গত ১৩ জুন সংসদ প্রশ্নোত্তর পর্বে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জনাব এ বি তাজুল ইসলাম বেশ চমৎকার একটি তথ্য দিয়েছেন, তথ্যটি হচ্ছে যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কোন তালিকা সরকারের কাছে নেই (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই জুন, ২০১০)। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কোন শান্তি কমিটির কথা বুঝিয়েছেন, সেটা ঠিক বোঝা গেল না, তবে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কতৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৭ম খন্ডের) ৭১২ নম্বর পৃষ্ঠাতে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহবায়ক এবং সদস্যসহ সবার নামই বলা আছে।
শান্তি কমিটির নতুন নামকরণ
গত বুধবার শান্তি কমিটি নামে পরিচিত নাগরিক শান্তি কমিটির এক সভায় সংস্থার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে এই কমিটির কাজের আওতায় আনা হয়েছে।
এপিপি পরিবেশিত এই খবরে বলা হয়েছে যে, কমিটি প্রয়োজনমত আরো সদস্য কো-অপট করতে পারবেন। জনসাধারণ যাতে দ্রুত প্রদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য তাদের পেশার কাজ শুরু করতে পারেন তার জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি প্রদেশে সত্বর স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
কমিটি তাদের লক্ষ্য পুরনের জন্য জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কেন্রীয় শান্তি কমিটি তাদের কাজ দ্রুত ও যথোপযুক্তভাবে চালিয়ে যাওয়ার ও তাদের নীতি পুর্ণ আন্তরিকতার সাথে কার্যকরী করার জন্য নিম্নলিখিত ২১ জন সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন করেছেঃ – ১) আহবায়ক সৈয়দ খাজা খয়েরঊদ্দিন ২) জনাব এ কিঊ এম শফিক ইসলাম ৩) অধ্যাপক গোলাম আযম ৪) জনাব মাহমুদ আলী ৫) জনাব আব্দুল জব্বার খদ্দর ৬) মওলানা সিদ্দিক আহমেদ ৭) জনাব আবুল কাসেম ৮) জনাব মোহন মিয়া ৯) মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুদ ১০) জনাব আব্দুল মতিন ১১) অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার ১২) ব্যারিষ্টার আখতার উদ্দিন ১৩) পীর মহসিন উদ্দিন ১৪) জনাব এ এস এম সোলায়মান ১৫) জনাব এ কে রফিকুল হোসেন ১৬) জনাব নুরুজ্জামান ১৭) জনাব আতাউল হক খান ১৮) জনাব তোয়াহা বিন হাবিব ১৯) মেজর আফসারউদ্দিন ২০) দেওয়ান ওয়ারাসাত আলী ২১) হাকিম ইরতেয়াজুর রহমান।
দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১
আঞ্চলিক শান্তি কমিটি গুলোর কার্যকলাপ নিয়েও কিছু তথ্য একই খন্ডে আছে (পৃষ্ঠা নম্বর ৭১০ থেকে ৭২৯, স্ক্যান করা কপি এখানে)। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১৯৮৪ সালে ১৬ খন্ডে (সব মিলিয়ে প্রায় ১৫,০০০ পৃষ্ঠা) বিপুল অর্থ ও শ্রমব্যয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রায় ৩ লাখ পৃষ্ঠা দলিল বাছাই করে এই সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পূনঃপ্রকাশিত (আমি যদ্দুর জানি কম্পিউটার কম্পোজ করে) হয়। এই দলিল নিশ্চয় সরকারী টাকা খরচ করে বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরী, সরকারী অফিস, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। বেশীর ভাগ জায়গাতেই ষোল খণ্ডের এই দলিল লাইব্রেরীর এক কোনে বছরের পর বছর পরে থাকে, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র কোন গল্প উপন্যাস নয়, কেউ শখের বসে নিশ্চয় ১৫০০০ পৃষ্ঠা পড়বেন না। শাহরিয়ার কবির বা মুনতাসীর মামুনের মত গবেষকেরা অবশ্য পরিশ্রম করে এই দলিলপত্র ঘেঁটে বই লিখেছেন বা পত্র পত্রিকায় কলাম লিখেছেন।
প্রতিমন্ত্রীর উত্তরের নমুনা থেকে বোঝা গেল, তিনি নিজের মন্ত্রণালয় কতৃক প্রকাশিত দলিলে কি আছে, সে সম্পর্কে সম্ভবত নিজেই অবহিত নন। সম্প্রতি তাঁর মন্ত্রণালয় সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বয়স ছিল ৪ বছর, এমন ব্যক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের সনদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, এই প্রকল্প নিয়েও নিশ্চয় টেন্ডারবাজী চলছে। এসব নিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব, উপসচিব ব্যস্ত থাকতেই পারেন। তবে তাঁদের কাছে একটি বিনীত অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন এত ব্যস্ততার ফাঁকে, খানিকটা সময় করে মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেজ়ে মুক্তিযুদ্ধের দলিল উম্মুক্ত করে দেবার উদ্যোগ নেন, যেসব দলিল কম্পিউটার কম্পোজ করা হয়েছে, সেগুলো বাংলা ইউনিকোডে, যেগুলো এখনো কম্পোজ করা হয়নি, সেগুলোর স্ক্যান করা pdf, যাতে একটি দশম শ্রেণীর ছাত্রও জামাতের বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ (যিনি দাবী করছেন দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই) ৭১ এ কি বলেছেন বা করেছেন তা সহজেই খুঁজে বের করতে পারে। শর্মিলা বোসের তথাকথিত গবেষণা, যাতে তিনি দাবি করেছেন, ৭১ এর গণহত্যা বাড়িয়ে বলা হয়েছে, এর জবাবে দলিলের অষ্টম খন্ডে বিদেশি পত্র পত্রিকাতে (৬৪৭ থেকে ৬৬৭ নং পৃষ্ঠা) ৭১ এর গণহত্যার যে সামান্য কিছু বিবরণ আছে তাই যথেষ্ট। শুধু ভারত, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের পত্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার পত্রিকা, সবখানেই এই গণহত্যার বিবরণ ছাপা হয়েছিল, আমাদের হয়ে নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলায় এতগুলো পত্রিকার কোনই ঠেকা ছিল না। দশম শ্রেণীর ছাত্র আরও দেখবে যে দলিলের ৭ম খন্ডে (পাকিস্তানী দলিলপত্র) সার্চ দিয়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ মেজর জিয়ার নাম একবারও উঠে আসছে না। অথচ ‘পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণকারী’ শেখ মুজিবরের নাম অন্তত কয়েকশ বার আছে। তেলের ড্রামে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন জিয়া, সে ঘোষণা শুনে লক্ষ লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করে ফেলল, অথচ খোদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে কমিশনপ্রাপ্ত এই দলিলে পাকিস্তানী সরকারী কাগজপত্রের একটিতেও বিদ্রোহী হিসাবে জিয়ার নাম দেখানো গেলনা, ব্যাপারটা খানিকটা আশ্চর্য করার মতই। তবে কি মেজর জিয়া ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনা যেমন ‘অখ্যাত মেজর’ বলে বিরাট গুনাহের কাজ করেছেন, সে রকম কিছুই ছিলেন?
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা উঠতে বসতে বলছে, অনলাইনে টেন্ডার দেয়া যাবে, টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতি থাকবে না, কিছু ছেলেমেয়ে ‘কম্প্যুটার’ শিখে সফটওয়ার তৈরি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে আসবে, সবই চমৎকার ব্যাপার। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের উজ্জলতম অধ্যায়, সেই উজ্জ্বলতম অধ্যায় বখতিয়ার খলজির বংগ বিজয় নয়, তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা নয়, মাত্র ৩৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ দলিল দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কে দালাল ছিলেন, কে দিনে দালাল রাতে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সব তথ্যই ডিজিটাল কপি করে ফেলা যায়, একবার করে ফেললে সেই দলিল আর মুছে ফেলা যাবে না, ক্রমশ হলুদ হয়ে যাবে না, ঊঁই পোকা খেয়ে ফেলবে না। কে তেলের ড্রামে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন, কে ফ্রন্টে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন আর কে মনে মনে করেছেন, সবই আর্কাইভে সার্চ দিলেই জানা যাবে। ৪০ কোটি টাকা নয়, ৪ কোটি টাকা নয়, এর চেয়ে অনেক কম খরচেই এই আর্কাইভ গড়ে তোলা সম্ভব। সত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া হলোকস্ট আর একশ ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া মার্কিন গৃহযুদ্ধের যদি বিশাল অনলাইন আর্কাইভ থাকতে পারে, তবে মাত্র ৪০ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের অনলাইন আর্কাইভে সমস্যা কোথায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস বিকৃতির কারণ মুক্তিযুদ্ধের দলিলের অভাব নয়, সেই দলিলের সহজলভ্যতার অভাব। শান্তি কমিটির সদস্য তালিকা, রাজাকার বাহিনীর সদস্য তালিকা, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, সব কিছুই আছে, কিন্তু কোন মন্ত্রণালয়ের মহাফেজখানাতে আছে? তথ্য মন্ত্রণালয়ের মহাফেজখানাতে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহাফেজখানাতে, নাকি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহাফেজখানাতে? এত মহাফেজখানা ঘুরে তথ্য জোগাড়ের ধৈর্য সেকালের আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ আর একালের মুনতাসীর মামুনের থাকতে পারে, কিন্তু একজন সাধারন তরুণের নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা সেই তরুণের অস্তিত্বের প্রশ্ন। শায়েস্তা খানের টাকায় আট মন চালের আর সম্রাট আওরংগজেবের টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহের গালগল্পের ইতিহাসে তার কোনই প্রয়োজন নেই। তার প্রয়োজন আছে সেই ইতিহাসের, যে ইতিহাসে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, যাদের কারুরই পদমর্যাদা মেজরের উপরে নয়, যাদের কারুর বয়সই ৩৫ এর উপরে নয়, হারিয়ে দিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাতি আর ঘোড়া মারা পাকিস্তানী বিগ্রেডিয়ার আর মেজর জেনারেলদের। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের অনলাইন মহাফেজখানাই পারে এই ইতিহাসকে সহজলভ্য করতে।
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।