বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত সপ্তাহে সম্পাদক এবং ব্লগারদের উপরে নৃশংস হামলার পর বিডি আর্টসের সাথে সাক্ষাৎকারে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মতই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্তই ছিল। প্রায় পুরোটাই নীচে কোট করছি :
“সময়টা তো খুব আশঙ্কাজনক, একের পর হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আশঙ্কাজনক আরও এক কারণে যে, অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। আর অপরাধীরা ধরা পড়ছে না বলেই এই অপরাধ বাড়ছে। এর মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। এরা মনে করছে যে, এদের কোনও কিছুই হবে না। এমনিতেই এরা মনে করছে, ধর্মীয়ভাবে শহীদ হবে যদি শাস্তি পায়। তার ওপরে এরা শাস্তি পাচ্ছেও না। কাজেই তারা মনে করে যে, এভাবে পার পাওয়া যাবে এবং এটা তাদের পক্ষে অনেকটা বীরত্বপূর্ণ কাজে পরিণত হয়েছে।’ রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে এই ধরনের উগ্রবাদীরা সবুজ সংকেত পেয়ে যাচ্ছে কি না, এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তা তো বটেই। যারা লিখছে তারা তো অপরাধ করে নাই, নিজের মত প্রকাশ করছে। তারা বৈজ্ঞানিকভাবেই তা লিখছে, কোনো ধর্মীয় আক্রমণের জন্য লিখছে না।’ তিনি হতাশা বোধ করছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কার্যক্রমে। এটা প্রতিবাদী তরুণদের উৎসাহিতও করছে না। তার কারণে ‘প্রতিবাদ হচ্ছে না সেভাবে। কেউ গুরুত্বও দিচ্ছে না। এটা তো সবার জন্য সমস্যা। রাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে না, সমাজও গুরুত্ব দিচ্ছে না।’ উত্তরণের উপায় হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রকে সজাগ হতে হবে। রাষ্ট্র যে কেবল চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে, তা না। এরা আক্রমণ করছে রাষ্ট্রের যে ভিত্তি—যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কথা—সেই ভিত্তির ওপর আক্রমণ করেছে। এরা যে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে বিদেশিরা তাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। বিদেশি মানে বিদেশি পরাশক্তি।’ কিন্তু এটা কি বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা? বা একে কি আদৌ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায়? ‘একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার কোনও অজুহাতই নেই। এটা তো বোঝা যাচ্ছে যে, সুপরিকল্পিত। আর এরা যে নামেই আসুক, জঙ্গি বা অন্যকিছু এদের একটাই কাজ— রাষ্ট্রের মূলনীতিকে আঘাত করা।’
এই সাক্ষাৎকারে অবাক হবার মত কিছুই নেই। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডসহ গত কয়েকমাস ধরে ব্লগারদের উপর ক্রমাগত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী যে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা তিনি তাই দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারটি পড়তে পড়তে কয়েকমাস আগে তাঁর আরেকটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে গেল। সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় গত ২৬শে জুন, ‘আলোকিত বাংলাদেশ’এ। সেই সাক্ষাৎকারটিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ নিয়ে মোটেই চিন্তিত মনে হয়নি। বরং তিনি মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ নিয়ে ‘এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর’ অতি টেনশনে খানিকটা বিরক্তিই প্রকাশ করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের এই অংশটি নীচে কোট করছি :
“বাংলাদেশ এখন সস্তা শ্রম উৎপাদনের কারখানা। তারা গার্মেন্টসে কাজ করবে, গৃহভৃত্যের কাজ করবে এবং এরা সমুদ্রের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, একদল চলে যাবে বিদেশে, রেমিট্যান্স পাঠাবে। সেই রেমিট্যান্স আমরা এখানে ভোগ করব, বিদেশে পাঠাব, সুইস ব্যাংকে আমাদের টাকা জমতে থাকবে। এই ভয়াবহ বিষয়গুলো নিয়ে তো বুদ্ধিজীবীরা কিছু বলছেন না। তারা কেবল মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ নিয়ে আছেন।”
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান এবং অনন্ত বিজয় দাস কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের আগেই খুন হয়ে গিয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেসব হত্যাকাণ্ডের কোন রেফারেন্স সেই সাক্ষাৎকারে আনেননি। বরং নরেন্দ্র মোদীর হিন্দি বক্তৃতায় আমরা হাততালি দিলাম কেন সেটা নিয়ে বিষোদগার করেছেন। বলেছেন :
“বাঙালি জাতীয়তাবাদ আছে, কিন্তু তার এখন আর দেয়ার কিছু নেই। আমার রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা কি? একটা হলও নদীর সমস্যা। আমাদের চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর প্রবাহ যে শুকিয়ে আসছে সেটা নিয়ে কি জাতীয়তাবাদীরা কথা বলছে? হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কি তারা কথা বলছে? নরেন্দ্র মোদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দিতে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন। পাকিস্তানের কেউ যদি উর্দুতে বক্তৃতা দিত আমরা মানতাম? অথচ মোদীকে আমরা হাততালি দিলাম। জাতীয়তাবাদের কথা বললে- জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান তো ভাষা।”
শাহবাগ এবং হেফাজত নিয়ে তা যা বলেছেন সেটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক :
“শাহবাগ আন্দোলন পর্বে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির চেয়ে আমার কাছে বড় দিক মনে হয়েছে শ্রেণী পরিচয়। শ্রেণী-বিভাজনটাই সেখানে ছিল প্রধান ইস্যু। হেফাজতের সঙ্গে গণজাগরণের যে দূরত্ব সেটা আসলে শ্রেণী-দূরত্ব। গ্রামে মাদ্রাসাগুলোতে যারা পড়ছে তারা দরিদ্র, সুবিধা-বঞ্চিত। আমরা এখানে যারা পড়ছি তারা সুবিধাপ্রাপ্ত। এখানে দূরত্ব আছে। গণজাগরণ মঞ্চে তুমি কিন্তু শ্রমজীবীকে টানতে পারছ না। যে রিকশাঅলা তোমাকে ওখানে পৌঁছে দিয়ে যায় সে কিন্তু মঞ্চে যাচ্ছে না। রাস্তায় যেসব শ্রমিক আছে তারাও কিন্তু আসছে না। এমনকি তোমরা ভদ্রলোকরা যে সভা করছে সে তার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে যেতে পারে। যে ওটা বড়লোকদের ব্যাপার, নাচানাচি করতেছে, গান বাজনা করতেছে। শ্রেণীর সমস্যাটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে এগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না।”
শাহবাগ এবং হেফাজতের ইতিহাস এমন কিছু পুরনো নয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন জঙ্গিরা শাহবাগ আন্দোলনের একজন সংগঠক এবং ব্লগার রাজীব হায়দারকে তাঁর বাড়ির সামনে খুন করে ফেলে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করে এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের আশ্বাস দেন। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের ঢেউয়ে কোণঠাসা বিএনপি জামাত তখন রাজীব হায়দারকে নাস্তিক দাবী করে এবং এই সরকার নাস্তিকতা প্রশ্রয় দিচ্ছে এসব কথা বার্তা বলে পুরো পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়া আসে। অতিদ্রুত মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উদ্ভব ঘটে এবং তারা ২০১৩ সালের এপ্রিলে ঢাকার উদ্দেশ্য লংমার্চ করে সরকারের উদ্দেশ্যে নাস্তিকদের কঠোর শাস্তিসহ ১৩ দফা মধ্যযুগীয় দাবী পেশ করে। এর পরেই সাভারের রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে এবং সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে যায়। এই নাজুক সরকারকে শেষ ধাক্কা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মে মাসে হেফাজত আবারও লং মার্চ করে এবং পুলিশের সাথে দিন ব্যাপী সংঘর্ষে প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। তবে সেদিন রাতেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অভিযান চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী হেফাজতের কর্মীদের ঢাকা ছাড়া করে।
আপাত দৃষ্টিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে শাহবাগের কোন বিরোধ থাকার কথা নয়, আর হেফাজতের আন্দোলনের চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা তাঁর চোখ এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু এটা আশ্চর্যের বিষয় এই যে তিনি দিনের আলোর মত স্পষ্ট এই ব্যাপারটিকে এড়িয়ে গিয়ে শাহবাগকে বলছেন ‘বড়লোকের নাচানাচি’, আর হেফাজতে তিনি দেখেছেন ‘দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত’ দের জাগরণ।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে যে এই অতি সাম্প্রতিক হামলার আগ পর্যন্ত ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জঙ্গিবাদকে তেমন বড় কোন সমস্যা হিসাবে দেখেননি, এখন তাঁর ‘দিব্যদৃষ্টি’ খুলে গিয়েছে, এখন তিনি বলছেন ‘রাষ্ট্রের মূলনীতিকে আঘাত করা’ই হচ্ছে এদের উদ্দেশ্য। ব্যাপারটা অবশ্য এত সরল নাও হতে পারে, ইদানীং কালে তিনি ‘ফ্যাসিবাদ এবং হিন্দি আগ্রাসন’ নিয়ে সভা সমিতিতে যেসব কথা বলছেন তাতে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটছে। কোন কোন বেরসিক তাঁকে ইতিমধ্যেই ‘সিরাজ মাস্টার’ নামে অভিহিত করছে। আশা করছি এই শেষ বয়সে এসে তিনি ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়’ ভাবমূর্তিটি হারিয়ে ফেলবেন না, ‘সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’ নামেই হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিবেন, ‘সিরাজ মাস্টার’ হিসাবে নয়।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
ব্লগারাদিত্য - ৩০ নভেম্বর ২০১৫ (৬:২৪ অপরাহ্ণ)
প্রশংসা করি আপনার সুতীক্ষ্ণ অবজারভেশনের। ফলস্বরূপ একটি অসাধারণ লেখা পেলাম আমরা। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
রায়হান রশিদ - ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ (১১:১৪ অপরাহ্ণ)
এখানে কিছু নতুন কথা:
http://onlinebangla.com.bd/post/14070/বুদ্ধিজীবীদের-অবস্থান-উগ্রগোষ্ঠীকে-মদদ-দিচ্ছে
মাসুদ করিম - ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ (২:১৬ অপরাহ্ণ)
একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘সংকটে ও সম্ভাবনায় জনগণের পক্ষে’ ছিলেন বা আছেন? পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কথা বলে গেলেই কি বলা যাবে কেউ ‘সংকটে ও সম্ভাবনায় জনগণের পক্ষে’?
মোহাম্মদ মুনিম - ১৪ এপ্রিল ২০১৭ (৭:৪০ অপরাহ্ণ)
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্প্রতিকতম লেখা পড়ে মনে হচ্ছে তাঁর দিব্যদৃষ্টি আরও খোলাসা হয়েছে।
মোহাম্মদ মুনিম - ২৭ মে ২০১৭ (৩:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
মে ২৬, ২০১৭ সুপ্রিম কোর্ট থেকে মুর্তি সরানো বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন
মোহাম্মদ মুনিম - ৫ নভেম্বর ২০১৮ (৮:২৭ পূর্বাহ্ণ)
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নভেম্বর ৪, ২০১৮ সালে, হেফাজতের কওমি মাদ্রাসা বিষয়ক শুকরানা মাহফিলের প্রাক্কালে বলছেন