মিডিয়া শিক্ষা
আয় তোর প্রশ্নটা শুনি, আয় দেখি গলা টিপে ধরে,
দেখি কত বাকস্বাধীনতা আছে তোর মিডিয়ার ঘরে।
কত দিকে ন্যারেটিভ পাল্টে, কত কথা দিয়েছি যে চাপা,
মিডিয়ার যা তা করা প্রশ্নে, সবকিছু বের হচ্ছে ফাঁপা।
মন তোর কোন দেশে থাকে রে, কেন তুই ভুলে যাস কথা—
দেখিস না আর সব মিডিয়া, লিটনের ফ্ল্যাটে যায় একা।
টোল খাওয়া ছাতাপড়া মাথাটা, টুপি দিয়ে ঢেকে রাখি বিলকুল,
সংবাদ প্রকাশের দায়েতে, জেলখানা সব আজ হাউসফুল।
কাৎ হয়ে কান ধরে দাঁড়া, দীপ্ত কী এটিএন চ্যানেল আই
জুলাইয়ের ঝোল খেয়ে ঝুলে যা, আমি আর ফ্যাসিজম ভাই ভাই।
মিডিয়াকে বাঁশ দেওয়া সেরে, নোবেলের গোলাখানি চুষিয়ে,
মানবিক করিডোরে গান গাই, প্রেসক্লাব দেখে দাঁত কেলিয়ে।
(সুকুমার রায়ের বিজ্ঞান শিক্ষা ছড়া অবলম্বনে)
“জান ও জবানের স্বাধীনতা” এনে “দায় ও দরদের রাজনীতি” প্রতিষ্ঠার ছবক দেওয়া ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন মিডিয়ার সামান্য দুয়েকটি সহজ-সরল প্রশ্নও সহ্য করতে পারছে না। গত নয় মাসে গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত নজির আমরা দেখেছি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম আর মিথ্যা মামলা তো আছেই, সেই সাথে চলেছে একের পর এক গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা দখলের মহড়া। সরকারের সৃষ্ট মব দিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে নিজেদের লোক নিয়োগ, ইচ্ছেমতো সাংবাদিক ছাটাই, দেশের সার্বিক দুঃসহ পরিস্থিতি চাপা দিতে নির্লজ্জ মিডিয়া-সেন্সর এবং সবশেষে গত ২৮ এপ্রিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে শুধুমাত্র প্রশ্ন করার অপরাধে দীপ্ত টেলিভিশন, এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আই—তিনটি বেসরকারি চ্যানেলের সাংবাদিককে ২৯ এপ্রিল জোরপূর্বক চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে1। শুধু তাই নয়, ইউনূস সরকারের চাপে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি তাদের সংবাদ কার্যক্রমও স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ2।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে সাংবাদিকদের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশের একটি প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একে তো ড. ইউনূস ক্ষমতা দখলের পরই দেশের গণমাধ্যমগুলোতে নেমে এসেছে শকুনের নীরবতা। সারাদেশে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-শিবির ও তাদের দোসরদের এবং সমন্বয়ক সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের নির্বিচার সন্ত্রাসের কোনো সংবাদই আমরা দেশের গণমাধ্যমে দেখতে পাই না। এমনকি দেশজুড়ে ৫ আগস্টের পর থেকে নারীর বিরুদ্ধে যে ভয়ানক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কেও গণমাধ্যমগুলোতে কোনো সংবাদ বা ফলো-আপ নিউজ নেই। ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ নিজেই এখন অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু হয়ে গেছে। সমন্বয়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা এবং জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি করছে, সে সম্পর্কেও কোনো সংবাদ নেই কোথাও। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমই এখন সংবাদ পাওয়ার একমাত্র জায়গা; কিন্তু সেখানেও চলছে সরকারের নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ।
জুলাই সন্ত্রাসের মতোই এই সন্ত্রাস-পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনাবলী শঠতায় পরিপূর্ণ। যারা বুঝে বা না-বুঝে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মৌলবাদী-জঙ্গীবাদীগোষ্ঠী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ডিপস্টেট, স্বার্থান্বেষী একাডেমিশিয়ান ও বিভিন্ন এনজিওসহ যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত-শিবিরের এ পরিকল্পিত নৈরাজ্যে3 গা ভাসিয়েছিলেন—তারাও এখন হয় মুখে কুলুপ এঁটেছেন, নাহয় লজ্জায় মুখ ঢেকেছেন। জুলাই মাসে ‘আমরাই বিকল্প’ওয়ালাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক নানা স্লোগান শুনেছি, গ্রাফিতি দেখেছি; গণমাধ্যম ও মানুষের বাক-স্বাধীনতাবিষয়ক নানা গালভরা গপ্পো শুনেছি—কিন্তু দিনশেষে সব শিয়ালেরই দেখি এক রা। খোদ প্রধান উপদেষ্টা—যে অবৈধ দখলদারের মতো প্যারাট্রুপার দিয়ে নেমে এসে ক্ষমতার মসনদে বসেছে—সে-ও একদা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিল, “আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন।”4
