বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকার ২০০১ সালের শেষদিকে ক্ষমতায় আসার পর অত্যন্ত কূটকৌশলের মাধ্যমে সারা দেশেই তারা বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে দেয়। এক্ষেত্রে তারা ইসলাম ধর্ম আর মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীর সেনানীদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ করেনি।
চট্টগ্রামেই বিএনপি-জামাতের এই হীন চক্রান্তের অন্তত দুটি জলজ্যান্ত নমুনা চট্টগ্রামসহ দেশবাসীর চোখের সামনেই আছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের নামে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামও তারা পরিবর্তন করে ‘শাহ আমানত বিমান বন্দর’ নামকরণ করে। হযরত শাহ আমানতের নাম পরিবর্তন করতে গেলে একে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে, এবং এর ফলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়বে যে কেউ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনকে ব্যবহার করেছে বিএনপি-জামাত জোট সরকার, যাতে করে এ নিয়েও অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা যায়। আর বিএনপি-জামাতের পাতা ফাঁদেই পা দিলো বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার — এমনই মনে করছেন অনেকে। প্রসঙ্গত গত ১ জুলাই ২০০৯ বুধবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়ামের নাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শ্রম, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর নামেই পুনর্বহাল করা হয়। এই নতুন নামফলক উন্মোচন করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান।
এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকায় প্রায় ৩০ একর জায়গার উপর নির্মিত এই বিভাগীয় স্টেডিয়ামের নাম জহুর আহমদ চৌধুরীর নামেই করা হয়েছিল। সে সময়, ২০০০ সালের ১৭ নভেম্বর স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর এবং নির্মাণকাজ শেষে ২০০১ সালের ১৭ জুন নামকরণ করা হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়াম’। কিন্তু ২০০১ সালের শেষদিকে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই নাম পরিবর্তন করে ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম’ নামকরণ করে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ৫ বছর এবং গত ২ বছর (মোট ৭ বছর) স্টেডিয়ামটি ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম’ নামেই পরিচিতি পায়। সম্প্রতি বর্তমান সরকার দেশের ১২টি ক্রীড়া স্থাপনাকে পূর্বের নামে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে গত ২৫ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ীই আজ চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়ামের নাম বদলে আগের নামে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা।
বিএনপি-র পাতা ফাঁদে আওয়ামী লীগের পা দেওয়ার এই ঘটনা দুঃখজনক। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটু চিন্তা করলেই পারতেন নীতিনির্ধারকরা। বিএনপি-জামাত যে অগণতান্ত্রিক-অশালীন-অসাংবিধানিক কাজ করতে পারে তা বাংলাদেশের জনগণ জানে। আর তাই বিগত সংসদ নির্বাচনে সাধারণ জনগণ তাদের এতদিনকার ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছে বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে। বিপুল ভোটে জয়ী করেছে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই যে-কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সঠিক পদক্ষেপ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর।
এদিকে চট্টগ্রামে ‘শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন বিভাগীয় স্টেডিয়াম’-এর নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর নামে নামকরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের নামে এই স্টেডিয়ামের নামকরণ করে আবার তা প্রত্যাহারের মাধ্যমে তাঁর মহান কীর্তিকেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আজ দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসকাবে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের দু’মেয়ে নূরজাহান আমিন ও রিজিয়া আমিন এই অভিযোগ করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি নয়, তিনি সমগ্র জাতির গৌরব। একজন জাতীয় বীরের নাম এভাবে মুছে ফেলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। রুহুল আমিনের পরিবারের সদস্যরা দাবী করেন এই স্টেডিয়ামের নামটি পূর্বে যে জহুর আহমদ চৌধুরীর নামে ছিল তা তাঁরা জানতেন না। তাঁরা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর নামে দেশে আরও অনেক কিছু হতে পারে; যে সুযোগ এখনও রয়েছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ, এই ভূখণ্ড স্বাধীন হয়েছে তাঁদেরই একজন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের নামটি মুছে ফেলার প্রয়োজন ছিল কি না — এই প্রশ্নও তোলেন তাঁরা।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
রশীদ আমিন - ৪ জুলাই ২০০৯ (২:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
একটি বেশ সময়োপযোগী পোস্ট। এই বিষয়টি নিয়ে আমি অনেকদিন যাবৎ ভাবছিলাম, আমার বেইজিং-এর অভিজ্ঞতা বলে এই শহরে ব্যক্তির নামে কোনো স্থাপনা, রাস্তাঘাটের নামকরণ হয়নি। এখানে তো নেতা কিংবা কর্মবীর অথবা দেশপ্রেমিক তো অভাব নেই। তাহলে কেন এদের এই নামকরণে প্রবণতা নেই, এটি একটি প্রশ্ন! বাংলাদেশে এই নামকরণ নিয়ে একটি অপরাজনীতি শুরু হয়েছে, এর অবসান হওয়া উচিত। আমরা সব কিছু একটি জীবনের সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলি, কিন্তু সভ্যতার বয়স তো হাজার বছরের মধ্যেও সীমাবদ্ধ করা যায় না। আর মানুষের কীর্তি কি কোনো নামকরণের মধ্যে পূর্ণতা পায়? আমাদের প্রতিনিয়ত জীবনচর্চা আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে তাঁরা বেচে থাকেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ, লালন প্রমুখ। আমরা যেমন বঙ্গবন্ধুকে নানান নামকরণের মধ্য দিয়ে একটি ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, জাতির পিতা হিসাবে একটি জাতির অভ্যুদয়ের সাথে সাথে শত কোটি বাঙালির অন্তরে তাঁর নাম অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে।
রণদীপম বসু - ৪ জুলাই ২০০৯ (৮:০৬ পূর্বাহ্ণ)
খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন রশীদ আমিন। সহমত পোষণ করি তাঁর সাথে।
রায়হান রশিদ - ৭ জুলাই ২০০৯ (৫:৩৫ অপরাহ্ণ)
বেঁচে থাকলে শেক্সপিয়ার না জানি কি লিখে যেতেন এসব দেখে! অসাধারণেরা জীবন যাপন করেন, অন্য কিছু ভাবার হয়তো ফুরসতই হয় না তাদের। আমরা সাধারণেরা ইট কাঠ সুঁড়কি দিয়ে সৌধ গড়ে তাদের মহানত্বের অংশ হতে চাই। সে অংশ হতে চাওয়া হয়তো এক ধরণের রিচুয়াল – যার পেছনে কখনো থাকে পূজা, কখনো মতলব, কখনো থাকে ধর্মশালার পুরোহিতের পূজাকে পূঁজি হিসেবে অবলম্বনের উচ্চাভিলাষ। মজার ব্যাপার হল, এই আমরাই কখনো জীবিত যীশু চাই না, তখন চাই তাদের টেনে নামাতে। সব যুগের সব ক্রুশবিদ্ধ যীশুরা মানব চরিত্রের এই জটিল বৈপরীত্যের সাক্ষী হয়েই দেয়ালে দেয়ালে শোভা পান আজ, দিবারাত্র ঝুলে থেকে থেকে।