গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়েরের সাথে সাথে দু'টো বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে: (১) গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধের বিষয়টি নাকি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক মীমাংসিত একটি ইস্যু; (২) এমন বয়স্ক একজন মানুষকে বিনা জামিনে গ্রেফতার করে হেফাজতে রাখা বা বিচার করা ঠিক না। এই দু'টো বিষয়ের ওপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই পোস্টে।

গত ৫ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে আসামী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়। এই অভিযোগপত্র দায়েরের সাথে সাথে শুরু হল আসামীর বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া, এবং সেইসাথে অবসান ঘটলো ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধসমূহের দায়ে এক অভিযুক্ত শিরোমণির প্রায় চার দশক বিস্তৃত বিচারহীনতার অধ্যায়ের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার শুরু হয়েছে এখন, এবং আইন তার নিজের গতিতে চলবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হল, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের এবং তাঁর গ্রেফতারের পর থেকেই মিডিয়ায়, উইকিপিডিয়ার মতো উম্মুক্ত বিশ্বকোষগুলোতে (যে বিষয়ে পরে একসময় লেখার ইচ্ছে আছে), এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছু কিছু প্রচারণা চালানো হচ্ছে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে যে দু’টো বিষয় বারবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে গোলাম আযমের অনুসারী এবং নিযুক্ত আইনজীবীরা সেগুলো হল:

(ক) গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধের বিষয়টি একটি মীমাংসিত ইস্যু, কারণ ১৯৯৪ সালে তাঁর নাগরিকত্ব মামলার সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে তেমনটিই নাকি বলা হয়েছে;

(খ) গোলাম আযমের বয়স এখন ৮৯ বছর, এবং এমন বয়স্ক একজন মানুষকে বিনা জামিনে গ্রেফতার করে হেফাজতে রাখা বা বিচার করা ঠিক না।

দুই ভাগে ভাগ করে নেয়া এই পোস্টটিতে এই দু’টো বিষয়ের ওপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। কিন্তু তার আগে পাঠক এক নজরে দেখে নিন গোলাম আযমের মামলার বিষয়ে এই পোস্ট লেখা পর্যন্ত ঠিক কী কী ঘটেছে:

১৫ জুলাই ২০১০: আসামী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্য শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা। তদন্তের উদ্দেশ্য — আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ধারা ৩(২)-এর আওতায় উল্লেখিত অপরাধসমূহে অভিযুক্তের সংশ্লিষ্টতা যাচাই।

৩১ অক্টোবর ২০১১: তদন্ত শেষে আসামীর বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট, অন্যান্য তথ্য প্রমাণ, এবং আলামত তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউশন অফিসে দাখিল করা হয়।

১২ ডিসেম্বর ২০১১: প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইবুনালের কাছে আসামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (formal charge) দাখিল করা হয়।

২৬ ডিসেম্বর ২০১১: অভিযোগপত্রে উল্লেখিত অভিযোগসমূহ আমল গ্রহণের (cognizance) জন্য ধার্য এই দিনে ট্রাইবুনাল অভিযোসমূহ আমলে নেয়ার পরিবর্তে তা আবার প্রসিকিউশনের কাছে ফেরত পাঠান। কারণ, দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি সঠিক বিন্যাসে (not in form) উপস্থাপিত হয়নি।

৫ জানুয়ারি ২০১২: ফেরতপ্রাপ্ত অভিযোগপত্রটিকে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে প্রসিকিউশন টিম পুনরায় ট্রাইবুনালের কাছে দাখিল করেন। এইবার সেটা গৃহীত হয়।

৯ জানুয়ারি ২০১২: আসামী আইনজীবীদের ট্রাইবুনাল নির্দেশ দেন ১১ জানুয়ারি যেন সশরীরে আসামীকে হাজির করা হয়। উল্লেখ্য, আসামী তখনো গ্রেফতার হননি।

১০ জানুয়ারি ২০১২: আসামীর আইনজীবীরা ট্রাইবুনালের কাছে জামিনের জন্য তাদের দরখাস্ত পেশ করেন।

১১ জানুয়ারি ২০১২: ট্রাইবুনালের সামনে আসামীকে হাজির করা হয়। ট্রাইবুনাল আসামীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগসমূহ আমলে নেন এবং জামিনের দরখাস্ত নামঞ্জুর করে আসামীকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তাঁর স্বাস্থ্য ও বয়সজনিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে ট্রাইবুনাল তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেন। অভিযোগপত্রের জন্য উভয়পক্ষের শুনানির জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি ধার্য করা হয়।

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২: আসামী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রের শুনানির প্রথম দিন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে শুনানি শুরু করা হয়েছে।

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২: অভিযোগপত্রের শুনানির দ্বিতীয় দিন।

 

ফিরে আসি পোস্টের মূল দু’টো বিষয়ে . . .

 

ক. আসামীর অপরাধের বিষয়টি ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে:

