তোমার প্রিয় ছিল সুরাইয়া–চাঁদবদনী সুগায়িকা-সুকবি ফিল্মস্টার। সুরাইয়া ছিল তোমার চোখে সরস্বতী।
তোমার মেজদাদা (মুলুকচাঁদ) কাননদেবীর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ দেখেছেন উনিশবার…এই নিয়ে তুমি হাসতে কত!
তোমার প্রিয় ছিল বাইল্যামাছের ঝুরিভাজা।পাবদা মাছ কি গুলশামাছের ঝোল। ডাঁটা-আলু-বেগুন দিয়ে।
চিতল মাছের কোপ্তা। তোমার প্রিয় ছিল মুরগির মেটে।
তোমার প্রিয় ছিল টকের ডাল বা আমখিচুড়ি। চৈত্রবৈশাখমাসের দুপুরে, পাখার তলায় বসে আরামে ডাল মেখে ভাত খেয়েছি কত। তোমার সঙ্গে। বাইরে ঝাঁঝাঁ দুপুর, বাইরে কাক ডাকছে কমলা টাগরা বের করে।
তামসিক জীবন তোমার অপছন্দ ছিল, মাছ আর মাংসের পদ একই বেলায় খেতে চাইতে না। ছোটমামার ঝাল-গরগরে রান্না পছন্দ ছিল–তুমি অনুযোগ করতে নানী কেবল ছোটমামার পছন্দমতনই রান্না করেন, যদিও ছোটমামাকে তুমি দারুণ ভালবাসতে–বাইবেলের প্রডিগ্যাল সান্-এর মতন। ছোটমামা এন্তার বলে যেতেন–“তগো মাথায় যতডি চুল আসে, ততগুলি নায়িকার নাম কইতে পারি আমি” কিংবা “শোলে দেইখা দোস্তো-দুশমন দেকসি, দোস্তো-দুশমন বেশি ভাল্লাগসে”। তখন রীনা রায়-অমৃতা সিং-রেখা-অনিতা রাজ-টিনা মুনিমদের জয়জয়কার। ‘প্রেমগীত’ ইত্যাদি সিনেমা ভিসিআর-এ দেখার সময় হেঁকে বলতেন–“পুলাপান, চক্ষু বন্ধ কর্”, বড়রা খাবার ঘরের ডিম্বাকার টেবিলের চারদিকে চেয়ারে বসে সিনেমা দেখতেন, আমাদের মতো জুলজুলে চোখ ইঁদুরছানাদের জায়গা হতো টেবিলের তলায়, ছোটমামা মাঝে মাঝে টেবিলের তলায় ঝুঁকে দেখতেন তাঁর সেন্সরশিপ মেনে নিয়ে আমরা আসলেই চোখ বুঁজেছি কিনা–মামার এইসব কাণ্ডকারখানায় তুমি হাসতে। কিছু বলতে না।
যতবার তুমি টের পেয়েছ মৃত্যুর কড়ানাড়া, ততবার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে–“তোমার মামাকে দেইখো!” আমি কিন্তু খাপ্পা হতাম, কোথায় মামাকে বলে যাবে আমাদের দেখতে তা না, মামাকে দেইখো!
তুমি রোজা রাখতে পারতে না শেষের বছরগুলিতে। ছোটমামী আর তুমি দুপুরের ভাত খেতে খাবার ঘরের দরজা ভেজিয়ে, ছোটমামী এর নাম দিয়েছিলেন–আমাদের গেটলক সার্ভিস।
তুমি খুব বেশি নামাজ-কালামও জানতে না, সকালবেলা উঠলে তোমার গুনগুন শোনা যেত–“দ্বীনদুনিয়ার মালিক খোদা দিল কি দয়া হয় না”…কিংবা “আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু/ শেষ করা তো যায়না গেয়ে তোমার গুনগান”…সেটাই তোমার তর্পণ ছিল। সেকালের সাত্ত্বিকলোকদের নিয়মে তুমি ভোরে উঠতে। আমি উঠতে উঠতে তোমার রুটি খাওয়া শেষ। পত্রিকা পড়া শেষ।
তোমার গলা ছিল পঙ্কজ মল্লিকের মতো। একসময় রীতিমতো গান করতে তুমি। কাননদেবীর “যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে/এঁকে থাকো কোনো ছবি” কিংবা নজরুলের “আজ আগমনীর আবাহনে/ কী সুর উঠিছে বাজি/ সে সুরে গীতালি দেয় করতালি” কিংবা রামপ্রসাদী “মা আমায় ঘুরাবি কত/ কলুর চোখবাঁধা বলদের মতো” কিংবা “মা হওয়া কি মুখের কথা”। নির্মলেন্দু চৌধুরির গান, পূজাপ্যান্ডেলের গান। শচীনবাবুর সিরাজুদ্দৌলার লাইন শোনাতে। জগন্ময় নিজে বিপত্নীক হবার আগে যে “তুমি আজ কত দূরে” সঠিক পরিমাপের আবেগে গাইতে পারেন নাই সেই গল্প শোনাতে। যে গানগুলি আমি আর কোথাও শুনি নাই, সেগুলি ভাঁজতে (“আমি কারে দেখিয়া দিব ঘোমটা লো/ নাতিনজামাই আমার নেংটা” কিংবা “আয় না দিদি পিঠে ভাজি আমরা দু’জনে” কিংবা “ও ননদী আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে” কিংবা “চল্ কোদাল চালাই”)। জসীমউদ্দীনের ‘মধুমালা-মদনকুমার’ থেকে গাইতে “বেলা দশটা বাইজাছে/ মদনকুমার ছা-আ-আন করতে চইলাছে…”।
আর পরের দিকে গাইতে–“আমি একদিন তোমায় না দেখিলে/ তোমার মুখের কথা না শুনিলে” কিংবা “একদিন বাঙালি ছিলামরে…”, তোমার গলায় এইসব গান শুনে আমরা হাসতাম। আমি বিয়েবাড়িতে গিয়েছি শুনলে শোনাতে–“মা আমার হলো না বিয়ে/ জীবনটা মোর কেটে গেল পরের বিয়েয় উলু দিয়ে”, আমাকে রাগিয়ে দিতে বেদম মজা পেতে তুমি। নাতনিদের বিয়ের কথা হচ্ছে–এই খবর পেলে গেয়ে শোনাতে–“কেউ আশা লয়ে জাগে রে কারো আশা পুরালো/ আশা পুরালো/ কেউ হারানো প্রেম পেল রে কেউ পেয়ে হারালো/ পেয়ে হারালো”, তোমার গলায় যে এ-গান না শুনেছে সে কি করে বুঝবে পুরোনো বইয়ের গন্ধ কেমন–ভাঁজ করে রাখা পুরোনো শাড়ির গন্ধ কেমন! তোমার মোক্ষম টিপ্পনী ছিল–“কোথায় রানী ভবানী কোথায় বিছানা-মুতুনি”, এর বেশি মুখ খারাপ করতে না তুমি।
হাঃ রূপের গুমোর ছিল কিন্তু তোমার, শাদাকালো ছবিতে হাসন্ত মুখে তোমাকে দেখাতো দেব আনন্দের মতো, তুমি বলতে–মানুষ কেমন, তার জাত-কুল-শীল নাকি পায়ের পাতা দেখলে বোঝা যায়, আর আমরা আড়চোখে দেখতাম, তোমার অপূর্ব সুন্দর হাত-পায়ের পাতা। কী পরিষ্কার নখ, কেমন যত্ন করে কাটা, ছন্দের মতো আঙুল। বিশখানা আঙুলের কোথাও ছন্দপতন হয়নি।
ঢিলে জামা পছন্দ ছিল না তোমার, ফিটিং নিয়ে খুঁতখুঁত করতে, আম্মা তোমাকে বুঝিয়ে বলতো–যে তোমার আগের নিটুট স্বাস্থ্য আর নাই, তাই জামা গায়ে ঢলঢল করছে, তুমি তোমার মেয়ের কথা শুনতে না। নিজেকে নিয়ে রগড়ও করতে, বলতে, তোমার উদ্গত বিউটি-বোন (কন্ঠাস্থি)-এর খোঁড়লে নাকি ১ পোয়া+১ পোয়া = ২ পোয়া সয়াবিন তেল ধরবে। তোমার গায়ের জোর কমে আসছিল, হেঁটে পরামানিকের দোকানে যাওয়া হতো না তোমার আর। তোমার চুলদাড়ি ছেঁটে দিতাম বারান্দায় রোদে বসিয়ে–খবরের কাগজ পেতে, তুমি ঝকঝকে হাত-আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে ঠিকমতো হলো কিনা। তুমি সচরাচর বসতে সেতারবাদকদের মতো আসন করে, আর খবরের কাগজ পড়বার সময়, চিন্তা করবার সময় তোমার মুখ তুবড়ে যেত আপনা থেকেই। অভিমানে তুমি ছিলে দুর্বাসামুনি, নিজের অভিমান সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলে, চোরের ওপর রাগ করে চিরকাল তুমি মাটিতে ভাত খেয়েছ, তোমার মেয়েরা ফোনে তোমার সাথে কথা বলতে চাইলে তুমি নানীকে জিজ্ঞেস করতে–“তুমি দিলা নাকি ওরা কথা বলতে চাইলো?”
