অনেক অনেক দিন আগে, আওয়ামী লীগের ৯৬-২০০১ এর ‘কুশাসনে’র সময়ে, এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের এক সভায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে শিবিরমুক্ত করা যায় সেই নিয়ে আলাপ হচ্ছে, ছাত্রলীগ নেতার নাম ধাম কিছুই মনে নেই, কিন্তু কি বলেছিল সেটা এখনো মনে আছে, সে বলেছিল শিবির হচ্ছে তোমাদের স্কুলে পড়া Bogus Boo এর মত, রাতে একা পেয়ে গলা কেটে, সেই গল্প শুনিয়ে সবাইকে ভয়ে ভয়ে রাখতে চায়। বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে দেখবে শিবির এমন কিছু নয়।
শাহবাগের আন্দোলনের এই পটভূমিতে জামাত নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বিভিন্ন টক শোতে বিশেষজ্ঞদের জামাত শিবির নিষিদ্ধ হলে আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে কি করবে না করবে এই নিয়ে মহা ভীত হতে দেখা যাচ্ছে। মিশরে, সিরিয়ায়, ইরানে এবং তুরানে ইসলামী পার্টি নিষিদ্ধ করে কি বাজে ফলাফল হয়েছিল সেই বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। বাজিয়ে যাচ্ছেন সেই ভাঙ্গা রেকর্ড, জামাতকে “রাজনৈতিক” এবং “সাংস্কৃতিক” ভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
এই “রাজনৈতিক” এবং “সাংস্কৃতিক” লড়াইয়ের মানে হচ্ছে বর্ষীয়ান সাংবাদিক এ বি এম মুসা দিগন্ত টিভিতে বলে যাবেন ষাট দশকের উত্তাল দিনগুলোর কথা, বঙ্গবন্ধু তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কতবার নাস্তা খেয়েছেন আর কত শলা পরামর্শ করেছেন। চলতে থাকবে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সৌহার্দপূর্ণ আলাপ (শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করার ঢংও আজকাল কিছু কিছু বিএনপি নেতা করছেন)। দিগন্ত টিভি, নয়া দিগন্ত, ইবনে সিনা আর ইসলামী ব্যাঙ্কের ব্যবসা চলতেই থাকবে, ব্যবসার টাকায় দেওয়া হবে শিবির কর্মীদের মাসোহারা, রগ কাটার ট্রেনিং থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়ানো, সব ব্যবস্থাই সে টাকায় হবে। শিবিরকে ‘রাজনৈতিক’ ভাবে মোকাবেলার দায়িত্বটা অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হবে মফস্বলের চাঁদাবাজ, শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা ছাত্রলীগের হাতে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রলীগের কিশোর কর্মীর রগ বা কবজি বা গলা কাটা চলতে থাকবে, বদলা নিয়ে ফেরারি হবে ছাত্রলীগের আরেক কর্মী। শিবির শাসিত কলেজে সাহস করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া তরুণীকে দেওয়া হবে গণধর্ষণের হুমকি। রগকাটার খবর সাহস করে পত্রিকায় পাঠাবে না প্রথম আলোর মফস্বল প্রতিবেদক (ডাইনিঙের খাবার খারাপ হলে ছাত্রলীগের জানালা ভাঙ্গার খবর অবশ্য নিয়মিত ভাবেই আসবে)।
ফিরে আসি Bogus Boo তত্ত্বের ছাত্রলীগ নেতার প্রসঙ্গে। সেই আওয়ামী ‘ফ্যাসিবাদী’ আমলে ‘ফ্যাসিবাদী’ পুলিশের তেমন কোন সাহায্য ছাড়াই অল্প কিছু সশস্ত্র এবং বিপুল সংখ্যক নিরস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মী আর সাধারণ ছাত্র ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবির মুক্ত করে। মুক্ত করে হলের রুমে রুমে আটকে পড়া শিবির কর্মীদের জবাই করা হয় নি, রগ কাটা হয়নি, সামান্য চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, কদিন আগেই ইসলামী বিপ্লবের জন্য শহীদ হতে তৈরি এই শ্লোগান দেওয়া যুবকদের অনেককেই দেখা গেল চড় থাপ্পড় খেয়ে ‘ফ্যাসিষ্ট’ আমলে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। এদের কেউ কেউ ‘ফ্যাসিস্ট’ দলে যোগ দিয়েছিল কিনা, সেটা আমার জানা নেই, তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে দিয়েছিল।
শ্রদ্ধেয় মুসা ভাই, অমুক ভাই এবং তমুক ভাই, দয়া করে মফস্বলের ছাত্রলীগ, দল, ফ্রন্ট আর ইউনিয়নের কর্মীদের রক্তের উপর দাড়িয়ে, দিগন্ত টিভিতে বঙ্গবন্ধুর গল্প বলে, ইসলামী ব্যাঙ্কে লেনদেন করে, জামাতের বিরুদ্ধে এই ‘সাংস্কৃতিক’ এবং ‘রাজনৈতিক’ লড়াই বন্ধ করুন। গত কয়েক বছরে শিবিরের ছেলেদের বলেছেন “তোমরা তো যুদ্ধাপরাধ করোনি, বাবারা লাইনে আসো”। এখন জামাত নিষিদ্ধ হওয়ার কথা উঠলেই বলছেন “এই যে হাজার হাজার শিবির কর্মী, এরা তো নিষিদ্ধ হয়ে গেলে হয় সুইসাইড বম্বার হবে, না হলে বিএনপিতে যোগ দিবে, আওয়ামী লীগেও দিতে পারে।”
