ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িটি শরিয়াবাদীদের আমরণ ভীতির উৎস ।
রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গী হামলায় ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাদুঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং কালেমা লেখা সাদা পতাকা ওড়ানোর অত্যন্ত উদ্বেগজনক কর্মকাণ্ড স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ছাত্র আন্দোলনের ছদ্মাবরণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ও করছে। একটি প্রশ্ন স্বতঃই মনে জাগছে, বত্রিশ নম্বর বাড়ি জঙ্গীদের আমরণ ভীতির উৎস কেন? কারণ এই যে এ বাড়ি স্বাধীন বাংলার সূতিকাগার। মায়ের জরায়ূতে বেয়নেট ঠুকে ঠুকে কতো নারীকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ এ। ৫ ফেব্রুয়ারীর কালরাতে ধানমণ্ডির বত্রিশে, বাংলার জন্মের ঘরে হাতুড়ির ঠকঠক আওয়াজ সারারাত শোনা গেছে। বুলডোজার গর্জে এসে তার বুকের ওপর উঠে পড়েছিল। তারপর দেখা গেলো কিছু ইট কাঠ ও পাথর থেকে বত্রিশের প্রাণ মিশে গেলো বাংলার মাটিতে, দেশ-বিদেশে, স্বাধীন বাংলাকে ভালোবাসা প্রতিটি সন্তানের হৃদপিণ্ডে। বত্রিশের মাটির ঘ্রাণ ছড়িয়ে গেল বিশ্বময়। কাল এক অন্তহীন গাঢ় অমানিশা ছেয়ে ছিল বাংলাকে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যে হামলা চোরগুপ্তা শুরু হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় গত ৫ ফেব্রয়ারী ৩২ নম্বরে বুলডোজার নিয়ে হামলা, বাড়ি বাড়ি ঐ ভবনের ইট খুলে নিয়ে যাওয়া এবং অগ্নিসংযোগ শেষে অনেক রাততক আগুন জ্বলছিল বত্রিশে, লক্ষ লক্ষ জনতার বুকে। এ আগুন জ্বলতে থাকুক।
প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে যমুনার টিভির ভাষ্য জানানো হয়েছে: জনগণ অত্যন্ত রেগে আছে তাই এমন ঘটেছে, আট অগাস্ট পর্যন্ত তো কিছু ঘটে নি। জনগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুট হচ্ছে, ভাঙ্গা হচ্ছে; রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনাশ করা হচ্ছে। একটা ক্ষমতাসীন সরকার থাকলে এটা হতে পারতো না। সুতরাং বাংলাদেশে বাস্তবে কোনো সরকার নেই। এই নৈরাজ্য ইউনুস সাহেবের প্রতিহিংসার নৈরাজ্য। তবে হিংসাটা আওয়ামী লীগ ও শেখ-হাসিনাকে করতে গিয়ে তিনি গোটা দেশের সেকুলার জনগনকে হিংসা দেখিয়ে চলেছেন। এবং যতদূর বোঝা যাচ্ছে, তিনি ও তার জঙ্গী অনুসারীরা চাইছে, জনগণ নেমে পড়ুক। তাহলে দেখানো সম্ভব বাংলাদেশে যা ঘটছে তা নিছক নিজেদের মধ্যে মারামারি। তখন সরকারকে বৈধ করে নিতে দেশবিদেশের তাবড় তাবড় নেতা এগিয়ে আসবে, ‘ সেভ ইউনুস’ ক্যাম্পেইন নিয়ে। এসব এখন সুদূরপরাহত!
