তিন রাউণ্ড গুলি খেলে তেইশজন মরে যায় লোকে এত বজ্জাত হয়েছে!
স্কুলের যে ছেলেগুলি চৌকাঠেই ধ্বসে গেল অবশ্যই তারা ছিল সমাজবিরোধী।ওদিকে তাকিয়ে দেখো ধোয়া তুলসীপাতা
উলটেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই জানে না বুলেটেরা
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দেখে মাঝে মাঝে।পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।
শঙ্খ ঘোষ, ‘ন্যায়-অন্যায় জানিনে’
গার্মেন্টস-মালিকদের বিরুদ্ধে আবারও ষড়যন্ত্র হচ্ছে! গত শনিবার টঙ্গী শিল্প এলাকায় ২ জন (মতান্তরে ৪ জন) শ্রমিকের নিহত হওয়ার ঘটনা সেই ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ! বিজিএমইএ-র কর্তারা বলেছেন নাশকতা, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় শ্রমিকেরাই এই নাশকতার জন্ম দিয়েছে। তারা ভয়াবহ পরিকল্পনা আর ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। কোনো-কোনো পত্রিকার মতে দুই মাস, শ্রমিকদের দাবি ছয় মাস বেতন পাননি তারা। গত শুক্রবারও গার্মেন্টসটিতে রাত অবধি তারা কাজ করেছেন। শ্রমিকদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, ১০ নভেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। তাই বেতন না পেয়েও তারা রাস্তায় নামেননি। বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেননি। কিন্তু গত শনিবার কারখানার গেটে এসে শ্রমিকেরা যখন জানতে পারলেন গার্মেন্টস বন্ধ, তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তারা। মালিকেরা আগেই পুলিশকে জানিয়ে রেখেছিল। কেবল শ্রমিকেরা জানতেন না কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা বেশ দায়িত্বের সাথেই গার্মেন্টসটি পাহারা দিয়েছে। শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে — এ-কথা তো জানাই ছিল। কিন্তু তা-ই বলে গুলি খেয়ে মরবে! বিজিএমইএ-র নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে নাশকতার অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলেছেন, আইন মেনেই কারখানা লে-অফ করা হয়েছে। তাদের আইন অনুযায়ী লে-অফের আগে শ্রমিকদের জানানোর প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এদেশের আইন গার্মেন্টস-মালিকদের যা খুশি তা-ই করার অধিকার দিয়েছে। আর সেটা যাতে তারা নির্বিঘ্নে করতে পারেন, সেজন্য রাষ্ট্রের পুলিশ, বিচার বিভাগ, সান্ত্রী-সেপাই, আমলা-কামলা সব, সবাই তাদের সেবায় নিয়োজিত। তাই হুট করে এভাবে শ্রমিকদের মরে যাওয়ার ঘটনায় সকল পক্ষই যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাবে, তা আর বিচিত্র কী!
দৈনিক পত্রিকাগুলোতে চোখ বোলালে মনে হয়, এসব ঘটনায় শ্রমিকেরা কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙে, কারখানায় আগুন দেয়। যে-কোনো শ্রমিক-সংঘর্ষের সংবাদ পাঠ করলে শ্রমিকদের একটা নৈরাজ্যকর চেহারা পাঠকের মনে স্পষ্ট হয়। গত শনিবারের ঘটনাও দৈনিক পত্রিকাগুলো কম-বেশি তেমনভাবেই তুলে ধরেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, পুলিশ শ্রমিকদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, টায়ার পোড়ায়, ইট-পাটকেল ছোড়ে, বাসে আগুন দেয়। শ্রমিকেরা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বলে দৈনিকটি উল্লেখ করে। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা অনেকটাই চাপা পড়ে যায় এসব বিবরণের নীচে। কেবল তা-ই নয়, শ্রমিকেরা একজন পুলিশ কর্মকর্তার মোটর সাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে নর্দমায় ফেলে দেয় — এমন তথ্য পাঠকদের জানাতে ভুল করে না পত্রিকাটি। পাঠকের হয়তো মনে হতে থাকবে, তা-ই তো, এত দুঃসাহস! স্থানীয় বাস্তুহারা পল্লীর হাজার-হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সাথে এক হয়ে পুলিশের উপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাও অজানা থাকে না পাঠকের। তবে শ্রমিক-এলাকায় অবস্থিত বাস্তুহারা পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যালয়ের স্টিলের দরজায় গুলির চিহ্ন ছিল