এক.
জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে,- ঠিক এরকম আশঙ্কাই জেগেছিল যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবি ক্রমাগত জোরদার হওয়ার ঘটনা থেকে; এখন দেখা যাচ্ছে গ্রেফতার হওয়ার আগে-আগে জামাত নেতা কামারুজ্জামানও ওরকমই বলে গেছে, দলের কর্মীদের প্রতি সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে পরোক্ষে ওরকম এক নির্দেশই রেখে গেছে। ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর পত্রিকার সঙ্গে ওই আলাপচারিতায় কামারুজ্জামান বলেছে, নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের জন্যে তারা আইনি পন্থাই অবলম্বন করবে, তবে সরকার যদি তাদের হয়রানি করে তা হলে বলা যায় না, তরুণ অনুসারীরা চরমপন্থা বেছে নিতে পারে। কামরুজ্জামান আরও বলেছে, এরকম স্পর্শকাতর ইস্যুতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। এমনও হতে পারে যে, এদের অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে।
অবশ্য ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটরের কাছে কামারুজ্জামান এরকম আশঙ্কা প্রকাশের অনেক আগে থেকেই আমরা দেখে আসছি, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। জেএমবির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক খুবই সুস্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লারা খুনি হওয়ার দীক্ষা নিয়েছিল; আর উত্তরসূরি শিবিরপ্রজন্মের জন্যে তারা রগকাটার প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয় জেনে উন্মুক্ত করেছিল জেএমবি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগের কোনও কোনও নেতা যতই শিবিরপ্রজন্মকে ছবক দিন না কেন, তোমরা তো বাবা যুদ্ধাপরাধী নও, তোমরা কেন, এইসব যুদ্ধাপরাধীদের দায় নিতে যাবে- এসবই বিফলে যাবে; কেননা যুদ্ধাপরাধীরা তাদের মতো করেই প্রস্তুত করেছে তাদের পরবর্তী বাহিনীকে।
কামারুজ্জামানের এই কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা চান, তাদের কাজের পরিধি আরও বেড়ে গেছে। কামারুজ্জামান গ্রেফতারের আগে ঘোষণা দিয়ে গেল, আচানক হামলা হবে, একাত্তরের মতোই; আবারও আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক মানুষগুলিকে রাতের অন্ধকারে অথবা দিনের আলোতেই গুপ্ত হামলা চালিয়ে হত্যা করা হবে, যুদ্ধাপরাধী পালের গোদাগুলিতে বাঁচানোর জন্যে তাদের চেলারা মাটির নিচে চলে গেলেও যতটুকু করা সম্ভব সব টুকুই করবে।
তাই এদের যদি আমরা থামাতে চাই, আমাদেরও সঠিক প্রস্তুতি নিতে হবে। শান্তির ললিত বাণী কখনো কখনো ব্যর্থ পরিহাস হয়ে ওঠে, আমাদের বোধহয় আমরা অচিরেই সেরকম এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, মুখে জামায়াতে ইসলামী যতই বলুক না কেন- যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে, আসলে সবচেয়ে বেশি রাজনীতি তারাই করেছে, তাই সব রকম রাজনৈতিক প্রস্তুতিই তাদের নেয়া হয়ে গেছে। এমনকি ভূ-গর্ভে গিয়ে রাজনীতি করার মতো যাবতীয় প্রস্তুতিও তারা নিয়ে ফেলেছে- তাদের তরুণ সদস্যদের তারা প্রস্তুত করেছে জঙ্গি তৎপরতার জন্যে।
দুই.
