কামসাহিত্য
স্যুরা ভিলায় থাকার সময় রবের নামে একজনের সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়। সে আমার খুব প্রশংসা করতো এবং আমাকে প্রায় ঈশ্বরতুল্য মনে করতো। আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। আমরা জগতের প্রায় সব বিষয় নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত উন্মাদের মত কথা বলতাম।
আমার বন্ধু জোয়ি তখন রবের ও তার সুন্দরী বউ মিরেলের সঙ্গে থাকতো। তাদের বাড়িতে ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। মিরেলকে দেখলে আমরা দুজনেই ভেতরে ভেতরে উষ্ণ হয়ে উঠতাম। সে ছিল খুবই যৌনাবেদনময়ী নারী। প্রত্যেক সুযোগেই তাকে জাপটে ধরা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে এই উষ্ণতার অনুভবটুকুই ছিল আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। সে ছিল এক সত্যিকারের ছেনালি। তার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকানো, কারণে অকারণে আমাদের সামনে উবু হয়ে স্তনজোড়া প্রদর্শন করা, নিতম্বের প্রবল দুলুনি এবং ইত্যাকার উত্তেজক ভঙ্গিতে আমাদের মাথা ঠিক রাখা আসলেই কঠিন ছিল।
রবেরের নানী মারা গেলে তাকে শহরের বাইরে যেতে হয় শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার জন্য। সে যাওয়ার আগে জোয়িকে বলে যায় মিরেলের দেখভাল করতে, আর সেও দেরি মাত্র না করে তাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসে ডিনারে। ভালোই খাওয়াদাওয়া করি আমরা এবং প্রচুর পান করি সেইসাথে। আমরা সবাই ছিলাম খুব উল্লসিত চিত্তে এবং এটা খুব স্পষ্ট ছিল যে আমাদের সবার মনেই একটা জিনিষ খেলা করছিল, সেটা হচ্ছে কামেচ্ছা। আমরা প্রতি মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম এবং খুব দ্রুতই আমরা সবাইকে এক সঙ্গে এক সোফাতে আবিষ্কার করি। আমি তাকে চুমু খেতে শুরু করি, প্রবল ও প্রলম্বিত চুমু, সেইসঙ্গে স্তনমর্দন, সে এমন ঢিলেঢালা একটা ব্লাউজ পরেছিল যে তার ভেতর দিয়ে হাত চালিয়ে দেওয়া খুব সহজ ছিল। হঠাৎ জোয়ি বলে, “চলো হেনরি আমরা বেডরুমে গিয়ে সবাই মিলে খুব মজা করি।” মিরেল তাতে আপত্তি জানায়, আমিও তার সাথে যোগ দিই। “ঠিক আছে”, জোয়ি বলে, “তাহলে তোমরা দুজন আগে যাও, আমি পরে আসবো। শত হলেও এটা তোমার বাড়ি”। এটা ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছিল।
আমরা বেডরুমে যাই, মিরেল নিজেকে বিছানায় মেলে দেয়, আদ্যোপান্ত নগ্ন, সুন্দর! আমার কী হয় জানি না, আমি কিছুতেই উত্থিত হতে পারছিলাম না। খুবই বিচ্ছিরি ছিল ব্যাপারটা। আমাকে তার কাছে মাফ চাইতে হয়। আমার খুব খারাপ লাগছিল কেননা আমি এই মুহূর্তটার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম, আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি। তারপর জোয়ি আসে তার সঙ্গে রমণে লিপ্ত হবার জন্য। এবং তারও কোন উত্থান ঘটে না। আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলাম যে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না, বেচারা মিরেল নিশ্চয়ই খুবই আহত ও হতাশ হয়েছিল।
এর ক’দিন পর, জোয়ি তখন আমার বাসায়, দরজায় আওয়াজ শুনি, জোরালো আওয়াজ, রবের চীৎকার করে বলছে, “শুয়োরের বাচ্চা আমাকে ঢুকতে দে। ওই জারজসন্তানটা কোথায়? ওকে আমি খুন করবো আজ।” জোয়ি তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বলে ওকে বলতে যে সে এখানে নেই। সে তখন ভয়ে কাঁপছে আর বলছে,”বেটি নিশ্চই ওকে বলে দিয়েছে।” আমি সামনে গিয়ে খুব সাবধানে, খুব ভয়ে ভয়ে দরজা খুলি, কেননা সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে, সে বিষয়ে আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। রবের ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে চীৎকার করতে থাকে, “ওই শুয়োরের বাচ্চা, জারজসন্তানটা কই?”
সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সোজা বাথরুমের দিকে চলে যায় যেখানে তখন জোয়ি ভয়ে কাঁপছে। তালাটা ছিল পলকা, তাই সে সহজে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়, ‘বেজন্মা কোথাকার’ এই বলে সে তাকে ধাক্কাতে থাকে। জোয়ি তার দুহাত দুপাশে নামিয়ে রেখে সেখানে স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকে, কোন প্রতিরোধের চেষ্টা করে না। জোয়ি তাকে লাথি মারে, গলাধাক্কা দেয়, কিন্তু সে তা প্রতিহত করার কোন প্রয়াস পায় না। “শয়তান তুই যুদ্ধ করতে জানিস না, নচ্ছার কোথাকার?” জোয়িকে মারামারিতে উদ্বুদ্ধ করতে না পেরে হতাশ হয়ে রবের আমাদের ঘর ছেড়ে আবার দ্রুতবেগে বেরিয়ে যায়।
আমি ভয় পেয়ে জোয়িকে চীৎকার করে বলতে থাকি, “তুমি লড়াই করো নি কেন? সে তো তোমাকে মেরে ফেলতে পারতো।” আমি ভেবেছিলাম হয়তো রবের আমার মাথার খুলি ফাটিয়ে দেবে, কিন্তু সে আমার গায়ে টোকাটি পর্যন্ত দেয় নি। আপনারা জানেন জোয়ি কী উত্তর দিয়েছিল? “আমি বাধা দিই নি কেননা আমার ওটা পাওনা ছিল।” আপনারা এটা ভাবতে পারেন? “কারণ ওটা আমার পাওনা ছিল”, কথাটা এমন হাস্যকর শুনিয়েছিল আমার কানে।
সে যাই হোক, আমি এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি নি মিরেল কেন জোয়ির নাম বললো কিন্তু আমার কথা চেপে গেলো? অবশ্য মেয়েরা কেন এরকম অযৌক্তিক আচরণ করে সেটা সবসময়ই একটা রহস্য। সে হয়তো ভেবেছিল আমিও এর সঙ্গে যুক্ত জানতে পারলে রবের একেবারে ভেঙে পড়বে। আমার প্রতি তার এমনই গভীর শ্রদ্ধা ছিল। আমি আনন্দিত যে ঝড়টা জোয়ির ওপর দিয়েই গেছে, কেননা সত্যি বলতে কি কোন প্রকার শারীরিক সন্ত্রাসই আমি ঠিক উপভোগ করি না।
মাঝেমধ্যে সামান্য ঈর্ষা গভীর ভালোবাসার সম্পর্কের কোন ক্ষতি করে না। সত্যি বলতে কি, এটা ভালোবাসাকে পোক্ত হতে সাহায্য করে এবং তাকে তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলে।
মারণমানবী
জুন নিঃসন্দেহে একজন ‘ফাম ফাতাল’ তথা মারণমানবী ছিল, সেটা শুধু আমার চোখে নয় অন্যদের চোখেও। সে ছিল এমন একজন নারী যাকে দেখে পথেঘাটে, অন্য মেয়েরাও, একেবারে অচেনা, থেমে গিয়ে বলতো যে, সে কতটা সুন্দরী। এই ধরণের নারীদের জন্য পুরুষেরা মরতে ও মারতে পারে। সত্যি বলতে কী, সেরকম দুয়েকজন যে তার প্রতি তাদের আত্মনিবেদনের পরিণাম স্বরূপ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নি, সে-ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। আত্মনিবেদন এবং আত্মনিমজ্জন!
