‘বীরাঙ্গনা’ একটা শব্দ, একটা সংকেত, এই শব্দটার সাথে কত যে ফিসফাস জড়িত, শুনলেই আমরা নির্যাতিত নারী দেখতে পাই, বিবস্ত্র নারী, চুল দিয়ে উর্ধ্বফাঁস দিয়ে রাখা নারী, পরিখা থেকে পচনশীল হিউমাসের মতন উদ্ধারকৃত মিউটিলেটেড নারী, শিখ সৈন্যদের পাগড়ি দিয়ে লজ্জা নিবারণ করা নারী, মুখ লুকানো আশিরপদনখ বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া নারী। (‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র) এই সব দৃশ্যই আসলে বীরাঙ্গনাদের মৌলিক গুণনীয়ক। যাদের অবিশ্বাস্য নির্যাতনের বিবরণ একনিশ্বাসে আজো পড়া যায় না, যাদের ফিরে আসাকে কেউ স্বাগত জানায়নি, যাদের বেঁচে থাকাকে কেউ সৌভাগ্য মনে করেনি, তাদের জন্যে আমরা একটা শব্দ নিয়োগ করেছি ‘বীরাঙ্গনা’, এর সাথে ব্র্যাকেটবন্দী কিছু ফিসফাস এবং দৃষ্টিভঙ্গী (গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক)।
যে মৃত তার জন্যে মিনার আছে, সৌধ আছে, ‘শহীদ’ খেতাব আছে, বীরত্ব তার শ্রেষ্ঠত্বের মালা, তার প্রতীক।
যে অঙ্গহানি হওয়ার কারণে অর্ধমৃত, তার জন্যেও কোথাও না কোথাও একটু সহানুভূ্তির-আদরের ‘আহা’ শব্দ আছে, পিঠের ’পরে আত্মীয়তাকামী হাত আছে।
যে ‘সম্ভ্রম’ হারালো (একজনের ধর্ষণের কারণে কেমন করে আরেকজন মানুষের সম্ভ্রহামহানি হতে পারে? সম্ভ্রম তো নিজের জিনিস, অত্যুচ্চ এবং সার্বভৌম শব্দ)- তার জন্যে আছে পুনঃসম্ভ্রমহানি, এইবার আত্মীয়তাকামী হাতে, ‘আহা’ শব্দসমেত।
‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের ব্যঞ্জনা এইই, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি সেই শ্রদ্ধা সেই অসমাপ্ত শ্রদ্ধাকে শ্রদ্ধা বলতে রাজি নই, যা এই নারীদের মানুষ-অস্তিত্ব, নারী-অস্তিত্বকে পুনরায় সসম্মানে-সস্নেহে গ্রহণ করতে নারাজ। আমি সেই শব্দে কেবল কৌমার্যপূজারী পুরুষতান্ত্রিক পূঁজ দেখতে পাই, আর কিছু নয়।
‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের বদলে অনেকে এখন ‘বীরজননী’ আখ্যা দেয়া শুরু করেছেন, আসল কথা হচ্ছে, আপনি যাঁকে স্ত্রী হিসাবে, সঙ্গিনী হিসাবে স্থান দিতে অক্ষম হয়েছেন, সেই অক্ষমতা ঢাকতে আপনার এখন তাঁর জন্যে মাতৃত্বের পতিতপাবনী ঢাল দরকার হয়েছে, আরো বড় আড়াল, আরো সক্ষম আরো মহিমময়ী ঢাল। শব্দান্তর করলে কি মনান্তর ঘটে? নাকি নারীর প্রতি মনোভাব বদলায়? আহা যদি তাই হতো!
