গত ১৫ই আগস্ট ছিল বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন, ১৯৭৫ সালের একই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে একদল সামরিক কর্মকর্তার আক্রমণে নিহত হন। জন্ম মৃত্যুর উপর আমাদের কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, বিখ্যাত কারো মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার জন্মদিন হলে আমি জন্মদিন উদযাপন করতে পারবো না এমন কোন কথা নেই। কিন্তু উদযাপনের ব্যাপারটা যখন সারা দিন ব্যাপী গোটা পাঁচেক কেক কেটে করা হয় তখনই ব্যাপারটা চোখে লাগে। Wikipediaতে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়া জন্ম নেন ভারতে, ৪৬ সালে। তাঁর পরিবার দেশভাগের পরে বাংলাদেশে (মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) চলে আসেন। দেশভাগের টানাপোড়েনে তাঁর পরিবারের পক্ষে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ঘটা করে পালন করা সম্ভব ছিল না, এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জন্মদিন উদযাপন নিয়ে কোন কথাও শোনা যায়নি। জন্মদিন উদযাপন একটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপার, খালেদা জিয়াও তাঁর জন্মদিন নিভৃতেই উদ্যাপন করেছেন বলে মনে হচ্ছে।
১৯৯৬ সাল, বাংলাদেশে প্রথমবারের মত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। অবশ্য সে পালনের ব্যাপারটা বিভিন্ন অতি উৎসাহী ব্যক্তির কল্যাণে মোটামুটি ‘উদযাপনের পর্যায়েই পড়ে। এই উদযাপনের সাথে যুক্ত হয় খালেদা জিয়ার জন্মদিন উদযাপন। দলের নেতা কর্মী পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিন স্তর বিশিষ্ট কেকসহ তাঁর হাস্যোজ্জল ছবি পত্র পত্রিকায় দেখা গেল। পুরো ব্যাপারটা করা হলো বঙ্গবন্ধুর ইমেজকে defy করার জন্য, মানে বঙ্গবন্ধু স্রেফ একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, তাঁর মৃত্যুদিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের কিছু নেই, ১৫ই আগস্ট নিতান্তই সাধারন একটা দিন, এই দিনে জন্মদিন উদ্যাপন করাই যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু বন্দুকের গুলিতে মৃত্যুবরণ না করে জ্বরে ভুগে বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে পারতেন। কোন ব্যক্তি বিশেষের মৃত্যুর উপর কোন জাতির ভাগ্য নির্ভর করে না, কিন্তু বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে চলা সেই বিশেষ দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, কারণ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে সাথে তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে মেরে ফেলার দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে একটা ছুতো ধরে তাঁর পরিবারকে পাকিস্তানীরা সহজেই মেরে ফেলতে পারতো, যে কারণেই হোক এটা না করার মানবিকতাটুকু তারা দেখিয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের একদল তরুণ সামরিক কর্মকর্তা, যাদেরকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, তারা তাঁকে, তাঁর গর্ভবতী পুত্রবধূ এবং শিশুপুত্রকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে গুলি করে মেরে ফেলে। এই সামরিক কর্মকর্তাদের সংবিধান সংশোধন করে ইনডেমনিটি দেয়া হয় এবং তাদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠানো হয়, দীর্ঘ পনের বছর ধরে এই প্রক্রিয়াটি চলে। নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের এইভাবে পুরষ্কৃত করার আর কোন উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে আছে কিনা আমার জানা নেই। এইসব খুনিদের সাথে অসংখ্য বিদেশী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং নেতা করমর্দন করেছেন, কথা বলেছেন, কূটনৈতিক ভদ্রতার খাতিরে তাঁদের করতেই হয়েছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এঁরা বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় বর্বর একটি জাতি ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। জিয়া এবং এরশাদ রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে খুনীদের পুরস্কৃত করার এইসব কুকীর্তি করেছেন, কিন্তু জাতি হিসাবে আমরাও এই চরম লজ্জার দায় এড়াতে পারি না।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসী হয়েছে, বাকিরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সত্তরের দশকে এবং আশির দশকে তাঁরা ১৫ই আগস্ট কে নাজাত দিবস,আগস্ট বিপ্লব বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। প্রকাশ্য জনসভাতে বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন এই জাতীয় আস্ফালন করেছেন। তাঁদের ফাঁসী হয়েছে সাধারণ খুনীদের মত, সাধারণ খুনিদের লাশে কেউ জুতা নিক্ষেপ করে না, এদের লাশে তাও করা হয়েছে। নিজেদের পরিবার ছাড়া এই বিপ্লবীদের জন্য কাঁদার কেউ নেই।
১৫ই আগস্ট শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবস নয়, শুধু জাতীয় শোক দিবস নয়, ‘জাতীয় লজ্জা দিবস’। নারী ও শিশু হত্যাকারীদের সংবিধান সংশোধন করে দীর্ঘ ৩৫ বছর বাঁচিয়ে রাখার লজ্জা, ১৫ই আগস্টকে নাজাত দিবস বলার লজ্জা, খালেদা জিয়ার জাঁক করে জন্মদিন পালনের লজ্জা।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ আসলে কি, সেটা আমার কাছে কখনোই বোধগম্য হয়নি, এক মুঠো ভারত বিরোধিতা, এক গ্লাস বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর এক চিমটে ইসলাম (এখন অবশ্য আর এক চিমটে নেই, এক বালতি হয়ে গেছে) মিলিয়ে তাঁর যে রাজনীতি, এই রাজনীতি করেই তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, নিজের মুরোদেই হয়েছেন, লোকের ভোট পেয়েই হয়েছেন। এই ‘জাতীয় লজ্জা দিবসে’ তিন তলা কেক না কাটলেও তিনি ভোট পাবেন। কেক কেটে তিনি কি আত্মতৃপ্তি পান আমি জানি না, তবে আমাদের লজ্জা যে তিনি বহুগুনে বাড়িয়ে দেন, তাতে সন্দেহ নেই।

পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
