...২০১২-এর ১১ জানুয়ারিও হয়তো ২০০৭ সালের পুরানো চেহারায় ফিরে যেতে পারত। এ ধরণের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটানোর মূল ধাত্রী বলে যাদের মনে করা হয় তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টাও হয়েছে নানাভাবে। ‘সামরিক বাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তারা গুম খুনের শিকার হচ্ছেন’, রাজনৈতিক অঙ্গনের এরকম বক্তব্যে ও লিফলেটে সেনাবাহিনীতে ভীতি-অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দেয়া অস্বাভাবিক ছিল না। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরিরের পক্ষ থেকে তো সেনাবাহিনীর প্রতি সরাসরি বর্তমান সরকারকে অপসারণের আহ্বানই রাখা হয়েছিল। ...

একটি ক্রান্তিদিনই বলা যায় বোধকরি এবারের ১১ জানুয়ারিকে। এ দিনে আমাদের মনে হয় ২০০৭ সালের কথা, সামরিক বাহিনীশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্থানের কথা। সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই সম্ভব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পথ বন্ধ করা-এরকম একটি পাকিস্তানবাদী, সামরিকতান্ত্রিক ধারণা ফিরে আসতে শুরু করে ওই ১১ জানুয়ারি থেকে। এবং এ ধারণার পালে বাতাস যোগাতে থাকেন সুশীল নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীরা। সেই অর্থে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সুশীলতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের গাঁটছড়া বাঁধার দিবসও বটে।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারিও একইভাবে আলোচিত হয়ে উঠেছে। জনগণ দেখেছে, এদিন একদিকে গোলাম আযম গ্রেফতার হচ্ছেন, অন্যদিকে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে যাচ্ছেন, একইসঙ্গে আবার বিএনপি বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, সরকার ‘আইএসপিআরকে দিয়ে উস্কানি দিচ্ছে (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮)।’ রাজনীতির এরকম বড় বড় ঘটনাগুলির বাইরে ওইদিন দেখা গেছে, সিআইডি অভিযোগপত্র দিচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মী ইব্রাহিম আহমেদ খুনের মামলায় ভোলা-৩ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ নূরন্নবী চৌধুরী শাওনকে বাদ দিয়ে। সাক্ষী করা হয়েছেন নূরন্নবী শাওনকে (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮)। এখন জানা যাচ্ছে, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার খন্দকার মোঃ আবদুল হালিম বিয়ে করেছেন এমপি শাওনের আপন মামাতো বোনকে (মানবজমিন, ১ মাঘ ১৪১৮)। নারায়নগঞ্জে এইদিন ‘যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ কমিটি’র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮) সরকার আমাদের আবারও নিশ্চিত করেছে, গণতন্ত্র আর সরকারি গণতন্ত্র দু’ রকম গণতন্ত্র, সরকারি গণতন্ত্রে নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন জায়েজ করা আছে।
অনেকেই হয়তো একমত হবেন না, তবে মনে হচ্ছে, এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আইএসপিআর’এর বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি’র বিবৃতিটি। এ বিবৃতি থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, বাংলাদেশের প্র্রধান বিরোধী দল বিএনপি সামরিক বাহিনীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তারা মনে করে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে থাকায় আইএসপিআর’কে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা মনে করছেন, বেসামরিক পর্যায়ে যেমন গুম খুন চলছে, সামরিক সামরিক কর্মকর্তারাও তেমনি গুম হয়ে যাচ্ছেন (প্রথম আলো, ২৭ পৌষ ১৪১৮)। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপি’র এ অভিযোগ খুবই স্পর্শকাতর অভিযোগ। সামরিক বাহিনীতে কারও বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে সে অপরাধ বিচারের জন্যে বাহিনীটির নিজস্ব আইন আছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার এ অভিযোগ সত্য হলে, কোনও অভিযোগ বা অপরাধের ঘটনা নয়, বিচারের ঘটনা নয়, সামরিক কর্মকর্তাদের সরাসরি গাযেব করে দেয়া হচ্ছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, খালেদা জিয়া ২৬ পৌষ চট্টগ্রামের সমাবেশে এ বক্তব্য দেয়ার আগে বিএনপি’র কোনও নেতা অথবা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ ধরণের গুমের অভিযোগ করা হয়নি।