বাংলার সাদাসিধা জনগণ এই কথা কতখানি বিশ্বাস করেছিলেন জানি না—তবে দুয়েকজন যারা ‘মন খুলে সমালোচনা’ করা শুরু করেছিলেন, তাদের কাপড় খুলে দিয়েছে সরকারের মব বাহিনী। এ পর্যন্ত দেশের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যে মব সন্ত্রাস ঘটেছে, তার কোনোটিরই কোনো বিচার হয়নি, আইনের আওতায় আনা হয়নি একজনকেও। এসব ঘটনার সময় সরকার চোখে লালপট্টি বেঁধে রাখে আর সচিবালয়ে প্রেসব্রিফিংয়ের সময় সাংবাদিকরা যেন কোনো উল্টো প্রশ্ন করতে না পারেন, সে জন্য চোখ টাটিয়ে রাখে। গণমাধ্যমকর্মীরাও এখন তারাপদ রায়ের সেই মাতালের সুরে আওড়ে যাচ্ছেন—রিপোর্টিংয়ের সময় আমরা কোনো রিস্ক নিই না।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ২০২৫: ইউনূস সরকারের চুঁয়া ঢেঁকুর
কথায় আছে, চোরের সাক্ষী মাতাল—আর বাংলাদেশে বর্তমানে চোর ইউনূস সরকারের সাক্ষী হলো মাতাল সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও তাদের বগলঘেঁষা সুবিধাবাদী একাডেমিশিয়ানরা। কথাটি বলছি কারণ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নানা সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি দেখানো হচ্ছে, তার গলদগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যদি ধরতে পারি, তবে তারা কেন পারছেন না? মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে অসাংবিধানিক ইউনূস সরকারের সদ্যপ্রাপ্ত রতিসুখের প্রেক্ষাপটটি আলোচনা প্রয়োজন। ০৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)5 ২০২৫ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করেছে। সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। ১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ ও স্কোর ৩৩.৭১। ২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫ ও স্কোর ছিল ২৭.৬৪6।
ব্যাস! সূচক প্রকাশিত হতেই ইউনূসেক্সুয়াল জনতার হেভিওয়েট ইংরেজি আর লো-ফি বাংলায় ফেসবুক, এক্স আর ইনস্টাগ্রাম কাঁপানো শুরু হয়ে গেছে। সেই কাঁপুনির চোটে বাংলাদেশের বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গীসংগঠন হিজবুত তাহরীরের নেতা মো. মাহফুজ আলম7 গদগদ হয়ে বলেছে, “বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব গণমাধ্যম এখন সরকারের প্রভাবমুক্ত। কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে টেলিফোন করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না।”8
তথ্য উপদেষ্টা স্বীকার করলো, ১৪৯তম অবস্থানের মূল কারণ হলো গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের প্রভাবমুক্ত আচরণ। তার এই কথাটিকে গুরুত্ব দিয়েই আমি একটু খুঁজে দেখা চেষ্টা করেছি, এই সূচকে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান কত ছিল? আলোচ্য সূচকটি ২০০২ সাল থেকে প্রকাশ করে আসছে সংস্থাটি। রাজনীতি, আইনি সুরক্ষা, অর্থনৈতিক পরিবেশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও নিরাপত্তা—এ পাঁচটি বিষয়ের ওপর প্রশ্নমালাভিত্তিক জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে সূচকটি প্রণয়ন করে আরএসএফ। এক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট গবেষণা পদ্ধতি (Research Methodology) অনুসরণ করা হয়, যার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয় ২০২২ সালে9।
২০০৯ সাল থেকে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কী ছিল, তা নিচের সারণিতে দেখানো হলো।
সাল | দেশের সংখ্যা | বাংলাদেশের অবস্থান | বৈশ্বিক স্কোর |
---|---|---|---|
২০০৯ | ১৭৫ | ১২১ | ৩৭.৩৩ |
২০১০ | ১৭৮ | ১২৬ | ৪২.৫০ |
২০১১-১২ | ১৭৯ | ১২৯ | ৫৭.০০ |
২০১৩ | ১৭৯ | ১৪৪ | ৫৭.৯৯ |
২০১৪ | ১৮০ | ১৪৬ | ৫৭.৪২ |
২০১৫ | ১৮০ | ১৪৬ | ৫৭.০৫ |
২০১৬ | ১৮০ | ১৪৪ | ৫৪.০৬ |
২০১৭ | ১৮০ | ১৪৬ | ৫১.৬৪ |
২০১৮ | ১৮০ | ১৪৬ | ৫১.৩৮ |
২০১৯ | ১৮০ | ১৫০ | ৪৯.২৬ |
২০২০ | ১৮০ | ১৫১ | ৫০.৬৩ |
২০২১ | ১৮০ | ১৫২ | ৫০.২৩ |
২০২২ | ১৮০ | ১৬২ | ৩৬.৬৩ |
২০২৩ | ১৮০ | ১৬৩ | ৩৫.৩১ |
২০২৪ | ১৮০ | ১৬৫ | ২৭.৬৪ |
২০২৫ | ১৮০ | ১৪৯ | ৩৩.৭১ |
এখন সাইকেডেলিক তথ্য উপদেষ্টার কথাই যদি মেনে নিই, তাহলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এই সূচক অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো সময় ছিল ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত—প্রায় এক দশক—অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদ। এখন এক দশক ধরে দেশের গণমাধ্যমকে সন্তোষজনক অবস্থানে রেখেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার—আমি বলছি না, তথ্য উপদেষ্টার ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে সূচকের অংক বলছে। কিন্তু এই কথা তো তথ্য উপদেষ্টার ডানহাত (যেহেতু সকল মিটিংয়েই উপদেষ্টার ডানদিকে বসে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরীনই মানতে চাইবে না। মানতে চাইবে না আলী রীয়াজ, বদিউল আলম মজুমদার, শহীদুল আলম, ব্যারিস্টার সারা হোসেনের মতো ইউনূস সরকারের বগল-সংলগ্ন প্রথিতযশাগণ। তাহলে এই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর কি বদহজমের লক্ষণ নয়?