১৯৯০-এর দশকে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলার রায়ের উদ্দেশ্যমূলক অপব্যাখ্যা থেকেই মূলত এই বিভ্রান্তির সূচনা। বিখ্যাত সেই নাগরিকত্ব মামলার ইতিহাস নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই, তারপরও সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। ১৯৭৩ সালে এক সরকারি ঘোষণার ((নোটিফিকেশন নং–৪০৩-আইএমএন/III, তারিখ ১৮ এপ্রিল)) মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার দেশ থেকে পলাতক গোলাম আযম সহ আরও ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৭৮ সালে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এসে পুনরায় বসবাস শুরু করলেও তাঁর নাগরিকত্বের বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায় আরও প্রায় দেড় দশক। ১৯৯২ সালে আগের সেই সরকারি আদেশের বরাত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসামী গোলাম আযমকে একটি কারণ দর্শাও নোটিশ ((স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিশ নং: HH: MA(Bhai-l)/১৩৪, তারিখ ২৩ মার্চ, ১৯৯২)) দিয়ে জানতে চাওয়া হয় কেন তাঁকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী একজন অ-নাগরিক হিসেবে দেশ থেকে বহিঃস্কার করা হবে না। ১৯৭৩ সালের আদেশ এবং ১৯৯২ সালের নোটিশ দু’টোই আসলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রচলিত নাগরিকত্ব আইন ((Bangladesh Citizenship (Temporary Provisions) Order 1972 (President’s Order 149 of 1972) ))-এর ৩ নম্বর ধারার প্রয়োগকে কেন্দ্র করে দেয়া হয়েছিল। গোলাম আযম এই কারণ দর্শাও নোটিশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন দায়ের করে। রিট আবেদনটির মূল প্রার্থনা এবং বিচার্য বিষয় ছিল আইন অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিকত্ব প্রাপ্তি এবং বহাল রাখার অধিকার। হাইকোর্টের রায় গোলাম আযমের পক্ষে যায় এবং আদালত তাঁর নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করেন (হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের লিংক) ((Professor Golam Azam v. Bangladesh, Per Mohammad Ismail Uddin Sarkar, Justice) DLR 46 (1993). )) । এর বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা হয়, এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সেটিরও নিষ্পত্তি হয় গোলাম আযমের পক্ষে (আপিল বিভাগের বিস্তারিত রায়ের লিংক) ((Bangladesh v Professor Golam Azam, 1994 CLC (AD) ))।

যেটা বোঝা দরকার তা হল — গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর ভূমিকার কারণে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে এসে সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বললো — নাগরিকত্ব একটি জন্মগত অধিকার, এবং এটি কোনো প্রাপ্ত অধিকার নয়। ফলে ১৯৭১-এ একজন ব্যক্তির ভূমিকা ভাল-মন্দ যা-ই হোক তার সাথে প্রযোজ্য নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্বের বিষয়টির কোনো সম্পর্ক নেই। ফলতঃ আদালতের অবস্থান হল — গোলাম আযমের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি (ধারা#৩) ১৯৭৩ এবং ১৯৯২ সালের সরকারি আদেশ দু’টিতে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখানে বিষয়টি একেবারেই সোজাসাপ্টা। পুরো মামলাটিই গোলাম আযমের নাগরিকত্বের মতো একটি নাগরিক অধিকারকে ঘিরে, এবং সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগই ((হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপরল বিভাগ)) তাদের রায়ে এটা স্পষ্ট করে যে ১৯৭১-এ তাঁর ভূমিকার বিষয়টি এখানে বিচার্য নয়। সুতরাং, নাগরিকত্ব মামলার বরাত দিয়ে ১৯৭১-এ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগসমূহের নিষ্পত্তির কোনো প্রশ্নই কিন্তু এখানে আসে না। যে বিষয়টি বিচার্য বিষয় না, তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কীভাবে কোনো আদালত করে? এর উত্তর হল — করে না; গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও করেনি।

আরও একটি কারণেও সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে উপরোক্ত নাগরিকত্ব মামলার সময় গোলাম আযমের ১৯৭১-এর অপরাধের বিষয়টির নিরূপণ করা সম্ভব ছিল না, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা তো আরও দূরের কথা। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হল ১৯৭১ সালে সংঘটিত “আন্তর্জাতিক অপরাধ”-সমূহের সংঘটনে পাকিস্তান বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সহযোগী হিসেবে পরিকল্পনা করা, ষড়যন্ত্র করা, উসকানী দেয়া, সম্পৃক্ত থাকা ইত্যাদি। কিন্তু, “আন্তর্জাতিক অপরাধ” নিরূপণের জন্য যে ধরণের আদালত প্রয়োজন হয়, সুপ্রিম কোর্ট সে ধরণের আদালত নয়। অপরাধ নিরূপণের জন্য দরকার সাক্ষী-সাবুদ-এর জবানবন্দী-জেরার ব্যবস্থা, যা ‘কিছু ব্যতিক্রম’ ((যেমন: কোম্পানি আইন-এর আওতায় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে)) বাদে সুপ্রিম কোর্টে নেই। অপরাধ নিরূপণের জন্য প্রয়োজন হয় ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল আদালতের (যেমনটি বতর্মানের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল), কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সে জাতীয় কোনো আদালত নয়। সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ) কেবল আইনগত বৈধতা এবং সংবিধি ও সংবিধানের ব্যাখ্যার ((যেমন: statutory interpretation, অর্থাৎ কোনো আইনের শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যা বা আইনগত কোনো অসংগতি থাকলে সেটা তুলে ধরা)) বিষয়গুলোই নিরূপণ করতে পারে। যেমন: নাগরিকত্ব বাতিল আইনত বৈধ কি না এমন প্রশ্ন। কিন্তু, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী কিছু পরিস্থিতি ছাড়া, কোনো তথ্যগত প্রশ্ন (question of fact), বিশেষত তা যদি ১৯৭১ সালে গোলাম আযমের অপরাধ নিরূপণের মতো কোনো প্রশ্ন হয়, তাহলে তা সুপ্রিম কোর্ট নিরূপণ করতে পারে না। এ জাতীয় কোনো তথ্যগত প্রশ্ন যদি নিরূপণের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট বড়জোর কোনো নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দিতে পারে সাক্ষী-সাবুদ-জবানবন্দী-জেরা-আলামত বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা উদ্‌ঘাটন করতে, কিন্তু তাও কেবল সে-সব মামলার ক্ষেত্রে যেগুলোর উৎপত্তি নিম্ন আদালত থেকে ((এর অন্যথা হলে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি সঠিক আদালতে (proper forum) পুনরায় দায়ের করার পরামর্শ দিতে পারে))। অথবা, নীচের কোনো ফৌজদারি আদালত থেকে কারো অপরাধের বিষয়ে তথ্যগত নিষ্পত্তি এবং রায় হয়ে আসলে সুপ্রিম কোর্ট কেবল তার আইনগত প্রশ্নের বৈধতার দিকগুলো দেখতে পারে। সুতরাং, কোনো ধরণের সাক্ষী-প্রমাণ-আলামত যাচাই ছাড়া (যা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে সাধারণভাবে যাচাই সম্ভবও না) গোলাম আযম ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধে দোষী কি নির্দোষ তা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ঘোষণা করার প্রশ্নই ওঠে না। আর যদি রায়ে কথা প্রসঙ্গে তেমন কিছু উল্লেখও হয়ে থাকে, কেবল তা থেকে বিষয়টির আইনগত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ধরে নিলে ভুল করা হবে।