তোমার ভেতর জাতিভেদ ছিল না, গৈজুদ্দিন ফকিরের বাড়ি গিয়ে তুমি দিব্যি ভাত খেয়ে এসেছিলে। হিন্দুছাত্ররা তোমাকে হুগলী মঃ মহসীন কলেজে খ্যাপাতো। মুর্শিদাবাদের কান্ডীরাজ ইস্কুলেও খ্যাপাতো–“বাঙাল, বাঙাল/ পুঁটিমাছের কাঙাল”… আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইতাম, “তুমি কী বলতে জবাবে?” তুমি বলতে–বলতাম, “তরা আম রে আঁব ক’স, মামারে তো বাবা ডাকবি”… আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম, আমরা গভীর কৌতূহলে আভালতা সোমের গল্প শুনতাম, তোমার সহপাঠিনী। আমরা শুনতাম রিপন কলেজের এঁচোড়ে পাকা ছেলেরা স্বভাবলাজুক বুদ্ধদেব বসু-কে ডাকতো ‘বৌদি বসু’। আমরা সেইসব কালের গল্প শুনতাম, যে-কালে হিন্দুবাড়ির উঠানে পা দিলে ভাতের হাঁড়ি ছুঁড়ে ফেলতো লোকে… বিশ্বাস করা শক্ত ছিল এমনও কাল গেছে!
আমার মায়ের নাম তুমি রেখেছিলে ‘হাসুবানু’ থেকে, ‘হাসু’। তুমি ডাকতে ‘হাঁসমা’, আর আমার মনে হতো আম্মা বোধহয় নদনদে কোমল ক্যাম্পবেল ডাক্ একটা। আম্মার জন্ম হয়েছিল সিলেটের মজুমদারিতে, ছোটবেলায় হৃষ্টপুষ্ট উজ্জ্বল শিশু আম্মাকে কাঁধে নিয়ে তুমি নাকি ঘরের ভিতর নেচে বেড়াতে। বাড়িতে মাংস এলে একবেলা খাওয়ার পরেই বলতে–“বাকিটা হাঁসমার জন্যে তুলে রাখো, হোস্টেল থেকে এসে খাবে!” আমার আম্মার রঙ সুবর্ণশ্যাম, আম্মাকে বিয়ে করে আব্বা দেশে নিয়ে যাবার পরে লোকজন কনে দেখতে এলে আমার দাদী বলেছিলেন–“জানালার আলোতে বসো, তাইলে ফর্সা দেখাবে”, দাদীদের শখ ছিল আব্বার স্ত্রী হবেন ‘হৌরা ফুল’ (সরিষাফুল)-এর মতো হলুদ। এই গল্প তুমি গভীর যাতনার সাথে মনে রেখেছিলে। আম্মা সংসার শুরু করবার পরে তুমি প্রায়ই আম্মার বাসায় আসতে, বঁটি পেতে আম্মা আনাজ কুটছেন এইসব দেখে বাড়ি গিয়ে কান্নাকাটি করতে আর নানীর বকা খেতে। আমাকে রান্নাঘরে বা সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করতে দেখলে তুমি অস্থির হয়ে উঠতে–তোমার আশঙ্কা ছিল আমি নানী বা আম্মা-খালাদের মতো হয়ে যাব, যা তুমি চাইতে না, আমি ছিলাম তোমার ‘নুরজেহান’, আফিমগ্রস্ত সম্রাটের সাথে বিয়ে হলেও নাকি হিন্দুস্তান চালাতে পারবো, এইসব বলতে তুমি। তবে আম্মার সুকুমার মনের পরিচয় পেলে কিন্তু তুমি শিশুর মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠতে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে আম্মার হাতের কাজ–আস্ত ফুলকপির দোলমা, আমার লেসের ফ্রক কিংবা আম্মার মুক্তার মতো হাতের লেখা। খুব ভালো ক্যারম খেলতে তুমি, দাবা একেবারেই নয়, আর্থার কোনান ডয়েল যাকে বলেছিলেন ‘স্কিমিং হেড/হার্ট’, সেটা তো তোমার ছিল না, দাবা কি করে পারবে? ক্যারম খেলতে বসে অবলীলায় বলে ফেলতে আম্মা ছোটবেলায় ক্যারম খেলতে বসে কেমন চোরামি করতো, আর আম্মা খুব রাগ করতেন। তোমার রাখঢাক ছিল না, হাসতে হাসতে বলতে “ক্লাস এইটে পড়ার সময় হাসুর মাথার চুল ন্যাড়া করে দিলাম, তারপর মাথায় বাতাস লাইগা হাসু যা দুষ্টু হইলো!” আম্মার জুতার শখ ছিল, নানান রঙের ফিতেঅলা শৌখিন স্যান্ডেল শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরতে ভালবাসতেন, তুমি আম্মার জুতার আলনা দেখে বলে ফেললে–“আমার মেয়ে দেখি ইমেল্ডা মার্কোস হয়ে গেছে!”
