আমরা কি জানি, ঠিক এই মুহূর্তে যে-শিশুটি জন্ম নিল বাংলাদেশ নামক মানচিত্রের মাটিতে, সে ১০,৬৩০ টাকা বৈদেশিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মায়ের জরায়ু ছিঁড়ে পৃথিবী নামক গ্রহে আগমন করল! পৃথিবীর সকল দেশে যে-কোনো শিশু জন্মের পর সুতীব্র কান্নায় জানান দেয় তার আগমনী বার্তা। এটাই একটি সুস্থ শিশুর জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নবজাতকের এই জন্মক্রন্দনে চিকিৎসকসহ আমরা সকলে আনন্দিত হই, একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ ও সবল শিশুর জন্মানন্দে। কিন্তু বাংলাদেশ নামক দুর্নীতিপরায়ন ও ঋণগ্রস্ত এই দেশে একটি শিশুর জন্মের সময়ে কান্নার সুতীর্ব চিৎকার আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। এদেশে একজন নবজাতকের জন্মের সময়ে কান্নার সুতীর্ব চিৎকারে শুনতে পাই প্রতিবাদ। সে যেন কান্নার মাধ্যমে বলতে চায়, ’আমাদের পূর্বসূরিদের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কেন বাংলাদেশ নামক ঋণগ্রস্ত দেশে জন্ম নিলাম? কেন একটি ঋণগ্রস্ত দেশের মায়ের জঠরে আমি লালিত হয়ে ১০,৬৩০ টাকার বৈদেশিক ঋণের গ্লানি নিয়ে আমার জীবনের শুরু? হে ইশ্বর, কেন তুমি আমাকে জীবনের প্রারম্ভে পূর্বসূরিদের ঋণের তাজ আমার মাথায় পরিয়ে ন্যুব্জ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই পৃথিবীতে আগমন ঘটালে?’
উপরের উক্তিগুলো হাস্যকর মনে হচ্ছে কি? প্রিয় পাঠক, এটি কোনো রম্যরচনা নয়। বিদেশি দাতা ও অর্থযোগানদারী সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক ঋণখেলাপি। এই মহূর্তে বাংলাদেশের ঘাড়ে ২ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের বোঝা। মাথাপিছু হিসাবে যা দাঁড়ায় ১০,৬৩০ টাকা। অর্থনৈতিক হিসাবে যা দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র ৫০ শতাংশ (৪৯.৯) । স্থানীয় ও বৈদেশিক উৎস মিলিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে সরকারের ঋণ গ্রহণের হার এবং এর বিপরীতে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হচ্ছে জাতীয় বাজেটের বিরাট এক অংশ। শুধু চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি-র ২০ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি-র ২৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর এই সব ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়েই প্রতি বছর বাজেটের উপর চাপ বাড়ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালের মধ্যে শুধু বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর কাছে দেনাবাবদ সরকারকে ১৪ হাজার ৮৫৬ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। আমাদের রপ্তানি আয় ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মাধ্যমে অর্জিত সকল বৈদেশিক মুদ্রা সরকারের এসব ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে । বর্তমান সরকারসহ অতীতের সব সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর কৌশলের উপর নজর না দিয়ে, বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে গিয়ে জাতির উপর আজ এই বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
৮০-এর দশকে আমার এক শিক্ষক আমাকে একদিন অর্থনীতি পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এই, বল তো, বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিক কত টাকা বৈদেশিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হাঁটছে, ঘুমাচ্ছে, আনন্দ করছে?’ আমি সঠিক উত্তরটি বলতে না পারলেও সেদিন স্যার বলেছিলেন, ‘ব্যাটা, এটা জানিস না! তুই এই মহূর্তে ৬৩০ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে হাঁটছিস, খাচ্ছিস, ঘুমাচ্ছিস, আনন্দ-ফুর্তি করছিস!’ সেদিন মনে হয়েছিল, ‘মাত্র ৬৩০ টাকা! এই আর এত বেশি কি? আমি তো ইচ্ছে করলেই আমার ঋণটা শোধ করে দিতে পারি।’
কিন্তু সেদিনের সেই ছেলেবেলার ইচ্ছেটুকু পূরণ করা সম্ভাবনার আওতার মধ্যে থাকলেও, বর্তমানে কারও পক্ষে ১০,৬৩০ টাকা ঋণ শোধ করার কথা কল্পনা করাও কি সম্ভব?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
মোহাম্মদ মুনিম - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না, তবে Wikipedia পড়ে মনে হলো বাংলাদেশ খুব খারাপ অবস্থায় নেই। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ২১ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির প্রায় ১১ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণ প্রায় জিডিপির সমান, আর যুক্তরাজ্যের ঋণ জিডিপির প্রায় চার গুন, মানে শতকরা ৪০০ ভাগ, ইঊরোপের সবগুলো দেশেরই ঋণ জিডিপির দুশ থেকে চারশ ভাগ।
আরমান রশিদ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:০২ পূর্বাহ্ণ)
উন্নত বিশ্বের তুলনাটা বোধহয় ঠিক হল না কারন তাদের ঋণের অধিকাংশই আসে নিজ দেশের জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম সরকারি বন্ড এর মাধ্যমে। তাই প্রকারান্তরে সূদের অর্থ নিজ দেশের অর্থনীতিতেই ঘুরপাক খায়। আমাদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
গৌতম - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
অর্থনীতির বিষয়আশয় তেমন বুঝি না, তবে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের লেখা-মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পড়ে যেটা বুঝি— বাংলাদেশের এখন আর বিদেশি সাহায্য সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশ চাইলে আস্তে আস্তে ঋণ পরিশোধ করে নিজেই নিজের অর্থের সংস্থান করতে পারে। যেমনটা আর্জেন্টিনা করেছে। তারা আস্তে আস্তে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পরিশোধ করে তাদেরকে না করে দিয়েছে। এই সংস্থাগুলোর দরজা এখন আর্জেন্টিনার জন্য বন্ধ।
কিন্তু বাংলাদেশে যারা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা বোধহয় এমনটা মনে করেন না। এর সাথে অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত কিনা জানি না, তবে এই সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন স্ট্রং মানুষ আসা দরকার যিনি দেশ থেকে আস্তে আস্তে এই সংস্থাগুলোকে বিদায় করার একটা ব্যবস্থা করবেন। সেটা করা গেলে এই ঋণের বোঝাটাও আস্তে আস্তে কমে যাবে বলে আমার মনে হয়।
রুশো বলেছিলেন— মানুষ জন্মায় স্বাধীন কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। আজকের অবস্থা দেখলে তিনি নিশ্চিতভাই এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতেন। মানুষ এখন স্বাধীনভাবেও জন্মায় না, জন্মায় ঋণের বোঝা নিয়ে, নানা অসাম্যের উপাদান মাথায় নিয়ে। অবশ্য মানুষটা কোন দেশে জন্মাচ্ছে, তাও একটা ব্যাপার।
ডাঃ আতিকুল হক - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (২:৪৬ অপরাহ্ণ)
পড়লাম—বুঝলাম—-এবং চিন্তা করছি গতকাল আমার একটা ভাতিঝি জন্মেছে ১০৬৩০ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে—-ওর জন্য মায়া হচ্ছে—-