সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। [...]

সত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হৃদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য। পূর্ব কিনারে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ, একটি স্টেশন ও সামান্য দূরে ঘাটাঘর আর ওখানেই আমাদের পাঠশালা—আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত মৌলানা, হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের সভাসদ, তাঁর মুরিদবর্গ ছিল সারা ভারতে। প্রথম পাঠশালা-যাত্রা, মনে আছে, ইনাই চাচার কোলে চড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের সংসারেরই একজন। ছোটদের অভিভাবকের মতো, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব আবদার মেটাতে কসুর করতেন না। মোটাসোটা গড়ন, হাতে লাঠি ইনাই চাচাকে গ্রামের লোকজন কেন জানি সমীহ করত, এমনকি পাঠশালার মাস্টারমশাইও। মাঝেমধ্যে স্কুলেও হানা দিতেন এবং মাস্টারমশাইকে শাসাতেন যেন আমাকে বকাঝকা না করেন। কিশোরকালের স্মৃতিভুবনে তিনি আছেন অনেকটা জায়গাজুড়ে, তাঁকে নিয়ে বড় একটা গল্প লেখাও যায়। স্কুল বলতে একটিই টিনের ঘর, লম্বা বারান্দা, সামনে রাস্তা, তারপর একসার আমগাছ, পেছনে উঠোন, এক পাশে একটি কাঁঠালগাছ, অন্য পাশে নাগেশ্বর, শেষ মাথায় বাঁশ ও গাছগাছালির জঙ্গল। পুরো ঘরে একটিই শ্রেণীকক্ষ, প্রধান শিক্ষক নীরদচন্দ্র শর্মা, সর্বদাই অগ্নিশর্মা, সহকারী আছদ্দর আলী একেবারেই উল্টো, সর্বদাই স্নেহসিক্ত। ‘বেত নেই তো ছেলে নষ্ট’—আদর্শনির্ভর সেকালের পাঠশালাগুলো ছিল কিশোরদের জন্য আনন্দহীন অকুস্থল। স্কুলে যেতাম শেক্সপিয়রের মতো ‘শম্বুকগতিতে পা দুটি টেনে টেনে’ একান্ত অনিচ্ছায়। বেঞ্চিতে বই-শ্লেট রেখেই রেললাইনে ছোটা, উত্তরমুখে একদৃষ্টিতে দাঁড়ানো, মনে দুরাশা—যদি তিনি না আসেন। কিন্তু বৃথা, অনিবার্য ছিল সেই আগমন। ক্ষণিক পরেই চোখে পড়ত পতপত উড়ছে সাদা ধুতির খুঁট, আখেরি নিশান। ছুটে গিয়ে বেঞ্চিতে বসতাম পাথরখণ্ডের মতো। কেন তাঁকে এত ভয় পেতাম? খুব যে মারধর করতেন তাও না। তবে? সেকালে গুরুজনদের ভয় পাওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সম্ভবত সে জন্য। তবে এমন শিক্ষক সেকালেও ছিলেন, আজও আছেন, যাঁরা স্বভাবগুণেই নিষ্ঠুর। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পক্ষপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকেরা ছেলেদের শিক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন—প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা…

প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দুদিন পরেই মক ভাই তাঁর দল নিয়ে ক্যান্টন চলে গেলেন জরুরি কাজে। আমার মাল্টিপল ভিসা নেই, তাই আমি যেতে পারলাম না। তাতে আমার অসুবিধা হলো না; হংকং যেহেতু আমার পরিচিত জায়গা, ভাবলাম একা একা ঘুরব। [...]