বলে প্রতিবেদনের শেষ দিকে এসে জানতে পারে পাঠক। পুলিশ শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে কি না এ-প্রতিবেদন পড়ে তা কোনোভাবে জানা যায় না। তাহলে শ্রমিকেরা কার গুলিতে প্রাণ দিলেন? অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ধীরে ধীরে শিকড় গাড়তে থাকে পাঠকের মনে। নিপ্পন পোশাক কারখানার শ্রমিক রোকসানার ভ্যানচালক স্বামীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে বলে তার অভিযোগ। রোকসানার কান্নায় এলাকার মানুষ পথে নেমে এলেও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের নীচে চাপা পড়ে গেছে তার হাহাকার। সে-হাহাকার এদেশের ক্ষমতাবান মানুষের সরকারের কানে পৌঁছেনি। ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে বাস্তবভিত্তি দিতেই কি তৈরি করা হয়েছে দুই মহিলা পুলিশের নিখোঁজ হওয়ার গল্প? রোকসানা তার নিহত স্বামী বাবলু শেখের (৪০) লাশও দেখতে পাননি। কারখানায় গোলমালের খবর পেয়ে রোকসানাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে গিয়ে নিহত হন তিনি। শ্রমিকদের অভিযোগ, কেবল বাবলু নয়, পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। নিহতদের লাশ গোপনে পুলিশের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। অথচ শনিবার মধ্যরাত অবধি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টঙ্গীর ঘটনায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
ক্রন্দনরত রোকসানার ছবি দৈনিক পত্রিকাগুলোর কল্যাণে ইতিমধ্যে পাঠকেরা দেখে থাকবেন। অনুমান করা যায়, তার বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর ঘরে। কত বেতন পেতেন তিনি? এক হাজার, বারশো কিংবা দুই হাজার? স্বামী ছাড়া কে কে ছিল তার সংসারে? না, এসব জানার উপায় নেই এখন। রোকসানা এদেশের ২০ লক্ষ গার্মেন্টস-শ্রমিকদের একজন। এ-তথ্যটুকুই শুধু আমরা জানি। ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে সার-সার মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় রোকসানাকে কেউ না কেউ দেখেছে। দেখেছে আবার ভুলে গেছে। এমন তো আমরা হররোজই দেখি। দেখি কারখানার গাড়ির জন্য অপেক্ষারত কান্ত-বিধ্বস্ত চেহারাগুলোকে। দেখি অথচ ভুলে যাই। ভুলে যাই সে-সব মানুষের কথা, যারা ভোর থেকে রাত অবধি নিজের রক্ত দিয়ে গেঁথে তোলে আমাদের পরিধানের পোশাক। সে-পোশাক গায়ে দিয়ে কখনও কি কোনো বস্ত্রবালিকার কথা ভেবেছি?
গত রোজার ঈদের আগের কথা। আমাদের প্রত্যেকের হাতে যখন ঈদের নতুন জামাকাপড়ভর্তি শপিং ব্যাগ, তখন খবর এল বিজিএমইএ-কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে তিন হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়েছে। এ-টাকা না পেলে তারা শ্রমিকদের ঈদে বেতনভাতা-বোনাস কিছুই দিতে পারবে না। কারণটা না কি বিশ্বমন্দা! অথচ এই ঘোষণা দিয়েই বিজিএমইএ-নেতৃবৃন্দ সদলবলে চলে গেলেন হজে। শ্রমিকদের বেতনভাতা দেওয়ার টাকা নেই, কিন্তু হজ তো ফরজ কাজ!
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ ফেরত না দিয়ে গার্মেন্টস-মালিক হয়েছেন যারা, আজ তাদের রক্ষায় মরিয়া রাষ্ট্রযন্ত্র। টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু সে-সত্যটাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দৈনিক পত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতেও গার্মেন্টস-শিল্প যায় যায় বলে রব তোলা হয়। এদের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন দিলে বিরাট ক্ষতির শিকার হবে এদেশের গার্মেন্টস-শিল্প। তাই শ্রমিক আন্দোলনকে প্রায়শ চিত্রিত করা হয় এনার্কি হিসেবে। শ্রমিকদের নিহত হওয়ার ঘটনাকেও তাই অনেক তরল করে আনার চেষ্টা থাকে। রাজধানীর একটি সংবাদ সংস্থা গতকাল খবর দিয়েছে, শ্রমিকেরা না কি পুলিশের টিয়ার সেলে নিহত হয়েছে। কবে থামবে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার? আসুন, ষড়যন্ত্রের গন্ধ না খুঁজে আমরা ভালো করে একবার রোকসানার দিকে তাকাই। শূন্যে দু’হাত তুলে ধরে ও কী বলতে চাইছে তা শোনার চেষ্টা করি।