আম্মাদের ছোটবেলার গল্প বলতে গিয়ে তুমি সহাস্যে বলতে–“তিন খানা মেয়ে, একটাও কোনো কাজ করতো না” আর আম্মার শুনে কী রাগ, আমার মেজখালা রীতিমতো ঘরের কাজ করতেন, আম্মা একটু ফাঁকিবাজ ছিলেন কুমারীজীবনে আর ছোটখালাও একটু অপটু ছিলেন, তাই বলে এই অপবাদ। আম্মা বলতেন–“তোমার নানা যে বাড়িতে মেহমান আসলে নিজেই মেহমান হয়ে যেত, সেইটা তো বললো না”, তুমি মেহমানদারিতে নানীকে ঠিক সহযোগিতা করতে জানতে না, সত্যিই মেহমানদের সাথে মিলে মেহমান হয়ে যেতে। এইসব সহাস্য অভিযোগের ভেতরে তিক্ততা ছিল না, উভয় পক্ষেই। তিক্ততা তোমার সাথে ঠিক যেত না। দারুণ বেদনায়ও তিক্ত হতে না। তবে তোমার সন্তানদের যারা অন্যায় আঘাত করেছে, তাদের তুমি সখেদে মনে রেখেছিলে, প্রতিশোধ নাওনি কোনোদিন, তাই বলে ভুলেও যাওনি।
মেজখালা মেরী জন্মাবার সময় তুমি ছিলে সারদায়, ট্রেনিং-এ। সেখানে পি.টি.-প্যারেড করে করে তুমি চীনাপুতুলের মতো ফুটফুটে মেজমেয়ের নাম ভুলে গেছিলে, চিঠিতে লিখেছিলে ‘মেজখুকি’। আমার মেজখালার স্নেহের কথা লিখে শেষ করা যাবে না, ছোটবেলায় আমার অসুখ হলে শিথানে কতো যে রাত তিনি জেগেছেন অক্লান্ত। আমার কাপড়ের পুতুল, আমার জন্মদিনের খাওয়া, আমার জামা-জুতো সবকিছু মেজখালার অপার মনো্যোগ পেয়েছে। তুমি বলতে–“স্নেহের ঋণ শ্রেষ্ঠ ঋণ, একথা ভুলো না”। মেজখালার শ্বশুরবাড়ি কমলাপুর, জসীমউদ্দীন রোড। আজীবন তোমার কাছে কাছে রইলেন তিনি, সুখে-দুখে একটানে চলে আসতেন তোমাকে দেখতে, তোমার কুশলসাধন করতে।
আমাদের ছোটখালা তুহিন ছিলেন তোমার ‘জাহানারা’, তুমি বলতে। কালোমেয়ে হিসেবে বাংলাদেশে যা যা শুনতে হয়, তার সবই শুনেছেন আজীবন, কিন্তু তোমার কাছে নয়। নানী সাবান ডলে গোসল করাতেন, সফেদ ফেনা সারা গায়ে মেখে ছোটবেলায় খালা ভাবতো এইবার ফর্সা হয়ে উঠছি, কিন্তু নানী মগে করে আরেকবার পানি দিতেই সেই প্রপঞ্চ কেটে যেত, কান্না শুরু করতো ছোটখালা। এই কান্না অর্থহীন, এই কান্না পুষে রাখা আরো অর্থহীন, কারণ ছোটখালা দেখতে ছিলেন অদ্ভুত রূপসী। যেমনি নাক-চোখ-মুখ, তেমনি গড়নপেটন। ছোটখালা দোতলার খাবারঘর থেকে তোমাকে চেঁচিয়ে নাস্তা খেতে ডাকতেন, আর তুমি নাকি ছাদের ঘর থেকে বুক চেপে ধরে নামতে যে তোমার মেয়ে আর্তনাদ করছে কেন! যতদিন বাসাবোর বাড়িতে ছোটখালা ছিলেন, সাবানদানিতে নতুন নিটোল সাবান, বেসিনে নতুন অ্যাড-এ দেখানো টুথপেস্ট, দেয়ালে কবে লিখে রাখা ‘ভাইটামিন খেতে হবে’, গান শিখবার হারমোনিয়াম আর গলা সাধা–“আমার আঁধার ভালো, ও আমার আঁধার…” খালার একটা আধুনিক-স্বতন্ত্রতা ছিল, আর ছিল তোমার থেকে পাওয়া গানের প্রতি ভালোবাসা, জীবনের সুকুমার বস্তুগুলির প্রতি পক্ষপাতিত্ব। ছোটখালার বিয়ের ভিডিওতে একটা গান ছিল–“তুমি কোন কাননের ফুল/ কোন গগনের তারা”, এই গানটা পরে তুমি যেখানেই শুনতে, ছোটখালার জন্যে কান্নাকাটি করতে। শ্বশুরবাড়িতে ফোন করে তুমি জানতে চাইতে–নতুন শীত পড়েছে, এখন ছোটখালা পায়ে মোজা পরছে কিনা, ছোটখালা শীতকালে মোজা পরতো নইলে খালার ঠাণ্ডা লেগে যেত চট করে। এই নিয়ে ছোটখালার শ্বশুরবাড়ির লোকে হাসতো, তারা তোমার সদাশঙ্কিত পিতৃহৃদয় দেখতে পেত না। আমার ছোটভাই নানান দুরন্তপনার কারণে আম্মার মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল, তুমি তাকে ডেকে হেঁকে বলতে–“শোন হে, পরের মেয়েকে কষ্ট দিও না।”
তোমার মেয়েরা ছিল তোমার ন্যাওটা, তুমি মেয়েদের পরমবন্ধু হয়েছিলে, তোমার কালের জন্যে যথেষ্ট আধুনিক। বিকেল হলে মেয়েদের গা ধুয়ে চুল বাঁধা-কাজল দেয়া-একটু সেজে ফিটফাট থাকা এইসব তোমার প্রিয় ছিল। মেয়েদের সাথে তুমি গান করতে, টিভির নাটক-সিনেমা দেখতে, গল্প করতে, তর্কও করতে অবিরাম। হজ্বে গিয়ে তুমি ফিরে এসেছিলে ছোটখালার জন্যে সিল্কের কাপড় আর একটা মেকআপ বক্স নিয়ে, ছোট্ট বুড়ি (মাস্টারনানার নাতনি) ছিল মহাসাজুনি, ওকে মেকআপ বক্স দিয়ে বললে–“কবুল বললেই এই মেকআপ বক্স তোমার”, বুড়িকে পায় কে, সে তৎক্ষণাৎ কবুল করে ফেললো। এই নিয়ে কতকাল হাসাহাসি চলেছে। নাতনির বিয়ের আসরে তুমি গান গেয়েছিলে–তোমার প্রিয় জগন্ময় মিত্রের “তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন”… এত ভালবাসতে কেন তুমি হাসতে? আমোদ করতে? কেন ঊষর ডাঙায় এত পলাশ ফুটিয়ে রাখতে?
