সাংসদ হুইপদের দুর্নীতি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড়। জনৈক প্রাক্তন হুইপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে – তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে সংসদের ক্যান্টিন থেকে বিস্তর তেল ঘি হজম করেছেন! তিনি যে খুব ভোজন-রসিক তা তার তালিকা দেখেই অনুমান করা যায় – ঘি, পোলাওয়ের চাল, ডানো গুঁড়ো দুধ, তাজা লিপটন চায়ের পাতা, দাদখানি চাল ইত্যাদি। হুইপ সাহেবের বাসায় যে বিস্তর পোলাও-মাংসের আয়োজন হয় সে-ব্যাপারেও নিশ্চয় কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। [...]

১. সাংসদ হুইপদের খাদ্যবিলাস এবং জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা অথবা ভ্যান গগের ‘দ্য পটেটো ইটার্স’।

সাংসদ হুইপদের দুর্নীতি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড়। জনৈক প্রাক্তন হুইপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে – তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে সংসদের ক্যান্টিন থেকে বিস্তর তেল ঘি হজম করেছেন! তিনি যে খুব ভোজন-রসিক তা তার তালিকা দেখেই অনুমান করা যায় – ঘি, পোলাওয়ের চাল, ডানো গুঁড়ো দুধ, তাজা লিপটন চায়ের পাতা, দাদখানি চাল ইত্যাদি। হুইপ সাহেবের বাসায় যে বিস্তর পোলাও-মাংসের আয়োজন হয় সে-ব্যাপারেও নিশ্চয় কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। সাম্প্রতিক বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরিপে দেখা গেছে : পৃথিবীতে একশো কোটি লোক অভুক্ত থাকে। কী পরিমাণ লোক ভালো-মন্দ খাবার খেয়ে থাকে তার একটা তালিকা তৈরি করা গেলে তাতে আমাদের মতো গরিব দেশের বড়লোকরাই চ্যাম্পিয়ন হবে। এত পোলাও-মাংস হজম করার পরিণতি কী, তা আপনারা সবাই জানেন – শেষ গন্তব্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটাল। যেটা হুইপ সাহেবের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সরকারি টাকায় প্রচুর ঘি-পোলাও খেয়ে হার্টের ব্লক, আবার তা সারানোর জন্য সরকারি অর্থেই মাউন্ট এলিজাবেথে ভর্তি। সত্যিকার প্রহসনই বটে।

আমাদের দেশের গরীব মানুষের খাদ্যতালিকা কী? তাদের কপালে কি জোটে পোলাও-মাংস? গ্রামে বসবাসরত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শুধুমাত্র কাঁচামরিচ আর লবণ দিয়ে থালার পর থালা ভাত হজম করতে হয় তাদের। মাছ-মাংসের কোনো বালাই নেই, তাই প্রোটিনের ঘাটতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে গরীবের পোলাও-মাংস খাওয়ার বিষয়টি একবার নিজের চোখে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। কাওরান বাজারের পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বস্তির সামনে দেখেছিলাম, বিভিন্ন বিয়েবাড়ি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া উচ্ছিষ্ট পোলাও-মাংস রাস্তার পাশে ভাগ দিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। আর কেউ কেউ কিনে নিয়ে দিব্যি পরমানন্দে খাচ্ছে সেই খরখরে পচা খাবার! এত বৈষম্যপীড়িত দেশ পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা কে জানে।

মাঝে-মাঝে বিদেশীরা আমাদের দেশের দারিদ্র্য নিয়ে আমাকে নানা প্রশ্ন করে; আমি তাদের বলি, আমাদের বড়লোকদের তো দেখোনি, দেখলে নিশ্চয় অবাক হবে। গুলশান, বনানী, বারিধারাতে এক চক্কর ঘুরিয়ে আনলে তোমাদের বিশ্বাসই হতে চাইবে না বাংলাদেশের গরিবিয়ানা হাল। আমাদের মন্ত্রী মিনিস্টার সাংসদ আর আমলাদের যে ঠাট-বাট তা দেখে হয়তো মূর্ছা যাওয়ার দশা হবে তোমাদের। যে-ধরনের গাড়িতে তারা চড়ে, তা হয়তো জন্ম দেবে আরেকটি রেকর্ডের – পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশের হর্তাকর্তাদের সবচেয়ে দামি গাড়ি! আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দিই – বাংলাদেশ গরীব-করে-রাখা একটি দেশ, বৈষম্যের যাঁতাকলে নিয়ত নিষ্পেষিত একটি দেশ।