মুহাম্মাদ ইউনুসের ভাগ্য তাকে নিয়ে বড়ো হৃদয়বিদারক খেলা খেলিয়ে নিচ্ছে। তার এক সুপ্ত স্বপ্ন ছিলো হয়তো, মুজিবের মতো জাতির পিতা হবার। নোবেল পেয়েছেন না। জাতির পিতার চেয়ে কমে হয়? কিন্তু হয়তো ভাগ্য অং সান সুকীর চেয়ে মর্মন্তুদ হতে যাচ্ছে, যদি তিনি জঙ্গীদের থেকে নিজের দূরত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম না হন। লীগকে ধ্বংস করতে দিয়ে, এনার্কিকে যাবতীয় উপায়ে রক্ষা করতে দিয়ে জেনেভায় গিয়ে লুকিয়ে থাকলেই কি তা সম্ভব ? যদি জঙ্গীবিরোধী তিনি না হন, তবে তিনি জঙ্গীর পোষক। তাও নন। তার প্রেস সেক্রেটারী বলেছেন তাদের সরকার নিজের স্টেকহোল্ডারকে সার্ভিস দিচ্ছে।
এই স্টেহোল্ডার কারা, তাও স্পষ্ট করেছেন প্রেস সচিব- সেই ছাত্রদের যারা আগের সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান করেছে। ইতিমধ্যে এটা প্রমাণিত সত্য যে তারা হচ্ছে চরমপন্থী ইসলামিস্ট এবং তাদের মধ্যে সবাই ছাত্র নয় । এমন কি সবাইর লক্ষ্য দেশভিত্তিক নয় এবং তাদের সাথে তাদের দেশী -বিদেশী সহায়ক শক্তি রয়েছে। এই দলগুলোর অনেকগুলো বাইরের ইসলামিস্ট নেটওয়ার্ক। এটা বলা যাবে না যে এদের পরিচয় মুহাম্মাদ ইউনুসের বা তার টীমের অজানা।
থামুন। একটু ভাবুন এখানে। এদের সবার উদ্দেশ্য কিন্তু অস্পষ্ট নয়, আলাদা নয়, বরং এক। পাকিস্তানের সাথে সমঝোতা, একাত্তর নালিফাই করা, মুজিবকে নাই করে দেয়া, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যত দায়-দেনা এখনও বাংলাদেশ পাকিস্তানের নিকট দাবী করতে পারেনি সেসব মওকুফ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশের সাথে ভাগ করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি, যাতে বিহারী কমিউনিটি, ইসলামিক কমিউনিটি, মাদ্রাসা পড়ুয়াদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দিকে বাংলাদেশ অগ্রসর হয়।
অপরদিকে হাতুড়ির বাড়ি বুকে নিয়ে ফিরেছে বাংলার জনতা। তারা নিরব বটে কিন্তু শক্ত করে ফেলেছে নিজেদের। তাদের চোখে জল নেই।
বাংলার ফিনিক্সরা বত্রিশ নম্বরের আগুন থেকে জন্ম নিয়েছে কাল রাতে।
মুহাম্মাদ ইউনুসের কার্যালয়ে থেকে বত্রিশ নম্বর পোড়ানোর ঘটনার যে ব্যাখ্যা জনগণকে জানানো হয়েছে তাতে তথাকথিত রেগে থাকা ”জনগণ” বা বাংলাদেশের দাস মিডিয়ার ভাষায় কথিত “ছাত্র-জনতা” রয়েছেন। যারা বত্রিশ ভেঙ্গে গরুর গোশত রান্না করে খাচ্ছে বিলাচ্ছে এখন। এরা কারা? বোজা জরুরী। এদের চিহ্নিত করা যাক:
এরা বাস্তবে জামাত-শিবির-হিযবুত, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা বিএনপি, ব্যক্তিগত বিশ্ব-মাদ্রাসা মানে প্রাইভেট তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয় নামের মাদ্রাসা যেখানে যুক্তির চেয়ে নামাজ পড়ে কপালে কালো দাগ ফেলে দেয়া ধর্মব্যবসায়ী তৈরী হয় বেশি, সেখানকার ধর্মের আফিম খাওয়া ইসলামী এমপায়ারের স্বপ্ন দেখা ছাত্র-শিক্ষক, পাকিস্তানী জামাত- শিবিরের বাংলা শাখার সদস্যরা, ইউকের হিযবুতিদের বাংলা মুসলিমব্রাদার দিগের এনজিও এবং পার্টি, হেফাজত ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেয়া রাজাকার শাবকেরা। রাজাকার মানে স্বেচ্ছাসেবী। এরা স্বেচ্ছায় ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সেবা করেছে, তারপরও এরা পাকিস্তানকেই সেবা করে এসেছে। মুসলিম মুসলিম ব্রাদারে পাপ গোপন রাখে, স্বীকার করে না।
২০২৪ এ যখন তারা তাদের এই পরিচয় নিয়ে গর্বভরে শ্রোগান দিচ্ছিল আপনারা তাদের সেই শ্লোগানের পশ্চাত আয়রণি ধরতে পারেন নি। তা অনুবাদ করেছেন ’রাগ-অভিমান’ রূপে।
ইউনুস সাহেবের বাড়িতে ৭১ সালে রাজাকারদল হামলা করলে, ওরা রেগে আছে, এটা স্বাভাবিক‘ বলতেন না। তার একাত্তরের রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা নাই। তখন আমি শিশু ছিলাম, সেই আমিও রণাঙ্গনের ভেতরে ছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখেছি, বিগত রাতে যে যুবক আমাদের ঘরে ঘুমিয়েছে সকালে সাদা হাঁসের মতো তার লাশ পড়ে আছে, আমার বাড়ির অদূরে।
তিন মিলিয়ন নিহতের শোণিতে ও চার লক্ষাধিক নারীর ধর্ষনের মৃত্যু থেকে জাত বাংলাদেশের জনগণের বেদনার চেয়েও জুলাই তার কাছে বড়ো গণহত্যা হয়ে উঠেছে। এ কথা বলে আমি জাস্টিফাই করছি না ওই নিষ্ঠুরতাকে। জুলাইয়ে নিহতদের মৃত্যু যে কোনও বিবেকবান মানুষের জন্য অনভিপ্রেত, বেদনার। তা ঘটে যাওয়ার পর যে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি, তা কিন্তু নয়। কালীন যে কোনও দায়বদ্ধ সরকারের মতো আগের সরকারও প্রতিটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। মিথ্যা বলতে বলতে ক্লিনিকাল মিথ্যেবাদীরা নিজের মিথ্যে বিশ্বাস করা শুরু করে। এই রোগটা ছগিয়ে যাবার জন্য ছয় মাস বড়ো দীর্ঘসময়।
সত্য ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে অতিরঞ্জন। মুহাম্মাদ ইউনুসের স্টেহোল্ডার জামাত শিবির যা বলছে তিনিও তাই বলছেন। তারা বলছে এটা ’গণহত্যা’, তিনিও বলছেন ’গণহত্যা’। তারা বলছে, ’সব চুরী করে নিয়ে গেছে’, তিনিও দাভোসে গিয়ে একধাপ আগ বাড়িয়ে আরও অতিরঞ্জন করে বলেছেন ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি’ রেখে গেছেন শেখ হাসিনা। হাস্যকর নয়?