সম্প্রতি প্রকাশিত সূচকটি সম্পর্কে উপরের যুক্তিগুলো তুলে ধরলাম, কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি বাকস্বাধীনতার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছি। আমার মতো বাংলাদেশটাও এখন সকালে ঘুম থেকে উঠে গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাকস্বাধীনতা দিয়ে মুখ ধুচ্ছে, তিনবেলা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চিবিয়ে খাচ্ছে এবং লাল বাহাদুরেরা নীরেন্দ্রনাথের “বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়” জাতীয় পঙক্তিমালা জাপটে ধরে উপদেষ্টাদের দিকে তাকিয়ে বলছে—দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। সুতরাং, এইমুহূর্তে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো, বরং একমত হও ইউনূসের সাথে…তারপর বেঁচে থাকলে আপনিই জেনে যাবে, কত বড়ো ইতরের সাথে একমত হয়েছিলে তুমি। তাই আরএসএফের সূচকের বক্তব্য আমি মেনে নিলাম এবং মেনে নিয়েই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলাম যে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বর্তমানের তুলনায় জান্নাতুল ফিরদাউসে ছিল।
সাংবাদিকের লাশ ও ইউনূস সরকারের অবৈধ শাসন
অসাংবিধানিক ইউনূস সরকারের ন মাসের শাসনামলে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন তিনজন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই দেশের নানাস্থানে গণমাধ্যমকর্মীরা হামলার শিকার হতে থাকেন। ইউনূস ক্ষমতা দখলের পরও সাংবাদিক নির্যাতন কমেনি, বরং মাত্রাহীনভাবে বেড়েই চলেছে।
ইউনূসের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে প্রথম গণমাধ্যমকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় ২৮ আগস্ট দিবাগত রাতে10। রাত পৌনে দুইটার সময় রাজধানীর হাতিঝিলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জিটিভির নিউজরুম এডিটর ৩২ বছর বয়সী রাহনুমা সারাহর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর মরদেহ হাতিরঝিল লেকের পানিতে ভাসছিল11। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী গোলাম দস্তগীরকে গ্রেফতার করা হয়12, তার মালিকানাধীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টায়ার কোম্পানী, গাজী টায়ারের কারখানায় আগুন দেওয়া হয়13 এবং সেখানে পুড়িয়ে শ্রমিক হত্যা করা হয়14। জিটিভিও গাজী গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন গণমাধ্যম। যে সময়ে এই গণমাধ্যমের সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর লাশ পাওয়া গেছে, সে সময় রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানার শ্রমিকদেরও পুড়িয়ে মারছে জামাত-শিবির-জঙ্গী নেতৃত্বাধীন ইউনূস সরকারের মব বাহিনী15।

(ছবি সূত্র: প্রথম আলো)
গত নয় মাসে এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে আর কোনো তথ্য আমরা জানতে পারি না। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে কি না, হলে সেই মামলার অগ্রগতি কী—এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। তবে লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ জানিয়েছিল, এটা হত্যা না আত্মহত্যা—তা জানতে হলে ময়নাতদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; কিন্তু আজপর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যমেই সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর ময়নাতদন্তের বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। কী আড়াল করতে এই সাংবাদিক হত্যাকান্ডের তথ্য আড়াল করছে ইউনূস প্রশাসন?

এই হাতিরঝিল এলাকাতেই ১০ অক্টোবর বিএনপির নেতার প্রত্যক্ষ নির্দেশে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় দীপ্ত টেলিভিশনের সম্প্রচার কর্মকর্তা সাংবাদিক তানজিল হাসান ইসলাম তামিমকে16। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায় গণমাধ্যমসূত্রে, কিন্তু এই হত্যামামলা নিয়েও ইউনূস সরকারের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতার করা হলেও17, বর্তমানে এই মামলা ঠাঁই পেয়েছে ড. ইউনূসের ডিপফ্রিজে। এই হত্যামামলার মূল আসামী মামুন ইতোমধ্যে জামিনও পেয়ে গেছে18। সাংবাদিক তামিম হত্যা মামলার বিষয়ে ইউনূসের কর্তৃত্ববাদী নিপীড়নে মুখ খুলছে না গণমাধ্যমগুলোও।

মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় ১১ অক্টোবর ময়মনসিংহের সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জের মাঝিপাড়া টানপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির সামনে ৬৫ বছর বয়সী প্রবীণ সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্রকে বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা19। দুঃখজনক ঘটনা হলো, ইউনূস প্রশাসন প্রথমে স্বপন কুমার ভদ্রের হত্যাকান্ডকে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল—কেননা, ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক আদর্শের মানুষদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাকান্ড, দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মারক ভাস্কর্য ভাঙচুর ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনকে ড. ইউনূস নিজে “Celebration Mood” হিসেবে প্রকাশ্য গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিল20। স্বপন কুমার ভদ্রের নৃশংস হত্যাকান্ডকেও ইউনূসের অবৈধ প্রশাসন প্রথমে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে চালানোর অপচেষ্টা করেছিল; কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যাকান্ডের মূল কারণ ও হত্যাকারীর পরিচয় উঠে এলে, পুলিশ হত্যাকারী মাদক ব্যবসায়িকে গ্রেফতার করে। কিন্তু অগ্রগতি বলতে এটুকুই—এরপর সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্রের হত্যাকান্ড মামলার আর কোনো অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায় না।
কার্যালয়ে হামলা ও সাংবাদিক নির্যাতন: ইউনূসের ‘বাংলাদেশ ২.০’
ক্ষমতা দখলের পর ড. ইউনূস সাংবাদিকদের ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যে প্রতিহিংসা দেখিয়ে চলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। একের পর এক খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া ৫ আগস্ট বিকেলেই দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা চালায় জামাত-শিবিরসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী এবং বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। রাজধানীর বীর উত্তম সিআর দত্ত সড়কের সময় টেলিভিশন, বারিধারায় একাত্তর টেলিভিশন, মহাখালির ওয়্যারলেস গেইট এলাকার ডিবিসি নিউজ, কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ, তেজগাঁওয়ে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও প্রগতি সরণিতেগান বাংলা চ্যানেলের কার্যালয় ভাঙচুর করে তারা। শুধু কার্যালয় ভাঙচুর ও সাংবাদিক নির্যাতনই নয়, প্রতিটি অফিসেই নির্বিচারে লুটপাট চালায় এই জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাসীরা21।
ইউনূস সরকার ক্ষমতা দখলের পর ১৯ আগস্ট বেলা তিনটায় হামলা চালানো হয় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের ভবনে22। এই ভবনে কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, নিউজ টুয়েন্টিফোর ও রেডিও ক্যাপিটালের কার্যালয় অবস্থিত। সরকারি মদদে গণমাধ্যমের কার্যালয়ে মব সৃষ্টি করে এমন ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে কখনও ঘটেনি। সেই সাথে চলতে থাকে মালিকানা দখলও। রাতারাতি বিভিন্ন মিডিয়ার মালিকানা বদলে যায়—কার্যত বিএনপি-জামাত ও বৈষম্যবিরোধীর নেতারা দখল নেয় এসব মিডিয়ার।
ইউনূস ক্ষমতা দখলের পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত অপপ্রচারে নামে জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাসীদের সাইবার বাহিনী। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ-জামাত-শিবিরি ও হিজবুত তাহরীর বিরোধী সংবাদ পরিবেশনা করেছেন যাঁরা, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের নাম-ঠিকানাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো হয়। বিভিন্ন স্থানে কর্তব্যরত প্রতিবেদকরা মব-সন্ত্রাসের শিকার হন। অনেকের বাড়িঘরেও হামলা চালানো হয়।
অবশেষে একে একে শুরু হয় সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা। ২১ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিক দম্পতি একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক ও উপস্থাপক ফারজানা রূপা ও বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদকে23। কোনো মামলা ছাড়াই তাঁদের গ্রেফতার করে ইউনূস সরকার, খারিজ করে জামিন আবেদন24 এবং পরবর্তীতে তাঁদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে ইউনূস ও তার উপদেষ্টা পরিষদ25। ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত ও একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবুকে26। পরবর্তীতে তাঁদের নামেও খুনের মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
সরকারি মদদে মবের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের করুণ চিত্র এই অবৈধ-অসাংবিধানিক ইউনূস সরকারের আমলে বাংলাদেশ দেখেছে। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সাংবাদিক রাহাত সুমন ৫ আগস্টের পর জীবন বাঁচাতে ঢাকায় এসেও ইউনূস বাহিনী ও বিএনপি-সমর্থিতদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন গত বছরের ২৩ অক্টোবর।
(ভিডিও সূত্র: ফেসবুক)
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইউনূস সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে জামাত-শিবির-বিএনপি ও জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাসী কার্যক্রমের স্টেক হোল্ডার বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর এই প্রতিহিংসামূলক নির্যাতনের প্রতিবাদ যাঁরা করছেন, তাঁদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে নির্বিচারে। সাংবাদিক নেতা শেখ জামালকেও ইউনূসের প্রশাসন গ্রেফতার করে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করায়।

বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক মুন্নী সাহা কেবল সাংবাদিকতার অপরাধে ৩০ নভেম্বর রাতে মবের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় এবং শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়27। তাঁর নামেও করা হয়েছে ততোধিক মামলা। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন মতে, ৫ আগস্টের পর থেকে এই পর্যন্ত মোট ১৩ জন সাংবাদিক কারাগারে আছেন28।
জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করায় বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি নুরুজ্জামান লাবুকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় ইউনূস সরকারের ঠিকাদার জঙ্গীরা। গত ১১ এপ্রিল “আইএস আল কায়দার পতাকা নিয়ে মিছিল, ক্ষুণ্ন হচ্ছে ভাবমূর্তি’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি করার পর প্রতিবেদককে মোবাইলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে—কীভাবে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর পতাকা প্রদর্শনসহ চিহ্নিত জঙ্গীদের ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এছাড়াও এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন নুরুজ্জামান লাবু29।
শুধু মিথ্যা মামলা, হত্যাকান্ডের শিকার বা মব-সন্ত্রাসের শিকারই হচ্ছেন না সাংবাদিকরা; দায়িত্বরত নারী সাংবাদিক দলবদ্ধ ধর্ষণেরও শিকার হয়েছেন এই অসাংবিধানিক ইউনূস সরকারের আমলে। চলতি বছরের ১৭ মার্চ রাজধানীর পল্লবীর বারনটেকের গ্রিন সিটি এলাকার এক নির্মাণাধীন ভবনে একজন নারী সাংবাদিককে সারারাত আটকে রেখে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে অপরাধীরা। মূলত জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাসের স্ট্রাইকিং ফোর্স কিশোর গ্যাংয়ের অপকর্মের সংবাদ সংগ্রহের কারণেই এমন নির্মম নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে বটে, কিন্তু আর কোনো অগ্রগতির সংবাদ নেই30।