খোঁচাখুঁচি করতে ভালবাসতে, আমাকে শোনাতে তুমি নাকি হিটলারের প্রণীত রান্নাঘর-আঁতুড়ঘরের ছক মোতাবেক নানীকে রেখেছো, আমি চেঁচামেচি করতাম, তুমি মজা দেখতে। শেষের দিকের বছরগুলিতে খবরের কাগজ পড়া তোমার বাতিক হয়ে গেছিল, বাছবিচার করতে না, সংগ্রাম-মিল্লাত-ইনকিলাব যা পেতে তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে। ঘোষণা দিতে–তুমি মৌলবাদী, মূলের অনুসন্ধান করে যে। এই সমাস আমাদের আনন্দের কারণ হয়নি। ধুন্দুমার তর্ক বেঁধে যেত তোমার সাথে। হিজাব-নেকাব ছিল তোমার দুই চক্ষের বিষ, পরান্নপুষ্ট-ধর্ষকামী হুজুর জাতটার প্রতি কোনোরকম প্রীতি তোমার ছিল না। তুমি সদাচারের জন্যে কারো মুখাপেক্ষী ছিলে না যে–তোমার জন্যে কোনো ‘প্রিস্ট’ প্রয়োজনীয় ছিল না।
জীবনে একটি দিনের জন্যেও তুমি আমাকে ধমক দাওনি, রাগও করোনি আমার ওপরে, আমাদের কোনোদিন মতের অমিল হয় নাই। আমি যা ভাবতাম, তুমি প্রাঞ্জলভাবে তা বুঝে নিতে। আমাকে তুমি শাসন থেকে বাঁচাতে চাইতে, বাসাবোর একটা পুকুরে আমি পড়ে গেছিলাম, কাদা-জোঁকে একাকার নোংরা পানি মাখামাখি আমি বাড়ি ফিরতেই আম্মার চ্যালাকাঠের বাড়ি, নানীর বকা (আমার সঙ্গে আমার ছোট ভাই, মামাতো ভাই আর খালাতো বোন ছিল, সবাই ছোট্ট ছোট্ট, যদি ওরাও পড়তো! কী হতে পারতো, তাই নিয়ে মার খাচ্ছি, আশ্চর্য!), তুমি বকাবকির ধার দিয়েও গেলে না, হাসতে হাসতে বললে–“আমার নাতনি নিশ্চয়ই আর্কিমিডিসের বয়েন্সির সূত্র প্রমাণ করতে গেছিল!”
আব্বা ছেলেমেয়েদের মারধোর করায় বিশ্বাসী ছিলেন (পড়ুন, জরাসন্ধের মতো দু’টুকরো করে ফেলায় বিশ্বাসী ছিলেন), তুমি ছিলে না, তুমি বলতে “মন্টু, ঘোড়ারে পিটায়া গাধা বানাইতাসে”, আব্বার মেলা থেকে কিনে আনা রকমারি বেত তুমি ফেলে দিয়েছিলে। আমাকে শাসন করবার নিত্য নতুন উপায় ফাঁদা হচ্ছে দেখে তুমি হাসতে, বলতে–আলেকজান্ডার পোপ নাকি কবিতা লেখার জন্যে বাপের মার খেতে খেতে বলেছিলেন ‘ফাদার ফাদার মার্সি টেক/ ভার্স শ্যাল আই নেভার মেক’ অর্থাৎ কাব্য করেই ক্ষমা চেয়েছিলেন, অর্থাৎ যে যা করবার জন্যে ইহদুনিয়ায় এসেছে, তাকে তাই করতে দেয়া ছাড়া আমাদের কোনো গন্তব্য নেই। গভীর অভিমানে ভাবতাম, আম্মার বাবা এত সুরেলা, আমার বাবা এমন বেসুরো কেন?
আমার জন্যে তোমার ভালোবাসার অন্ত ছিল না, বলা যায় অন্তবিহীন ভালোবাসার পাঠ কেবল তুমিই আমাকে দিয়েছিলে (ভরতরাজা বা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া এইরকম করে আর সম্ভব নয়), আর এই অভিজ্ঞান যে, অলস বেলায় আমকাঠের আনাড়ি পিঁড়ি বানিয়ে দিব্যি সময় কাটানো যায়, কোনো উচ্চাভিলাষ ছাড়া কোনো অনুযোগ ছাড়া, দিব্যি ঠকতে পারা যায়–তাতে আমোদ আছে, এই সান্ত্বনা আছে যে পৃথিবীতে কারো তো ঠকা চাই! কাঁচাবাজার থেকে তুমি ফিরতেই নানীর অনুযোগ শুরু হয়ে যেত–এমন ঠকে আসতে তুমি–হাজা পটল, পচা মাছ, বুড়ো মুরগি… তা, তোমাকে সবাই ঠকাতো, কাঁচাবাজারঅলা ঠকাতো, কাগজঅলা ঠকাতো, কয়েকদিন মামার দোকানের ক্যাশে বসেছিলে, ক্যাশ হাতিয়ে লোকে ভাঙতির নামে হাজার টাকা লোপাট করে দিয়েছিল, টেরও পাওনি। কাছের লোকে গঞ্জনা দিলে মন খারাপ করে বলতে–লক্ষ্মী আর সরস্বতী এক ঘরে থাকে না”। এরকম মানুষ যে তার পাঁচ ছেলেমেয়ের কারো জীবনে অনূদিত হবে না, সে আর আশ্চর্য কী!
আমার সাথে অনেক গল্প ছিল তোমার, কেমন করে আষাঢ়মাসের ইছামতি পাড়ি দিয়ে মেয়ে দেখতে গেলে, তোমার তের বছরের বালিকা স্ত্রী তোমার সঙ্গে একঘরে রাত্রিযাপনের ঘোর বিরোধী ছিল, নানীর ছোটবোন অমর্ত্যনানী ছিলেন গৌরী এবং ডাকের সুন্দরী–তাঁকে দেখে তোমার মা বলেছিলেন “আমার আফি যখন মেয়ে দেখতে আসছিল, তোমারে দেখে নাই ক্যান?” (তুমি বলতে অমর্ত্যনানী খানিকটা কুঁজো ছিলেন–আমার নানীর মতো সটান সোজা নয়–হাঃহাঃ তুমি মেরুদণ্ডী মেয়ে ভালবাসতে); কেমন করে দার্জিলিং-এ একরাত্রে ঘুম থেকে উঠে দেখলে মেঘ ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে আরেক জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল, গুর্খা মেয়েরা যে অনায়াসে পথের পাশে হিসি করতে বসে যেত, “নয়নসমুখে তুমি নাই…আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল” গান শুনে প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা কেমন হুহু করে কেঁদে ফেলেছিল (কোথায় গেল সেইসব ছাত্ররা, সেইসব সমব্যথী-শুভানুধ্যায়ী-সংবেদনশীল ছাত্ররা?), প্রেসিডেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজি পড়তে না পারার দুঃখে কয়েকমুহূর্ত কেঁদে ফিরে এসে শ্বাস ফেলে আবগারির চাকরির জীবনকে গ্রহণ করেছিলে–পিজি হাসপাতালে স্মৃতিভ্রষ্ট নজরুলকে দেখতে গিয়ে তুমি আবৃত্তি করেছিলে– “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার” আর তোমার মনে হয়েছিল কবির মতিচ্ছন্ন বড় বড় উৎকট দৃষ্টি নড়ে উঠেছিল, যেন স্মরণপারের ডাক শুনে।