লকের সাথে হংকং পরিভ্রমণ প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দুদিন পরেই মক ভাই তাঁর দল নিয়ে ক্যান্টন চলে গেলেন জরুরি কাজে। আমার মাল্টিপল ভিসা নেই, তাই আমি যেতে পারলাম না। তাতে আমার অসুবিধা হলো না; হংকং যেহেতু আমার পরিচিত জায়গা, ভাবলাম একা একা ঘুরব। কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। আর হংকং-এর সবাই মহাব্যস্ত। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় যেন জীবনের ছন্দ মেলানো। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম লক। লকের সাথে পরিচয় হয়েছিল মক ভাইয়ের অফিসে। হংকঙ্গিজ চীনা, সস্ত্রীক জাপানে থাকে। হংকং এসেছে ছুটি কাটাতে। নাটক, গবেষণা, সাংবাদিকতা — নানা ধরনের পেশায় যুক্ত থেকেছে; এখন জাপানে ঠিক কোন্ পেশায় যুক্ত তা পরিষ্কার হলো না। তবে আমার সাথে ভাব হয়ে গেল, এবং যে কয়দিন হংকং-এ ছিলাম প্রতিদিনই সে আমাকে ভালোই সঙ্গ দিয়েছে। মক ভাইরা চলে যাওয়ার সময় বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন কে আমাকে সঙ্গ দেবে। অবশ্য শুধু দুই দিনের জন্য, তার পরেই তো ফিরে আসবেন। লক এগিয়ে এল আমাকে সঙ্গ দিতে। মক ভাই আশ্বস্ত হয়ে ক্যান্টন চলে গেলেন। লকের অবশ্য তেমন কাজ নেই এই সময়ে। ছুটি কাটাতে এসেছে, একজন সঙ্গী পেয়ে সেও খুশি। আমরা ঠিক করলাম পরদিন সকালে বের হব একটু সাইট সিয়িং করতে। আমাদের গন্তব্য হংকং বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান আর্ট আর্কাইভ এবং হলিউড রোড। লকের সাথে ঠিক করে নিলাম যে, আগামীকাল সকাল দশটায় আমরা হংকং আর্ট সেন্টারে মিলিত হব। ইতিমধ্যে আমি আমার ডেরা পরিবর্তন করেছি; মকচাইয়ের আরেকটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট আছে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এডমিরাল্টি নামের জায়গায়, সেখানে উঠে এসেছি। সাবওয়ে লাইন খুব কাছে, উপরন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্র, সে-কারণেই মকচাই আমাকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর নিজে উঠে গেছে আপলেইছাও-এর বাড়িতে। এখান থেকে বিখ্যাত হংকং আর্ট সেন্টার কাছে বলে আগামীকাল লকের সাথে সেখানেই মিলিত হব। পরের দিন আমি হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছলাম হংকং আর্ট সেন্টারে। লক তখনও এসে পৌঁছয়নি। এই ফাঁকে আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আমার স্মৃতি বিজড়িত হংকং আর্ট সেন্টার চত্বরটি। ১৯৯৩ সালে এখানে এসেছিলাম ঢাকা প্রিন্ট মেকার্স-এর ছাপচিত্র প্রদর্শনী নিয়ে। ১৯৯২ সালে বেইজিং থেকে চারুকলার ডিগ্রি শেষ করে দেশে ফিরে এই সংগঠনটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৯৩ সালেই আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম হংকং ‘এশিয়ান আর্ট এক্টিভিজম’-এ দলগত প্রদর্শনীর জন্য। সেই…

একসময় যে-বিষয়গুলোকে এমন জগৎবিদারী, এমন মহাপ্লাবনিক বলে মনে হয়েছিল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সেগুলোকে কীরকম ফ্যাকাশে দেখায়। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সেগুলো কেমন বামনাকৃতি ও খর্বকায় হয়ে যায়[..]