মাঝে-মাঝে ভাবি, আমাদের দেশের উঁচুতলার হর্তাকর্তারা কি কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখেছে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা অথবা ভ্যান গগের ‘দ্য পটেটো ইটার্স’? আমি মনে করি, শিল্পের আছে অন্তরাত্মায় ঘা মারার শক্তি।

২. বাঙালির ভাতের অভাব থাকলেও টিভি দেখার কষ্ট ঘুচল

সরকার আরো দশটি টিভি চ্যানেল খোলার অনুমতি দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে দেশে বোকা-বাক্সের বাণিজ্য বেশ রমরমা আকার ধারণ করবে। বিস্তর আফিম-সোপ তৈরি হবে। ‘আফিম’ বলছি এজন্য যে, আমাদের দেশের নানা শ্রেণীর মানুষ এই সোপগুলো আফিমের মতোই গেলে। পনেরো কোটি বাঙালি সমস্ত দুঃখ-বেদনা ভুলে এক ধরনের টিভি বিনোদনে মত্ত হয়ে থাকবে – এও-বা মন্দ কী! পরাক্রমশালী রোমান সম্রাটরা মনে করতেন, জনগণের জন্য পর্যাপ্ত রুটি আর সার্কাসের ব্যবস্থা করতে পারলে তারা কখনো বিদ্রোহ করবে না। তাই রোমানদের জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হতো এবং তাদের জন্য রোম শহরে তৈরি করা হয়েছিল প্রচুর উষ্ণ স্নানাগার – তারা সেখানে অলস সময় কাটাত। আর সময় পেলেই চলে যেত কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের বীভত্স লড়াই দেখতে। তাতে শেষ রক্ষা হয়নি, ঠেকানো যায়নি রোমান সাম্রাজ্যের পতন। সে অবশ্য অন্য ইতিহাস। একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপট আবার ভিন্ন – এখন বিনোদন ঘরে ঘরে, অন্ন বস্ত্র আর বাসস্থানের সাথে টেলিভিশন দেখার অধিকারও এখন একটি মৌলিক অধিকার! মানুষ এখন বিস্তর সময় অতিবাহিত করে বোকা-বাক্সের সামনে। আগে ইউরোপ আমেরিকায় টেলিভিশনকে বোকা-বাক্স বলে অভিহিত করা হতো; এখন এই বাক্সটি যথেষ্ট চালাক-চতুর হয়ে গেছে, মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের সামনে বসিয়ে রেখে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন কীভাবে হজম করানো যায় তার যাবতীয় কায়দাকানুন রপ্ত করে ফেলেছে। আর গরীব দেশগুলোতে এই টেলিভিশন এক নব্য-আফিম হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

গার্মেন্টস-কর্মী সুফিয়া হয়তো কষ্টমষ্ট করে কিস্তিতে চোদ্দ ইঞ্চি সাদা-কালো অথবা কালার টিভি কিনে ফেলল; বিষয়টা যেন এমন যে, সে অনেকটা স্বর্গের কাছাকাছি চলে গেল। প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বস্তিতে ফিরে গা-টা এলিয়ে দিয়ে টেলিভিশন দেখায় মত্ত হয়ে ওঠে সে, লাক্স ফটো-সুন্দরীদের সুন্দর মুখগুলো দেখে এক ধরনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। অতঃপর সে ভুলে যায় তার অতি অল্প মূল্যে বিক্রি করা শ্রমের কথা, শোষণের কথা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের কথা। রিক্সা চালক হবিবরের একই সমস্যা, টিভি না দেখতে পারলে ওর মাথা ঠিক থাকে না। টিভি দেখতে দেখতে সে ভুলে যায় তার পায়ের গেঁটে বাতের সমস্যার কথা, ধীরে ধীরে সে যে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে সেটাও কিছুক্ষণের জন্য বেমালুম ভুলে থাকে। এই যুগের নব্য-আফিম সত্যি ভালোই ভূমিকা রাখছে। তবে এটা তো ঠিক, একটি গরীব দেশের উন্নয়নের জন্য টেলিভিশন খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারত, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণের একটি প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে নতুন প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের বার্তা পৌঁছে দিতে পারত। জানি না সরকার কী শর্তে নতুন চ্যানেলগুলোর অনুমোদন দিয়েছে। তবে সরকারের উচিত কিছু পজিটিভ শর্ত জুড়ে দেয়া। শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য চ্যানেল খোলার অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের মতো একটি ভুখা নাঙা গরীব দেশে, অশিক্ষা-কুশিক্ষায় নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া একটি দেশে, ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্যে ভরা একটি দেশে, যুদ্ধাপরাধীদের সদর্পে-ঘুরে–বেড়ানো একটি দেশে, শত অন্যায় আর দুর্নীতির পঙ্কিলতায় ডুবন্ত একটি দেশে, টেলিভিশন শুধু তথাকথিত বিনোদনের জোগান দেবে আর এক ধরনের আফিম-সিরিয়াল নির্মাণে মত্ত থাকবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।