‘সেদিনের ছেলে’ হিসাবেই বলছি, Bogus Boo তত্ত্বটি মাথায় রাখুন, সুইসাইড বম্বার কেউ হবে না, এদের কেউ অরাজনৈতিক হয়ে যাবে, কেউ বিএনপিতে যোগ দিবে, কেউ দিবে আওয়ামী লীগে। যোগ দিলেও ভাবনার কিছু নেই, সাচ্চা জিয়া এবং মুজিব সেনা হতে এদের দুদিনও লাগবে না। বায়তুল মালের মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেলে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দুদিনেই উবে গিয়ে মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। (এই পোস্টের লেখকও চট্টগ্রাম কলেজে শিবিরের বড় ভাইদের স্নেহের পরশ পেয়ে বার দুয়েক শিবিরের সমর্থক ফর্ম পূরণ করেছিল, বুয়েটে এসে মাস দুয়েক ‘জয় বাংলা’ বলেছে, ফ্যাসিস্টদের কাছে পাত্তা না পেয়ে পড়লো গিয়ে টাইগার বামদের হাতে, অবশ্য কি কারণে যেন প্রাণে ধরে কখনোই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বলতে পারেনি, যাই হোক সে অন্য গল্প)।
জামাত শিবির তালেবান নয়, ইসলামিক ব্রাদারহুড নয়, শেষ বিচারে এরা হচ্ছে মাফিয়ার মত একটি বিজনেস এবং ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ, পালের গোদারা তো জেলেই আছে, গণহত্যা, ধর্ষণের আর লুটপাটের অভিযোগ নিয়ে। আইনি প্রক্রিয়াতে এদের একে একে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে আশা করছি। নিষিদ্ধ করে দিলে বাকি নেতারা ব্যবসা হারিয়ে চলে যাবে লন্ডনে (যেমন গিয়েছিল ৭১ এর পরপর), গিয়ে কিছুদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এ জাতীয় চেঁচামেচি করে নিজ নিজ ব্যবসায় মন দিবে। কেউ কেউ অবশ্য দেশেই সমমনা ইসলামী দলে যোগ দিবে, ইসলামী ব্যাঙ্ক আর ইবনে সিনার টাকা না থাকলে সেই সমমনা দল নিয়েও বিশেষ চিন্তার কিছু নেই, বিশজনের জমায়েতে দাঁড়িয়ে ইরাকে বিশ লাখ মুজাহিদ পাঠানোর হুমকি তো আমরা কতই শুনেছি।
বাংলা পরীক্ষার দিন বাংলা নিয়েই আলাপ হবে, সেটা তো শাহবাগের ‘প্রগ্রেসিভ ছেলেপুলেরা” আপনাদের বেশ কয়েকবারই বলেছে, এদের ভয় দেখাচ্ছেন ইরান, তুরান আর সিরিয়ার, বলছেন আরবি আর ফারসিতে ওরা পাস করতে পারেনি। ওরা পাস করেনি কারণ ওরা আরবি আর ফারসি পরীক্ষা দিয়েছিল ব্রিটিশ আর আমেরিকানদের কোলে বসে। আমরা তো সেটা দিচ্ছি না, বাংলা তো শিখেছি তিরিশ লাখ শহীদের আর দু লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, ১০০ তে ১০০ পেয়েই ৭১ এ পাস করেছিলাম। ৭৫ এ বলা হল আমরা ফেল করেছি, আমরা বার বার বলেছি আবার পরীক্ষা দেব, সেই একই তো পরীক্ষা, পাশ তো করেই যাব, আমাদের পরীক্ষা বার বার পিছিয়ে দেওয়া হল, Bogus Booর ভয় দেখানো হল। সেই ভয় দেখানোর সময় শেষ, জাতি হিসাবে আমাদের সামনে অনেক পরীক্ষা আছে, সব পরীক্ষায় পাস করতে হবে, বাংলা পরীক্ষা দিতেই যদি ৪২ বছর লাগে তবে তো আমরা ‘আদু জাতি’তে পরিণত হবো।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৩:০৫ অপরাহ্ণ)
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম। রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ আলোচনা, জামাতকে এভাবেই দেখা উচিত।
বিশ্বজিৎ নন্দী - ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (৫:১৫ পূর্বাহ্ণ)
অত্যন্ত ভাল লাগল।
মাসুদ করিম - ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ (১২:৪৮ অপরাহ্ণ)
বারি ভিবজিয়র - ৬ মার্চ ২০১৩ (১১:৫৩ অপরাহ্ণ)
পাকিস্তান ও ইসলামকে জামায়াতে ইসলামী এক ও অভিন্ন মনে করে। পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমদের জন্য ইসলামের ঘর। পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াত কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা মনে করে না,’ূ গোলাম আযম (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর-৭১)
মাসুদ করিম - ১ আগস্ট ২০১৩ (২:৫৮ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৫ মার্চ ২০১৪ (১২:৫০ অপরাহ্ণ)