জামায়াতে ইসলামীর ওই প্রস্তুতির তুলনায় মতিউর রহমান নিজামীসহ পাচজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতারের ঘটনায় আমাদের চোখে-মুখে-মনে যত আনন্দই জাগুক না কেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকার এগুচ্ছেন একেবারেই নড়বড়ে পথ ধরে। এমনকি আমরা যারা এ বিচার চাই, বামপন্থী যে-সব দল এর বিচার চান, তাদের প্রস্তুতিও খুবই সামান্য। প্রস্তুতি সামান্য, কিন্তু প্রত্যাশা বিশাল। যে সত্যটি এখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটি হলো, এইসব গ্রেফতারের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালের কোনও ভূমিকা নেই। অন্য কথায়, এসব গ্রেফতারের ভিত্তি খুবই দুর্বল এবং এর ফলে আমরা বড় জোর এইসব যুদ্ধাপরাধীকে বড় জোর কয়েকমাস রিমান্ডে আনানেয়ার টিভিচিত্র ও সংবাদ পাঠ করতে পারব; কিন্তু শেষমেষ এরা সবাই জামিন পেয়ে যাবে।
এইসব গ্রেফতার প্রায় ৪০ বছর ধরে বিচারের আশায় অপেক্ষারত মানুষকে আনন্দিত করেছে, মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ঘুরতে দেখে অপমান ও ক্রোধে অবনত জনগণকে উদ্বেলিত করেছে, তাদের মনে এই আবেগ আরো দানা বেধেছে যে এদের বিচার করা সম্ভব এবং বিচার হতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, এর ফলে যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুটি আরও প্রলম্বিত হওয়ার এবং একে ঘিরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে জল ঘোলা করার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এইসব গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী কোনও প্রস্তুতি থাকুক বা না-থাকুক, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অঘোষিত এক যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। আর বলাই বাহুল্য, আমরা যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইছি তারাও এ পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েছি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলাকে এ-সরকার এত বেশি গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতে প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্যে কবর থেকে আবুল ফজল আর নাজমুল করিমকে তুলে এনে মানবধর্ম বই আর ধর্ম ও বিজ্ঞান নিবন্ধ লেখার অপরাধে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার দুয়ার পর্যন্ত খুলে গেল, আরজ আলী মাতুব্বরের কথা তো বলাই বাহুল্য। হুমায়ূন আজাদ পরিহাস করে এরকম একটি কথা লিখেছিলেন যে, এ শতাব্দীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হলো ধর্মীয় অনুভূতি- সামান্য স্পর্শেই এরা থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। তার সেই থরথরে কাঁপুনি থামানোর পয়লা পদক্ষেপ হিসেবে মামলা করে রিমান্ডে নেয়ার পথটি বাতলে দিল আওয়ামী লীগ সরকার।
তিন.
হতে পারে, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গ্রেফতারের বিকল্প কোনও পথ সরকারের সামনে খোলা ছিল না। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে-অঙ্গীকারগুলি করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঙ্গীকারটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। এটি স্পর্শকাতর কেবল এই জন্যেই নয় যে, এটি একটি প্রায়-কঠিন কাজ, যেটি সম্পন্ন করার জন্যে একদিকে প্রয়োজন রাজনৈতিক কমিটমেন্টের, অন্যদিকে প্রয়োজন আইনের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্যের। এটি স্পর্শকাতর এ কারণেও যে, এই দাবিটি মূলত তরুণ ভোটারদের দাবি, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তারুণ্যের তীব্র আবেগ এবং সেই আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারের প্রত্যাশায় নিভৃতে কেঁদে ফেরা পূর্বপ্রজন্মের অবরুদ্ধ গ্লানি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে এখন আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্টের কথাও ভাবতে হচ্ছে,- কেননা অন্যান্য দেশের যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল, আমাদের দেশের পরিস্থিতি তা থেকে একেবারে আলাদা। আর কোনও দেশেই যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, তাই তাদের বিচার করার ক্ষেত্রে সেসব দেশের সরকারকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সাড়ে তিন যুগে তারা এত বড় এক রাজনৈতিক দানব হয়ে উঠেছে যে, আমাদের তাদের কাছ থেকে পাল্টা রাজনৈতিক হুংকার শুনতে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে এই দানবরা তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার কেচ্ছা শুনাচ্ছেন। সঙ্গতকারণেই দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত বিচার কাজের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার আগেই সরকারকে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে তীব্র এক প্রতিকুল রাজনৈতিক প্রচারণার মুখে। যে রাজনৈতিক প্রচারণাকে সামাল দেয়ার একটাই পথ- অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো। কিন্তু এটুকুতেই সরকার রেহাই পাবেন ভাবলে ভুল হবে। তিন যুগ ধরে যুদ্ধাপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে, অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে। সরকারকে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হলে এইসব ভিত্তি থেকে যে-প্রতিরোধ আসতে শুরু করেছে বা আসবে, সে-সবও প্রতিরোধ করতে হবে।
আর শুধু সরকার কেন, সরকারের সঙ্গে যত রাজনৈতিক বিরোধই থাকুক না কেন, আমরা যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, তাদেরও এই প্রতিরোধের শিকার হতে হবে এবং তাই পাল্টা প্রতিরোধের দিকটি চিন্তা করতে হবে। তা না করে, যদি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা যুদ্ধাপরাধ বিচারের খেলা দেখতে থাকি, তা হলে পরে হয়তো যুদ্ধাপরাধ বিচারে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আমরা খুব ভালো ভালো অনেক জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে পারব, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কখনোই করতে পারব না। বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার জন্যে যারা অপেক্ষা করছেন, করতে থাকুন; আওয়ামী লীগকে ভাবে হোক আর চাপে হোক যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্যে বাধ্য করাটাই এখন হওয়া উচিত বিচারাকাঙ্ক্ষীদের মৌলিক কাজ। কেননা, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, ভবিষ্যতে সরকারগঠনের উপাদান রয়েছে এমন অন্য কোনও রাজনৈতিক দলেরই যুদ্ধাপরাধ বিচারের এজেন্ডা নেই। যুদ্ধাপরাধ বিচারের ব্যাপারে বিএনপির এজেন্ডা তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধনের মধ্যে দিয়েই বোঝা গেছে- ২০০৯ সালে দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের দলের সদস্যপদ দেয়ার পথ নিশ্চিত করতে এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধযুক্ত ধারাটি গঠনতন্ত্র থেকে বাতিল করেছে। এর মধ্যেই তারা জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে তাদের সাংগঠনিক অবস্থানটি আরও সুনিশ্চিত হবে।
চার.