প্রশ্ন হল — সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক গোলাম আযমের অপরাধ নিষ্পত্তি হয়ে গেছে — এমন বিভ্রান্তির উৎস তাহলে কী? এর উৎস হল নাগরিকত্ব মামলার রায়ে হাইকোর্ট বিভাগের দু’জন বিচারপতির একজন — বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকারের করা বিচার্য বিষয়ের সাথে সম্পর্করহিত একটি উক্তি। হাইকোর্ট বিভাগে দেয়া রায়ের অনু্চ্ছেদ–১৪ ((Professor Golam Azam v. Bangladesh, Per Mohammad Ismail Uddin Sarkar, Justice) DLR 46 (1993), p.433 )) -তে করা উক্তিটির সারমর্ম হল:

“সামরিক জান্তার সাথে সময় সময় মাখামাখি করা ছাড়া আদালত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এমন কোনো পর্যাপ্ত আলামত খুঁজে পায়নি যা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী রাজাকার আল-বদর আল-শামস কৃত মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধসমূহে তাঁর সংশ্লিষ্টতা প্রতীয়মান হয়।” ((ঐ. হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকারের দেয়া রায়ের অনুচ্ছেদ ১৪: “Except some news items and one photograph showing that the petitioner met General Tikka Khan or General Yahya Khan, there is nothing to directly implicate the petitioner in any of the atrocities alleged to have been perpetrated by the Pakistani Army or their associates – the Rajakars, Al-Badrs or the Al-Shams. Except that the petitioner was hobnobbing with the Military Junta during the war of liberation, we do not find anything that the petitioner was in any way directly involved in perpetuating the alleged atrocities during the war of independence”)).

বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকারের উক্তির সাথে সাথেই ঘটনার শেষ নয়। এরপর রিট মামলাটি আপিল বিভাগে যায়। সেখানকার চার বিচারপতির একজন বিচারপতি এটিএম আফজাল আপিল বিভাগের রায়ের (যেখানে চার বিচারপতিই তাঁদের মতামত পৃথকভাবে দিয়েছেন) অনুচ্ছেদ–৮১ ((Bangladesh v Professor Golam Azam, 1994 CLC (AD) )) -তে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিনের উপরোল্লিখিত অনুচ্ছেদটি কথাপ্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে পুনরায় উল্লেখ করেন উদ্ধৃতি প্রদান করার মাধ্যমে। আর এই সম্পর্করহিত উদ্ধৃতিটিকেও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা এবং আসামীর অনুগামী অন্যান্যরা আপিল বিভাগের রায় (অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়) হিসেবে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, যা আদৌ তা নয়, কারণ:

— ১) এটি কেবল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতির ((সুপ্রিম কোর্টের সে-সময়কার এই চার বিচারপতি হলেন: বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এটিএম আফজাল, বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান)) একজনের করা বিচ্ছিন্ন একটি মন্তব্যের অংশ;
— ২) মন্তব্যটি দেয়া হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের দুই বিচারপতির এক বিচারপতির রায়ের একটি উদ্ধৃতিকে উল্লেখ করে, তাও আলোচনার প্রসঙ্গক্রমে;
— ৩) মন্তব্যটির সাথে রিট মামলাটির মূল বিচার্য বিষয় নাগরিকত্বের কোনোই সম্পর্ক নেই;
— ৪) সঙ্গত কারণেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বাকি তিন বিচারকের কেউই বিচারপতি এটিএম আফজালের (এবং বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকারের) মন্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করেননি, যেহেতু তার ওপর বিচার্য বিষয় নির্ভর করে না;

এরপরও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর রায়ে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, যা সংশয় এবং বিভ্রান্তি নিরসনে সহায়ক হতে পারে। তিনি লিখেছেন —

First – commentaries on the criminal aspects of the political antecedents of the Respondent were never tested in a court of law.
Secondly – even if the allegations are correct, our citizenship law does not deny citizenship to those who opposed the creation of Bangladesh and even killed freedom fighters and were engaged in murder, rape, etc,’’

অর্থাৎ, যে পক্ষই উক্ত মামলায় ((এই ক্ষেত্রে মূলত এটর্নি জেনারেল)) গোলাম আযমের অপরাধের বিষয়গুলো উত্থাপন করুক না কেন, সে বিষয়গুলো কখনোই বাংলাদেশের কোনো ‘আদালতে’ পরীক্ষিত হয়নি। এবং, এই সব অপরাধের অভিযোগ যদি এমনকি সত্যও হতো, তারপরও নাগরিকত্ব মামলায় সে সবের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। এখানে ‘আদালত’ বলতে বুঝতে হবে সঠিক ধরনের ফৌজদারি আদালতকে, যার এই সব অপরাধসমূহ তদন্ত এবং দায় নিরূপণ করার মতো যথাযথ এখতিয়ার রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সে অর্থে সঠিক আদালত (proper forum) নয়, কারণ উপরেই ব্যাখ্যা করেছি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICT) মতো আদালতই হল আইন অনুযায়ী সঠিক আদালত, যেখানে এখন গোলাম আযমের মামলাটি বিচারাধীন। গোলাম আযমের অপরাধের দায় এত বছর ছিল একটি “অমীমাংসিত প্রশ্ন”, কেবলমাত্র এখনই সেটি সঠিক আদালতের/ফোরামের সামনে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে, চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে।