তবে বিএনপির মতো একই অভিযোগ করা হয়েছে জঙ্গী রাজনৈতিক দল হিযবুত তাহরীর-এর পক্ষ থেকে। নিষিদ্ধ করার পর থেকে এ দলটি বিভিন্ন সময় ঝটিকাগতিতে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টার বিতরণ করে আসছে। একইভাবে গত ২৪ পৌষ (৭ জানুয়ারি) থেকে তারা তাদের ভাষায় ‘‘মার্কিন-ভারতের নির্দেশে সেনাঅফিসারদের অব্যাহত গুপ্ত অপহরণ, গ্রেফতার ও অপহরণের প্রতিবাদ করার জন্যে’’ একটি লিফলেট বিতরণ করছে। এ লিফলেটে তারা তাদের ভাষায় ‘‘এই মুহূর্তে বর্তমান শাসনব্যবস্থা ও হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার’’ লক্ষ্যে ‘‘বাংলাদেশের মুসলিম সেনাবাহিনীর নিষ্ঠাবান সেনাঅফিসারগণের’’ কাছ থেকে রাজনৈতিক ভূমিকা প্রত্যাশা করেছে। এর দু’ দিন পর ২৬ পৌষ চট্টগ্রামে বিএনপির রোডমার্চ সমাবেশ হয়েছে এবং কাকতালীয়ভাবে সেখানে, কীমাশ্চার্য, বিএনপির প্রধান নেতা খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের জনসভায় হিযবুত তাহরীরের মতোই সামরিক বাহিনীতে গুম খুনের অভিযোগ তুলেছেন।
তার আগে বলে নেই, বিভিন্ন কারণে জানুয়ারির আগে থেকেই জনমনে নানা অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে এবং মিডিয়াগুলিতেও এ পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটতে থাকে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে (জনকণ্ঠ, ১১ পৌষ ১৪১৮), ঘাটতি বাজেট সঙ্কট দূর করতে ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারি ঋণের পরিমাণ আগের যে-কোনও সময়ের চেয়ে বেশি ইত্যাদি ধরণের খবর মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন মন্ত্রীর, বিশেষ করে অর্থ, বাণিজ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি-ব্যর্থতা। গুম খুনের ঘটনা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে, উদ্বিগ্ন করে। শেয়ারবাজার পরিস্থিতি মানুষকে টালমাটাল করে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছিল এখনকার মতেই ক্ষোভবিক্ষোভ। বিএনপি এসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অবস্থান নেয় এবং সুশীলদের একটি অংশকেও দেখা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নেতিবাচক অবস্থান নিতে। ক্ষুব্ধ জনগণ বিএনপির পক্ষে থাকুক বা না থাকুক বিএনপির পক্ষ থেকে রোড মার্চের মধ্যে দিয়ে একটি রাজনৈতিক বলয় সংঘবদ্ধ করে তোলার প্রয়াস সক্রিয় ছিল বা এখনও আছে। এবং ক্ষমতার অস্বাভাবিক পটপরিবর্তন ঘটলে এ ধরণের রাজনৈতিক বলয় থেকে স্বস্তি প্রকাশ করাও অস্বাভাবিক ছিল না।।
সব মিলিয়ে, ২০১২-এর ১১ জানুয়ারিও হয়তো ২০০৭ সালের পুরানো চেহারায় ফিরে যেতে পারত। এ ধরণের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটানোর মূল ধাত্রী বলে যাদের মনে করা হয় তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টাও হয়েছে নানাভাবে। ‘সামরিক বাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তারা গুম খুনের শিকার হচ্ছেন’, রাজনৈতিক অঙ্গনের এরকম বক্তব্যে ও লিফলেটে সেনাবাহিনীতে ভীতি-অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দেয়া অস্বাভাবিক ছিল না। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরিরের পক্ষ থেকে তো সেনাবাহিনীর প্রতি সরাসরি বর্তমান সরকারকে অপসারণের আহ্বানই রাখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল অজানা আশঙ্কা।
বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য এখন বলা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্ক থেকে গুমখুনের বিষয়টি জানা গেছে। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই জানেন, বিষয়টি যথেষ্ট স্পর্শকাতর, সময়টিও স্পর্শকাতর এবং তাই বেশ দায়িত্ব নিয়েই এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য দিতে হবে। উপমহাদেশের আরেক রাষ্ট্র পাকিস্তানে এই মুহূর্তে সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দূরত্ব দেখা দিয়েছে বিরোধী দল ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে-যার প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে গত কয়েক বছর ধরে সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনুপস্থিত থাকার মধ্যে দিয়ে। বিএনপি যেমনটি বলছে-সত্যিই কি সরকার সেনাবাহিনী কিংবা আইএসপিআর’এর সঙ্গে বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে চাইছে? নাকি বিএনপির পক্ষ থেকে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব প্রত্যাশা করা হচ্ছে? আমরা জানি না, এই প্রশ্নের কোনটি সত্য। তবে আমরা এ টুকু বুঝি এ দু’টি প্রশ্ন সত্য হোক বা না হোক, এ ধরণের প্রশ্ন দেখা দেয়াই গণতন্ত্রের জন্যে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এবং তাতে পাকিস্তানের মতো একটি পরিস্থিতিই হয়তো বাংলাদেশে দেখা দেবে।