একবার আপনি এরকম কোন মারণমানবীর পাল্লায় পড়লেন তো তার করুণার পাত্র হয়ে গেলেন, দুঃখ পাওয়া ছাড়া আপনার কোন গত্যন্তর নেই। মুদ্রার অপর দিক হলো, অবশ্যই এইসব নারীদের হাতেই সংঘটিত হয় জগতের অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা। তারা অনন্যসাধারণ, রহস্যময়ী, খুবই ক্ষণিকের, একমেবাদ্বিতীয়ম, এক কথায় অলৌকিক। এমন সুন্দরীর সঙ্গ মুহূর্তের জন্যও একঘেয়ে ঠেকবে না আপনার কাছে। আপনি তখনই কষ্ট পাবেন যখন তাকে দখল করতে চাইবেন, কারণ এতে করে আপনি তার সে-ই রহস্যকেই হরণ করবেন যে রহস্যের কারণে আপনি তার প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আপনি যখন প্রজাপতির লীলালাস্যকে বন্দি করতে চাইবেন তখনই তাকে চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখবেন।
জুন নিছক সুন্দরীর চেয়েও বেশি ছিল। সে ছিল আরেক পৃথিবীর, আরেক গ্রহ থেকে আসা। এই পৃথিবী ঠিক তার জন্য তৈরী হয় নি, উল্টোটাই বরং সত্যি। আমাকে লেখক হিসাবে গড়ে উঠতে, সামনে এগিয়ে যেতে সে যা করেছে সে-কথা ভাবলেও আমার খারাপ লাগে। তার জন্যই আমি আমার প্রথাগত অস্তিত্বকে- আমার বউ, বাচ্চা, টেলিগ্রাফ কোম্পানির চাকরী বিসর্জন দিই। জুন বলেছিল, “হেনরি, আমি জানি তুমি লেখক হতে চাও। তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও, আমি আমাদের দুজনের খরচ চালাবো, এটা নিয়ে একদম ভেবো না।” এবং আসলেই সে সব দায়িত্ব তুলে নিল নিজের হাতে। সে কোত্থেকে কীভাবে টাকা যোগাড় করছে জিজ্ঞাসা করার সাহস হতো না আমার, কেননা আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম, স্বপ্নেও যেটা হতে পারবো বলে আমি ভাবি নি আমাকে সে চেষ্টা করার একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমার জীবনে জুনই ছিল প্রথম ব্যক্তি যে আমার লেখা একটি শব্দও পড়ার আগে থেকেই আমার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখেছিল, বিশ্বাস করেছিল যে আমার লেখার ক্ষমতা রয়েছে। সত্যিকার লেখালেখি করার আগেই আমি লেখা বিষয়ে তাকে যা বলতাম সেটা শুনেই সে তার স্বজ্ঞাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
তার মুখের সেই চাহনির কথা আমি কোনদিন ভুলবো না যখন সে দিনের শেষে বাড়ি ফিরতো, ঈশ্বর জানেন কী কাজ করে, আমাদের ভাড়া কিংবা রাতের খাবারের টাকার বন্দোবস্ত করে। “লেখা কেমন হলো হেনরি?” সে প্রথমেই এই কথা জিজ্ঞাসা করতো। তারপর আমার লেখার টেবিলে চোখ বুলিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করতো আমার লেখার কোন অগ্রগতি হয়েছে কি না। আমি তাকে কিছু দেখাতে অস্বীকার করতাম। “আরো কিছুদূর এগোনোর পর দেখাবো”, এই বলে আমি তাকে ঠেকিয়ে রাখতাম। আর সারাক্ষণই আমি সাংঘাতিক অপরাধবোধে ভুগতাম কেন না আমি তখন পর্যন্ত একটা শব্দও লিখতে পারি নি। আমি জানতাম আর যে কোন কিছুর চাইতে এটাই আমি সবচেয়ে বেশি করতে চাই কিন্তু তখনো আমি যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারি নি। সারাদিন আমি বসার ঘরের সেই গোটানো টেবিলের ওপর পা তুলে বসে অনুপ্রেরণার অপেক্ষায় থাকতাম। আমার সেই অপেক্ষার কালে বন্ধুরা আসতো আড্ডা দেওয়ার জন্য। আমি সবসময়ই জুন আসার আগেই তাদের তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। শত হলেও সে বাইরে কাজ করছে যাতে আমি লিখতে পারি।