ছুটিছাটায় তোমার সঙ্গে চলে আসতাম সুনসান নানাবাড়িতে, সন্ধ্যার মশার কয়েল, রেডিওতে ‘ঢাকা ৮৬’-এর “পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়”, নানীর এনামেলের ফিকে হলুদ মগে গাঢ় চা আর মুড়ি, তোমার টার্টান চেক মাফলারে বিঁধে থাকা জাম্বাক বা টাইগারবামের গন্ধ, শীতের রাতে ছাদে উঠে নানীর মাটির চুলায় পিঠা বানানো, সিমেন্টের সিঁড়িতে কবেকার বিয়ের আলপনা, ছোটখালার ঘরের দরজায় অফহোয়াইট সিল্ক আর মুক্তার কানবালা পরা জয়াপ্রদার পোস্টার, পুরোনো কাঁচের আলমারিতে আকবর হোসেন-নিমাই-আশুতোষ-কৃষণ চন্দর-ফাল্গুনী-তারাশঙ্কর আর অজস্র সিনেমাপত্রিকা, বিচিত্রা, নবকল্লোল, প্রসাদ… সকালবেলার বেতের টুকরিতে পরিষ্কার কাপড়ে মুড়ে রাখা আটার মোটা রুটি গরমাগরম আর নানীর অনবদ্য আলুপটলভাজি, ঈদসংখ্যার শখের রান্নার জন্যে ছোটমামার কাছে সওদা আনবার আবদার–ছোটমামার দেয়ালে ‘অ্যাবা’র বিশাল পোস্টারে নীল পুঁতির কাজ করা জামা পরা ফ্রিডা আর অ্যাগনেথা–মামা বিয়োর্নকে ডাকতেন–হনুমান, একসাথে বসে দ্যাখা সার্কভুক্ত দেশের সিনেমা ‘পাল্কো কি ছাঁও মে’, কাজ থেকে ফিরবার পথে ছোটমামার শাজাহানপুরের মিষ্টির দোকান থেকে কিনে আনা আজবদর্শন বালুশাই আর মনসুর (মাইসোর পাক)… এইসব মিলিয়ে আমি বাসাবোর বাড়িটাকে খুব ভালোবাসতাম। ছুটি হলেই বাড়িটা দ্বীপরাষ্ট্রের মতো–মাতৃভূমির মতো আমাকে টানতো। তুমি এই টানটা খুব বুঝতে, নিঃশব্দ গর্ব এবং আনন্দের সাথে উপভোগ করতে–ভাবতে এইবার তুমি একা নও।
বাসাবো তোমার খুব প্রিয় ছিল, ইটে বাঁধাই অতীশ দীপঙ্কর রোড, রাজারবাগ পুলিশলাইনের লাল-শাদা চুনকাম করা টানা নারকেলগাছের সারি, হুডখোলা কালো-হলুদ জিপ, ইটের রাস্তায় চরতে থাকা অসংখ্য শাদা-কালো ফুটকিদার তিতির, শাজাহানপুরের বেঁটে বেঁটে কলোনি আর উলুর মাঠ, বাসাবো বিলের উদার বুকে গোলাপি সূর্যোদয় আর লাল-নীল লঞ্চ, শ্রাবণমাসে লটকানো রঙ হয়ে ঘনিয়ে আসা বিপুল মেঘের নিচে ছোট্ট ছাদে কাজিপেয়ারা-থানকুনি-নয়নতারা-মোরগজবা-ঢেঁড়স, আধা-শহুরে কদমতলা হাই স্কুল- তোমার দক্ষিণা জলপাইগাছ, উত্তুরে অর্জুন গাছ, পুবের বিশাল নিমগাছ আর বাড়ির গেটের মেহেদিগাছ এইসব নিয়ে তুমি সন্তুষ্ট ছিলে খুব। পশ্চিমের কোণে ছিল মস্ত গিলা আম গাছ, লোকে আলফনসো আমের প্রশংসা করে, গিলা আম একবার খেলে আর করবে না। যেমনি রসালো আর টক-মিষ্টি, তেমনি আঁশছাড়া চমৎকার আম, যেন আমের রস বরফকলে জমিয়ে সে আম তৈরি। নানী সারা বছরের আচার, আমচুর, আমসত্ত্ব, আমতেল এইসব সেই আম দিয়ে তৈরি করতেন। গাছটা পাশের বাড়ির টিনের চালেও জাঁকিয়ে উঠেছিল, প্রতিবেশীরা তোমাকে বারবার তাড়া দিচ্ছিল গাছ কাটতে, তুমি শেষ চেষ্টা করেছিলে–বলতে, “এ তো তোমাদেরও গাছ, আম পেড়ে খাও যত খুশি”। কিন্তু ভবি ভোলেনি কেউ। মনে দারুণ দুঃখ নিয়ে গাছটা কাটিয়ে ফেলতে হয়েছিল তোমার। নিমগাছটার বেলাও তাই। অর্জুনগাছটাও তাই।
তুমি বাসাবো ছাড়তে চাইতে না, নগরায়ণের মূর্খ নরহরিদাসের গরাসে বাসাবো বিল আর তার গোলাপি সূর্যোদয় শেষ হয়ে যাবার পরেও না, অসংখ্য অন্ধগলিতে মায়াকানন-সবুজবাগ-কদমতলা ভরে উঠবার পরেও না, মশা আর বদ্ধ পানিতে ‘গায়ে তাহার বেলাউজ নাই’-বাসাবোর খোলামেলা শ্রী নষ্ট হয়ে যাবার পরেও না।তুমি বলতে–এখান থেকে তুমি শেষযাত্রা করতে চাও, তোমার আশা পূর্ণ হয়েছিল। আশাগুলি তো খুব বড় ছিল না, কম্পাসের বাক্সের চাঁদা দিয়ে তা দিব্যি মাপা যেত। টিফিনবাক্সের হাতরুটি-আলুভাজির পাশের ছোট খোপটায় ভাঁজ করে তার জায়গা হয়ে যেত।
শেষবার তোমার চোখে অস্ত্রোপচারের সময় আমি ছিলাম তোমার সঙ্গে, তুমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাক্তারের হাত ধরে নিচু গলায় বলেছিলে–“ডক্টর, আই ওয়ান্ট টু লিভ। লাইফ ইজ রিয়েল, লাইফ ইজ আর্নেস্ট” (শঙ্করাচার্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে কি?), আমার আত্মা অব্দি কাঁপুনি চলে গেছিল, ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–আপনার বাবা-দাদা হলে কি আপনি এখন অপারেশন করাতেন? সবাই বলছে এই বয়েসে আরেকবার অপারেট করালে অপারেশন টেবিলেই এক্সপায়ার করে যাবেন”, তিনি বলেছিলেন–“করাতাম, আপনি আশা রাখুন”। রেখেছিলাম। না রেখে উপায় কী। তোমার সাধু-সরস-দিব্যকরোজ্জ্বল চোখ কোটর থেকে তুলে ফেলবে এই ছিল আরেক সমাধান, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তা হয়নি। তুমি দু’খানা চোখ নিয়ে বেঁচে ছিলে। তোমার লেখা চিঠির খসড়া রয়ে গেছে আমার কাছে, একজায়গায় তুমি লিখেছ–“টাকাপয়সা খরচ করিয়া দেখি আরো কিছুকাল তোমাদের মধ্যে রহিয়া যাইতে পারি কি না।” আহা রে, তুমি কি জানো তুমি চিরটাকালই আমাদের মধ্যে রহিয়া যাইবে?
