হিচহাইকিং
ন্যুয়র্কে স্রেফ বেঁচে থাকার লড়াই করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আমি নিজেকে ‘এই নরক থেকে বেরুতে হবে, হেনরি’ এ-কথা বলে ঝোলাতে ক’টা কাপড় ভরে নিয়ে, বুড়ো আঙুল তুলে একটা গাড়ি থামিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে পড়তাম, জানি না কোন্ নিরুদ্দেশের পানে। আমার অঙুলিনির্দেশে প্রথম যে-গাড়িটি থামতো আমি সেটাতেই উঠে পড়তাম, সেটি কোথায়, কতদূর যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে আমি কী করবো এইসব সাতপাঁচ না ভেবেই।
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” আমি জিজ্ঞাসা করতাম। তিনি হয়ত জবাব দিতেন, “রলে”, এবং আমি সেই সম্পূর্ণ আগন্তুকের সঙ্গে সেখানেই চলে যেতাম চমৎকার আড্ডায় মজে গিয়ে। পথে আমি এমন-সব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি যাদের সঙ্গে খুব মনখোলাভাবে মিশতে পেরেছি, কেননা তাদের কোন লোকদেখানো ভদ্রতার ভনিতা ছিলনা। আমি সেইসব লোকের সঙ্গে জগতের যে-কোন বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কথা বলতে পারতাম: ট্রাক ড্রাইভার, চাষা, বেচনদার, যত ধরনের লোকের কথা আপনি ভাবতে পারেন। আমি যাদের বলি, আসল মানুষ।
মাঝেমাঝে তাদের কেউ আমাকে রাতের খাবার কিনে দিত পথে, কেউবা বাড়িতে নিয়ে রাতে ঘুমাতেও দিত। সেইসব সহজসরল সাধারণ মানুষেরাই কিন্তু সত্যিকারের মানুষ। শহুরে শিক্ষিত, উন্নতভ্রু, তথাকথিত রুচিশীল মানুষেরা নয়- আমার দেখা রাস্তার মানুষগুলোর কাছে তারা প্রায় বামনতুল্য।
সেইসব পথ-অভিযান থেকে আমি সবচেয়ে মূল্যবান যে শিক্ষা নিয়েছি সেটি হলো, কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মানুষ ও জায়গা সম্পর্কে আমার যে পূর্বধারণা ও মতামত ছিল সেগুলো একেবারে ডাহা ভুল। সর্বস্তরে এবং সর্বত্রই যে অসাধারণ সব মানুষ রয়েছে আমার এই আবিষ্কারটা ছিল সত্যি চমকপ্রদ।
রাস্তার সবচেয়ে সেরা অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল আমার জুন-এর সঙ্গে। সে এত চোখে পড়ার মত সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিল! আমাদের দুজনের জুটি ছিল যাকে বলে অপ্রতিরোধ্য। আমি কী বলতে চাইছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন আপনারা।
এক দম্পতি আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে ঝাড়া পাঁচ/ছয় ঘন্টা ধরে গাড়ি চালান আর আমরা দুজনে যাবতীয় কথা বলাবলি করি। তাঁরা আমাদের তাঁদের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে বলেন, এটা সম্ভবত দক্ষিণের কোন রাজ্যে হবে, কী সুস্বাদু ভোজই না ছিল সেটা! আমি সবসময় দক্ষিণের খাবার ভালোবেসেছি, সেখানকার রান্নাঘরে বাদাম-কাঠের ধোঁয়ার গন্ধের কথা মনে করেই আমার জিবে জল আসে। আমরা খেতে বসি এবং যাকে বলে ভুরিভোজন করি। সত্যি অসাধারণ ছিল তা। এই দম্পতি ছিলেন খুবই দয়ালু ও মহানুভব, সাধারণ মধ্যবিত্তই ছিলেন তাঁরা, কিন্তু তাঁদের যা ছিল তাইই তাঁরা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। আমরা বিদায় নেবার সময় তাঁরা আমাদের এমনকি কয়েকটি টাকাও দিয়েছিলেন। এই ধরনের মানুষেরাই গরীবগুরবো সরলসিধা লোকদের সম্পর্কে আপনার নাকউঁচু-ধারণার রোগ সারিয়ে দেয়।