তবে ইতিবাচক ঘটনা হলো, বিএনপি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছেন এবং রাষ্টপতি জিল্লুর রহমানের কাছে থেকে আমরা শুনতে পেয়েছি, ‘‘আমি আশা করি, আপনাদের মতামত নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮)। আমরা রাষ্টপতির কথার ওপর আস্থা রাখতে চাই; যদিও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমনটি বিশ্বাস করা কষ্টকরই বটে। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবিকই আমাদের রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থার জন্যে মারাত্মক সঙ্কট হয়ে উঠেছে। এর ফলে বিচার বিভাগের নিয়োগপ্রকিয়া ম্যানিপুলেটেড হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই আমরা বলতে শুনেছি, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে একটা ফর্মুলা তৈরি করে আমরা সুপ্রিম কোর্ট ধ্বংস করেছি। আমার মনে হয় না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে নির্বাচন বয়কটের ঘটনা ঘটবে। আমার চেয়েও মেধাবী, মস্তিষ্কবান এবং ধৈর্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই একটা উপায় খুঁজে বের করবেন’ (প্রথম আলো, ১৮ পৌষ ১৪১৮)।
কিন্তু রাজনীতিতে ইস্যু চাই এবং আমাদের রাজনীতিতে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেরকম একটি ইস্যু। রাষ্টপতির সঙ্গে সংলাপ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকেও বলতে শোনা গেছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করে নির্বাচন কমিশন গঠন করে কিছু হবে না (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮)। দলগতভাবে বিএনপি রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে যে একেবারেই আশাবাদী নয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মওদুদ আহমদের কথা থেকেও, ‘‘দু’টি কারণে এই সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না। এক. এই সংলাপ রাষ্ট্রপতি নিজের ইচ্ছায় করেননি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে করেছেন। দুই. এককভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই (প্রথম আলো, ২৯ পৌষ ১৪১৮)।’’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অবশ্য বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বললে আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেবে।’ মনে হচ্ছে, সরকারি দলের পক্ষ থেকে এভাবে রাজনীতির অথবা আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। খুব আশাবাদী ব্যক্তিরা এ থেকে আশার আলো দেখলেও দেখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকারি দলের সাংসদরা কেন অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে আগহী না হলেও (যেমন, ট্রানজিট ইস্যু, টিপাইমুখ ইস্যু, ইত্যাদি) বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে সংসদের ফ্রেমওয়ার্কে আলোচনায় আগ্রহী তা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। এমন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে চান, অথচ সংসদে যাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। তারা আলোচনা করবেন কোনখানে? তাদের মত-অভিমত যাচাই করা হবে কোন নিরিখে? বিষয়টি যদি এরকম হয়, বিএনপিকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার নিজের রাজনৈতিক বিজয় ঘটাতে চায়, তা হলে ভবিষ্যতে তা আরও মারাত্মক গণতান্ত্রিক সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিএনপি অবশ্য কেবল সংলাপ নয়, রাজপথেও সক্রিয় থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া আগামী ১২ মার্চ ‘ঢাকা চলো’ অভিয়ানের ঘোষণা দিয়েছেন। সংবাদপত্র জানাচ্ছে, তিনি কী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তা নাকি এমনকি নীতিনির্ধারকদেরও জানা ছিল না। দলের যে কর্মসূচি সম্পর্কে এমনকি