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। যুদ্ধাপরাধীরা আত্মগোপনে ছিল, গোলাম আযমদের মতো বড় বড় সাপগুলি বিদেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্যে আন্দোলনে নেমেছিল আর ছোট ও মাঝারি গোছের নেতারা যোগ দিয়েছিল ন্যাপ, জাসদের মতো দলগুলির কর্মীদলে, গোপন রাজনীতিতে যুক্ত দলগুলিতে, এমনকি আওয়ামী লীগেও। জাসদ ও সর্বহারা পার্টির মতো অনেক সংগঠন তখন শক্তিশালী ছিল, তার অনেক যৌক্তিক কারণও ছিল। কিন্তু এ-ও সত্য যে, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধিতাকারীরা তখন সব রাজনৈতিক দলগুলিকেই রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করেছে। আদর্শের জায়গাটি ছিল অনেক বড়, কিন্তু ভারতবিরোধিতার শ্লোগানটিই তাই বড় হয়ে উঠেছে এসব দলের প্রচারণা থেকে। বিপরীতে আওয়ামী লীগও বেছে নিয়েছিল অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী পথ- মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে যে-সহিষ্ণুতা দেখানো দরকার ছিল, আওয়ামী সীমাহীন ঔদ্ধত্য নিয়ে তার বিপরীত দিকে যেতেই আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। অনিবার্য কারণেই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে চূড়ান্ত স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিতেই দেখা গেল, আওয়ামী বিরোধিতার জন্যে যারা মাঠে নেমেছিল, তাদের সংগঠনের ঝুলি শূন্য হয়ে পড়ছে, অনেকেই সটকে দৌড় দিচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দলে। যারা ধর্মের ব্যাপারে পুরোপুরি ভেজেটারিয়ান ছিলেন না, তারা যোগ দিয়েছিলেন বিএনপিতে। ভূ-গর্ভস্থ রাজনীতিতে তখন কতটুকু পচন ধরেছিল তার উজ্জ্বল সাক্ষী বিএনপিতে যোগদানকারী চৈনিক বাম নেতারা।
এখন যুদ্ধাপরাধী বিচারের পথে জামায়াত ও জামায়াতের মতো দলগুলির রাজনৈতিক সাংগঠনিক কার্যক্রমে যে-ধ্বস নামবে তা সামলানোর জন্যে তাদেরকে যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের মতোই অন্য কোনও দলের ওপর ভর করতে হবে। ভেতরে ভেতরে তারা থাকবে পুরো মিলিট্যান্ট, কিন্তু প্রকাশ্যে কাজ চালানোর জন্যে প্লাটফরম হিসেবে ব্যবহার করবে অন্য কোনও দলকে। বাংলাদেশে এখন সেরকম যোগ্য সংগঠিত দল মাত্র একটিই বলতে হবে- আর সেটি হলো বিএনপি। অচিরেই বিএনপির মিছিলমিটিং-গুলি অনেক বড় হতে শুরু করবে। মান্নান ভূইয়া যত সুস্থ হচ্ছেন, খালেদা জিয়া তত স্বস্তি পাচ্ছেন আবেগের বশে সেই রাতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেননি বলে। যুদ্ধাপরাধীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন। কেননা মান্নান ভূইয়া বুর্জোয়া রাজনীতিতে মিশে গেলেও তাদের জন্যে তত স্বস্তিকর ছিলেন না। বিএনপিতে জামাতবিরোধী যে ক্ষীণ ধারা ছিল, তা এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। নতুন এ পরিস্থিতি পুরো বিএনপিকেই গিলে খাবে। এই পরিস্থিতিতে কোনও কোনও বামদলেও জোয়ার দেখা দিতে পারে। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায়, যুদ্ধাপরাধী বিচার ভূ-গর্ভস্থ রাজনীতির খপ্পরে পড়তে চলেছে।