মুহাম্মাদ ইউনুস, যুদ্ধটা কাদের সাথে কার, তা অবশ্য খোলাসা করেন নি। উপলব্ধি হয় এই যে তিলকে তাল বানানো এটা ম্যাচুরিটির অভাব নয়: এই যে তার ও তার সরকারের প্রতিটি ব্যক্তির ’একজন’ নেত্রীকে পায়ের তলে চেপে ধরার চেষ্টা, জামাতের আমিরের শেখ হাসিনাকে ’শয়তান’ বলা,, জামাত শিবির ও বি এনপির অনলাইন অফলাইনে লাগাতার হাসিনার ”অসুরায়ন”, এসব না ঘটলে মুহাম্মদ ইউনুস নিজে তো মহান হতে পারেন না।
তার কার্যালয় থেকে আরো জানানো হয়েছে যে আট তারিখ পর্যন্ত বত্রিশ নম্বরে কিছুই ঘটে নি। কথাটা সত্য নয়। বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি বারবার আক্রান্ত হয়েছে। ৫ তারিখেও আক্রান্ত হয়েছিল। পাঁচ তারিখে ঐ মিউজিয়াম পোড়ানো হয়। তাতে আগুন ধরানোর আগে শিবিরের সদস্যরা ও তাদের সহযাত্রীরা ওই বাড়ির সামনে দলবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে আফগানি জেলেবি বাজিয়ে নৃত্য করেন।
সাত অগাস্ট তার বর্তমান সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ফেসবুকে লিখেন যে সরকারের উচিত হবে ওই বাড়িটি পুণরায় আগের আকারে ও চেহারায় পূণঃর্নির্মান করা ও যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে আগের মতো মিউজিয়ামটি সাজিয়ে মুহাম্মাদ ইউনুস নিজে সেটা পরিদর্শন করা।
পাঁচ তারিখের অগ্নিকাণ্ড শুধু আগুনের হিসেব নয়, প্রাণেরও হিসেব। সারারাত আগুন জ্বলে যখন ভোর হয়, তখনও বাড়িটি আগুনের আঁচে গরম। প্রাতঃকালে বাড়িতে তিন অথবা চারটে পোড়া মরদেহের মুখোমুখি হন কৌতুহলী শ্রমজীবি পথচারীরা। নিহতরা কে ছিল, কি ছিল তাদের পরিচয় এ বিষয়ে কিছু জানা যায় নি।
পাঁচ অগাস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গী ও তাদের দেশ দেশান্তরের সহকর্মীদের সমন্বয়ে যে ইসলামী রাজনৈতিক উপপ্লব ঘটেছে তাকে সামাজিক সমস্যার মোড়কে সামান্য রাগারাগি মাত্র হিসেবে উপস্থাপনের যতই চেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস ও তার উপদেষ্টামন্ডলী করে যাক না কেন, তাদের যত বড় ক্রীত ক্ষমতাশালী বন্ধু থাকুক না কেন, দেশে যে জঙ্গি তৎপরতাকে ব্যবহার করেই বর্তমান সরকার টিকে থাকতে চাইছে ও মুহম্মাদ ইউনুস নিজ ক্ষমতার কাল অন্ততঃ ২০২৯ পর্যন্ত বিলম্বিত করতে চাইছেন , সে বিষয়টি জনগনের কাছে স্পষ্ট।
মাত্র পরশু জেলারকে হুমকী ধামকী দিয়ে ফিল হিন্দালের ডেপুটি জঙ্গী মহিবুল্লাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসার বিষয়টি, এবং গত রাতে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম জ্বালিয়ে দেয়ার পরবর্তি সময়ে বত্রিশে এবং পাকিস্তান ডিফেন্সের টুইটারে বিপুল উল্রাসে ইঙ্গিত সুস্পষ্ট বোঝা যায়, জুলাইতে কি ঘটেছিল।
পাঁচ তারিখে জনতার ভিড়ে মিশে থাকা সশস্ত্র জঙ্গিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্যবস্তু করতে চেয়েছিল, তবে খুব অল্পের জন্য তারা ব্যর্থ হয়েছে। মুহাম্মাদ ইউনুসের এক উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন যে, তারা যদি সুযোগ পেত, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত। (প্রথম আলো)। ”শি উড হ্যাভ বিন টর্ণ… জনাব শাখাওয়াত বলেন।” এ কথা যিনি বলেছেন, তিনি যে হাসিনার আমল নিয়ে সুখী একজন অফিসার, তা কিন্তু নয়। সত্য বলার খাতিরেই তিনি বলেছেন।
এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হুমকি এখন চরমরূপ লাভ করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দমন নয়, জনগণের হাত থেকে তাদের রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আনসার আল-ইসলাম, হেফাজত, জামাত-শিবির ও হিযবুতের বা বি এনপির অনলাইন অফলাইন টেরর বাহিনী চব্বিশ ঘন্টা সক্রিয়। পয়সার বিনিময়ে নতুন সদস্য সংগ্রহও চলছে।
এ খবর লেখা অব্দি দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতৃত্বস্থাণীয়দের বাড়ি ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, সাথে দেশের গত একশো বছরের ইতিহাসের সব স্থানে হামলা হচ্ছে ।