কামসাহিত্য স্যুরা ভিলায় থাকার সময় রবের নামে একজনের সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়। সে আমার খুব প্রশংসা করতো এবং আমাকে প্রায় ঈশ্বরতুল্য মনে করতো। আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। আমরা জগতের প্রায় সব বিষয় নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত উন্মাদের মত কথা বলতাম। আমার বন্ধু জোয়ি তখন রবের ও তার সুন্দরী বউ মিরেলের সঙ্গে থাকতো। তাদের বাড়িতে ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। মিরেলকে দেখলে আমরা দুজনেই ভেতরে ভেতরে উষ্ণ হয়ে উঠতাম। সে ছিল খুবই যৌনাবেদনময়ী নারী। প্রত্যেক সুযোগেই তাকে জাপটে ধরা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে এই উষ্ণতার অনুভবটুকুই ছিল আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। সে ছিল এক সত্যিকারের ছেনালি। তার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকানো, কারণে অকারণে আমাদের সামনে উবু হয়ে স্তনজোড়া প্রদর্শন করা, নিতম্বের প্রবল দুলুনি এবং ইত্যাকার উত্তেজক ভঙ্গিতে আমাদের মাথা ঠিক রাখা আসলেই কঠিন ছিল। রবেরের নানী মারা গেলে তাকে শহরের বাইরে যেতে হয় শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার জন্য। সে যাওয়ার আগে জোয়িকে বলে যায় মিরেলের দেখভাল করতে, আর সেও দেরি মাত্র না করে তাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসে ডিনারে। ভালোই খাওয়াদাওয়া করি আমরা এবং প্রচুর পান করি সেইসাথে। আমরা সবাই ছিলাম খুব উল্লসিত চিত্তে এবং এটা খুব স্পষ্ট ছিল যে আমাদের সবার মনেই একটা জিনিষ খেলা করছিল, সেটা হচ্ছে কামেচ্ছা। আমরা প্রতি মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম এবং খুব দ্রুতই আমরা সবাইকে এক সঙ্গে এক সোফাতে আবিষ্কার করি। আমি তাকে চুমু খেতে শুরু করি, প্রবল ও প্রলম্বিত চুমু, সেইসঙ্গে স্তনমর্দন, সে এমন ঢিলেঢালা একটা ব্লাউজ পরেছিল যে তার ভেতর দিয়ে হাত চালিয়ে দেওয়া খুব সহজ ছিল। হঠাৎ জোয়ি বলে, "চলো হেনরি আমরা বেডরুমে গিয়ে সবাই মিলে খুব মজা করি।" মিরেল তাতে আপত্তি জানায়, আমিও তার সাথে যোগ দিই। "ঠিক আছে", জোয়ি বলে, "তাহলে তোমরা দুজন আগে যাও, আমি পরে আসবো। শত হলেও এটা তোমার বাড়ি"। এটা ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছিল। আমরা বেডরুমে যাই, মিরেল নিজেকে বিছানায় মেলে দেয়, আদ্যোপান্ত নগ্ন, সুন্দর! আমার কী হয় জানি না, আমি কিছুতেই উত্থিত হতে পারছিলাম না। খুবই বিচ্ছিরি ছিল ব্যাপারটা। আমাকে তার কাছে মাফ চাইতে হয়। আমার খুব খারাপ লাগছিল কেননা আমি এই মুহূর্তটার জন্য দীর্ঘদিন…

ন্যুয়র্কে স্রেফ বেঁচে থাকার লড়াই করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আমি নিজেকে 'এই নরক থেকে বেরুতে হবে, হেনরি' এ-কথা বলে ঝোলাতে ক'টা কাপড় ভরে নিয়ে, বুড়ো আঙুল তুলে একটা গাড়ি থামিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে পড়তাম [..]