এই ভূ-গর্ভস্থ রাজনীতি যাতে আমাদের আর্সেনিক-আক্রান্ত করতে না পারে, সেজন্যে এখন থেকেই সক্রিয় হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলিকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। বামপন্থীদের একাট্টা হতে হবে। বামপন্থী দলগুলি যদি ছাত্রবেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে যে-কোনও সরকারের শাসনামলে অনমনীয় রাজপথমুখী হয়ে উঠতে পারে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে কেন পিছিয়ে থাকবে? আওয়ামী লীগ সরকারকে শুধু চাপের মুখে রাখার জন্যেই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের যে-অংশটি আন্তরিকভাবেই বিচার চায়, তাদের স্বস্তি দেয়ার জন্যেও বিচারের দাবিতে সবার সোচ্চার হওয়া আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১২ comments
সৈকত আচার্য - ১৬ জুলাই ২০১০ (৫:৫২ অপরাহ্ণ)
অবিশ্রুত লিখেছেনঃ
১। এই কথাটা সর্বাংশে সত্য। এর বিপদ টের পাওয়া যাবে, একদিন। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এর মর্ম উদ্দ্বার করার বোধ-বুদ্ধি ও চেতনা আমরা মনে হয় হারিয়ে ফেলছি। ভোটের জন্য গণতান্রিক সেক্যুলার শক্তির উপর নির্ভর করতে পারি। কিন্ত এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্টিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে হলে এই শক্তির উপর ভরসা হয় না। কেন? তাদেরই বটিকা জাতিকে সেবন করানোটা ক্ষ্ণণিকের জন্য অনেকের কাছে স্বস্তিদায়ক হলেও এর মাধ্যমে মৌলবাদ-এবং উগ্র-সাম্প্রদায়িকতাকে কি আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি না?
২। আমলাদের বুদ্ধিতে দলীয় রাজনীতি এগুচ্ছে। মানুষের কাছাকাছি থেকে রাজনীতি করা নেতাগণ এখন তফাতে আছেন। এটা একটা মৌলিক পরিবর্তন এবং নেতিবাচক প্রবনতা। ক্ষমতার কাছে থাকা প্রগতিশীল রাজনীতি কোণঠাসা হওয়ার এটিও হয়তো একটি কারন। শুনেছি, কিছুদিন আগে, এক প্রধান আমলা বলছেন, “বংগবন্ধু পরিবার-ই এদেশে ইসলাম প্রতিষ্টিত করার জন্য সবচাইতে বেশি কাজ করেছেন” -জাতীয় চরম দায়িত্বহীন, মোসাহেবি ও ক্ষতিকর উক্তি! এই একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে, আমাদের দেশে। মানে হলো, এসো ধর্ম নিয়ে নেমে পড়ো। কারন এই পথ সোজা। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নেতার বিকল্প কোন ভাবেই ‘আমলা’ হতে পারে না। এরা রাজনীতিকে একবার গাইড করতে শুরু করে দিলে, রাজনীতির বারোটা বাজতে খুব দেরি হবে না।
৩। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ঠিক কিভাবে এগুতে চায়, তার রোডম্যাপটা মানুষের কাছে পরিস্কার নয়। এই কারনে সাম্প্রতিক গ্রেফতারগুলো ঠিক কিভাবে সরকার দেখছেন বা এনিয়ে তাদের সমন্বিত কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা রুপরেখা আছে কিনা তা মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। তাছাড়া বিভিন্ন সিভিল-সোসাইটি গ্রুপগুলোর কাছেও বিষয়টি ঠিক পরিস্কার নয়। এই বিচারের বিষয়টী খুব পপুলার। কিন্ত প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মানুষকে এখানে সম্পৃক্ত হতে দেয়া হচ্ছে না। এটাও কি জনবিচ্ছিন্ন আমলা বুদ্ধিতে হচ্ছে নাকি রাজনৈতিক-সংকল্পে চিড় ধরতে শুরু করেছে। যেন আড়ালে আবডালে কোন ভয়াবহ খেলা শুরু হয়েছে। একারনে গুজব এবং সন্দেহগুলো বাড়ছে। এই বিচারের ক্ষেত্রে, সরকারের প্রস্ততি নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রবল সংশয় দেখা দিয়েছে। এত বড়ো একটা কর্মযজ্ঞে সরকারের স ম ন্ব য় হী ন তা চোখে পড়ার মতো। কি হতে যাচ্ছে আসলে?