রমা চৌধুরীর ক্রন্দনবিকৃত মুখ দেখে আমাদের চোখে আজ পানি আসে, আমাদের বুক মুচড়ে ওঠে যখন দেখি তিয়াত্তর বছর বয়স্ক এই মহিলা পায়ে জুতা পরেন না, এই মাটিতে কত লাশ, তাঁর সন্তানদেরও লাশ, সে লাশ জুতায় মাড়াবেন কি করে! (আমাদের কি মনে পড়ে শহীদ আজাদের মাকে, ছেলে ভাত খেতে চেয়ে মরে গেছে বলে আর কোনোদিন ভাত খেতে পারলেন না যিনি?) আত্মসম্মানে টনটনে রমা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কাছেও সাহায্যবিলাসী নন, নিজের বই বিক্রি করে ফেরেন এখনও। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখার মতন সেই অনড় সম্মানবোধ। আপনি বিশ্বাস করুন, এইরকম আরো বহু রমা চৌধুরী আছেন, আমাদের দেশে, অপরিসীম তাঁদের দাঁড়িয়ে থাকবার ক্ষমতা। এইরকম আরো বহু রমা চৌধুরী চলে গেছেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে, কাজ করছেন ধর্ষকের দেশের পতিতালয়ে, অপরিমেয় তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া অভিশাপের বোঝা।
ফেসবুক এবং নেট এর খবরাখবরের কল্যাণে রমা চৌধুরী কে, কি করে তিনি পাকিস্তানী সেনার নির্যাতনের কবলে পড়েন, কেমন করে গানপাউডার ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয় তাঁর ঘরগেরস্থালি, এইসবই আপনাদের জানা। আসুন, আমরা গণিতজ্ঞের অভিনিবেশ দিয়ে তাঁর জীবনকে আরেকবার দেখি, গরিষ্ঠ সাধারণ গুননীয়কটিকে আরেকবার খুঁজি। রমা ধর্ষিত হয়েছিলেন পাকিস্তানী সেনার হাতে, সেই অসম্ভব নির্যাতনের আঘাত শমিত করবার জন্যে কি করেছে তাঁর কাছের মানুষ? তিনি তো বিয়ে করেছেন, দু’বার, নিশ্চয়ই তাঁরা ছিলেন সচেতন-সুস্থ-সামাজিক পুরুষমানুষ, এঁরা তাঁকে নিয়ে (একজন ধর্ষিতাকে নিয়ে) সংসার করতে সক্ষম হন নি। প্রাথমিকভাবে, ধর্ষণ ছিল গুরু অপরাধ, পরবর্তীতে ধর্ষিতাকে ধর্ষণের দায়ে পুনঃনির্যাতন-পরিত্যাগ এইসব গুরুতর অপরাধ নয়? আমরা যে পড়েছিলাম ‘দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরো দেব অস্থি’, এই অস্থিদান, সম্ভ্রমদানের কী মূল্য আমরা সামাজিক মানুষ হিসেবে চুকিয়েছি? যাকে শুশ্রুষা করবার কথা, যাকে আদরে-স্নেহে-সাহসে-পরিচর্যায় পুনর্বাসিত করার কথা, তাকে আমরা কোথায় ঠেলে দিয়েছি? নারীহন্তা-শিশুহন্তার সাথে আমরা না কদাচ হাত মেলাই না? বঙ্গবীরেরা?
বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে তাঁদের দিয়ে পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করানোর দরকার নেই। তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের নিজেদের পাপক্ষালনের জন্যে, যেন তাঁদের সন্তানরা বিনাচিকিৎসায় মারা না যায়, অনাহারে-অপুষ্টিতে-সামাজিক শ্লেষে কোনঠাসা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন না করে। দেশের জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ এই নারীরা করেছেন। আমরা দরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র দেশ, সমাজ গোল্লায় যাক, অন্ততঃ আমাদের রাষ্ট্র যেন হৃদয়ের দৈন্য না দেখায় এই নির্যাতিত মানুষগুলিকে। আজকে যদি ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দসংকেতটার সাথে পুঁজির যোগ থাকত, যদি খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতন মৌলিক দাবীগুলির সোচ্চার যোগ থাকত, যদি চিকিৎসা-শিক্ষা-চাকুরি ইত্যাদির যোগ থাকত, তাহলে বোধ করি এই শব্দের কলংক নিয়ে মাথা নিচু করে থাকতে হতো না এই নারীদের পরিবারকে। কি প্রলাপ বকছি বলুন, আমরা তো সেই দেশ, যে দেশ যুদ্ধাপরাধীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেতা স্বীকার করে, তাদের ইঞ্জিনচালিত শকটের সামনে পতপত করে রমা চৌধুরীর পতাকা, গুরুদাসীর পতাকা, তারামনবিবির পতাকা!