হিচহাইকিং ন্যুয়র্কে স্রেফ বেঁচে থাকার লড়াই করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আমি নিজেকে 'এই নরক থেকে বেরুতে হবে, হেনরি' এ-কথা বলে ঝোলাতে ক'টা কাপড় ভরে নিয়ে, বুড়ো আঙুল তুলে একটা গাড়ি থামিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে পড়তাম, জানি না কোন্ নিরুদ্দেশের পানে। আমার অঙুলিনির্দেশে প্রথম যে-গাড়িটি থামতো আমি সেটাতেই উঠে পড়তাম, সেটি কোথায়, কতদূর যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে আমি কী করবো এইসব সাতপাঁচ না ভেবেই। "আপনি কোথায় যাচ্ছেন?" আমি জিজ্ঞাসা করতাম। তিনি হয়ত জবাব দিতেন, "রলে", এবং আমি সেই সম্পূর্ণ আগন্তুকের সঙ্গে সেখানেই চলে যেতাম চমৎকার আড্ডায় মজে গিয়ে। পথে আমি এমন-সব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি যাদের সঙ্গে খুব মনখোলাভাবে মিশতে পেরেছি, কেননা তাদের কোন লোকদেখানো ভদ্রতার ভনিতা ছিলনা। আমি সেইসব লোকের সঙ্গে জগতের যে-কোন বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কথা বলতে পারতাম: ট্রাক ড্রাইভার, চাষা, বেচনদার, যত ধরনের লোকের কথা আপনি ভাবতে পারেন। আমি যাদের বলি, আসল মানুষ। মাঝেমাঝে তাদের কেউ আমাকে রাতের খাবার কিনে দিত পথে, কেউবা বাড়িতে নিয়ে রাতে ঘুমাতেও দিত। সেইসব সহজসরল সাধারণ মানুষেরাই কিন্তু সত্যিকারের মানুষ। শহুরে শিক্ষিত, উন্নতভ্রু, তথাকথিত রুচিশীল মানুষেরা নয়- আমার দেখা রাস্তার মানুষগুলোর কাছে তারা প্রায় বামনতুল্য। সেইসব পথ-অভিযান থেকে আমি সবচেয়ে মূল্যবান যে শিক্ষা নিয়েছি সেটি হলো, কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মানুষ ও জায়গা সম্পর্কে আমার যে পূর্বধারণা ও মতামত ছিল সেগুলো একেবারে ডাহা ভুল। সর্বস্তরে এবং সর্বত্রই যে অসাধারণ সব মানুষ রয়েছে আমার এই আবিষ্কারটা ছিল সত্যি চমকপ্রদ। রাস্তার সবচেয়ে সেরা অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল আমার জুন-এর সঙ্গে। সে এত চোখে পড়ার মত সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিল! আমাদের দুজনের জুটি ছিল যাকে বলে অপ্রতিরোধ্য। আমি কী বলতে চাইছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন আপনারা। এক দম্পতি আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে ঝাড়া পাঁচ/ছয় ঘন্টা ধরে গাড়ি চালান আর আমরা দুজনে যাবতীয় কথা বলাবলি করি। তাঁরা আমাদের তাঁদের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে বলেন, এটা সম্ভবত দক্ষিণের কোন রাজ্যে হবে, কী সুস্বাদু ভোজই না ছিল সেটা! আমি সবসময় দক্ষিণের খাবার ভালোবেসেছি, সেখানকার রান্নাঘরে বাদাম-কাঠের ধোঁয়ার গন্ধের কথা মনে করেই আমার জিবে জল আসে। আমরা খেতে বসি এবং যাকে বলে ভুরিভোজন করি। সত্যি অসাধারণ ছিল তা। এই…

