থাটা আমার জানাই ছিল না ।
Syed Sakhawat - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ)
দারুণ লিখেছেন!সিনেমার সাথে যোগসূত্রটি বেশ ইকরারন্টারেস্টিং।সিনেমা রিড করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটা বেশ ক্রিটিক্যালি চোখ…..