এটা খুব মজার, আমাকে যে-প্রতিষ্ঠা এনে দেওয়ার জন্য সে এতটা করেছে আমার সেই প্রতিষ্ঠাই এক পর্যায়ে আমাদের সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়। শেষ পর্যন্ত যখন আমি আমার কন্ঠ খুঁজে পাই, লেখক হিসাবে আমি আমার শক্তিকে যখন অনুভব করতে থাকি, তখন সেটাই তাকে আমার কাছ থেকে তাড়িয়ে দেয়। সে এই বাস্তবতাকে সহ্য করতে পারছিল না যে তার সাহায্যের দরকার নেই আমার আর। সে নিরন্তর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা দাবী করতো, চাইতো আমি তার ওপর নির্ভরশীল থাকি সবসময়। তার ব্যাপারে আমার তরফে পরিপূর্ণ এবং সার্বিক আচ্ছন্নতা ছাড়া আর কোন কিছুই তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাকে নিয়ে আচ্ছন্নতার জীবনযাপন করার চাইতে আমি সেটা নিয়ে লিখতে শুরু করেছি, এই সত্যটাই তাকে প্রচণ্ড ক্ষেপিয়ে তোলে।
শেষবার পারী-তে এসে সে আমাকে আমার লেখালেখি ও নতুন জীবনে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে আমি তাকে দেখামাত্র সবকিছু ছেড়েছুড়ে দেবো না। আর তারপর, সে কোনভাবে, সেটা কার মাধ্যমে আমি আজও জানি না, জেনে যায় যে আমি আর আনেই নিন এক শয্যায় ঘুমাই। একদিন বাড়ি ফিরে আমি তার হাতের লেখা একটি চিরকুট পাই, যাতে লেখা ছিল,” যত তাড়াতাড়ি পারো ডিভোর্স নাও।” সেখানেই জুন-পর্বের সমাপ্তি। গভীর প্রণয় ও উচ্চ নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ একটি সম্পর্কের অতি সাধারণ পরিসমাপ্তি। আমার মনে হয় আমি হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম, কেননা ব্যাপারটা এতটাই আচমকা এবং এমনই অপরিবর্তনীয় ছিল। কিন্তু ততদিনে আমি তার উৎকেন্দ্রিক আচরণের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম, আমি জানতাম তার মন পাল্টানোর চেষ্টা করাটা বৃথা, কেননা তার মত অসাধারণ নারীরা, যাদেরকে বলা যায় মারণমানবী, তারা ঠিকঠিক জানে তারা কী চায় এবং তা পাওয়ার জন্য তারা যে কোন কিছু এবং সবকিছু করতে প্রস্তুত। আপনি যদি তাকে বাধা দেবার কথা ভেবে থাকেন তাহলে ঈশ্বর আপনার সহায় হোন।
জুন-কে নিয়ে কিছু বিলম্বিত ভাবনা
জুন ও আমার পথ আলাদা হয়ে যাওয়ার পরপরই যেন সব শেষ হয়ে গেল। আমার কাছে সে যেনবা একজন মৃত মানুষ। তবে তার স্মৃতি আমার লেখায় জীবন্ত ছিল। কুড়ি কিংবা ত্রিশ বছরের মধ্যে আমাদের আর কখনোই দেখা হয় নি। আর সেই সাক্ষাতের মুহূর্তটাও ছিল একেবারে বিধ্বংসী, হৃদয়-ভেঙে-দেওয়া।
আমাদের উভয়ের বন্ধুদের মাধ্যমে সেই সাক্ষাৎটির আয়োজন হয় এবং আমি তার বাড়িতে রাতের খাবার খেতে যাই। সেই এলাকার চেহারা দেখেই আমার আন্দাজ করা উচিৎ ছিল কী শোচনীয় অবস্থায় বাস করে সে। জায়গাটিকে এতটাই বিমর্ষ লাগছিল যে মনে হচ্ছিল সে বুঝি হার্লেমের ধারেকাছে কোথাও থাকে।
আমি দরজা ধাক্কা দিলে সে তা খুলে দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়। আর তাৎক্ষণিকভাবে আমি দরজা ভাঙা ছাড়া অন্য যে কোন উপায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠি। এক ধরণের ভয় ও চরম হতাশায় আমি কাবু হয়ে যাই।
এটা স্পষ্ট যে সে নিজেকে সুদর্শনা করে তোলার জন্য যারপরনাই কসরত করেছে। সেই প্রসাধনী আর সুগন্ধীবস্তুর আড়ালে সে আসলে একজন মানবীর ধ্বংসাবশেষমাত্র, শুধু তার মুখমণ্ডল নয়, গোটা দেহটাই সে কথা বলছিল। মনে হচ্ছিল বুঝি তার অন্তস্তল অবধি সে ক্ষয়ে গেছে। সেই জুন-এর কিছুমাত্র অবশিষ্ট ছিল না তার মধ্যে যার জন্য আমি এমন পাগল হয়েছিলাম, যে আমাকে এমন অসুরের মত লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে, যে ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা। আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে একজন সম্পূর্ণ আগন্তুক বলে মনে হচ্ছিল।