‘সমাজ’কে দোষ দিয়ে আর কতদিন? আমরাই তো তার একেকটি একক। অতএব, “কেমনে সকাল হবে?” (তোমার ছেলে, তোমার ভাই-বন্ধু-সহকর্মী-সহযোদ্ধা-পড়শী সব্বাই জাগলে, জেগে বিষম বেদনায় নিজেদের আবিষ্কার করলে রাত পোহাবে তবে) আসুন নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাই, তাকে আরেক অস্তিত্ব হিসেবে সর্বতোভাবে স্বীকার করি, জনসভায় তার নিজের নামটি নিজে বলতে দিই, তার যথাস্থান তাকে বেছে নিতে দিই। কন্যা-জায়া-জননী হিসেবে ধরে নিয়ে তারপরে তাদের জন্যে শোক করা বন্ধ করি, অপর মানুষ হিসেবে তাকে ভাবতে চেষ্টা করি।
ধর্ষণ একটি অপরাধ+যুদ্ধাপরাধ, শারীরমানসিক-স্নায়বিক বিচারে এর ক্ষয় করবার ক্ষমতা প্রায় অসীম। অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত, অপরাধীকে জন্মদায়ী ঈশ্বরের না, নিয়তির না, কপালের না, কররেখার না, সর্বোপরি ধর্ষিতার তো কোনো অবস্থাতেই না। আমরা যতদিন এই অপরাধ নিয়ে চোখে চোখে নিঃশব্দে কথা বলা বন্ধ না করতে পারব, যতদিন সামাজিক অনুষ্ঠানে-জনসমাগমে-জনবিরলে এই নিয়ে ফিসফিস করবার মনোবৃত্তি বন্ধ করতে না পারব- ততদিন আমরা এই অপরাধের দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব না, সত্যিকারের অপরাধীরও সাজা হবে না। সাজা হবে নিরপরাধের। আমাদের জ্ঞাতসারে আর অজান্তে বহু রমা চৌধুরী খালি পায়ে হেঁটে ক্ষতবিক্ষত হবেন, জানতেও পারব না। খালি পা বড় বেদনার,সম্ভবতঃ মুরাসাকি শিকিবুর আমলে জাপানী নারীরা জুতা পায়ে দিতে পারতেন না, ভারতবর্ষের সাধারণীরা খালিপায়ে হাঁটতেন, আর আমরা খালিপায়ে হাঁটি প্রভাতফেরীতে, প্রতিটি খালি পায়ের সাথে কত বঞ্চনার ইতিহাস।
পরিশিষ্টঃ
আমরা চেষ্টা করছি, স্কুলের লাইব্রেরিতে-পাড়ার লাইব্রেরিতে-কাউন্সিল লাইব্রেরিতে রমা চৌধুরীর বইগুলি পৌঁছে দিতে। একটিমাত্র শিশু/কিশোর/যুবক যদি অনবধানে বই তুলে নিয়ে আবিষ্কার করে আমাদের যুদ্ধের এবং যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, যদি তার চোখ জ্বলে ওঠে তিক্ত অশ্রুতে, যদি রক্ত জ্বলে ওঠে ঘৃণায়- দেশে অথবা বিদেশে, তাহলে ঐ খালি পায়ে চলার বেদনা সার্থক হবে। এই সংক্রমণ প্রক্রিয়ায় আমাদের আরো সঙ্গী চাই।
বিপন্ন বিস্ময়ের অন্তর্গত খেলায় ক্লান্ত।