আরকানসাস রাজ্যের রজার্স শহরে (উইল রজার্স-এর নামে নামকৃত) আমি একটা ছোট্ট সরাইখানায় ঘর ভাড়া করি একবার। এটা ছিল আমার এয়ারকন্ডিশন্ড নাইটমেয়ার ভ্রমণের ঘটনা। আমি দেশের বিভিন্ন শহর থেকে এক-একটি অধ্যায় পাঠাচ্ছিলাম ডাবলডে প্রকাশনী সংস্থাকে। পঞ্চম কী ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমি তাঁদের কাছ থেকে একটা বার্তা পাই, “দুঃখিত, আমরা আপনার বইয়ের প্রকাশনা বাতিল করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” আমার বইয়ের অকপট স্বরের কারণেই এই সিদ্ধান্ত, এমনটি তাঁরা একদম প্রত্যাশা করেন নি।
এই তো আমি, আরকানসাস রাজ্যের একটা মোটেলে, যার ঘরভাড়া দেবার টাকাও আমার কাছে নেই। আমি ম্যানেজার ও তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলি কী হয়েছে। “আমার হয়ত আপনাদের পাওনা পরিশোধ করতে আরো কয়েক সপ্তাহ, এমনকি মাসখানেকও লেগে যেতে পারে।” আমি কিছু বন্ধুর কাছ থেকে টাকা পাবার আশা করছিলাম যারা অমার এই ভ্রমণের খরচ জোগাতে রাজি হয়েছিলেন।
মোটেল চালাতেন যে দম্পতি তাঁরা ছিলেন জগতের সবচেয়ে সুন্দর, উদারহৃদয়, বুঝদার মানষ। তাঁরা আমাকে বলেন আমি যতদিন চাই থাকতে পারি, টাকাটা কোন ব্যাপার নয়। তাঁরা জানতেন যখনি সম্ভব হবে আমি তাঁদের পাওনা শোধ করে দেবো।
সেইসব আশ্চর্য ভ্রমণ, আসল মানুষ-দের সঙ্গে সেইসব সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাই আমার জীবনের সবচেয়ে ঐশ্বর্যময় স্মৃতি।
বিগ সুর-এর সঙ্গে পরিচয়
আমি তখন প্রায় দুবছর ধরে বেভার্লি গ্লেন এলাকায় বাস করছি, এমন সময় একদিন আমার পুরনো বন্ধু, শিল্পী জাঁ ভার্দা আসে এবং আমাকে বলে আমি মন্টেরে-তে বেড়াতে যেতে চাই কি না। সে তখন রেড বার্ন বলে একটা জায়গায় থাকছিল এবং কাজও করছিল, সেখানে সে আশ্চর্য কিছু কোলাজ-এর কাজ করে যা তাকে কালক্রমে বিখ্যাত করে তোলে।
তার স্ত্রী ভার্জিনিয়া তখন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিল, বোঝা গেল ভার্দা চাচ্ছিল আমি তার স্ত্রীকে সঙ্গ দেব আর সে কাজ করবে। ভার্জিনিয়ার সঙ্গে আমার ভালোই বোঝাপড়া হয়েছিল, তবে সেটা বন্ধুত্বের বেশি কিছু নয়, কিন্তু দুয়েক সপ্তাহ পর ভার্দা এই ভেবে ভয় পেয়ে যায় যে আমি বোধ হয় সেখানে চিরস্থায়ীভাবে থেকে যাবো, যা তাকে রীতিমত অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
এক বিকেলে সে আমাকে বলে, “হেনরি তোমাকে অবশ্যই বিগ সুর দেখতে হবে, সেখানে তোমার খুবই ভালো লাগবে। সেটা তোমাকে গ্রীসের কথা মনে করিয়ে দেবে।”