হঠাৎই আমি আর এটা সহ্য করতে পারছিলাম না। মিনিট পনেরোর মত লোকদেখানো আলাপচারিতার পর আমি উঠে দাঁড়াই, হাতে টুপি, কোনমতে বিড়বিড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে তার ডিনারের নেমন্তন্ন থেকে নিস্তার চেয়ে নিই। শুধুমাত্র রান্নাঘর থেকে আসা ঘ্রাণটাই যে ক্ষুধাসংহারক ছিল তা নয়, যে মানুষটি আমাকে রাতে থাকার জন্য অনুনয় করছিল সেও এতটা সঙ্গকাতর ছিল আর আমাকে খুশি করার জন্য এতটা মরিয়া যে আমার দম বন্ধ হয়ে প্রায় মারা যাবার উপক্রম হয়েছিল।
“কী?”, সে বলে, “তুমি আমার সঙ্গে রাতটা কাটাবে না বলছো?”, যা আমাকে পালানোর জন্য আরো বেশি উদগ্রীব করে তোলে। “না”, আমি চীৎকার করে বলি, আমার চোখে তখন অশ্রুর ধারা, “আমি দুঃখিত, আমাকে যেতেই হবে”, এই বলে সে কিছু করার আগেই আমি দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসি।
কয়েক বছর একাধারে আমি তার কোন সাড়াশব্দ পেতাম না। তারপর হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই সে ঘনঘন ফোন করতে শুরু করতো। সে অবিশ্রান্ত অর্থহীন কথা বলে যেত, জগতের যে কোন এবং সমস্ত বিষয় নিয়ে। তার কথার আড়াল থেকে আমি এটুকু বুঝতে পারতাম যে সে কোথাও আটকা পড়ে গেছে, মরিয়া জীবন থেকে সে কিছুতেই বেরুতে পারছে না । আমি যখন পারতাম টাকা পাঠাতাম তাকে। এর বেশি আর কীইবা করতে পারতাম আমি।
শেষবারের কথার পর আমি শুনেছি যে সে হাসপাতালে আছে এবং ভালোই আছে। মনে হয় সে বুঝি একেবারে খাদের শেষ কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে চব্বিশ ঘন্টাই টিভি দেখতো যা কিনা যে কোন সুস্থ মানুষকেই পাগল করে দিতে পারে। কিন্তু টেলিভিশন ছাড়া বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার আর কোন সংযোগ ছিল না। একদিন সে জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রেগেমেগে উঠে জানালা দিয়ে টিভিটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রাস্তায় তখন প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়, পুলিশ আসে এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। তার পরিবার তাকে একটা ভালো হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। তারপর কোন এক মরুভূমিতে বসবাসরত তার এক ভাইয়ের কাছে সে সেরে ওঠার জন্য চলে যায়। তার সম্পর্কে সেই শেষকথা শুনি আমি।
আমাদের এই মহান প্রেমকে আমার কাছে এখন নিজেদের তৈরী একটা কিংবদন্তি বলে মনে হয়, এক ধরনের রূপকথা বিশেষ (যদিও সবসময়ই যে সেটা খুব সুন্দর কিছু ছিল তা নয়)। একদিন আমি, জুন ও আমার সম্পর্কটা নিয়ে ভাবছিলাম,”হায় যীশু, হেনরি, এ-সবের মানে কী? এই নিয়ে এত হৈ চৈ করার কী কারণ ছিল? এত কষ্ট পাওয়া, এত বাগাড়ম্বর?” এবং এই ভেবে আমি হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলি, কেননা আমার মনে হচ্ছিল আমি বিনা কারণে এমন ঘর্মাক্ত করেছি নিজেকে।
একসময় যে-বিষয়গুলোকে এমন জগৎবিদারী, এমন মহাপ্লাবনিক বলে মনে হয়েছিল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সেগুলোকে কীরকম ফ্যাকাশে দেখায়। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সেগুলো কেমন বামনাকৃতি ও খর্বকায় হয়ে যায়!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৪ অক্টোবর ২০১০ (৭:৩৫ অপরাহ্ণ)
আহা, কী চাটনিদার লেখা!!!
সালাউদ্দীন খালেদ - ২৪ অক্টোবর ২০১০ (৯:০৮ অপরাহ্ণ)
ভাল লাগল
জিল্লু্র রহমান - ২৮ অক্টোবর ২০১০ (৪:৫৯ অপরাহ্ণ)
লেখা; তা যেকোনো প্রকারের হোক না কেনো পড়ার পর ভেতরের স্বত্মা কিংবা ভেতরের কেউ কথা বলতে চায়। ওই যে সে যা বলতে চায়, তাই মূলত ঐ লেখার সারসংক্ষেপ। সুতরাং হেনরি মিলারের ভাবনাগুচ্ছের অনুবাদ মিলারের মতো আমারও অকপট কামভাবকে সুন্দরের পথে নিয়ে যাবে এমনটি ভেবেছিলাম। মিরেলের জন্য আমিও উষ্ণতা অনুভব করলাম। অনুবাদে কিছু শব্দ যেমন-একমেবাদ্বিতীয়ম, এর ব্যবহার ভাল লেগেছে।