তোমার প্রিয় ছিল সুরাইয়া--চাঁদবদনী সুগায়িকা-সুকবি ফিল্মস্টার। সুরাইয়া ছিল তোমার চোখে সরস্বতী। তোমার মেজদাদা (মুলুকচাঁদ) কাননদেবীর 'মানময়ী গার্লস স্কুল' দেখেছেন উনিশবার…এই নিয়ে তুমি হাসতে কত! তোমার প্রিয় ছিল বাইল্যামাছের ঝুরিভাজা।পাবদা মাছ কি গুলশামাছের ঝোল। ডাঁটা-আলু-বেগুন দিয়ে। চিতল মাছের কোপ্তা। তোমার প্রিয় ছিল মুরগির মেটে। তোমার প্রিয় ছিল টকের ডাল বা আমখিচুড়ি। চৈত্রবৈশাখমাসের দুপুরে, পাখার তলায় বসে আরামে ডাল মেখে ভাত খেয়েছি কত। তোমার সঙ্গে। বাইরে ঝাঁঝাঁ দুপুর, বাইরে কাক ডাকছে কমলা টাগরা বের করে। তামসিক জীবন তোমার অপছন্দ ছিল, মাছ আর মাংসের পদ একই বেলায় খেতে চাইতে না। ছোটমামার ঝাল-গরগরে রান্না পছন্দ ছিল--তুমি অনুযোগ করতে নানী কেবল ছোটমামার পছন্দমতনই রান্না করেন, যদিও ছোটমামাকে তুমি দারুণ ভালবাসতে--বাইবেলের প্রডিগ্যাল সান্-এর মতন। ছোটমামা এন্তার বলে যেতেন--"তগো মাথায় যতডি চুল আসে, ততগুলি নায়িকার নাম কইতে পারি আমি" কিংবা "শোলে দেইখা দোস্তো-দুশমন দেকসি, দোস্তো-দুশমন বেশি ভাল্লাগসে"। তখন রীনা রায়-অমৃতা সিং-রেখা-অনিতা রাজ-টিনা মুনিমদের জয়জয়কার। 'প্রেমগীত' ইত্যাদি সিনেমা ভিসিআর-এ দেখার সময় হেঁকে বলতেন--"পুলাপান, চক্ষু বন্ধ কর্", বড়রা খাবার ঘরের ডিম্বাকার টেবিলের চারদিকে চেয়ারে বসে সিনেমা দেখতেন, আমাদের মতো জুলজুলে চোখ ইঁদুরছানাদের জায়গা হতো টেবিলের তলায়, ছোটমামা মাঝে মাঝে টেবিলের তলায় ঝুঁকে দেখতেন তাঁর সেন্সরশিপ মেনে নিয়ে আমরা আসলেই চোখ বুঁজেছি কিনা--মামার এইসব কাণ্ডকারখানায় তুমি হাসতে। কিছু বলতে না। যতবার তুমি টের পেয়েছ মৃত্যুর কড়ানাড়া, ততবার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে--"তোমার মামাকে দেইখো!" আমি কিন্তু খাপ্পা হতাম, কোথায় মামাকে বলে যাবে আমাদের দেখতে তা না, মামাকে দেইখো! তুমি রোজা রাখতে পারতে না শেষের বছরগুলিতে। ছোটমামী আর তুমি দুপুরের ভাত খেতে খাবার ঘরের দরজা ভেজিয়ে, ছোটমামী এর নাম দিয়েছিলেন--আমাদের গেটলক সার্ভিস। তুমি খুব বেশি নামাজ-কালামও জানতে না, সকালবেলা উঠলে তোমার গুনগুন শোনা যেত--"দ্বীনদুনিয়ার মালিক খোদা দিল কি দয়া হয় না"…কিংবা "আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু/ শেষ করা তো যায়না গেয়ে তোমার গুনগান"…সেটাই তোমার তর্পণ ছিল। সেকালের সাত্ত্বিকলোকদের নিয়মে তুমি ভোরে উঠতে। আমি উঠতে উঠতে তোমার রুটি খাওয়া শেষ। পত্রিকা পড়া শেষ। তোমার গলা ছিল পঙ্কজ মল্লিকের মতো। একসময় রীতিমতো গান করতে তুমি। কাননদেবীর "যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে/এঁকে থাকো কোনো ছবি" কিংবা নজরুলের "আজ আগমনীর আবাহনে/ কী সুর উঠিছে বাজি/ সে সুরে…

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.