নাগরিকত্ব নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের এই বিষয়টি এবং গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর প্রকৃতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের বাংলা টিভিতে কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে আইসিএসএফ -এর পক্ষ থেকে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছিল।

 

খ. আসামীর বয়সের বিবেচনায় তাঁকে জেলে রেখে বিচার করা প্রসঙ্গে

যে-সব কারণে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচারকালে সাধারণত জামিন দেয়া হয় না, সেগুলো হল — আসামীর পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, আসামী কর্তৃক মামলার বিষয়ে বিরুদ্ধ মতামত গড়ে তোলা, বিচারকার্যে বাধার সৃষ্টি করা, আসামী কর্তৃক সাক্ষীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন বা হয়রানি করা, আসামী কর্তৃক সাক্ষ্য-প্রমাণ ধ্বংস করা ইত্যাদি। আসামী গোলাম আযমের বয়স ৮৯ বছর এই অজুহাতে তাঁর আইনজীবীরা বার্ধক্য এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার যুক্তি দেখিয়ে আসামীর জামিন চেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁদের পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয় যে আসামীর দিক থেকে পলায়নের কিংবা বিচারকার্যে বাধা প্রদানের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আদালত আসামীর আইনজীবীদের এই বয়ানকে অগ্রাহ্য করে আসামীর জামিনের আবেদন নাকচ করে তাঁকে জেল হাজতে পাঠান, যদিও তাঁকে বাস্তবে রাখা হয় হাসপাতালের প্রিজন সেল-এ। এখন দেখা যাক, আসামী গোলাম আযমের বয়সকে গ্রাহ্য না করে তাঁকে জেল হাজতে প্রেরণ করাটা আইনের এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কতখানি সঙ্গত হয়েছে।
প্রথমতঃ ট্রাইবুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয় — যেখানে আসামীর বিরুদ্ধে “আন্তর্জাতিক অপরাধ”-এর মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে সেখানে আসামীর বয়স কিংবা কোনো স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা জামিনের পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে গোলাম আযমের চেয়ে আরও বেশি বয়সের আসামীকেও “আন্তর্জাতিক অপরাধের” বিচারকালে জামিন দেয়া হয়নি। উদাহরণ হিসেবে ৯১ বছর বয়স্ক নাৎসি যুদ্ধাপরাধী জন দেমইয়ানযুক (John Demjanjuk) -এর বিচারের ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে — গোলাম আযমের জামিনের শুনানির সময় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকেও যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকা-নিবাসী ইউক্রেনীয় দেমইয়ানযুকের বিরুদ্ধে মিউনিখের এক আদালতের অভিযোগ ছিল — তিনি ১৯৪৩ সালে ইউক্রেনের এক নাৎসি মৃত্যুশিবিরে প্রায় ২৭,০০০ ইহুদি নিধনে সহযোগিতা করেছিলেন। ২০০৯ সালে জার্মানির আদালত দেমইয়ানযুক-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। একই বছর তাঁকে বিচারের জন্য আমেরিকা থেকে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো বিচারকালীন সময়টুকুতেই তাঁকে স্টাডেলহেইম জেলখানার মেডিকেল ইউনিটে বিনা জামিনে আটক রাখা হয়েছিল। এখানে দেমইয়ানয়ুক-এর বার্ধক্য তাঁকে হাজত-বাস থেকে বাঁচাতে পারেনি। গ্রেফতারকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৯ বছর বয়স, ঠিক গোলাম আযমের মতোই। ২০১১ সালের মে মাসে বিচার শেষে দেমইয়ানযুককে মিউনিখের আদালত ২৭৯০০ ইহুদি নরনারীর হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এবং শাস্তি প্রদান করে।
দ্বিতীয়তঃ আসামী গোলাম আযমের কর্মকাণ্ডে এটা খুবই স্পষ্ট যে সুযোগ পেলেই তিনি এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বিচারের বিপক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে, নিজের সপক্ষে জনমত তৈরি করায় অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু একে ঠিক কী চোখে দেখতে হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করবে কেউ কাজটি ঠিক কখন করছেন এবং কী উদ্দেশ্যে করছেন তার ওপর। যেমন, ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ আসামী গোলাম আযম এক দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে নিজের বক্তব্য পেশ করেন (এটিএন বাংলায় পুরো সংবাদ সম্মেলনটিরই ভিডিও রয়েছে, এই লিংকে দেখুন। লক্ষ করুন, তারিখটি হল ১৪ ডিসেম্বর, অথচ তার দু’দিন আগেই, অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর, আসামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলনটি যদি আরও তিনটি দিন আগেও করা হতো তাহলেও হয়তো বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ ছিল, কিন্তু এটি আয়োজন করা হয়েছে এমন এক সময় যখন আসামীর পক্ষ থেকে যাবতীয় কথোপকথন বা বক্তব্য উপস্থাপন হওয়া উচিত ছিল কেবল ট্রাইবুনালের বিচারকদের সামনে, মিডিয়ার সামনে নয়। মিডিয়াকে ব্যবহারের মাধ্যমে আসামী বিচারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির, এবং বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার যে নজির রেখেছেন, তাতে এই ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট যে জামিনে মুক্ত থাকলে তিনি এই কর্মটিই আরও জোরের সাথে অব্যাহত রাখতেন।

তৃতীয়তঃ ২০০৮ সাল থেকেই আসামী গোলাম আযম ব্রিটেনে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ২০০৮ সালে ব্রিটেনে সফরের জন্য আসামীর ভিসার আবেদন “জনস্বার্থমূলক কারণে” ((যুক্তরাজ্য Immigration Rules-এর ৩২০(১৯) ধারার আওতায়)) নামঞ্জুর হওয়ায় আসামীর পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন আপিল ট্রাইবুনালে (Immigration Appeal Tribunal) সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল দায়ের করা হয়, এবং অবশেষে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আসামীর পক্ষে সিদ্ধান্ত হয় (এখানে দেখুন)। সে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গোলাম আযমকে ব্রিটেনের ভিসা দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্য অভিবাসন আপিল ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এখানে পাঠক কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করুন:

— ২০১০ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাজ্য অভিবাসন আপিল ট্রাইবুনাল চূড়ান্তভাবে গোলাম আযমের ব্রিটেনের ভিসা লাভের পক্ষে রায় দেয়।

— ২০১০ সালের জুন মাসেই গোলাম আযম বাংলাদেশ ত্যাগ করে যুক্তরাজ্য চলে যেতে পারেন এবং সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন এমন খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এখানে দেখুন।

— ২০১০ সালের জুলাই মাসে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধের তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা।

— ২০১০ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে গোলাম আযম ১০ বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের মাল্টিপল-এনট্রি ভিসা লাভ করেন।

যেটা লক্ষনীয় তা হল — বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রম অনুসারে নিজে একজন সম্ভাব্য প্রধান আসামী জেনেও (সারা দেশ জানে, সুতরাং গোলাম আযমের না জানার কোনো কারণ নেই) গোলাম আযম যুক্তরাজ্যে ভিসা লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এর পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য আসলে কী ছিল? যুক্তি আর তথ্য আমাদের কী বলে? এটা কি ধরে নেয়ার কোনো কারণ আছে যে তিনি যুক্তরাজ্যে কেবল পরিবারবর্গকে দেখতেই যাচ্ছেন (যেমনটি তিনি ভিসার আবেদনে দাবি করেছেন), আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল তাঁকে বিচারের জন্য “ডাক দেয়া মাত্র” তিনি আবার বাংলাদেশ পানে নিজ দায়িত্বে ছুটে এসে হাজিরা দেবেন? ইতিহাস বলে — অতীতে তিনি তা দেননি। অনেকেরই স্মরণে আছে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছু দিন আগেই তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দালাল আইনে যখন আর সবার বিচার চলছিল সেই পুরো সময়টাই গোলাম আযম দেশ থেকে দূরে দূরেই থেকেছেন দালাল আইনের আওতায় বিচারের হাত বাঁচিয়ে। এভাবে কখনো থেকেছেন পাকিস্তানে, কখনো যুক্তরাজ্যে, বাংলাদেশের বিপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টায়। সুতরাং, তাঁর অতীতের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে এটা ধরে নেয়া খুবই যুক্তিযুক্ত হবে যে সুযোগ পেলেই গোলাম আযম আবারও ট্রাইবুনালে বিচারের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করতেন, যুক্তরাজ্যের ভিসা লাভের অব্যাহত প্রচেষ্টা যার প্রমাণ। সুতরাং, শুধু পলায়নের সম্ভাবনা প্রতিরোধের জন্য হলেও আসামী গোলাম আযমকে জামিন না দিয়ে আটক রাখা যুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়।
***********************
এই হল গোলাম আযমের গ্রেফতার এবং বিচারকে ঘিরে সাম্প্রতিক দু’টো বিভ্রান্তির জবাব। পরের কোনো পর্বে চেষ্টা করবো গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগগুলোর প্রকৃতি নিয়ে লিখতে।

ধন্যবাদ।

***********************
রেফারেন্স:

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

১৪ comments

  1. মাসুদ করিম - ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (১০:৩১ অপরাহ্ণ)

    আরেকটা ব্যাপার গোলাম আযম হাজিরা দিতে গেলেই তার কোনো এক গুণধর পুত্রের হুইল চেয়ার ধরতে হয় কেন, এটা তো গোলাম আযমের শেষ যাত্রার মুর্দার খাটিয়া নয় যে তার পুত্ররা খাটিয়া ধরে শোক করবেন। এভাবে তার পুত্রদের এন্ট্রি নিতে দেয়া কি ঠিক?

  2. Pingback: -নিঝুম মজুমদার এর বাংলা ব্লগ » গোলাম আজমের নাগরিকত্বের মামলা ও জামাতী মিথ্যাচারের উত্তর» blog.

  3. বিবেকবান মুসলিম - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (১:০৩ অপরাহ্ণ)

    nijum mojumder r raihan baroter taka khawa golam. eder dikkar janai.

    • মাসুদ করিম - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (২:১৫ অপরাহ্ণ)

      এটাই বিবেক[বহুব্যবহৃত টিব্যাগ]বান মুসলমানদের আরেক বিভ্রান্তি,বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বললে — বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কথা বললে তাকে ভারতের দালাল/গোলাম বলা। কেন? রায়হান রশিদ ও নিঝুম মজুমদার তো ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন — তাদেরকে বলতে হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দালাল/গোলাম বলুন।

      • সায়মা সুলতানা - ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৫:৫০ পূর্বাহ্ণ)

        জটিল জবাব মাসুদ ভাইয়া, স্যালুট আপনাকে!

  4. এ হাসনাত - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৫:১০ অপরাহ্ণ)

    অপরাধ নিরূপণের জন্য প্রয়োজন হয় ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল আদালতের (যেমনটি বতর্মানের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল), কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সে জাতীয় কোনো আদালত নয়। সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ) কেবল আইনগত বৈধতা এবং সংবিধি ও সংবিধানের ব্যাখ্যারviii বিষয়গুলোই নিরূপণ করতে পারে।

    এ তথ্যটি আমার জানামতে ভুল। আদালত ৩ প্রকার।
    ১। ক্রিমিনাল কোর্টঃ যেমন, ম্যাজিস্ট্রট কোর্ট
    ২। সিভিল কোর্টঃ যেমন, অ্যাসিস্টেন্ট জাজ কোর্ট।
    ৩। ক্রিমিনাল ও সিভিল উভয়ঃ যেমন, সুপ্রিম কোর্ট।
    এ কোর্টগুলোর ক্ষমতাও নির্দিষ্ট। একটু খোজ নিলেই পেয়ে যাবেন, সুপ্রিম কোর্ট সকল ধরণের মামলা পরিচালনা করতে পারেন।