এই ধরনের হামলা শুধু ইতিহাসের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি দেশের নিরাপত্তার জন্যও গুরুতর হুমকি বলে অনলাইন খবরের কাগজ বাংলা ট্রিবিউন এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ অবস্থায় যে কোনও সরকার প্রথমেই যা করতো, তা হলো নিরাপত্তা বাহিনীকে সচেতন করা, আরও কঠোর নজরদারি চালাতে তাদের নির্দেশ দান যাতে কোনো জঙ্গীর দ্বারা রাষ্ট্রের ও জনগণের জানমালের আরো ক্ষতি না হয়। জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল। পাশাপাশি, প্রকৃত ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে সঠিক আন্দোলন ও সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করাও জরুরি ছিল্। কিন্তু বাস্তবে যেহেতু জঙ্গী সংগঠনগুলো সরকারেরই স্টেকহোল্ডার, সরকার তাদের অরাজকতা চালিয়ে যেতে দিচ্ছে। সরকারের প্রেস থেকেও এর অর্থহীন নানা যৌক্তিকতা দেবার চেষ্টা নির্লজ্জতার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে যাদুঘরে প্রদর্শনযোগ্য হয়ে বিরাজ করছে। এইসব কেন ঘটেছে। গতকাল ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে শিক্ষার্থী সমাজের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন বলে একটি খবর প্রচার হয়।
তিনি কেন কথা বলবেন? তার কথা বলার উত্তর হলো, ’সব ভাঙ্গো। তিনি কথা বলতে অনলাইনে আসার একঘন্টা আগেই ভাংচুর শুরু হয়ে গেছে।
শুধু কি তাই ? এখন ছয় তারিখের রাত। এখনও চলছে ভাংচুর।
এখন অব্দি কি কি ভাঙ্গা হলো, এক নজর দেখা যাক:
* খুলনায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পৈতৃক সম্পত্তি।
* কুড়িগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৩ ম্যুরাল।
* টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়।
* ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে সিএন্ডবি রোড এলাকায় অবস্থিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর আমলে তার মায়ের নামে নির্মিত সাহানারা আব্দুল্লাহ পার্ক ।
* চাঁপাইনবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়ি।
* নাটোরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে।
* ঝালকাঠিতে আমির হোসেন আমুর বাসভবন।
* রাজশাহীতে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাসভবন।
* লক্ষ্মীপুরে সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ তিন নেতার বাড়ি।
* সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল।
* কুমিল্লার আদালত ও নগর উদ্যানের স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল।
* পঞ্চগড়ের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ।
* জামালপুরে মির্জা আজমের বাড়ি।
* ফেনীতে নাসিম ও আনিসুল হকের নানার বাড়ি।
* নওগাঁয় সাধন চন্দ্র মজুমদারের বাড়ি ভাঙচুর।
* নারায়নগঞ্জে শতবর্ষের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি।
* দিনাজপুর জেলা,শহর ও সদর ঊপজেলা আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যালয়।
মুহাম্মদ ইউনুস এ ধরণের কর্মকাণ্ডকেই বলছেন ’নজিরবিহীন স্বাধীনতা’।
নজিরবিহীন গণমাধ্যমের স্বাধীনতারও একটি নমুনা হলো, কাল থেকে সব গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামের আগে ’বঙ্গবন্ধু’ লেখা ও বলা বন্ধ করে দিয়েছে । ব্যতিক্রমের কথা নাই বা বললাম।
দেশের জনগণ, মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার ও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র কে এখনও যদি না চিনে থাকেন, তবে চিনে নিন। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, যাতে দেশ, স্বাধীনতা, জাতির ইতিহাস ও মূল্যবোধ রক্ষা করা যায়।
এ এক ঐতিহাসিক সময় আপনার জীবনে। ইতিহাস প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে তাকে দিয়ে যা সম্ভব তা করিয়ে নেয়। কিন্তু সেটি নির্ভর করে ব্যক্তি কোন্ পথ গ্রহণ করবে তার ওপর।
আপনি কোন্ পথ গ্রহণ করবেন?