আমরা এক সাংঘাতিক ঝড়বৃষ্টির বিকালে তার গাড়িতে চেপে সমুদ্রসৈকতের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকি। কিছুক্ষণ পর সে রাস্তার ধারে গাড়ি থামায়, বৃষ্টি তখন ঝেঁপে নেমেছে। “ওখানে একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছো?” সে বলে, “সেখানে গিয়ে তুমি লিন্ডা সার্জেন্ট-এর জন্য অপেক্ষা করো। সে এলে বলো আমি তোমাকে পাঠিয়েছি, সে তাহলে খুশি হয়েই তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবে।” এই বলে সে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। আমি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য দৌঁড়ে গিয়ে লিন্ডার গাড়িবারান্দার নিচে গিয়ে কয়েক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। অবশেষে সে সত্যি দেখা দিলে আমি ভেজা কুকুরের বেশে তাকে অভিবাদন করি।
আমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাৎক্ষণিকভাবে। সে আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেয়, খাওয়ায়-দাওয়ায় এবং বিগ সুর ঘুরিয়ে দেখায়। সে ছিল ব্যতিক্রমী নারী, স্বাধীন ব্যক্তিত্ব, তার আরণ্যক পরিপার্শ্ব সম্পর্কে এবং সেখানে একাকী বাস করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানসম্পন্ন। নতুন ধরনের এক জীবনযাত্রায় দীক্ষা দেবার জন্য তার চেয়ে ভালো কোন মানুষ আমি পেতাম না, আমি ততক্ষণে এখানে শিকড় নামিয়ে দেবার জন্য মনস্থির করে ফেলেছি।
এটা ছিল আমার জীবনের জন্য একটা নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সূচনাবিন্দু। গ্রীস থেকে ফেরার পর এই প্রথমবারের মত আমি প্রকৃতি, অসীমতা এমনকী ঈশ্বরের সঙ্গে গভীর একাত্মতা অনুভব করি। প্রত্যেকদিন আমি ঠোঁটে হাসি নিয়ে জেগে উঠতাম। আমি সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াতাম। আমি তখন এক ধরনের ধর্মাচারের মত করে সবকিছুকে আশীর্বাদ করতাম। আমি সমুদ্র, বৃক্ষ, পুষ্প, পক্ষী এমনকী বিষাক্ত ওক-কেও আশীর্বাদ করতাম। তারপর আমি পৃথিবীর সব মানুষকে – নারী, পুরুষ, শিশুকে আশীর্বাদ করতাম। আমি এমনকী আমার শত্রুদেরকেও আশীর্বাদ করেছি। জার্মান ও জাপানীদের, যাদের সঙ্গে তখন আমাদের যুদ্ধ চলছে, জন্যও আমি প্রার্থনা করি। এমন একটি জায়গা, যেটি কার্যত স্বর্গতুল্য, সেখানে আপনি গভীর মানবিকতা এবং আপনার চতুষ্পাশ্বের্র পৃথিবীর মাটিতে চলেফিরে বেড়ানো সবকিছু ও সবার সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তা বোধ না করেই পারবেন না।
ডাক-এর কনে
বিগ সুর-এ কিছুদিন থাকার পর আমি নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকি। এমন একটি বিচ্ছিন্ন, বিস্রস্ত জায়গায় কোন ভালোগোছের মেয়েকে আকৃষ্ট করাটাও কঠিন ছিল। ভালো অর্থাৎ কোন সুশ্রী, সুঠাম, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমি তাই একটা ম্যাগাজিনে একজন সঙ্গী কাম পাচক কাম পরিচারিকা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিবার সিদ্ধান্ত নিই। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করি যে, ভিনদেশী যেমন চিনা, জাপানি, পারসি বা এ-জাতীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