৩. চীন জাগিল… বাংলাদেশ কবে জাগিবে…

মওলানা ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় প্রায়ই বলতেন, চীন জাগিল, জাপান জাগিল, বাংলাদেশ কবে জাগিবে…। বাস্তবিক পক্ষেই চীন জেগে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন চীনের ষাট বছর পূর্তিতে সেটাই যেন নতুন করে প্রমাণিত হলো। এই উপলক্ষে বিস্তর রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে প্যারেড, বিগ বাজেটের সিনেমা, ব্যয়বহুল চারুকলা প্রদর্শনী মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার যে, চীন আর সেই জমানায় নেই, তাদের কৌলীন্য কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। মাও সে-তুং-এর সেই মহান তৃতীয় বিশ্বের তত্ত্ব বোধহয় চীনদেশের ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য নয়। মওলানার সাথে চীনদেশের দহরম-মহরম ভালোই ছিল; খোদ মাও আর চৌ এন লাই-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল বলে জানা যায়, আর তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টাঙ্গাইলের সন্তোষে একটি ছোট ট্রাক্টর এখনো সংরক্ষিত আছে যা ছিল চেয়ারম্যান মাওয়ের উপহার। চীনদেশে অবশ্য এই ধরনের কমরেড-সুলভ আদান-প্রদানের সেই দিন আর নেই, বরং বাণিজ্যিক আদান-প্রদানই এখন মুখ্য। যাই হোক একটি দেশ বিশাল জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত, তারপরও নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দিব্যি ভালো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এর পেছনে অবশ্যই তাদের পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ইত্যাদির ভূমিকা আছে। সেই লং মার্চ, ইয়েন আন থেকে বেইজিং, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েই তো তাদেরকে এই জায়গাই আসতে হয়েছে; এই উত্তরণ মোটেই সহজ কর্ম ছিল না। আজকের এই উন্নতি পরিশ্রমী চীনা জাতির যোগ্য প্রাপ্তি। মাঝে-মাঝে ভাবি, আমরা কেন পারলাম না, আমরা কি পরিশ্রমী জাতি নই? আমাদের দেশের চাষীদের খাবার নেই, হাড়জিরজিরে শরীর, তাই নিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে পারে। আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টাই কাজ করে। আমাদের ছাত্ররা বিদেশে সব দেশের ছাত্রদের ছাপিয়ে প্রথম হয় – সে তো পরিশ্রমেরই গুণে। তাহলে আমরা কেন জেগে উঠতে পারলাম না বা পারছি না? তবে কেউ কেউ অবশ্য ঠিকই জেগে ওঠে! যেমন, যে-দল ক্ষমতায় আসে তার ছাত্র ক্যাডার বাহিনী বিপুল বিক্রমে জেগে ওঠে – হল দখল, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজিতে। ক্ষমতাসীনদের যুবশক্তি জেগে ওঠে নদী দখলের জোশে। যখন এ ধরনের দখলদারিত্বের বিপ্লব শুরু হয়ে যায় সর্বত্র, তখন আমার মাথায় আসে এক ভিন্ন ভাবনা, এক আকাশ কুসুম কল্পনা – ‘এমন যদি হতো’! শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের কর্মীরা গ্রামে চলে যাবে বাংলাদেশের সমস্ত নিরক্ষর মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে! মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টার আর পোর্টেবল স্ক্রিন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ছবি দেখাবে গ্রামের মানুষকে! ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলবে। ছাত্রলীগের ডাক্তার কর্মীরা গ্রামে গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিত্সা-সেবা দেবে। ইঞ্জিনিয়ার ছাত্ররা রাস্তাঘাট-সাঁকো তৈরি করে দেবে। কৃষিবিদ ছাত্ররা চাষীদের হাতে তুলে দেবে উন্নত বীজ। আর সত্যিই যদি এমন ঘটত তাহলে বাংলাদেশের জেগে উঠতে আর বাকি থাকত কি? চীনদেশ কিন্তু এভাবেই জেগে উঠেছিল।

  • রশীদ আমিন

    জ়ীবনের এই রহস্য কে করিতে পারে ভেদ, ভুবনডাঙ্গায় ঘোরা-ফিরা ক্ষণিকের বিচ্ছেদ

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

4 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
4
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.