নারী সংবাদকর্মীদের ওপর পৈশাচিক যৌন আক্রমণ জুলাই সন্ত্রাস পরিচালনার সময়ও করেছিল আন্দোলনকারীরা। ৩০ জুলাই বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০ জুলাই বিকেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় পেশাগত দায়িত্বপালন করার সময় যৌন-সন্ত্রাসের শিকার হন তিনজন নারী সাংবাদিক। গ্যাস লাইট দিয়ে তাঁদের একজনের মুখমণ্ডলও পুড়িয়ে দেয় জুলাই আন্দোলনকারীরা31।
এ তো গেল সাংবাদিকের ওপর শারীরিক-মানসিক-অর্থনৈতিক নিপীড়নের ইতিহাস। ইউনূস সরকারের আমলে তিন দফায় দেশের ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিশন কার্ড বাতিল করা হয়, তা নজিরবিহীন32।

শুধু তা-ই নয়, গণমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রেস অ্যাক্রিডিশন নীতিমালা পর্যন্ত পরিবর্তন করেছে এই অবৈধ ইউনূস সরকার। এই নীতিমালা পড়লেই বোঝা যায়, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কতটা চাপে রাখতে চাইছে এই অসাংবিধানিক ইউনূয়স সরকার। নীতিমালায় বলা হয়েছে, অ্যাক্রিডিশন কমিটি প্রয়োজন মনে করলে সাংবাদিকদের তথ্য যাচাইয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন করাতে পারে33।
না, আপাতদৃষ্টিতে বক্তব্যটিতে আপত্তি করার মতো হয়তো কিছুই নেই; কিন্তু যখন আমরা জানতে পারি, অবৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাগরিকদের পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মতো সংবেদনশীল বিষয়টি উঠিয়ে দিয়ে34 সাংবাদিকের ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োগ করছে; তখনই বোঝা যায়—এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী।
মব সৃষ্টির মাধ্যমে কীভাবে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকরাই বা কী ভাবছেন, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া মব সন্ত্রাসের শিকার ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাক্তন সাংবাদিক জনাব ওমর ফারুকের ভাষ্যে। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ইউনূসের অবৈধ সরকার যখন জামাত-শিবির-জঙ্গীগোষ্ঠীকে দিয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, তখন ওমর ফারুক সেখানে ছিলেন সংবাদ পরিবেশনার দায়িত্বে। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন,
আমি তখন লাইভে ছিলাম। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষের কথা বলছিলাম। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝাতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। এমনকি সেখানে জাদুঘরটিও ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ নামে পরিচিত ছিল। এই শব্দটি ব্যবহার করার কারণে মব আমাকে ঘিরে ধরে মারধর করে।… বিচার পাওয়ার আশা নেই। মব সৃষ্টিকারীরা জানে যে সাংবাদিককে মারধরে তাদের কোনো শাস্তি হবে না।35
ক্ষমতা দখলের পর ইউনূসের শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতনের মাসভিত্তিক খতিয়ান নিচে একটি চার্ট আকারে উপস্থাপন করা হলো। অনেক ঘটনাই দেশের কর্পোরেট গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ করতে পারেননি সাংবাদিকরা—কারণ, ইউনূসের অলিখিত সেন্সরশিপ আইন। কোনো গণমাধ্যম অপ্রিয় সত্য লিখলেই ইউনূস বাহিনী হয় সেই গণমাধ্যমের সাংবাদিকের নামে মামলা দিচ্ছে, নাহয় মব লেলিয়ে প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালাচ্ছে।
তাই ফেসবুক-এক্স-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব এ চারটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অধিকাংশ তথ্য নিয়ে, স্থানীয়ভাবে প্রতিটি তথ্য যাচাই করে এবং কর্পোরেট গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, বিবিসি বাংলা, ডয়েচে ভেল, প্রথম আলো, সমকাল, ভয়েস অব আমেরিকা ও নিউএজ—এ আটটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদ বিবেচনায় নিয়ে নিচের চার্টটি তৈরি করা হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন বলতে এখানে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো—আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন বা হুমকি, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, উগ্রপন্থী-জঙ্গী বা তাদের দোসর কর্তৃক প্রাণণাশের হুমকি, মব বা অন্যান্য সন্ত্রাসের শিকার, দায়িত্বরত অবস্থায় নির্যাতন বা হুমকির শিকার ইত্যাদি। গবেষকদের বিশ্লেষণের সুবিধার্থে ২০২৪ ও ২০২৫ সালের তথ্য স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।


প্রাপ্ত তথ্য থেকে অবৈধ ইউনূস সরকারের আমলে গত নয় মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের ধরন সংক্রান্ত একটি বিশ্লেষণ করা যায়। সে বিশ্লেষণটি নিচে একটি পাই চার্টের মাধ্যমে দেখানো হলো।

নির্যাতনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ: আওয়ামী লীগের ১০ বছর বনাম ইউনূসের ৯ মাস
সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনামলেও ঘটেছে। বিশেষ করে নিবর্তনমূলক আইন সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ বা এর পূর্ববর্তী আইনসমূহ—ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা ৫৭ ধারার প্রয়োগের মাধ্যমে শুধু সাংবাদিক নয়; ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এমনকি সাধারণ মানুষও নানা ধরনের আইনি জটিলতায় পড়েছেন। এসব নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ হয়েছে রাজপথে ও অনলাইনে। গণমাধ্যমেই এ বিষয়ক প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রচার করা গেছে, আলোচনা করা গেছে টেলিভিশনের টক শো-তে। দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন বা কারাবন্দী করার ঘটনাও ঘটেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাংবাদিক নির্যাতনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। উপরোক্ত বিষয়গুলো তো আছেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যথেচ্ছভাবে সাংবাদিকদের খুনের মামলার আসামী করে মামলা দেওয়া, বিনা বিচারে কারাদন্ড প্রদান, আইন-বহির্ভূতভাবে কোনো কারণ ছাড়াই ছাঁটাই, গণমাধ্যমের মালিকানার দখল নেওয়া, গণমাধ্যমের অফিসে সরকারি মব সন্ত্রাসের হামলা-ভাঙচুর, সাংবাদিকদের মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি প্রদান এবং নারী সাংবাদিকদের দায়িত্বপালনকালে নির্মমভাবে নির্যাতন করা ইত্যাদি। ইউনূসের অবৈধ শাসনামলে দেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে36।
শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তনই নয়, সংখ্যার বিচারেও ইউনূসের শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিগত ১০ বছরের তুলনায় অনেক বেশি। আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের মোট ১৫ বছরের শাসনামলের মধ্যে শেষ ১০ বছরে ঘটে যাওয়া সাংবাদিক নির্যাতনের প্রাপ্ত ডাটা সাথে ইউনূসের অবৈধ সরকারের মাত্র নয় মাসের ডাটার তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে গত ১০ বছরের সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের কর্পোরেট গণমাধ্যমগুলো তো বটেই, মার্কিন ডিপস্টেটপন্থী ও আওয়ামী লীগবিরোধী এনজিও—যেমন: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), ব্র্যাক, ব্লাস্ট, আর্টিকেল নাইনটিন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নানা সময়ে পরিচালিত এ সংক্রান্ত বিভিন্ন জরিপ বা গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যও গ্রহণ করা হয়েছে।
এই তথ্য বিবেচনায় নিচের লেখচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দশ বছরের সাথে ইউনূস সরকারের গত নয় মাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

লেখচিত্রটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৩-২০২৪ এর জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই)। এই সময়ে ৩১৮টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর যখন অবৈধ ইউনূস সরকার ক্ষমতা দখল করলো, তখন ২০২৪ সালের পরবর্তী পাঁচমাসে (আগস্ট-ডিসেম্বর) সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬৭১টি—অর্থাৎ পূর্ববর্তী সাত মাসের দ্বিগুণেরও বেশি। ইউনূস সরকারের এখনও ১ বছর পূর্ণই হয়নি—নয় মাসেই প্রায় হাজারের কাছাকাছি সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশের ইউনূসেক্সয়াল বুদ্ধিজীবীরা যা-ই বলুক না কেনো—এই ডাটা কিন্তু তাদের এনজিও, তাদেরই পত্র-পত্রিকা বা প্রকাশনা থেকে নেওয়া। শুধু ইউনূস আমলে যেহেতু দেশের কর্পোরেট গণমাধ্যম ও সুবিধাবাদী এনজিওগুলো মৌনব্রত ভূমিকায় আছে, তাই এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি ঘটনা পোস্টদাতার সাথে যোগাযোগ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ভিকটিম বা তার পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
সব সাংবাদিকই খুনের মামলার আসামী: ইউনূসের চমকপ্রদ আবিষ্কার
মামলা দেওয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকদের কোণঠাসা করে ফেলার অভিনব এক অত্যাচার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ইউনূসের অবৈধ সরকার। ক্ষমতা দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু জুলাই সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় ২৬৬জন সাংবাদিকের নাম জড়ানো হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায়—৮৮টি। সিলেট ও চট্টগ্রামে যথাক্রমে ৩৯ এবং ৩৬ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বগুড়ায় ১০ থেকে ২০ জন করে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, বরগুনা, নড়াইল, পটুয়াখালী, ঠাকুরগাঁও, বরিশাল, মুন্সিগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, পিরোজপুর এবং নেত্রকোনাসহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও সাংবাদিকরা জুলাই-আগস্টের সহিংসতা সম্পর্কিত হত্যা বা অন্যান্য মামলায় আসামি হয়েছেন37।
সিলেটে যুক্তরাজ্যের একজন প্রবাসী ও দৈনিক সময়ে আলোর যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি মনোয়ার জাহান চৌধুরীকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে, যদিও কয়েক বছর আগেই যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন তিনি। সেখানে খেলাফত মজলিসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান গত বছরের ২৭ আগস্ট কোতোয়ালি থানায় নয়জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। বর্তমানে পিবিআই মামলাটি তদন্ত করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেবল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার জন্যই নয়, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ নিয়েও প্রতিশোধমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই জেলায় মোট ১৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং অন্তত দুইজন সাংবাদিক, যারা দুটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেন, মামলার কারণে তাদের চাকরি হারিয়েছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পরে যে ২৬৬ জন সাংবাদিককে বিভিন্ন হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাদের একজন ঢাকার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক শাহনাজ শারমীন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন বিবিসি বাংলার প্রতিবেদকের কাছে। তিনি বলেন,
৫ই অগাস্ট বঙ্গভবনের সামনে আমি লাইভ করছিলাম। সেদিনই ঢাকার আরেক প্রান্তে হওয়া একটি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ের করার মামলায় আমার নাম দেয়া হয়েছে।38
বাদ যায়নি প্রথম আলো-ডেইলি স্টার : স্বজনের পিঠেই ইউনূসের ছুরি
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড়ো সমালোচক ছিল বাংলাদেশের এই দুটো মিডিয়া। গুরুত্বের বিচারে তো বটেই, অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকেও তারা বিগত সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে কাজে লাগিয়েছে। ড. ইউনূসের আর্থিক দুর্নীতি, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও শ্রম আইন লঙ্ঘন সংক্রান্ত অপরাধগুলো নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ সরকার আইনি তদন্ত শুরু করে, তখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সর্বান্তকরণে ইউনূসকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। শুধু তা-ই নয়, একটি আইনি বিষয় নিয়ে তারা যেভাবে প্রতিবেদন ও মন্তব্য করে ইউনূসকে সমর্থন জানিয়েছিল—তা সাংবাদিকতার কোনো আইনেই পড়ে না।
জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপট তৈরি এবং বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের জিরো টলারেন্সের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল অবস্থানে ছিল এ দুটো গণমাধ্যম। কিন্তু পাপ তো বাবকেও ছাড়ে না। ৫ আগস্টের পর এ দুটো গণমাধ্যম মৌলবাদের টার্গেটে পরিণত হয়। যে গণমাধ্যম একসময় আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গীবিরোধী অভিযানকে “বিরোধী মত দমন” হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আজ তারাই জঙ্গীবাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো কীভাবে একসময় সরকারের জঙ্গীবিরোধী অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো, তার একটি ছোট্ট প্রমাণ এখানে উপস্থাপন করা হলো। পত্রিকাটির সাংবাদিক সোহরাব হাসানের এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালের ২ জুলাই—গুলশানের হোলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গী হামলার পরদিন।

এ রকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যাবে এই দুই পত্রিকার সংবাদভাষ্য, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এমনকি ফিচার থেকেও। কিন্তু সেটা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। এখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার একদিন যাদের গা বাঁচাতে কলম ধরেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের যৌক্তিক জঙ্গীবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে; সেই জঙ্গীরাই এখন এ দুটো গণমাধ্যমকে টার্গেট করেছে। তারা এই গণমাধ্যম দুটোর নিষিদ্ধ চাইছে। ‘গণতন্ত্রের অবাধ প্রবাহের ঠ্যালায়’ এ দুটো পত্রিকাকে এখন অফিস চালাতে হচ্ছে সেনা-প্রহরায়39। সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র তাদের কর্মফল।
ড. ইউনূসের এই অবৈধ সরকারের মূল ঠিকাদার জঙ্গী-জামাত-শিবিরের বি-টিম তৌহিদী জনতা এ দুটো পত্রিকার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। যে ভারতবিরোধিতাকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জঙ্গীবাদের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, সেখানে আজ তাকেই পড়তে হয়েছে নির্মমভাবে। ডেইলি স্টারের ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ধারণাকে বাংলাদেশে ট্যাবলেট হিসেবে গেলাতে ড. ইউনূসের সঙ্গে মাহফুজ আনামের যে সখ্য—তারই ঘটনাক্রমের চূড়ান্ত অঙ্ক হলো জুলাই-আগস্ট সন্ত্রাস এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকারের পতন। বাংলাদেশ এখন ইউনূসের নেতৃত্বে জঙ্গীবাদের খপ্পড়ে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুধু কার্যালয় ভাঙচুরই নয়, ২৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে প্রথম আলোর কর্মীকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়40। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল প্রথম আলোর সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেয়41। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোড়ানো হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা42। এছাড়াও রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রথম আলোর কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটায় তৌহিদী জনতা43।
সম্প্রতি প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যা নিয়ে ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তৌহিদী জনতা44। এ বিষয়ে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত ইসলামীর আমিরও মওকা বুঝে প্রথম আলোকে একহাত নেওয়ার বাসনা জানান দিচ্ছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধ—এ বিতর্ক বহু পুরোনো। কেবল বাংলাদেশেই নয়, এ বিষয়ে আলোচনা চলে সারা পৃথিবীতেই। কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা কোনো যুক্তিতেই কোনো দেশে কোনো কালেই গ্রহণযোগ্য নয়, হতে পারে না। বাংলাদেশের ৫৫ বছরের ইতিহাসে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সাংবাদিক হত্যাকান্ডের মতো নৃশংস অপরাধও ঘটেছে। কিছু ঘটনার বিচার হয়েছে, অধিকাংশই বিচারের আওতায় আসেনি। কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতনের যে পদ্ধতিগত নির্মমতা আবিষ্কার করেছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অবৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার—তা অতীতের সামরিক শাসকরা শুনলেও চমকে উঠবে। মব লেলিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে হেনস্তা, পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনাও ইউনূস সরকার ঘটিয়েছে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তার ওপর প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে যেভাবে একের পর এক খুনের মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের নির্মমতার শেষপ্রান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে—তা-ও বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায়নি। বিনা বিচারে কারাগারে আটক রেখে সাংবাদিকদের যে নির্যাতন করছে ইউনূস সরকার—তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অমানবিক অধ্যায়। গত নয় মাসে এদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান—তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু ইতিহাসের নিয়মই হচ্ছে, ইতিহাস ঘুরপথে হলেও সত্য আর ন্যায়ের পথটি চিনে নিতে পারে। সাংবাদিক নির্যাতন করে বাংলাদেশে কোনোদিন কোনো অবৈধ শাসক টিকে থাকতে পারেনি। সেনাবাহিনীর জোরেও না, জঙ্গীবাদের জোরেও না। বাংলাদেশ কথা বলবে—হত্যার শিকার, নির্যাতনের শিকার, কারাবন্দী সাংবাদিকের রোধ করা কণ্ঠগুলো ষোলো কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে, উঠবেই। ইউনূস, তোমার ফিরতি টিকেট কাটা আছে তো?