দেশরক্ষার?
না দেশ ধ্বংসের ও পরাধীনতার?
সিদ্ধান্ত আপনার।
কাল যে ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামে গড়া যাদুঘরটি ভাঙ্গা হলো শুধু এই কারণে যে, তা শেখ হাসিনার পিতার বাড়ি ও তাতে শেখ মুজিবের স্মৃতি সংরক্ষিত ছিল। বাড়িটি ভাঙ্গার যে বিভৎস উল্লাস, যার ভেতর উড়ছিল সাদা কাপড়ে কালেমা লেখা দোলানো পতাকা, ও তারপর যেভাবে লীগের সব নেতার বাড়ি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙ্গা চলছে এবং বলা হচ্ছে তিপ্পান্ন বছরের প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে, সে সব শব্দ ও দৃশ্যাবলী থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে:
মূলতঃ যা জুলাইতে ঘটেছে, তা দেশে গত তিরিশ বছরে ধরে গড়ে ওঠা জঙ্গী তৎপরতার এক চরম ফলাফল। ছাত্রছাত্রীদের আড়ালে লুকিয়ে শরিয়া শাসনের পক্ষের ইসলামিক গোষ্ঠী ও তাদের সশস্ত্র জঙ্গী দলগুলো কোটা আন্দোলনটিকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। খুব সামান্য মার্জিনে ভীড়ের ভেতর লূকিয়ে থাকা জিহাদী জঙ্গীরা শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করতে পারে নি।
ইউনুস এর উপদেষ্টাই ঘটনার পর বলেছেন যে,মব হাতের কাছে পেলে তাকে ছিঁড়ে ফেলতো।
এই ষড়যন্ত্রে আছে দেশ বিদেশের চরমপন্থী গোষ্ঠী, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চতুর ইন্টেলিজেন্স, জামাতের দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন নানা শাখা ও পাকিস্তানে অবস্থিত হেডকোয়ার্টার। তাদের ইসলামিক ব্রাদারহুডের নানা ভাই-বেরাদারও এই জিহাদে অংশগ্রহণ করেছে ও করছে। এসব গোষ্ঠীকে প্রধানতঃ দুটো ভাগে ভাগ করা যায়: এক. দেশের ভেতর ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে আন্দোলনরত গোষ্ঠী । ২. দেশের বাইরে থাকা তাদের শাখা প্রশাখা বা হেডকোয়ার্টার ও নেটওয়ার্ক।
এর বাইরে দেখা যায় আরেকটি দল যার নাম বি এন পি, যাদের নিজস্ব কোনও আদর্শ নেই, এমন কি নিজস্ব মেনিফেস্টো নেই, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা নীতিগত অবস্থান নেই। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় যেতে হলে জামাতের ওপর ভর করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধ করেছেন এমন একজন সৈনিকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠার পরও এই দলটিকে ক্ষমতার জন্য শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদেরই পদলেহন করতে হয়েছে ও হচ্ছে। এরা সবাই মিলে এখন বাংলাদেশকে সেই যায়গায় নিয়ে যেতে চায় যেখানে গেলে দেশটির অবস্থান হবে সাতচল্লিশের পূর্ব-পাকিস্তানের মতো।