অবিশ্রুত - ১৭ জুলাই ২০১০ (৬:২৮ পূর্বাহ্ণ)
এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। সরকার বিভিন্ন ইসলামী পাঠাগারগুলি থেকে বই প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। আমাদের সময়-এ এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট :
এই সিদ্ধান্তের একটি ইতিবাচক দিক অবশ্যই আছে; কিন্তু তা পেতে-পেতে আমাদের সময় অনেক লেগে যাবে। সংগঠনগুলি যদি কর্মশালা ও বিবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রচারে নামে, মওদুদীবাদের অন্যায্যতা ও হিংস্রতাগুলি তা হলে সম্ভব অনেক অপপ্রচারকে ঠেকিয়ে দেয়া।
মওদুদীর বই বাতিল হওয়া নিয়ে বিবিসি-র প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে:
তবে এইসব বইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও সরকারের উচিত হবে না এগুলি বাতিল করা- বরং এগুলিকে বার বার নানা ভাবে উপস্থাপন করা উচিত, কীভাবে আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে ধর্মের অপব্যবহার করা হয়েছে, তার উদাহরণ হিসেবে। কয়েক পর্বের সুন্দর টিভি ডকুমেন্টারিও তৈরি করা সম্ভব এসব অপব্যাখ্যা ও ধর্মের অপব্যবহারগুলির দৃষ্টান্ত দিয়ে।
শোয়েব মুহাম্মদ - ১৬ জুলাই ২০১০ (৮:৩০ অপরাহ্ণ)
জামাত শিবিরের আন্ডার-গ্রাউন্ডে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। তারা আন্ডার-গ্রাউন্ডে গেলে তারা খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হবে, লাভের কিছুই হবে না। সেই ক্ষেত্রে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে আসা তাদের জন্যে সম্ভব হবেনা। তারা জেনে শুনে এ আত্নঘাতি সিদ্ধান্ত নিবেনা। নির্যাতন চালিয়ে, ফাঁসি দিয়ে, জেল দিয়ে কোন আদর্শ কে নির্মূল করা যায়না। জামাত-শিবির খুব সহজে নির্মূল হবেনা। আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলেই তারা আবার পুরো শক্তিতে ফিরে আসবে, যেমনটি এসেছিল ৭৫ পরবর্তি সময়ে।
অবিশ্রুত - ১৭ জুলাই ২০১০ (৬:৪০ পূর্বাহ্ণ)
জামাত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে কি না সেটি ভবিষ্যতই বলে দেবে, তবে এরকম একটি পরিপ্রেক্ষিত যে তৈরি হয়েছে এবং জামায়াতের নেতারাই সে কথা জানান দিচ্ছে, সে তথ্যের ভিত্তিতেই এই লেখা। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, সিদ্ধান্তটি জামায়াতের জন্যে যত না আত্মঘাতী, তারচেয়েও বেশি সর্বনাশা বিএনপি-র জন্যে। কেননা এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী নামক পার্টির নাম ও কর্মকাণ্ড আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেও,প্রকাশ্যে তারা তাদের সাংগঠনিক কর্ম করবে বিএনপির প্লাটফরমে দাড়িয়ে। এটি তাদের পুরানো টেকনিক।
আর একটি কথা আছে- অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে কিন্তু ক্ষুদ্র তেলাপোকা এত কিছুর পরও বাঁচিয়া রহিয়াছে… জামায়াতে ইসলামী বেঁচে থাকবে সেই ক্ষুদ্র তেলাপোকার মতো। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকার বা না-থাকার নয়,বিষয়টি মুক্তচিন্তা চর্চা করার। আসলে ১৯৭৫-এ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার আগে থেকেই ধর্মবাদী রাজনৈতিক দলগুলি তৎপরতা ফিরে চাইতে শুরু করেছিল। কেননা বিপরীত চিন্তাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি ইতিবাচক রাজনীতির ধারা।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মাসুদ করিম - ১৭ জুলাই ২০১০ (৪:২১ অপরাহ্ণ)