তথ্যসূত্র ও টীকা
- “সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার জেরে তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি – যা জানা যাচ্ছে”, বিবিসি বাংলা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫। ↩︎
- “উপদেষ্টা ফারুকীকে প্রশ্নের পর দীপ্ত টিভির খবর বন্ধ, চাকরি গেল ৩ সাংবাদিকের”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২৯ এপ্রিল ২০২৫। ↩︎
- “Leaked files expose covert US government plot to meddle in Bangladesh’s politics”, The Grayzone, 30 September 2024. ↩︎
- “মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন: প্রধান উপদেষ্টা”, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ↩︎
- ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) একটি অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যাদের সদরদপ্তর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত। মূলত তথ্য ও তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে থাকে এই প্রতিষ্ঠানটি। ১৩টি আঞ্চলিক ও জাতীয় দপ্তর রয়েছে তাদের। স্বাধীন গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির অবমুক্ত করা বাজেটের সূত্রে জানা যায়, তাদের ৮ মিলিয়ন ইউরোর সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে, যার ৫২ শতাংশ আসে রাষ্ট্রীয় নানা খাত থেকে। তারপরও কাগজে কলমে ছাড়া আর কীভাবে তারা নিজেদের বেসরকারি দাবি করতে পারে, সেটা একটি আলোচনার বিষয় বটে। এরা অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের অনুদান গ্রহণ করে থাকে। ২০০৫ সালে লেখক ডিয়ানা বেরাহোনা তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করেছিলেন যে, আরএসএফ কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারকে উৎখাত করার জন্য মার্কিন ডিপস্টেট প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ফ্রি কিউবা’র কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ করে। এ অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটি স্বীকার করেছিল, যদিও তারা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিল, এই টাকা তারা আফ্রিকার সাংবাদিকতা উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করে। ↩︎
- https://rsf.org/en/country/bangladesh ↩︎
- “ভয়ংকর ঘটনা, ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা পদ পেল হিযবুত তাহরীর জঙ্গী”, এই মুহূর্তে, ১০ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ: তথ্য উপদেষ্টা”, প্রথম আলো, ২ মে ২০২৫ ↩︎
- Methodology used for compiling the World Press Freedom Index, Reporters without Borders. ↩︎
- “হাতিরঝিলে ভাসছিল জিটিভির নারী সাংবাদিকের মরদেহ”, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৮ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “হাতিরঝিল লেকে নারী সাংবাদিকের লাশ”, প্রথম আলো, ২৮ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার”, প্রথম আলো, ২৫ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “লুটের পর গাজী টায়ার কারখানায় আগুন, নিখোঁজের তালিকায় ১৭৩ জনের নাম”, প্রথম আলো, ২৬ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “গাজী টায়ারসে আগুন: প্রতিবেদনেও নিখোঁজ ১৮২, ‘ধামাচাপার’ অভিযোগ”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০ অক্টোবর ২০২৪। ↩︎
- “শ্রমিক হত্যাকারী ইউনূস সরকারের মে দিবস”, মুক্তাঙ্গন ব্লগ, ২ মে ২০২৫। ↩︎
- “রাজধানীর রামপুরায় বাসায় ঢুকে দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে হত্যা”, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, ১১ অক্টোবর ২০২৪। ↩︎
- “দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা হত্যায় আরও একজন গ্রেপ্তার, বিএনপি নেতার খোঁজ চলছে”, প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০২৪। ↩︎
- “দীপ্ত টিভির সাংবাদিক তামিম হত্যায় মূল আসামি মামুনের জামিন”, চ্যানেল আই, ৩ মার্চ, ২০২৫। ↩︎
- “মাদকের বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় হত্যার শিকার সাংবাদিক স্বপন: পুলিশ”, বাংলা ট্রিবিউন, ১২ অক্টোবর ২০২৪। ↩︎
- “Unstable Bangladesh Can Lead To “Volcanic Eruption”, Says Nobel Laureate”, NDTV, 6 August 2024. ↩︎
- “সময় টিভিসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের অফিসে হামলা”, যমুনা টেলিভিশন, ৫ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “দিনদুপুরে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপে হামলা-ভাঙচুর”, একাত্তর টেলিভিশন, ১৯ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা আটক”, প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “সাংবাদিক শাকিল-ফারজানার জামিন স্থগিত”, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২২ জানুয়ারি ২০২৫। ↩︎
- “গার্মেন্টসকর্মী হত্যা মামলায় শাকিল-রুপা কারাগারে”, দ্য ডেইলি স্টার, ৩১ আগস্ট ২০২৪। ↩︎
- “সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত ময়মনসিংহ সীমান্তে আটক”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “সাংবাদিক মুন্নী সাহা গ্রেপ্তার”, ঢাকা পোস্ট, ৩০ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ”, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৩ মে ২০২৫। ↩︎
- “আইএস-আল কায়েদার পতাকা নিয়ে মিছিল, ক্ষুণ্ন হচ্ছে ভাবমূর্তি”, বাংলা ট্রিবিউন, ১১ এপ্রিল ২০২৫। ↩︎
- “পল্লবীতে ‘দলবদ্ধ ধর্ষণের’ শিকার নারী সাংবাদিক, গ্রেপ্তার ২”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ১৯ মার্চ ২০২৫। ↩︎
- “‘যৌন হেনস্তা’ করে, লাইটার দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেয়: নারী সাংবাদিক”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ জুলাই ২০২৪। ↩︎
- “তিন দফায় ১৬৭ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল”, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, ১৩ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “নতুন প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন”, দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। ↩︎
- “পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের পরিপত্র জারি”, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। ↩︎
- “২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ”, প্রাগুক্ত। ↩︎
- “সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ”, বিবিসি বাংলা, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪। ↩︎
- প্রাগুক্ত। ↩︎
- “রাজনৈতিক পালাবদলের পর কোনো পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়?”, বিবিসি বাংলা, ৩ মে ২০২৫। ↩︎
- “প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভের কারণ কী? যা জানা যাচ্ছে”, বিবিসি বাংলা, ২৭ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- ”ময়মনসিংহে প্রথম আলোর কর্মীকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়”, প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি”, প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০২৫। ↩︎
- “ঢাবিতে ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকা পুড়িয়ে বয়কটের ডাক”, কালের কণ্ঠ, ১ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- ”রাজশাহীর পর প্রথম আলোর বগুড়া অফিসে হামলা–ভাঙচুর”, প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০২৪। ↩︎
- “প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলার আবেদন, আদেশের অপেক্ষায় বাদী”, বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ এপ্রিল ২০২৫। ↩︎

“প্রাচীন সেই সব আশ্চর্য শ্লোকে
যদিও থেমে থাকে রহস্য-
আমাদের প্রশ্ন আর আশ্বাসের মনীষার নীড়ে।”