দেশের বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যেও শুধু সাম্রাজ্যবাদী নানা দলকে গুনলে হবে না, গুনতে হবে এদের পাকিস্তানে বা ব্রিটেনে অথবা অন্যান্য দেশে থাকা হেড-কোয়ার্টার। এমন একটি বাইরের দলের উদাহরণ হলো জামাত-শিবির। গত ষাট বছরে জামাতের অফিস বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে । সুতরাং যারা দেশকে পাকিস্তানের পদানত করছে তারা আপনার দেশ সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়, আপনার সেকুলার সমাজের সব কিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দেবে এটাই বাস্তব। তারা কখনও আপনাকে বা এ দেশকে নিজের দেশ ভাবে নি।
এখনও ভেঙ্গে চলেছে তারা কিন্তু আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। জামাত হিযবুতের মতো ফরেন ইলেমেন্টকে নিজের দেশ ধ্বংস করতে দিয়ে আপনি আমি স্বাধীন হবো না। মুক্তিযুদ্ধ, লীগ, মুজিব, ৭১ এর পক্ষের জনগণ, ৫২-র ভাষার লড়াই, ঊনসত্তুরের গণ-উত্তান স্মৃতি সবকিছু ধ্বংস করে ফেলুন। এরপর যে দেশ আসবে, তা নিয়ে আপনি আমি নিজেকে ক্ষমতা করতে পারবো না।
মুক্তিযুদ্ধ একটি সেকুলার ধারণা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার একটা সেকুলার ধারনা, অর্থ নৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সেকুলার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সব মানুষের সাম্য একটি সেকুলার বাস্তববাদী ভাবনা।
এ প্রসঙ্গে শাহবাগ আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আকরামুল হক মন্তব্য করেছেন, “গতকালের ঘটে যাওয়া নৈরাজ্য দেখে যদি আপনাদের মনে হয়, পাপেট প্রধানের চেহারা দেখে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। তাহলে আপনি আহাম্মক!
দেশে বেকারত্ব বাড়ছে হু হু করে, তরুণদের বড় অংশটিই পাশ করে বেকার থাকছে। চলমান নৈরাজ্য অর্থনীতি সঙ্কুচিত করছে, ধর্মের সিলসিলায় অর্থনীতি গতি পাবে না।
আফগান নারীরা কিডনি বেচছে, দেশের নারীরা সে সুযোগও পাবে না, কেননা কেনার লোক থাকবে না।
প্রতিশোধ স্পৃহার অনলে পুড়ছে দেশ। দমকল বাহিনী যে আগুন নেভায় এ আগুন তার চাইতে ঢের ঢের বেশী সর্বগ্রাসী ও ভয়ঙ্কর!”
দেশব্রতীগণ, জেগে উঠুন। প্রতিরোধের কাল এসেছে।
সাংবাদিক, সেকুলার যুক্তিবাদী লেখক, মানবাধিকার এ্যাক্টিভিস্ট। চরমপন্থী ইসলমিক মৌলবাদী দল ও জিহাদী জঙ্গীরা লাগাতার জবাই, ধর্ষন, ও বিচারে ফাঁসীর হুমকী দিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে দেশহীন মানুষ। বর্তমানে ইউরোপ ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে থাকেন। তার লেখার কেন্দ্রে রয়েছে নর্ডিক দেশগুলো এবং দক্ষিণ এশীয় জাতিরাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রশ্নগুলো। বিদ্যালয় জীবন থেকে সৃষ্টিশীল লেখালেখিতে নিয়োজিত। গ্রন্থ সংখ্যা: বারো (সাহিত্য), পাঁচ ( সাহিত্য ও উন্নয়ন গবেষণা বিষয়ে)