নীতিনির্ধারকরাও অন্ধকারে থাকেন, সেই কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, তা এখন দেখার বিষয়। কেননা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসংকান্ত আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করছে, সামরিক বাহিনীতে গুমখুনের অভিযোগটিকে তারা কত বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারবে তার ওপরে। এই বল বিএনপি নিজেই নিজের কোর্টে টেনে নিয়েছে। তবে সাফল্য প্রত্যাশা করার আগে বিএনপিকে এখন এটি অবশ্যই মনে করতে হবে, সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীতে গুম খুনের অভিযোগ তোলার মধ্যে দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের গুমখুনের অভিযোগগুলি তারা মার্জিনালাইজ করে ফেলেছে। আগেই বলেছি, একই অভিযোগ হিযবুত তাহরিরের লিফলেটেও করা হয়েছে। সেখানে আরও এক পা বাড়িয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মুসলিম সেনাবাহিনী’ হিশেবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরির তাদের ওই লিফলেটে দাবি করেছে, ‘‘সেনাবাহিনীতে যেসব অফিসারগণ ইসলাম এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন’’ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। লিফলেট প্রচারের পর দলটি এখন পোস্টার লাগানোর কাজে নেমেছে। অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করার পরপরই এ খববের উৎস সম্পর্কে একটি গা-ছাড়া অবস্থান নেয়ায় জনসমক্ষে দলটির পিছিয়ে যাওয়ার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিএনপি’র এরকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থান এখন পর্যন্ত তেমন স্পষ্ট নয়। এর আগে সাধারণ নাগরিকদের গুম খুনের অভিযোগ ওঠার পর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমরা বলতে শুনেছিলাম, তিনি নাকি পত্রপত্রিকা পড়ে গুমখুনের কথা জানতে পেরেছেন (মানবজমিন, ১ পৌষ ১৪১৮)। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা বলতে শুনেছি, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীই এসব গুম খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে (প্রথম আলো, ৪ পৌষ ১৪১৮)। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে সে ব্যাপারেও সরকার এর বেশি কিছু বলবেন বলে আশা করা যায় না। ইতিমধ্যে অবশ্য দু’একটি সংগঠন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে, মানববন্ধনও করা হচ্ছে। বিএনপির সামরিক বাহিনীতে গুম খুনের অভিযোগের ইস্যুটিকে নাড়াচাড়া করার মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষকে গুম খুন করার ঘটনাগুলি মার্জিনালাইজ করার এ সুযোগ সরকার হাতছাড়া করবে কেন? বিএনপি এ ইস্যুকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে এসে সরকারের হাতে একদিকে সাধারণ মানুষকে গুম খুন করার ইস্যুটিকে মার্জিনালাইজ করে ফেলার সুযোগ তুলে দিয়েছে, অন্যদিকে, সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক বাহিনীতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পুরানো ক্ষতগুলি জাগিয়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই ইস্যু নিয়ে বিএনপি বেশি দূর যেতে পারবে বলে মনে হয় না, মাঝখান থেকে তারা শুধু সরকারের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুপ্তহত্যা, গুম খুন ইত্যাদির অভিযোগকে অর্থহীন করে তোলার বড় সুযোগ তৈরি করে দিল।
বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য রাষ্টপতির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টিকে বড় করে তোলার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক সংলাপের ব্যাপারে দলটির আন্তরিকতাকে বড় করে দেখানোর একটি প্রয়াসও রয়েছে। কিন্তু বিএনপিও এটি জানে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ যত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হোক না কেন, ওইদিনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, গোলাম আযমের গ্রেফতার হওয়া। এই গ্রেফতার জনগণের কাংখিত ঘটনা; কিন্তু বিএনপির কাছে কতটা কাক্সিক্ষত ছিল তা গবেষণার বাপার। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে, এ ঘটনা তাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। গোলাম আযমের গ্রেফতারের জন্যে তারা খুব বেশি প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয় না। আর গ্রেফতার যখন করা হলো, তখন তাদের মধ্যে নতুন এক আশা দেখা দিয়েছিল-আবদুল আলিমের মতো গোলাম আযমকেও হয়তো ‘অসুস্থতার’ কারণে জামিন দেয়া হবে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি, সেরকম কিছু আইন অনুযায়ী প্রত্যাশা করার অবকাশও ছিল না। মাত্র মাসখানেক আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে আমরা দেখেছি, গোলাম আযম বৃদ্ধ বয়সেও প্রচণ্ড স্পর্ধার সঙ্গে কয়েকটি স্যাটেলাইট মিডিয়ায় বক্তব্য রেখেছেন, নির্দোষ ও সৎ সাজার চেষ্টা করেছেন। কোনও কোনও মিডিয়া এখন চেষ্টা করছে সেই গোলাম আযমকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুস্থ ব্যক্তি হিশেবে হাজির করার। জনগণের সহানুভূতি আদায় করার।
আর কে না জানে, ১১ জানুয়ারির আগের দিন পর্যন্তও বিএনপি সোচ্চার ছিল অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। বিএনপি’র রোড মার্চ কর্মসূচির সব কটিতেই, বিশেষত চট্টগামের রোড মার্চে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দাবিটিই বড় হয়ে এসেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু নির্বিকার থেকেছে বিএনপি। এমনকি খালেদা জিয়ার মুখ থেকে আমরা এ-ও শুনেছি, প্রকৃত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের গোপন চুক্তি করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে (নয়া দিগন্ত, ৪ পৌষ ১৪১৮)। মির্জা ফখরুলকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার করা হবে (প্রথম আলো, ১৯ পৌষ ১৪১৮)। কিন্তু ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারির নিশ্চয়ই কোনও বড়সড় মাহাত্ম্য আছে, যার জন্যে এখন তারা নিজেদের রাশ খানিকটা টেনে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন-গোলাম আযমের গ্রেফতারের ব্যাপারে মুখ বন্ধ রেখেছেন বিএনপি’র নেতারা, দলটির পক্ষ থেকে নাকি আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়াও জানানো হবে না (সমকাল, ৩০ পৌষ ১৪১৮)। এ থেকে অবশ্য এটা বোঝায় না যে, তারা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এ থেকে শুধু এটুকুই বলা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বিএনপি আবারও কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিয়ে কৌশলী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। এই ক্ষেত্রে বার বার কৌশলী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-এবারও হতে চলেছে।
গোলাম আযম গ্রেফতার হওয়ার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীরা অবশ্য ২৮ পৌষেই (১১ জানুয়ারি) মাঠে নেমেছিল। পরদিন ২৯ পৌষ সংঘবদ্ধভাবে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছে তারা-চেষ্টা করেছে পুলিশকে হত্যার, ছিনতাই করেছে পুলিশের অস্ত্র (সমকাল, ৩০ পৌষ)। কিন্তু অনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে বেশিদূর এগুনো যায় না; যত আতঙ্কই ছড়াক না কেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা, খুব বেশি দূর তারা এগুতে পারবে না। তাদের দরকার একটি বড় প্লাটফর্ম, যে প্লাটফর্মটিকে তারা ব্যাপক জনগণের সামনে দাঁড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যকে তারা ব্যবহার করছে সেরকম একটি প্লাটফরম হিশেবে। অন্যদিকে দলগতভাবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে পলিটিক্যাল ভায়োলেন্সের।
বিএনপি ভাবতেই পারে, তারাই জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। ভাবতেই পারে, নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের নেতাকর্মীদেরও তারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে। কিন্তু বিএনপি যে গোলাম আযমের গ্রেফতারের ব্যাপারে নিশ্চুপ রয়েছে, সামরিক বাহিনীর ‘গুম খুনে’র তথ্যসূত্রের ব্যাপারে এখন যে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলির দিকে ইঙ্গিত করছে, তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বড় ধরণের এক রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে তাদের। ইতিহাসে তাদের অনন্তকাল সাধারণ গুম-খুনকে মার্জিনালাইজ করার দায় বহন করতে হবে।

ঢাকা, ২ মাঘ ১৪১৮

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

19 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
19
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.