    • রায়হান রশিদ - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৬:০৭ অপরাহ্ণ)

      @ এ হাসনাত,

      ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

      আপনি লিখেছেন:

      ৩। ক্রিমিনাল ও সিভিল উভয়ঃ যেমন, সুপ্রিম কোর্ট।
      এ কোর্টগুলোর ক্ষমতাও নির্দিষ্ট। একটু খোজ নিলেই পেয়ে যাবেন, সুপ্রিম কোর্ট সকল ধরণের মামলা পরিচালনা করতে পারেন

      এখানে ধারণাগত কিছু ভুল হচ্ছে বলে মনে করি। সিভিল এবং ক্রিমিনাল বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে সুপ্রীম কোর্ট, একথা ঠিক, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব ধরণের সিভিল আর সব ধরনের ক্রিমিনাল বিষয় সুপ্রীম কোর্ট দেখতে পারে। সুপ্রীম কোর্ট যখন তার ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন ব্যবহার করে, সেটার ধরণ “ট্রায়াল কোর্ট” এর ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন থেকে গুণগত এবং প্রকৃতিগতভাবে আলাদা। সুপ্রীম কোর্ট ফৌজদারী ব্যাপারে যে বিষয়গুলো দেখে সেগুলো হল: ক্রিমিনাল আপিল (ফৌজদারী নিম্ন আদালতে রায় হয়ে যাওয়ার পর), ক্রিমিনাল রিভিশন, ক্রিমিনাল মামলার ইন্টারলোকিউটারী আপিল (নিম্ন আদালতে প্রোসিডিং এর মধ্যখানে), নিম্ন আদালতে ক্রিমিনাল প্রোসিডিং এর বৈধতা বিষয়ে কোন রীট আবেদন (যেমন: certiorari) ইত্যাদি ইত্যাদি। একে “ট্রায়াল কোর্ট” এর ফৌজদারী এখতিয়ারের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ, ট্রায়াল কোর্টের ফৌজদারী এখতিয়ারগুলো হল: অভিযোগ আমলে (cognizance) নেয়ার এখতিয়ার; ফৌজদারী অপরাধের সাপেক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করবার এখতিয়ার; তার সামনে ফৌজদারী অপরাধের বিষয়ে সাক্ষীদের জেরা-জবানবন্দী গ্রহণের এখতিয়ার; সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দায় (আপিল বা কনফার্মেশন বাদ দিয়ে) নিরূপণের এখতিয়ার। তালিকাটা আরও দীর্ঘ।

      আপনি আমার লেখার যে অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন, তার ঠিক আগের লাইনটি আপনি হয়তো খেয়াল করেনি, এবং উদ্ধৃত করা অংশটুকুর পরের লাইনগুলোও হয়তো লক্ষ্য করেননি, যেখানে বিষয়টি এবং ব্যতিক্রমের দিকগুলো ভালভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

      যেমন, আপনি আমার লেখার যে অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন, তার ঠিক আগের লাইনটি হল:

      “আন্তর্জাতিক অপরাধ” নিরূপণের জন্য যে ধরণের আদালত প্রয়োজন হয়, সুপ্রিম কোর্ট সে ধরণের আদালত নয়। অপরাধ নিরূপণের জন্য দরকার সাক্ষী-সাবুদ-এর জবানবন্দী-জেরার ব্যবস্থা, যা ‘কিছু ব্যতিক্রম’ বাদে সুপ্রিম কোর্টে নেই।

      আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না কোন অভিযুক্তের “আন্তর্জাতিক অপরাধ” প্রাথমিকভাবে নিরূপনের এখতিয়ার সুপ্রীম কোর্টের আছে? থাকলে কোন্ আইনে আছে আশা করি তা উল্লেখ করবেন এখানে। সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ার এখানে আপিল এখতিয়ার (appellate jurisdiction, আপীল বিভাগের ক্ষেত্রে), রীট জুরিসডিকশন (original jurisdiction, হাইকোর্ট এর ক্ষেত্রে) supervisory এখতিয়ার (হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি। পরের বিষয়টি এখনও আইনগতভাবে নির্দিষ্ট হয়নি। ২০১০ এ জামাতের করা রীট পিটিশন দু’টো দেখে নিন।

      এখানে বলাই হয়েছে “কিছু ব্যতিক্রম” এর ক্ষেত্রে হাইকোর্ট সাক্ষী-সাবুদ এনে তাদের কাছ থেকে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে। এই ব্যতিক্রমের উদাহরণ হল “কোম্পানী আইন” সংক্রান্ত বিষয়গুলো। অপরাধ বা ফৌজদারী কোন বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের সেভাবে সাক্ষী-সাবুদ আদালতে এনে জেরা-জবানবন্দী করার কোন নজির আমার জানা নেই। আপনার জানা থাকলে আশা করি জানাবেন। আর সাক্ষী-সাবুদকে আদালতে এনে যদি জেরা-জবানবন্দীই না করতে পারেন (তালিকাটা আরও দীর্ঘ), তাহলে অপরাধ নিরূপণ হবে কি উপায়ে?

      সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে যদি হাইকোর্ট অন্যান্য নির্দিষ্ট ফৌজদারী আদালতের যা কাজ (অপরাধ নিরূপণ) তা করতেই পারতো, তাহলে দেশের অন্যান্য ফৌজদারী আদালত বা ফৌজদারী আইনের কোনও প্রয়োজন পড়তো না।

      আমার লেখার মধ্যখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করা অংশটির পরের অংশটিও হয়তো আপনি খেয়াল করেননি। সেখানে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা হয়েছে:

      অপরাধ নিরূপণের জন্য প্রয়োজন হয় ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল আদালতের (যেমনটি বতর্মানের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল), কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সে জাতীয় কোনো আদালত নয়। সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ) কেবল আইনগত বৈধতা এবং সংবিধি ও সংবিধানের ব্যাখ্যারviii বিষয়গুলোই নিরূপণ করতে পারে। যেমন: নাগরিকত্ব বাতিল আইনত বৈধ কি না এমন প্রশ্ন। কিন্তু, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী কিছু পরিস্থিতি ছাড়া, কোনো তথ্যগত প্রশ্ন (question of fact), বিশেষত তা যদি ১৯৭১ সালে গোলাম আযমের অপরাধ নিরূপণের মতো কোনো প্রশ্ন হয়, তাহলে তা সুপ্রিম কোর্ট নিরূপণ করতে পারে না। এ জাতীয় কোনো তথ্যগত প্রশ্ন যদি নিরূপণের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট বড়জোর কোনো নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দিতে পারে সাক্ষী-সাবুদ-জবানবন্দী-জেরা-আলামত বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা উদ্‌ঘাটন করতে, কিন্তু তাও কেবল সে-সব মামলার ক্ষেত্রে যেগুলোর উৎপত্তি নিম্ন আদালত থেকেix। অথবা, নীচের কোনো ফৌজদারি আদালত থেকে কারো অপরাধের বিষয়ে তথ্যগত নিষ্পত্তি এবং রায় হয়ে আসলে সুপ্রিম কোর্ট কেবল তার আইনগত প্রশ্নের বৈধতার দিকগুলো দেখতে পারে।

      সবচেয়ে বড় কথা গোলাম আজম এর বিরুদ্ধে ১৯৭১ এ সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার কেবলমাত্র দু’টো আইনে হতে পারে বা হতে পারতো:

      ১- ১৯৭২ সালের দালাল আইনে, এবং
      ২- ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনে।

      এই দু’টো আইনের বাইরে বাংলাদেশের আর কোন আইনে গোলাম আজমের ১৯৭১ এর অপরাধ নিরূপন করা যাবে না, বা বিচার করা যাবে না। (কেন যাবে না সেটা অন্য প্রসঙ্গ)। আর এই দু’টো আইনের কোনটিতেই এমন কিছুই বলা নেই যা থেকে কেউ (ভুলভাবে) ধরে নিতে পারে যে সুপ্রীম কোর্টকেও এ ধরণের “আন্তর্জাতিক অপরাধ” নিরূপণের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে! (এই “আন্তর্জাতিক অপরাধ” -গুলো হল: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদি)। এমন কোন বিধান যদি আপনি উল্লেখিত দু’টো আইনে (দালাল আইন, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস আইন) পেয়ে থাকেন তাহলে এখানে উল্লেখ করার অনুরোধ থাকলো।

      ধন্যবাদ।

      • সায়মা সুলতানা - ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ)

        এই জবাবটা না আবার হাসনাত ভাইয়ার কাছে বদহজম হইয়া যায়, তাই-ই ভাবতাছি!!

  5. সায়মা সুলতানা - ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    @ জনাব এ হাসনাতঃ ভাইয়া, সুপ্রীম কোর্টের কাজের ধরন ধারন না বুঝে পান্ডিত্য জাহির করতে এসে অবশেষে আপনি বললেন, আদালত নাকি ৩ প্রকার। হাসব না কাঁদব ভেবেই পাচ্ছি না। ভাইয়া আপনি খুব ফানি! এটা কি “হাসনাত’স ম্যানুয়াল অন কোর্ট’স স্ট্রাকচার” থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা হয়েছে? আজব বটে, যে বিষয়ে ভালমতো জানা-বোঝা নাই, সেই বিষয়ে সাহসিকতার সাথে দু’কলম লিখেও ফেললেন, তাও কিনা একজন আইন গবেষকের লেখাতে এসে!!

    • Sabuz Paul - ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (১০:৪৮ অপরাহ্ণ)

      লেখাটি নিয়া মন্তবের প্রেক্কিতে বিবেকবান মুসলিম নামের ভদ্ররোকের ডিএনএ টেস্ট করানোর প্রয়োজনীয়তা আছে মনে হয় । বয়স নিয়া আরো একটি জবাব আছে এ লিন্কে http://www.thedailystar.net/magazine/2012/01/02/chintito.htm

  6. জয় - ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ (৩:২৯ পূর্বাহ্ণ)

    রায়হান সাহেব এ জাতিয় daily news paper এ পাথান না কেন

  7. Pingback: মুক্তাঙ্গন | অন্তঃমিল: লাজলো সাতারি, জন দেমইয়ানযুক, গোলাম আযম | রায়হান রশিদ

  8. মাসুদ করিম - ১৬ জুলাই ২০১৩ (১:৩০ পূর্বাহ্ণ)

    ১৫ জুলাই ২০১৩এ গোলাম আযমের আন্তর্জাতিক অপরাধের রায় হল। রায়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু প্রদত্ত দণ্ড গোলাম আযমের ‘বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা’করে বা বিবেচনাপীড়িত হয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না হয়ে ৯০ বছরের কারাবাস হয়ে গেল। এ রায়ের ফলে একটি বিভ্রান্তির (আসামীর অপরাধের বিষয়টি ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া) অবসান হলেও আরেকটি বিভ্রান্তি (বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা)রয়েই গেল।

    যুদ্ধাপরাধের মূল হোতার ৯০ বছর জেল

    ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারক এ টি এম ফজলে কবীর সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন।

    ঐতিহাসিক এই রায়ে বলা হয়, অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ৯১ বছর বয়সী এই আসামিকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

    বিচারপতি কবীর বলেন, “তার যে অপরাধ এর সবগুলোই সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি আছেন। তার বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এই সাজা দেয়া হয়েছে।

