গতকাল হোলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তি হল, গত বছরের পহেলা জুলাই (ঈদের কয়েকদিন আগে) পাঁচজন জঙ্গি রেস্তোরাটির অতিথিদের জিম্মি করে এবং দেশি বিদেশি মিলিয়ে বাইশ জনকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডটির নৃশংসতার মাত্রা দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে দেয়। এই একই দলের জঙ্গিরা এর আগে প্রায় দেড় বছর ধরে নিয়মিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। সেসব হত্যাকাণ্ডের শিকার ছিলেন মূলত প্রগতিশীল ব্লগার, প্রকাশক, সমকামী এক্টিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রমুখ। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পরপর সাধারণ লোকজন, বুদ্ধিজীবী এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর রি-একশনে একটা কমন প্যাটার্ন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সমমনা অনলাইন এক্টিভিস্টরা এসব হত্যাকাণ্ডের পরে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন ঠিকই, রাস্তাঘাটেও নেমে এসেছিলেন, কিন্তু একই সাথে ফেসবুকে এবং অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে সাধারণ লোকজনের অসংখ্য মন্তব্যের মাঝে একটা প্রছন্ন সন্তুষ্টিও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। নাস্তিকদের ধর্মকে আঘাত করে লেখা আর প্রকাশ্যে কেউকে চাপাতি দিয়ে খুন করার মধ্যে কোনটা বড় অপরাধ এটা নিয়ে ফেসবুকে নানা আলাপও জমে উঠেছিল। মানে ব্যাপারটা এমন যে অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য ব্লগাররা ‘নাস্তিকতা পূর্ণ লেখা অনলাইনে দিয়ে প্রথম আঘাতটা করেন, এখন এই জঙ্গিরা পাল্টা আঘাত করছে, জঙ্গিদের খুন করাটা উচিত হয়নি, কিন্তু ধর্মকে আঘাত করে লিখলে কারো কারো মাথা গরম হয়ে খুনও করে ফেলতে পারে। মুল ধারার বুদ্ধিজীবীরাও এই হত্যাকাণ্ডগুলোর নিন্দা করেছেন বটে, তবে তাঁরা ‘নিরাপত্তার অভাব’ নিয়েই বেশী চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয়েছে, মানে অভিজিৎ রায় যে খুন হয়েছেন তার চেয়েও বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে কি করে পুলিশের এত কাছে খুন করে খুনিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, যেন অভিজিৎ রায় নির্জনে খুন হলে তাঁরা ততটা চিন্তিত হতেন না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের চাইতে নিহত ব্লগাররা তাঁদের লেখার মাধ্যমে কতখানি ‘উস্কানি’ দিয়েছেন এই নিয়ে গবেষণা করতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন, প্রতিটি খুনের পর পরই শোনা যাচ্ছিল তারা ব্লগারদের লেখা ‘খতিয়ে দেখবেন’। এছাড়াও তখনো বেঁচে থাকা ব্লগারদের ‘সীমা লঙ্ঘন’ না করতে পুলিশ-কর্তা উপদেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য নিহত ব্লগারদের লেখা খতিয়ে দেখে তারা কি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটা আমরা কখনো জানতে পারিনি। পুলিশ কর্তা একটা ‘নাস্তিকতা পূর্ণ’ লেখা সংশোধন করে অনলাইনে দিয়ে দিতে পারতেন, এতে ব্লগাররা কি করে সীমার ভেতরে থাকা যায় সে ব্যাপারে একটা নির্দেশনা পেতেন, সেটাও ঘটেনি। এই বিষয়ে আরেকটি চমকপ্রদ থিয়োরিও শোনা গেল, সেটা হচ্ছে সরকার দেশে এমন একটি ‘দমবন্ধ’ করা পরিবেশ তৈরি করেছেন যা জঙ্গি সহায়ক। মানে জঙ্গিরা মনের কথা খুলে বলতে পারলে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাত না।
