আজকাল অনেক বাংলাদেশীকেই ছুটি কাটাতে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে যেতে দেখা যায় (একটু আগেই ঢাকা বিমানবন্দরের ফ্লাইট-সূচিতে দেখলাম আজ সিঙ্গাপুর গামী ফ্লাইটের সংখ্যা ছয়।) এরা বিদেশে গিয়ে হোটেলে থাকা, ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটাতে সব মিলিয়ে কত টাকা খরচ করেন সেটার হিসাব কোথাও পেলাম না। তবে এর পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকার কম নয় সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তাঁরা এসব প্লেজার ট্রিপ কাটছাঁট করে সহজেই প্রায় হাজার কোটি টাকা দান খায়রাত করতে পারেন এবং তাতে দেশের অনেক দরিদ্রেরই নানা চাহিদা মিটে যায়। তাঁরা সেটা করেন না এবং এই নিয়ে ফেসবুকে কেউকে অভিযোগও করতে দেখিনি।
তবে বাংলাদেশ সরকার আজ বিভিন্ন কর্পোরেশন থেকে ৫০ কোটি চাঁদা নিয়ে যে সমবেত জাতীয় সঙ্গীতের আয়োজন করলো তাতে গত কয়েকদিনে ফেসবুকে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে। এই ৫০ কোটি টাকায় কতজন গরীবকে দু বেলা খাওয়ানো যেতো, কতটা স্কুল দেওয়া যেতো এই জাতীয় হিসাব অনেকেই দিচ্ছেন। এত যজ্ঞ করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার কি আছে, দেশপ্রেম ভেতর থেকে আসতে হবে, জাতীয় সঙ্গীত যার গাওয়ার সে মনে থেকেই গাইবে, এমন সব কথা বলা হচ্ছে।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যারা এই ঘটা করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া পছন্দ করছেন না তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত মনে মনেও গাইতে পছন্দ করেন না। আর যারা জাতীয় সঙ্গীত মনে মনে বা গুন গুনিয়ে গাইতে ভালবাসেন, তারা ৫০ কোটি টাকা ‘অপচয়ের’ এই মহাযজ্ঞে খুশিই হয়েছেন। কিশোর বয়সে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৫ বছর কাটিয়েছি, এর মধ্যে খুব বেশী হলে ৫ দিন জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি। পরে জেনেছি স্কুলের জামাতি শিক্ষকেরা নানা ছুতায় এসেম্বলি এবং জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া আটকে দিতেন। যে স্কুলে নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় সেখানে কি শিবির-কর্মী রিক্রুটমেন্ট কঠিন হয়ে পড়ে? আমার ধারণা কঠিন হয়ে পড়ে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’, এই গান প্রতিদিন সকালে গেয়ে শিবির কর্মী হয়ে যাওয়া এবং হয়ে থাকা খুব সহজ নয়। কোন স্কুল পড়ুয়া কিশোরের পক্ষে সকাল বিকাল এই কালচারাল শিফট সহ্য করা বেশ কঠিন।
জামাত শিবিরের জাতীয় সঙ্গীতে এলার্জির ব্যাপারটা বোধগম্য, বামপন্থীরাও কিন্তু এই গান নিয়ে খুব স্বচ্ছন্দ নন। একে তো রবীন্দ্রনাথ এসেছেন ‘শোষক জমিদার শ্রেণী’ থেকে, তিনি নিজের গানে নিজের শ্রেণী চরিত্রই প্রকাশ করবেন, এই জাতীয় একটা যুক্তি আছে। এর সাথে আছে জাতীয়তাবাদ আর আন্তর্জাতিকতাবাদের সংঘর্ষ। আবার এই গানটিকে যেহেতু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটা কি করে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়, এই জাতীয় আপত্তিও কোথাও কোথাও চোখে পড়েছে। তবে আমার ধারণা রসুনের সব কোয়ার গোঁড়া যেমন এক জায়গাতেই মেশে, তেমনি এই গান নিয়ে নানা শ্রেণীর লোকের এলার্জির গোঁড়া এক জায়গাতেই, সেটা হল একটি মুসলিম প্রধান দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কি করে একজন ‘অমুসলিম’ এবং ‘ভারতীয়’ লেখক হতে পারেন?
এই ‘অমুসলিম’ এবং ‘ভারতীয়’ লেখক পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) সফরের কোন এক সময়ে (উনিশ শতকের শেষের দিকে) বাউল গান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচন করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বহাল রাখেন। একটি আপাত অরাজনৈতিক গান অতি দ্রুত রাজনৈতিক হয়ে উঠে এবং এই গান বুকে নিয়েই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা লড়াইয়ে অংশ নেন। মাত্র চব্বিশ বছর আগেই ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগানে গলা ফাটানো জনগোষ্ঠী এই গানের মাঝেই পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় নিজের ঠিকানা খুঁজে পায়।
৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে অনেক পাকিস্তানপন্থীকেই রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেন, তাঁর মৃত্যুর পরে এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং কিছু কিছু বাঙ্গালী ঠিকানা হারানো শুরু করে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ছেড়ে আবারও তুরস্কে, ইরান, তুরানে ঠিকানা খোঁজা শুরু হয়। ৭৫ এর পরে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, ঠিকানা হারানোদের সন্তানরাও বড় হয়েছে, কেউ কেউ দু কলম পড়াশোনাও করেছে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব জার্মানি আর ইতালিতে নাৎসি আর ফ্যাসিবাদীদের আচরণের সাথে তিন লাখের জাতীয় সঙ্গীতের মিল খুঁজে পাচ্ছে। (‘আমার সোনার বাংলার’ সাথে নাৎসি এবং ফ্যাসিস্ট জাতীয় সঙ্গীতের lyrics এখানে দেখুন)। আমাদের গানে যুদ্ধ নিয়ে একটা লাইনও নেই, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে একটি লাইনও নেই, আছে শুধু অঘ্রানের ভরা ক্ষেতের কথা, বটের মূলের কথা, নদীর কূলের কথা, বাঙ্গালী জাতির গত হাজার বছরের ঠিকানার কথা, যে ঠিকানা আমরা খুঁজে পেয়েছি মোটে ৪৩ বছর আগে।
জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ৫০ কোটির এই মহাযজ্ঞে যাদের মাথায় আগুন ধরে গেছে, তাদের অনুরোধ করছি আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার এই জাতীয় সঙ্গীতটি নিজে নিজেই গাইতে। আশা করি মাথা ঠাণ্ডা হবে। যজ্ঞ করে জাতীয় সঙ্গীত মার্কিন মুলুকেও গাওয়া হয়, কিন্তু কেউ তাতে ফ্যাসিবাদ দেখে না। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে শতধাবিভক্ত মার্কিন সমাজ Star Spangled Banner গেয়েই নিজেদের খুঁজে পেয়েছিল, আমাদেরও নিজেদের খুঁজে পেতে হলে এই ‘আমার সোনার বাংলা’তেই ফিরতে হবে।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি
আজকাল অনেক বাংলাদেশীকেই ছুটি কাটাতে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে যেতে দেখা যায় (একটু আগেই ঢাকা বিমানবন্দরের ফ্লাইট-সূচিতে দেখলাম আজ সিঙ্গাপুর গামী ফ্লাইটের সংখ্যা ছয়।) এরা বিদেশে গিয়ে হোটেলে থাকা [..]
সাবস্ক্রাইব করুন
লগ্-ইন
5 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
wpDiscuz