সম্প্রতি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বাঙালির একটা ভাল সংজ্ঞা দিয়েছেন, তারাই বাঙালি যারা পাকিস্তানের শত্রু। বেনজিরের হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তান কিছুটা বিহ্বল ছিল, তার গতি শ্লথ হয়েছিল কিছুটা, কিন্তু বোম্বে আক্রমণের পর থেকেই পাকিস্তান গতিশীল ও উদ্ধত। শত্রুরা যখন তাদের গতি ফিরে পেয়েছে তখনই আমরা বাঙালিরা খুব বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। এই সমূহ বিপদের ভেতর ‘যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতা বিরোধী অপরাধ’ এর বিচার বাঙালির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেচ্যালেঞ্জে বাঙালির দিশাহারা হওয়ার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। কিন্তু এই বিচারপ্রক্রিয়ার দাবির মধ্যে বসবাস আমাদের গণমাধ্যম ও গণবাস্তবতাকে যদি কিছুটা হলেও আলোড়িত ও লক্ষ্যভেদী করতে পারে তাই হবে আমাদের জন্য একটা বড় পাওয়া। ভূতলবাসী যে হবার সে হবেই, আমাদের বাঙালি জীবনের দুর্দশার বিভৎসতা যদি আমাদের আরো আঘাতের সম্মুখীন করে তবে তা হতেই হবে। ইতিহাস ও ভবিষ্যতের পথে তির্যক উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই।
নীড় সন্ধানী - ১৭ জুলাই ২০১০ (৫:২৩ অপরাহ্ণ)
সরকার একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা। সরকারের হাত অনেক লম্বা। আন্তরিক হলে পাতাল থেকেও খুজে আনতে পারে যে কোন সন্ত্রাসীকে। বাংলাদেশ অতি ঘনবসতি পূর্ণ দেশ। এখানে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো দুর্গম গিরি পর্বত নাই। লুকানোর জায়গা হলো নদী নালা খালবিল আর বস্তিবাসি জনগনের ভিতরে। জনগনের ভেতর তাদের অবস্থান খুবই নাজুক। সুতরাং সরকার চাইলে যে কোন আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থা থেকে জামাত শিবিরের তথাকথিত আন্ডারগ্রাউন্ড খুড়ে ফেলতে পারে। পালিয়ে পাশের ভারতে বার্মায় গিয়েও সুবিধা করতে পারবে না। সুতরাং কামারুজ্জমানদের আন্ডারগ্রাউন্ড চাপাবাজি হুমকিতে ভীত না হয়ে জেএমবি সহ যত ইসলামী দল আছে সবগুলার উপর একসাথে ধোলাই নাজেল করতে হবে।
কিন্তু সে কাজই করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষকে সাথে রাখতে হবে। ষোল কোটি মানুষের দেশে দু চার লাখ জামাতীকে সাইজ করার তেমন ব্যাপার না। তাই এখন থেকে জামাত শিবির জেএমবি সন্দেহজনক লিষ্ট তৈরী করে হিটলারের ফরমূলায় স্টাডি করা যেতে পারে। সফলতার সম্ভাবনা ধনাত্মক।
kamruzzaman Jahangir - ১৯ জুলাই ২০১০ (৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ)
আপনার লেখাটি বেশ ভালো লাগল।
অনিবার্য কারণেই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে চূড়ান্ত স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াতে হয়েছে।
এই অংশটুকুই ঠিক বুঝতে পারছি না! তাহলে অনিবার্য কারণ আর চূড়ান্ত স্বৈরাচার এই দুই অবস্থানের কোন্ দিকে আপনি আছেন এবং কেন?
আপনি অনিবার্য কারণ বলতে বোঝাচ্ছেন সশস্ত্র বিপ্লবীদের উত্থান? আপনি কি এই দিকটা ভেবেছেন, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এই শক্তির এমন প্রবল উত্থান কেন হল? জনসংস্কৃতির এমন কি পরিবর্তন হল বা মানুষের এমন কি আকাঙক্ষা ছিল যা তৎকালীন সরকার ধরতে চাননি বা আমলেই আনেননি?