আমার নানীর ডাকনাম চিনি। সেকালের নিয়মে তুমি নানীকে নাম ধরে ডাকতে না কখনো, ডাকতে হ্যাঁগা/আগা/ওগো, ছোটমামার ছেলেরা জন্মাবার পরে তারা ধরে নিয়েছিল নানীর নাম ‘ওগো’ এবং তারাও মনের সুখে ‘ওগো’/’আগা’ ডাকতো। তেরবছরের নানী তোমার সংসারে এসেছিলেন, বিয়ের পরদিন থেকে সংসারখরচের সব দায়িত্ব তাঁর, তুমি রোজগার করেই খালাস। নানীর প্রতি তোমার গভীর টান ছিল, এই টান সংস্কারজাত নয় শুধু, ষাটবছরের জীবন্ত সম্বন্ধ তো শুধুই সংস্কারের হতে পারে না, তোমাদের বোঝাপড়া ছিল নিঃশ্বাসের মতন সহজ–তুমি দুরূহ ইংরেজিতে কিছু বললেও নানী দিব্যি বুঝে যেতেন তুমি কী বলছো। একটিমাত্র নারীরূপই তোমার চোখে তাবত নারীজগতে গ্রহণ লাগিয়ে দিয়েছিল, তুমি সেই সূর্যগ্রহণের ভেতর আর কাউকে দেখতে পেতে না, কাউকে জানতে না। নানী আমাকে অলিভ অয়েল মাখাতেন জবজবে করে, তারপর রৌদ্রে ফেলে রাখতেন। শীতকালের বিকেলে চুলে সেকালের কেতা অনুযায়ী ‘বাটালি হিল’ খোঁপা বানিয়ে–কানের পাশ দিয়ে চুলের লতা বের করে আমাকে কোলে নিয়ে নানী পাড়ার ‘শ্যামলী স্টুডিও’তে ছবি তুলতে যেতেন–আচ্ছা, কত আর বয়েস তখন নানীর, মধ্য-ত্রিশ কি? তুমি আর নানী মিলে শালমুড়ি দিয়ে টিভি দেখতে, ‘হীরামন’, ‘মাটি ও মানুষ’ আর রাতের খবর। ‘মাটি ও মানুষ’ দেখে নানী ছাদের বাগানে কাজিপেয়ারা ফলিয়েছিলেন, আম ফলিয়েছিলেন, কাঁকরোল- ঝিঙা-কাগজিলেবু-ঢেঁড়স আরো কত কী! নানীর ধৈর্য্য, নানীর আচার-আমসত্ত্ব, কাঁচের মতন স্বচ্ছ-উৎকৃষ্ট জেলি, ফ্রুটকেক-এর ওপরে চিনি আর ট্যাং-এর গ্লেইজ, নানীর অসামান্য পরনিন্দাহীন বাকসংযম, তুতো ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহ বিষয়ে নানীর বিপুল বিরাগ এইসবই তুমি ভালবাসতে–আধুনিকতার লক্ষণ হিসেবে জানতে (আমাদের বাড়িতে দু’একদিন থাকবার পরেই আইঢাই শুরু হয়ে যেত তোমার, বলতে–“কদমতলায় রাধা ফেলে এসেছি”)। নানীর নানান বাতিক ছিল, গজার মাছ নাকি মানবশিশু খেয়ে ফ্যালে, অতএব গজার মাছ খাওয়া যাবে না, বোয়াল মাছ সুযোগ পেলে ছুঁচো-ইঁদুর খেয়ে ফ্যালে, অতএব বোয়াল মাছও চলবে না। শোলমাছ দেখতে সাপের মতো চক্রাবক্রা, বাইম মাছও কদাকার। পাঙাশ মাছ অতিরিক্ত তৈলাক্ত। টাকি মাছ কোন কারণে নিষেধ এইটা মনে নাই। এইসব বাতিক নানীতেই স্থির ছিল না, কন্যাসূত্রে প্রবাহিত হয়েছিল।
এমনিতে নানী ছিলেন অসম সাহসী, খুব তীব্র নীতিবোধ এবং সততা ছাড়া ঐরকম সাহস হয় না মানুষের। বাড়িতে চোর এসেছে মনে হলেই তুমি নানীকে জাগিয়ে দিতে, নানী লাঠি নিয়ে চললেন চোর তাড়াতে–এই নিয়ে আমরা হাসতাম কত! নানী ছিলেন কঠিন নিয়মনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, শাসনের ঘেরাটোপে নিজের হাতে নিজেই বন্দী, মৌসুমের ওষধি–অম্লের সমস্যা মেটাতে চুনের পানি–কৃমি তাড়াতে আনারসের পাতার রস–ঠাণ্ডাসর্দির বাসকপাতা–রাতে অবধারিত রুটি তরকারি। কেবল ভাল করে রাঁধা ইলিশমাছ ছাড়া আর কিছুর প্রতি নানীর আসক্তি কাজ করতো না। তুমি অতশত মানতে না, স্বভাবে মিতাহারী ছিলে, ওই অতটুকুই। নীতি মানতে যতটা, নিয়ম অতটা নয়। নানীর প্রসঙ্গে তুমি বলতে–ঐ যে দেখতেসো সিঁড়িতে দাঁড়ায়া সালাম নিতেসে, আসলে কিন্তু তাকায়া আছে তোমার পায়ের দিকে, জুতা নিয়া ঘরে ঢুকলা কিনা তাই দ্যাখে!” আমরা নানীর পরিচ্ছন্নতার বাতিকের কথা জানতাম। নানীর পেটেন্ট স্টোনের লাল মেঝে ছিল হাতআয়নার মতো চকচকে। নানীর বিছানায় ধুলপায়ে ওঠার কথা ভুলেও ভাবা যেত না। বঁটি দিয়ে যেসব বাড়িতে আম কেটে দেয়, সেসব বাড়িতে নানী আম খেতে চাইতেন না। আমি যে সারাক্ষণ বই মুখে করে বসে থাকি, টেবিলে গিয়ে যার তার এঁটো পানি গ্লাস থেকে খেয়ে ফেলি (কত মানুষের সাথে যে ভাব হইবো এর!), ছোট্ট আমি যে কেউ সাধলেই দ্বিতীয়বার বলার আগেই গান গেয়ে ফেলি,নেচে ফেলি, এইসব নির্লজ্জপনায় নানী চিন্তিত ছিলেন, তুমি ছিলে না মোটেই। আমি কি করে ভবিষ্যতে সংসার করবো এইজাতীয় দুর্ভাবনা তোমার কস্মিনকালেও হয়নি, সংসারই যে আমার করতে হবে এটাও তোমার চিন্তায় ছিল না। নানী ভাত বেড়ে দিয়ে বাথরুম সাফ করতে চলে গেলে তোমার রাগ হতো, তুমি সেবা চাইতে না তেমন, কিন্তু সান্নিধ্য এবং সঙ্গ চাইতে। নানীর ব্যস্ততা দেখলে বলতে–“কাজ না থাকলে চাইলে-ডাইলে মিলায়া আলাদা করতে বসবো তোমার নানী”, নানী তো কর্মযোগী, তোমাকে ডাকতেন–কুঁইড়া।
আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় তুমি বাসাবো থেকে মিরপুর এসে হাজির, নানীর ঢাউস বহুতল টিফিনক্যারিয়ার টানতে টানতে। কি না, ফাঁসির খাওয়া নিয়ে এসেছো। ভুনা মাংস আর চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, মুগপাকন পিঠা আর দুধচিতই। আর সঙ্গে এনেছ নানীর একলা হাতে সেলাই করা নকশীকাঁথা, চারপাপড়ির লালফুল বড়বড় খোপে সেলাই করা, কোণের দিকে তুমি সুঁইসুতা ধরে আমার নাম লিখেছ ইংরেজিতে আর বাংলায়। কাঁথাটা আমার কাছে এখনো আছে, আজীবন থাকবে।
আমাকে ইংরেজি দেখিয়ে দিতে তুমি। বাংলা প্রতিশব্দ পারি কিনা পরখ করতে (“বলো দেখি ‘তব হৃদি কোকনদে’… এই কোকনদ মানে কী”, আমিও বাগিয়ে উঠি–“কোকনদ-অরবিন্দ-ইন্দীবর-পুষ্কর এইরকম আমি আরো অনেকগুলি জানি, তুমি আরো শুনতে চাও?”), পারলে খুশি হতে (হাসতে, সামনের দাঁতে একটু ভাঙা ছিল তোমার–এত মধুর ভাঙা দাঁত আমি আর দেখিনি), না পারলে অনর্গল বলে যেতে কী কী হতে পারে… কী অপূর্ব ইংরেজি জানতে তুমি, তোমার লেখা চিঠি আমি জন ও’রাইলীকে দেখিয়েছিলাম, ওরকম সরস-সুরেলা-সরমাখনে পূর্ণ ইংরেজি পড়ে সে বিশ্বাস করতে পারেনি, এ কোনো ইংরেজিভাষীর লেখা নয়। আমি তোমাকে বলতে শিশুর মতো খুশি হয়েছিলে, বলতে, ইংরেজি যার মাতৃভাষা তার তারিফ পেলাম তবে! ভাষার ভালোবাসাও আমার জীবনে তোমারি দান। একটা কথা কয় রকমে বলা যায়, কত পদের বিশেষণ চলে, কোন রকমে বললে ভাষার ভেতর দুষ্টু হাসি ধরা দেয়, কোন ভাষায় কোন পদের মানুষ ধরা পড়ে… এ চর্চা তোমার বাহিত ছোঁয়াচে রোগ। একটিই বর্ণভেদ ছিল তোমার জীবনে, ভাষাভাষীর বর্ণভেদ। সুভাষী আর কটুভাষীর ভেদ। রাবেয়া খালা (রাবেয়া খাতুন) তোমাকে বই উপহার দিয়ে যেতেন ফি-মৌসুমে, একমাত্র জীবিত কাকা হিসেবে সমাদর করে, তুমি তাঁর বইয়ে ভাবের গুরুচণ্ডালি দেখলে খেপে উঠতে।
তোমার স্বভাব ছিল খোঁচাখুঁচি করা, সেটা নিজের পিঠাপিঠি ভাই হাফিজউদ্দিন আহমেদের (আমরা তাঁকে ডাকতাম মাস্টারনানা) সাথেই হোক আর নাতিনাতনিদের সাথেই হোক।তুমি ছিলে উদার এবং উদাস, তর্ক করতে কিংবা শুনতে তোমার কোনো বাধা ছিল না। মাস্টারনানা ছিলেন অটোক্র্যাট, দারুণ নিয়মে বাঁধা, অল্পবয়েস থেকে দুরন্ত শ্বাসকষ্টের রোগী, নিয়ম না মেনে তাঁর উপায় কী! সকাল হলেই মর্নিং ওয়াক, সকাল হলেই নিজস্ব টোটকা পেঁপে বাটা/সেদ্ধ আর রসুনকোয়া, সকাল হলেই পড়তে বসানো, দুপুরে হাতের লেখা প্র্যাক্টিস, এইসব ছিল মাস্টারনানার কাজ। মজার মজার থিওরি ছিল তাঁর, আমানি আর কাঞ্জির জল কেন খাওয়া উচিত, ছাত্রছাত্রীদের কেন শুঁটকিমাছ এবং চ্যবনপ্রাশ খাওয়া উচিত এইসব নিয়ে একবার ভাষণ শুরু হয়ে গেলে আর থামাথামি ছিল না। তাঁর বাড়িতে কোচিং সেন্টার ছিল। তিনি সংস্কৃত জানতেন, ছেলেমেয়েদের তিনি বাংলা কৃৎ প্রত্যয়-তদ্ধিত প্রত্যয়, সমাস-কারক বিভক্তি এইসব হাতে ধরে শেখাতেন। ইংরেজি কারেকশান্স করাতেন। টেস্ট পেপার সল্ভ্ করাতেন। আমি ছিলাম তাঁর খুব প্রিয়, ফলে অসহনীয় বকাঝকার ঝড় যেত আমার উপর দিয়ে। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রের দিন। দেয়ালে কাচের ফ্রেমে বাঁধাই কশিদার কাজ–‘অকূল পাথারে খোদা তুমিই ভরসা মম’, ফুটে ওঠা ভাতের গন্ধে কলোনির ঘর ভরপুর। টিভির ‘এইসব দিনরাত্রি’ শেষ হতো–আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ থেকে আজান দিত জোহরের। আমি বাড়ি যাবার জন্যে নড়াচড়া করতেই উনি বসিয়ে দিতেন ম্যাপ আঁকতে নয়, আরেক পাতা কারেকশান্স করতে। আমার বাংলা আর ইংরেজি হাতের লেখা তাঁর প্রিয় ছিল। এইসব মাত্র দু’এক দশক আগের কথা, যখন গুরুজনেরা হাতের লেখাকে সুলক্ষণ হিসেবে দেখতেন। এইখানে বলে রাখি, আমাকে লোকে মুখ দেখে যতটা বাধ্য ভাবে, আমি মোটেই তা নই, স্বভাবতঃ তেরিয়া। আমি প্রায়ই নানান কথা জিজ্ঞেস করতাম (পরখ করবার জন্যে)–বলো তো, “উত্তরিবে প্রতিধ্বনি কোথা জনা বলে… এইটা কোথাকার লাইন?” মাস্টারনানা সাথে সাথে বলতেন–“মাইকেল। বীরাঙ্গনা কাব্য।”
মাস্টারনানার এক ছাত্র ছিলেন মাসউদুর রাহমান শুভ্র, ম্যাট্রিকে ঢাকা বোর্ডে ফার্স্ট, উজ্জ্বল বাদামি তরুন, নানা তাঁকে অন্ধের যষ্টির মতো ভালোবাসতেন, ডাকতেন–আমার নাদির শাহ!” অল্পবয়েসে সড়কদুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হলে মাস্টারনানা ধ্বসে পড়েছিলেন–প্রায়ই বলতেন, আল্লাহ আমারে নিল না কেন। বিদ্যাদেবী ছিল তাঁর আরাধ্যা দেবী, লক্ষ্মীঅর কথাও যে ভাবতেন না তা নয়, না ভেবে উপায় কী, ছেলেপুলের সংসার, মাস্টারির আয়ে সংকুলান হওয়া মুশকিল। তুমি তোমার ভাইকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলে নিঃশব্দে, তোমার বিধবা বোনের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলে সঞ্চয় ভেঙে। তোমাদের বাড়িতে এসে পুরোনো কাজের লোকেরা দুঃখের শতরঞ্চি খুলে বসতো–খেত–মাখতো, স্থায়ী সম্বন্ধ ছিল এদের সাথে তোমাদের দু’জনের। কোনোদিন তোমাকে নিজমুখে এইসব দানধ্যানের কথা বলতে শুনিনি আমি।