হোলি আর্টিজানে ইতালীয় এবং জাপানী নাগরিকরা খুন হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল যারা এতদিন নাস্তিক হত্যার পর পর ফেসবুকে আনন্দ প্রকাশ করতো, তারা এতগুলো ‘ইহুদি নাসারা’র মৃত্যুর পরও একেবারেই আনন্দিত নয়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিহতদের ‘লেখা খতিয়ে দেখতে’ আর আগ্রহী নয়, তাঁরা অতি দ্রুত মাঠে নেমে পড়েন। আমরা দেখলাম অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পেয়ে যাচ্ছেন, শুধু তাই নয়, জঙ্গিদের পালের গোদা থেকে শুরু করে মাঠ কর্মীরা সবাই দ্রুতই মারা পড়ছে। এই ‘খতিয়ে দেখা’ বন্ধ করে মাঠে নেমে আসার কারণ হচ্ছে হোলি আর্টিজানে বিদেশিরা খুন হয়ে যাওয়ার পরই দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ফুটপাতের ক্ষুদ্র বিক্রেতাটি পর্যন্ত বুঝতে পারেন যে, জাতির পাছায় আগুন লেগেছে (ইংরেজিতে বলে ass is on fire)। এরকম ঘটতে থাকলে গার্মেন্টস ও জনশক্তি রপ্তানিতে ধ্বস নামবে, রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে আসবে আর বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্য আসাও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের ধর্মপ্রাণ (কিন্তু ধর্মান্ধ নয়) মুসলমানরাও বুঝতে পারেন যে তখন রাতদিন ইসলাম ইসলাম করলেও পেটে ভাত জুটবে না। এ কারণে নাস্তিক অভিজিৎ রায় বা অনন্ত বিজয়ের খুনের সংবাদে আনন্দিত মুমিনরাও এতগুলো ‘ইহুদি নাসারা’র মৃত্যুর পরও আনন্দিত হতে পারেননি। দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বও এই ‘পাছায় আগুন লাগার’ ব্যাপারটা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কানে পৌঁছে দেন এবং এতে দ্রুতই জঙ্গি হুমকি কমে আসে।
ব্যাপারটা এমন নয় যে হোলি আর্টিজানের হামলার পরপরই জঙ্গিদের আস্তানার খোঁজ জানিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর অহি নাজিল হয়েছিল, এই বিষয়ে তাঁদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল, কিন্তু ‘নাস্তিক’ ব্লগার অভিজিৎ রায় বা কোন হিন্দু পুরোহিত খুন হয়ে গেলে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে জঙ্গিদের আস্তানায় রেইড করে ৭-৮ জন করে জঙ্গি মেরে ফেলা যায় না। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে যায়, এছাড়াও দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মানুভুতিতেও আঘাত লেগে যেতে পারে। রেইড করার জন্য তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছে জাতির পাছায় আগুন লাগা পর্যন্ত। হোলি আর্টিজানের হামলার শুরুতেই দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছিলেন, বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানোর সময়েও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভয়ানক ঝুঁকি নিয়েছেন, কয়েকজন নিহতও হয়েছেন। এরা শুধু কর্তব্যের খাতিরে জীবন দিয়েছেন তা নয়, তাঁরা ভালভাবেই জানতেন কোনটা ‘পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনের’ ইসলাম, আর কোনটা জঙ্গি ইসলাম। কিন্তু উপরের মহলের পাছায় আগুন না লাগা পর্যন্ত তাঁদের কিছুই করার থাকে না।