অবিশ্রুত - ১৯ জুলাই ২০১০ (৭:২২ অপরাহ্ণ)
অনিবার্য কারণ বলে আমি কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রেণীচরিত্রের সংকটকেই বুঝাতে চেয়েছি- তার মানে এই নয়, ওই অবস্থানকে সমর্থন করেছি। আমি বলতে চেয়েছি, যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি আওয়ামী লীগ নিতে পারত, সেসব না নেয়ার অনিবার্য ফল হিসেবে একের পর এক আরো বেশি স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপের দিকে তাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
সশস্ত্র বিপ্লবীদের উত্থান এবং তৎকালীন রাজনীতির সমস্যাগুলি বোধহয় এখানে বিস্তৃতভাবে আলোচনার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে বামপন্থী রাজনীতিকদের রণনীতি-রণকৌশল, সমাজ বিপ্লবের স্তর বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এবং পরবর্তী সরকার সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন ইত্যাদি অনেক প্রসঙ্গ আসবে। আমি এ লেখাটিতে এটুকু বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই যে, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেকেই তখন কি বুর্জোয়া, কি বামপন্থী, কি সশস্ত্র বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী বিভিন্ন দলের পতাকার নিচে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাতে বুর্জোয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন দোদুল্যমানতা এসেছে, বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রেও আপোষকামীতা এসেছে। এবং এসবের মূল্যও এখন পর্যন্ত কী বামপন্থী, কী বুর্জোয়া সবাইকেই দিতে হচ্ছে। ধর্মবাদী রাজনীতির প্যাটার্নটিকে সবাই ব্যবহার করতে চাইছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাই মৌলবাদীতে পরিণত হচ্ছেন।
আর সশস্ত্র বিপ্লবীদের উত্থান পূর্ববাংলায় স্বাধীনতার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তার একটি আদর্শিক রূপও ছিল। স্বাধীনতার পর সশস্ত্র বামদের তৎপরতা তীব্রাকার ধারণ করলেও জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামল শুরু হওয়ার পর, ধর্মবাদী রাজনীতিকে অনুমোদন করার পর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে স্তিমিত হয়ে পড়ে, গোপন বাম রাজনীতিকদের একটি বড় অংশ বিএনপি’র ধর্মবাদী বুর্জোয়া রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আস্থা স্থাপন করে এবং সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, ক্রমশ তা আদর্শিক রূপ হারায়। ১৯৭৫ অবধি ধর্মীয় রাজনীতি করার অধিকার না থাকায় ধর্মবাদী নেতা ও মাঝারি কর্মীরা বামপন্থী রাজনীতির কাঁধে ভর করার ফল কী দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে এখনো কেউ আলোচনা করেননি, তবে বিষয়টি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।
এটুকু বুঝি, স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র তখনকার মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল, সে কারণে আওয়ামী লীগকেও সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হতো, বামরাও বলত।
রায়হান রশিদ - ২০ জুলাই ২০১০ (১১:৩৭ অপরাহ্ণ)
মাওলানা মওদুদীর বই নিষিদ্ধ করা নিয়ে পাকিস্তানর ডন পত্রিকার সম্পাদকীয়:
হতাশাব্যঞ্জক!
জঙ্গি এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ক্রিস ব্ল্যাকবার্ণ সম্পাদকীয়টির একটি প্রত্যুত্তর দিয়েছেন একই পত্রিকায় সম্পাদক বরাবরে:
মোহাম্মদ মুনিম - ২০ জুলাই ২০১০ (১২:৪১ পূর্বাহ্ণ)
আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি তো জামাতের জন্য নতুন কিছু নয়, জেএমবির মাধ্যমে তারা বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের রাজনীতির একটা চরমপন্থী ধারা শুরু করেছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এবং সামরিক বাহিনীতেও জামায়াত সমর্থক আছে বলে শোনা যায়। সরকারি চাকুরিজীবি বা সামরিক বাহিনীর সদস্য হলে কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করা যাবে না, এমন কোন কথা নেই। কিন্তু জামাতকে সমর্থন করা আর আওয়ামী লীগ/বিএনপিকে সমর্থন করা এক জিনিস নয়। জামাত সাধারণ কোন রাজনৈতিক দল নয়, এই দলের সাথে নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদেরই শুধু তুলনা চলে। মাটির উপরে এবং নীচে, সহিংস এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি, যেভাবেই হোক ক্ষমতা নেয়াই এই দলের একমাত্র উদ্দেশ্য। ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে তারা কি করতে পারে, তার স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে আর ২০০১ সালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। যেকোন সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল কোন বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলের শীর্ষস্থানে রাখে না। কিন্তু স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও এই দলের প্রতিটি শীর্ষনেতা চিন্থিত রাজাকার। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, পতাকা আর আদর্শের প্রতি এই দলটির বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই।