    এর মধ্যে প্রথম দুটি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার দায়ে ১০ বছর করে মোট ২০ বছর, তৃতীয় অভিযোগে অপরাধের উস্কানি দেয়ার দায়ে ২০ বছর, চতুর্থ অভিযোগে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করার দায়ে ২০ বছর এবং পঞ্চম অভিযোগে হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ায় ৩০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে গোলাম আযমের।

    রায়ের দিন থেকেই প্রতিটি অভিযোগের সাজা একের পর এক কার্যকর হবে। অর্থাৎ মৃত্যু না হলে টানা ৯০ বছর জেল খাটতে হবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ‘মূল হোতা’কে।

    উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর অন্যতম প্রধান শিষ্য গোলাম আযম রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। তবে রায়ের পর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি সাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত এই জামায়াত নেতা ।

    তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দণ্ড ঘোষণার পর হেসে ওঠেন। বাবার কাছে গিয়ে বলেন- ‘সব ঠিক আছে, ফাঁসি হয়নি।’

    একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের চার দশক পর এই বিচার নিয়ে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও রায়ের পর প্রসিকিউশন এবং আসামির আইনজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা, যারা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।

    রায় প্রত্যাখ্যান করে জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে গোলাম আযমের মুক্তির দাবিতে একই দিনে হরতাল ডেকেছে তার দল জামায়াতে ইসলামী।

    আগের রায়গুলোর পর জামায়াতি সহিংসতার প্রেক্ষাপটে রোববার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে পুলিশ ও র্যর‌্যাব সদস্যরা। ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।

  9. রেজাউল করিম সুমন - ২৪ অক্টোবর ২০১৪ (১১:৫৯ অপরাহ্ণ)

    ২৩ অক্টোবর ২০১৪ : যুদ্ধাপরাধীদের ‘গুরু’ গোলাম আযমের মৃত্যু

    বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যার নাম আসে সবার আগে, সেই গোলাম আযম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সাজা ভোগের মধ্যেই মারা গেছেন।

    ৯২ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে তার, যার আরও ৮৯ বছর কারাভোগ বাকি ছিল।

    বিচারাধীন অবস্থা থেকে এই হাসপাতালে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযম। গত বছরের ১৫ জুলাই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পরও এখানেই ছিলেন তিনি।

    ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের আপিলের শুনানির দিন ঠিক হওয়ার একদিন বাদেই গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটার খবর আসে।

    এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে, তারও কয়েক ঘণ্টা পর মধ্যরাতে সাংবাদিকদের সামনে এসে মৃত্যুর ঘোষণা দেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া।

    যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে গোলাম আযমের আগে শাস্তি ভোগের সময় মৃত্যু হয় আব্দুল আলীমের। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার মামলারও কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায়।

    গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের রায় দেওয়ার সময় বিচারক বলেছিলেন, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হল।

    যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের তখনকার আমিরকে।

    তার তার জন্য যে শাস্তি তাকে দেওয়া হয়, তা এক বছর তিন মাস খেটেই মারা গেলেন তিনি। জীবদ্দশায় যিনি একাত্তরের বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কখনও ক্ষমা কিংবা দুঃখ প্রকাশও করেননি।

    গোলাম আযমের অবস্থার অবনতির খবর শোনার পর হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেছিলেন, “বিকালে তার প্রেসার কমে যায়। এ কারণে ওষুধ দিয়ে প্রেসার স্বাভাবিক রাখা হয়। এক কথায় ওষুধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।”

    তখন থেকে গোলাম আযমের কথা বলায় জড়তা দেখা দেয় বলে মজিদ ভূঁইয়া জানান।

    রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলে শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রাত পৌনে ১২টার দিকে জামায়াত নেতার মৃত্যুর ঘোষণা আসে।

    হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে গোলাম আযমের মৃত্যু হয়।

    বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর জামায়াত নেতাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।”

    হাসপাতালে উপস্থিত গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী রাত সোয়া ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “মনে হল, আমার বাবা আর নাই। নিস্তেজ অবস্থায় আছেন। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে ডাক্তাররা এখনও আমাকে কিছু জানায়নি।”

    ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হেফাজতে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন জামায়াত নেতা। সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে ঢাকার জেলার মো. নেছার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

    রাতেই হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেট তারিক হাসানের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করে দেয় পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৩টায়। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে রাখা হয়েছে।

    তবে ময়নাতদন্তের না করে লাশ হস্তান্তরের জন্য গোলাম আযমের পরিবার ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন দিয়ে চেয়েছেন। তাদের সকালে যেতে বলেছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

    গোলাম আযমকে মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আজমী। তবে তা তার অন্য ছেলেরা দেশে ফিরলে কয়েকদিন পর হবে বলে জানান। সেই পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীর লাশ থাকবে হিমঘরে।

    ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযমের পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাঁওয়ে।

    ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (এখনকার কবি নজরুল কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।

    গত শতকের ’৪০ এর দশকে এক মেয়াদে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন গোলাম আযম। ওই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জিএস হিসেবে তার একটি স্মারকলিপি দেওয়াকে ‘ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালায় তার দল জামায়াতে ইসলামী; যদিও পরে তিনি নিজেই তার ওই পদক্ষেপ ভুল ছিল বলে উল্লেখ করেন।

    ছাত্রজীবন শেষে ১৯৫০ থেকে পাঁচবছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান গোলাম আযম। ওই সময়ই সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন তিনি।

    ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়।

    ১৯৬৯ সালে গোলাম আযম যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

    একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

    মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

    ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; তা-ও পাকিস্তানি পাসপোর্টে।

    বাংলাদেশে ফেরার পর ১৯৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটি জানাজা পড়তে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের এই নেতা।

    ১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন।

    ওই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আবার সামনে আসে, যার পরিণতিতে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়।

    এর মধ্যে আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম। এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছিলেন, থাকছিলেন মগবাজারে।

    যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। পরের বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তিনি বিএসএমএমইউতে ছিলেন এবং বৃহস্পতিবার মারাও গেলেন সেখানে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.