বাংলাদেশে হোক বা অন্য যে কোন দেশেই হোক, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু বন্দুকের লড়াই নয়, এটা মূলত ন্যারেটিভের লড়াই। যারা জঙ্গিদের হামলা করতে পাঠায়, তারা আহত নিহতের সংখ্যা তো দেখেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখে পাবলিক রি-একশন। মানে পাবলিকের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে, ভয় থেকে আসে শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা থেকে আসে আনুগত্য। কিছু সংখ্যক লোকজনের আনুগত্য পেলে সন্ত্রাসী হামলা আরও বাড়ানো যাবে, এক পর্যায়ে সন্ত্রাসী হামলা থামাতে না পেরে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে অথবা ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে।
যেমন প্যারিসে শার্লি হেবদো হত্যাকাণ্ডের পর কিছু পশ্চিমা লিবারেল হত্যাকারীদের পাশাপাশি নিহত কার্টুনিস্টদেরও কার্টুন একে এই হত্যায় উস্কানি দেওয়ার জন্য দায়ী করেন। অধিকাংশ পশ্চিমা পত্রপত্রিকাই এই কার্টুনগুলো মুসলমানদের ধর্মানুভুতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ছাপানো বন্ধ রাখেন। এর ফলে হত্যাকাণ্ড যারা সমর্থন করেছে বা সহযোগিতা করেছে তারা নিজেদের বিজয়ীই মনে করেছে। অল্প কয়েকজন কার্টুনিস্টকে খুন করে যদি বাকি কার্টুনিস্টদের ‘শ্রদ্ধা’ আদায় করা যায়, তবে মন্দ কি। অভিজিৎ রায়কে খুন করার পরও বাংলাদেশে সেই একই প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তিনি কি লিখেছেন আর এতে মুসলমানদের মনে কি আঘাত লেগেছে এই নিয়ে আলোচনা তাঁর হত্যাকাণ্ড কেউও ছাড়িয়ে যায়। হত্যাকারীরাও বুঝে ফেলে যে হত্যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দেশের বুদ্ধিজীবী মহলও যখন হেফাজতের মাঝে সাব অল্টার্নের উত্থান দেখেন, ‘গণতন্ত্রের অভাবে’ই জঙ্গিবাদ বাড়ছে এই অভিযোগ করেন, কিন্তু ঘরের মাঝে হাতিটি দেখেও না দেখার ভান করেন, তখন জঙ্গিরা বুঝে নেয় যে পরিস্থিতি তাদের দিকেই যাচ্ছে, আর কয়েকটা বড় আক্রমণ করতেই পারলেই ক্ষমতার সুবাস পাওয়া যাবে।
হোলি আর্টিজানে নিহত অবিন্তা, তারিশী আর ফারাজ এই তিন বন্ধুর কথা আবারও আলোচনায় এসেছে, ফারাজ বেঁচে থাকার সুযোগ থাকা স্বত্বেও নিজের বান্ধবীদের ছেড়ে আসেনি, তাদের সাথেই প্রাণ দিয়েছে। এই ছেলেটির সাহসিকতা আর মানবিকতার প্রশংসা করছে সবাই, এই প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে এই ছেলেমেয়েগুলো উনিশ বছর বয়সে মরে গিয়ে ছবি হয়ে যেতে চায়নি। ৭১ এ উনিশ বছরের রুমী আর তাঁর সঙ্গীরা প্রাণ দিয়েছিলেন এই কারণে যে স্বাধীন দেশে উনিশ বছরের অবিন্তা, তারিশী আর ফারাজ মন খুলে আড্ডা দিতে আর হাসতে পারবে। জঙ্গিবাদের সাথে ন্যারেটিভের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া মানে শুধু বিতর্কে হেরে যাওয়া নয়, অবিন্তা, তারিশী আর ফারাজের চিরদিনের জন্য ছবি হয়ে যাওয়া।
অবিন্তা, তারিশী, ফারাজ আর এদের সাথে নিহত ইতালীয় নারীটির অনাগত সন্তানের প্রতি অনন্ত ভালবাসা রইল।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
মোহাম্মদ মুনিম - ২৭ নভেম্বর ২০১৯ (২:০৪ অপরাহ্ণ)
হোলি আর্টিজানে হামলায় সাত জঙ্গির ফাঁসির দণ্ড, একজন খালাস
https://muktangon.blog/wp-content/uploads/2019/11/selected.pdf