অবিশ্রুত - ২০ জুলাই ২০১০ (৬:৩৪ অপরাহ্ণ)
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা গোপন রাজনীতির উপযোগী নয়, কিন্তু তারপরও এখানে গোপন রাজনীতি দেখা দিয়েছে, কখনো এর রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল, আবার কখনো রোমান্টিকতাই মুখ্য ছিল। এই রাজনীতির সঙ্গে যারা দীর্ঘকাল রোমান্টিকতাজনিত কারণে জড়িত ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, মনস্তাত্ত্বিক সংকটে পড়েছেন এবং দুরারোগ্য আশাহীনতায় নিপতিত হয়ে একরোখামি অর্জন করেছেন। গোপন রাজনীতি পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক কারণে অনেক সময় দেখা দিয়েছে, কিন্তু যারা গোপন রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছিলেন, তারা নিজেরাও জানতেন এটি রাজনীতির কোনও দীর্ঘমেয়াদী পথ নয় এবং তারা সেপথ থেকে বেরিয়েও এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এক শ্রেণীর বামপন্থী ছিলেন বা এখনো আছেন, যারা গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির রাজনৈতিক অধিকারটুকু ব্যবহার করতেও রাজি নন। অহেতুকই গোপন রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছেন তারা। কিন্তু যদি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের ব্যবহার করতেন, তা হলে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিকুল রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতার কারণে যদি কখনো তাদের গোপন রাজনীতির পথ বেছে নিতে হতো, তা হলে জনগণও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন। যেমন, স্বাধীনতাপূর্ব সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি, স্বাধীনতাউত্তর সময় জাসদের প্রতি গোপন রাজনীতিতে চলে গেলেও বাংলাদেশের জনগণের সহানুভূতি ছিল।
জামায়াতে ইসলামী গোপন রাজনীতি প্রস্তুতি রেখেছে, আবার গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুর সুযোগ নেয়ারও চেষ্টা করেছে। জেএমবি তাদের এক্সপেরিমেন্ট; কিন্তু ওই এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েই তারা ধরা খেয়েছে, জঙ্গি তৎপতার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু জেএমবি-র প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সহানুভূতিশীল না হওয়ায় তারা নিজেরাও হয়তো উপলব্ধি করছে, ওই পথে পা বাড়াতে গেলে তারা আরও অজনপ্রিয় হয়ে পড়বে। বিগত নির্বাচন প্রমাণ করেছে, দল হিসেবে জামায়াত এখন আরও বেশি অজনপ্রিয়। আর জামায়াতকে চিরস্থায়ীভাবে অজনপ্রিয় করে রাখতে পারে মৌলবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা। ব্রিটেনের মতো দেশে বর্ণবাদী দল বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার আছে, কিন্তু জনসচেতনতা এবং সরকার পর্যন্ত এদের রাজনীতির বিরোধী হওয়ায় এরা কখনোই দানা বেধে উঠতে পারে না, সভাসমাবেশও করতে পারে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, মুশকিল হলো, রাজনৈতিক দলগুলিই জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে এবং এখনো দিচ্ছে। সরকার বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর এবং একটি সাংবিধানিক পর্যালোচনা কমিটি গঠনের কাজ শুরু হওয়ার পর বিএনপি এর বিরোধিতায় নেমেছে- এবং সেইসূত্রে প্রকাশ্য রাজনীতিতে দলীয় ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর আরও অনেকদিন সক্রিয় থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে কখনো কখনো আমার মনে হয়, জামায়াতকে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদী ধারার তৎপরতার মাধ্যমেও নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব এবং সেটিই করা উচিত, আমাদের উচিত এ দলটিকে ব্রিটেনের বর্ণবাদী বিএনপি বা ইডিএল-এর পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া।
মাসুদ করিম - ৩ নভেম্বর ২০১১ (১১:৩৭ অপরাহ্ণ)
রাজপথ ও ভূ-গর্ভের মাঝামাঝিও কিছু একটা আছে, এটা আমাদের আগে চোখে পড়েনি, এখন চোখে পড়ছে : এক অলি ও এগারো গলি — এই নিয়ে বাংলাদেশের অলিগলির রাজনীতিও এখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে দুই ভিন্ন মেরু থেকে সোচ্চার, ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝেছেন আমি কী বলছি। আগ্নেয়গিরির মতো অলিগলিও তিন রকম : জীবন্ত, সুপ্ত ও মৃত। আমাদের কে শুধু জানতে হবে এই এক অলি এগারো গলির অলিগলি কোন রকমের : জীবন্ত? সুপ্ত? না মৃত?
আমি বলব মৃত।