ন্যুয়র্ক থেকে আমার এক পরিচিত নির্মাণকর্মী, হ্যারি হের্শকোয়িৎজ্ আমার এ-দশার কথা জানতো। সে তাই আমাকে জানায় যে সে তার এক তরুণী নৃত্যশিল্পী বান্ধবীকে আমার কাছে পাঠাচ্ছে, আমার নিশ্চয়ই তাকে পছন্দ হবে।
সেই মেয়ে মন্টেরে-তে এসে পৌছুঁলে শিল্পী ভার্দা তাকে আনতে যায়। তাকে এক নজর পর্যবেক্ষণ করেই সে বুঝতে পারে যে তাকে দেখে আমি হতাশ হবো। দেখতে সাদামাটা একজন মেয়ে, এমন কোন আহামরি সুন্দরী নয় সে। তাই আর দেরি না করে আমার জন্য তাকে প্রস্তুত করতে লেগে যায় ভার্দা। প্রথমত সে খানিকটা খাটো ছিল, তাই আমি আসার আগেই সে তাকে একটা উঁচু পাটাতনে উঠিয়ে দেয় যাতে করে তাকে আমার চেয়ে লম্বা দেখায়। সে তাকে চমৎকারভাবে সাজিয়ে তোলে, কাঁধে সুন্দর একটা শাল জড়িয়ে মনোহারী এক ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে দেয়।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পরপরই আমাকে অভিবাদন জানায় উঁচু পাটাতনে নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো এক চিত্তাকর্ষক নারীমূর্তি। আমি কাছাকাছি গেলে তার চেহারাকে হতাশাব্যঞ্জকই মনে হয়, তাই বলে আমি তাকে ন্যুয়র্ক পাঠিয়ে দিতাম না, অন্তত তাকে ভালো করে না জানার আগে।
ভার্দা ছিল অসাধারণ পাচক ও গৃহকর্তা। সে প্রায় শূন্য থেকেই দারুণ সব খাবার বানাতে পারতো। গ্রীকরা এই গুণের জন্য বিখ্যাত। আমরা তাই খাবারের আয়োজন করতে থাকি যেনবা এটা প্রকৃতই কোন বিয়ের ভোজ।
সে রাতেই আমরা বিগ সুর-এ ফিরে যাই। তারপর ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে, বিছানার যাবার আগে সে বলে, যেনবা সাংঘাতিক কোন একটা স্বীকারোক্তি করছে এমন ভঙ্গিতে, “তোমাকে আমার এ-কথা বলতেই হবে যে সারাজীবনেও আমি মিলনে চরম আনন্দ পাই নি! আমার মা-ও না, আমার কোন বোনও না, এমনকি আমার নানীও না।” হায় যীশু! মধুচন্দ্রিমা শুরুর পূর্বমুহূর্তে এ কী ধরনের কথা! আমি কখনোই তার প্রেমে পড়ি নি; আমি তাকে পছন্দ করতাম কিন্তু সেটা তেমন বিশেষ কিছু নয়। সে আমার সঙ্গে প্রায় তিন-চার মাস থেকে যায়।
একদিন আমার এক বন্ধু তার কানে এই কথাটা তুলে দেয় যে আমি তাকে ভালোবাসি না। আমার ধারণা বন্ধুটি আমার উপকারই করতে চেয়েছিল। সে এর অল্প ক’দিন পরেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। যেখানে সে কাম্য নয় সেখানে জোর করে থেকে যাবার পাত্রী সে ছিল না।
সেই মেয়েটির ছিল সুন্দর একটি হৃদয় ও সুন্দর একটি অন্তরাত্মা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের জন্য যে রসায়ন দরকার সেটা ছিল না আমাদের মধ্যে। একদিন বনের মধ্যে হঠাৎ করে তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। আঁটোসাঁটো একটা পোশাক পরে সে গাছের ডালে সার্কাসের মেয়েদের মত দোল খাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে তার সম্পূর্ণ নতুন একটা দিক আমার কাছে উন্মোচিত হলো। বিগ সুর ছেড়ে যাবার আগের রাতে সে সারা রাত নেচেছিল আমার জন্য। সে নানা দেশের, নানা ধরনের যাদুকরী ও আধ্যাত্মিক সব নাচ করেছিল যা দেখে আমি প্রায় প্রেমেই পড়ে যাচ্ছিলাম তার।