আমার সুপণ্ডিত মাস্টারনানার পাশেই পৃথুলা-বিরলকেশ-টকটকে ফর্সা মাস্টারনানী ছিলেন গণ্ডমূর্খ। আমার উপর দিয়ে বকাবকির ঝড় বয়ে যাচ্ছে এইসব দেখে উনি নির্বিকার থাকতেন, তবে নানা অন্যঘরে যাওয়ামাত্র যেন বকার শোধ স্নেহে দেবার জন্যেই বলতেন–“আইজকা ভাত না খায়া যাইস না, বুড়ি আর হিটলার (তাঁদের ছেলের ঘরের নাতিনাতনি) আইতাসে দাওয়াত খাইতে”; মাস্টারনানীর সামনেই মাস্টারনানা বলতেন–“তোর নানীর হাতের লেখা হইলো দোয়াতে তেলাপোকা ভিজায়া কাগজের উপরে ছাইড়া দিলে যা হবে তাই” আর বলতেন–“তোর খাতাগুলি তোর নানীকে দিয়ে যাইস, মার্জিন টেনে রাখবে”–আমার চিনি নানী তো মোটেই বিদ্যাদিগ্গজ ছিলেন না, কিন্তু নানীকে এভাবে তুমি কখনো বলতে না, তোমার সহজাত সম্মানবোধে বাধতো, যদিও তুমি বলতে স্পেইডকে তুমি স্পেইড-ই ডাকো! মাস্টারনানীকে তুমি ‘ভাবী’ ডাকতে না, ডাকতে ‘ভবিষ্যৎ’, এমনি ছেলেমানুষি তোমার! তোমাকে মাস্টারনানাও স্নেহচ্ছলে ডাকতেন–কুঁইড়া, তাঁর ধারণা ছিল আবগারির চাকুরি বাদ দিয়ে তুমি ইংরেজির মস্ত শিক্ষক হতে পারতে! ইচ্ছে করে কিছু হলে না। আসলে হবার তাড়া–হয়ে দেখানোর ক্ষুধা তোমাকে তাড়িত করতো না।
তুমি কী করতে পারতে, কী হতে পারতে, এই জল্পনা কেউ শেষ করতে পারতো না, তোমার ছেলেমেয়েরা এই নিয়ে রাগ করতো, অভিমান ছিল তাদের। কিন্তু, তুমি তো হবার অপেক্ষমাণ ছিলে না, তুমি ঘটমান ছিলে না, তুমি পুরাঘটিত ছিলে, আমূল মানুষ। যে ভালোবাসা–যে পূর্ণতাকে জেনে জীবনানন্দের বই-এ প্রসাদ আর তার বউ চারবছরের বিবাহিত জীবনের প্রেমবিথার নিয়ে মাঠের অন্ধকারে পাশাপাশি বসে থাকে, সেই গহীন পূর্ণতা পেয়েছিলে তুমি। বিভূতিভূষণ নাকি বলে গেছিলেন–“আমার কথা যখন লিখবেন, তখন লিখবেন আমি জীবনে পূর্ণ হয়েছি”, সেইরকম, বাড়ির পেছনের ঢোলকলমি সাফ করে, ছাদে ঝিঙেলতা চড়িয়ে, অবসরে মহামূর্খ প্রতিবেশীর পুত্রকন্যাকে ইংরেজি পড়িয়ে, ঝোলভাত খেয়ে একখানা সমগ্র জীবন যাপন করেছো তুমি, তোমার পরিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করি আমার সাধ্য কী!
শুধু তোমার ষাটবছরের সঙ্গিনী আমাদের বিদায়বেলায় সব সময় বলতেন–“যাওন নাই ভাই, আসো”, তাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে তুমি কেমন করে চলে গেলে?
(আমার নানা আফিজউদ্দিন আহমেদ আমাদের ২২ জুলাই, ২০১০ ছেড়ে চলে যান, তাঁর স্মৃতিমালা এইখানে সাজালাম।)
২৫ জুলাই-২২ সেপ্টেম্বর, ২০১০
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
ইমতিয়ার - ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ (৬:১৫ পূর্বাহ্ণ)
মানুষের কিছু কিছু স্মৃতি থাকে, যা তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই নিঃশেষিত হয়ে যায়; কিন্তু তার সব স্মৃতিই নিঃসঙ্গ নয়, তাই তারপরও মানুষটি আরও অনেকদিন বেঁচে থাকে এবং রক্তক্ষরণ ঘটাতে থাকে অন্যের স্মৃতিঘরে। সেই ক্ষরণ মাঝেমধ্যে খানিকটা উপচে পড়ে, স্মৃতিঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাইরের দিকে; এমনকি কখনও আশপাশ প্লাবিত করে। কিন্তু তারপরও কি পুরোপুরি চোখে পড়ে সেই রক্তক্ষরণ?
আরও অনেকদিন যাবে… তখন এই স্মৃতিমালা কেবল স্মৃতিমালা থাকবে না, কেউ তার মধ্যে দিয়ে সময় ও সমাজকে দেখবেন, কেউ শৈশবের নৃতত্ত্ব দেখবেন, কেউ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ও জীবনাচার দেখবেন, কেউ নগরায়নের হিংস্র থাবায় পরিবেশের বিপণ্নতার যন্ত্রণা খুঁজে পাবেন (অথবা, অস্বীকার কি করা যাবে, এখনও চাইলে সেরকমভাবে দেখা সম্ভব?)… কিন্তু তবু সন্ধ্যায় পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয় ভেঙে পড়ার শব্দ শোনার জন্যে,পুরানো বই আর পুরানো শাড়ির ভাঁজে জমে ওঠা রহস্যময় গন্ধটুকুর জন্যে, আঁধার ভালোলাগা দিনগুলির জন্যে ভালোবাসা নিয়ে এরকম সব স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে বেদনার গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ডেকে আনবে
আলম খোরশেদ - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ (১২:৩৪ অপরাহ্ণ)
বহুদিন পর এমন ‘সরস-সুরেলা-সরমাখনে পূর্ণ’, বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানার ভিয়েন-দেয়া স্মৃতিচারণ পড়তে পেরে উদর-মন দুটোই ভরে গেল। অচেনা এই সুনিপুণ লিখনশিল্পীকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। ধন্যবাদান্তে, আলম খোরশেদ
পুনশ্চ: ’অভিজ্ঞান’ শব্দটির সঠিক প্রয়োগটুকু একটু দেখে নিতে অনুরোধ করি এই প্রবল ভাষাসচেতন লেখককে।