কিন্তু সাজেদা চৌধুরী হয়তো জানেন না, দেশের মানুষ মুসলমান হোক হিন্দু হোক, রাষ্ট্রের তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ দেশ ও রাষ্ট্র দুটি আলাদা সত্তা : একটি ভূগোল আরেকটি ব্যবস্থা। তাই একই ভূগোলে থেকেও আমরা ছিলাম কখনো ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থায়, কখনো মোগলব্যবস্থায়, কখনো ইংরেজব্যবস্থায়, কখনো পাকিস্তানব্যবস্থায়, আর এখন বাংলাদেশব্যবস্থায় [...]

সাজেদা চৌধুরী ভাল মুসলমান। তিনি বিসমিল্লাহ বলে কোরান পড়েন, তিনি বিসমিল্লাহ বলে সংবিধান পড়েন; তিনি খেতে শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ পড়েন, গাড়িতে উঠে স্টার্ট নেয়ার আগে বিসমিল্লাহ পড়েন। এখন তিনি যদি খাওয়ার প্লেটে আর গাড়িতে বিসমিল্লাহ লিখে রাখেন – তাহলে আমরা নাক সিঁটকাবো, অনেকে এও বলতে পারেন, নওমুসলিম, রাতারাতি বড় মুসলমান হতে চাইছেন। আর তিনি যদি বই মাত্রের শুরুতেই বিসমিল্লাহ লিখতে চান, সংবিধানের বিসমিল্লাহ রেখে দিতে চান – তাহলে আমরা বলব, না, আপনি এটা করতে পারেন না, কারণ, একটা বই একটা খাওয়ার প্লেট নয়, এটা অনেক পাঠকের, সংবিধান আপনার নিজের গাড়ি নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের, আর রাষ্ট্র আপনার মতো মুসলিম নয়, কারণ মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী বস্তু ও ধারণা ধর্ম পালন করে না। সাজেদা চৌধুরী বলতে পারেন এদেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান এবং সংবিধান মানুষের জন্য, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগের শ্রদ্ধার প্রতিফলন সংবিধানে বিসমিল্লাহ। কিন্তু সাজেদা চৌধুরী হয়তো জানেন না, দেশের মানুষ মুসলমান হোক হিন্দু হোক, রাষ্ট্রের তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ দেশ ও রাষ্ট্র দুটি আলাদা সত্তা : একটি ভূগোল আরেকটি ব্যবস্থা। তাই একই ভূগোলে থেকেও আমরা ছিলাম কখনো ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থায়, কখনো মোগলব্যবস্থায়, কখনো ইংরেজব্যবস্থায়, কখনো পাকিস্তানব্যবস্থায়, আর এখন বাংলাদেশব্যবস্থায়। দেশ ধর্মনিরপেক্ষ (নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ অপেক্ষা-রহিত, মানে উদাসীন) হয় না, কারণ দেশের মানুষ ধর্মে উদাসীন থাকে না, তারা নিজ নিজ ধর্ম আবহমানকাল থেকে পালন করে আসছে, পালন করবে। কিন্তু রাষ্ট্রকে তার প্রশাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্যই হতে হয় ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মে আগ্রহ থাকলে তার কাজ চলে না, তার প্রশাসন শক্তিশালী হয় না, কারণ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি আগ্রহ তাকে আদর্শহীন করে, চরিত্রহীন করে। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যদি সে ধর্মরাষ্ট্র না হয়ে থাকে, নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, কেউ তা পেরেছে, কেউ তা পারেনি। আমরা পারতে চাই, কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধান তা পেরেছিল। আমরা বিসমিল্লাহ ছাড়াই সেখানে যেতে চাই।

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদগণকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল — জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হবে।

আমরা চাই সংসদে এমন আইন পাস হোক যে, সংবিধানের এই মূলনীতি কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না। দেশের প্রশাসনের প্রয়োজনে সংবিধানের অন্য কিছু পরিবর্তিত পরিবর্ধিত হোক, কিন্তু সংবিধানের মূলনীতি সর্বদাই অপরিবর্তনীয় থাকার ব্যবস্থা এই সংসদকেই করতে হবে।
হাসিনা সাজেদা আশরাফুল ও আওয়ামী এমপিরা স্বধর্ম পালন করুন, জীবনের প্রতিটি পবিত্র পালনীয় কাজের আগে বিসমিল্লাহ পড়ুন, কিন্তু সংবিধানে বিসমিল্লাহর ভুল পথে যাবেন না, কারণ সেপথ ইসলামের পথ নয় — জিয়ার এরশাদের খালেদার পথ, আমরা সবাই জানি, এদের পথ ক্ষমতাদখলের বিশ্ববেহায়ার ও ইসলামিগেরিলার পথ।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৭ comments

  1. bloodycivillian - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৬:৩১ অপরাহ্ণ)

    আপনার ধারণা ভুল। দেখুন কি সুন্দর (প্র)গতিশীল এই পোস্টটি, যেটি ঠাঁই পেয়েছে এক বিখ্যাত ব্লগে একাধিক (ধিক) জনের প্রশংসাসহ।

    • সৈকত আচার্য - ২৫ জানুয়ারি ২০১০ (১:৪৮ পূর্বাহ্ণ)

      “Bloody civilian” এর দেয়া সূত্র ধরে ঐ লেখা পড়ে এলাম। সেখানে, পোষ্ট লেখক যে সব মন্তব্যগুলো পেয়েছেন, তার প্রায় সবগুলোই গতবাঁধা এবং একারনেই হয়তো মন্তব্যগুলো অনেকটা একই মেজাজের, নিতান্ত হাল্কা এবং প্রায় একই রকম। তারা বোঝাতে পারেননি, তারা কেন একে সমর্থন করেন এবং এক্ষেত্রে নিজেদের যুক্তিগুলোই বা কি। ঔই ব্লগে যারা লেখেন, মন্তব্যকারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ছাড় দিয়ে দেন। নিজেরা পাল্টা মতামত দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, এই প্রবনতা কম। কিংবা, একমত হলে, কেন একমত তা নিয়ে নিজের ভাবনাগুলো শেয়ার করেন না। এ কারনে লেখকরা নিজেদের লেখনী যাচাই করার সুযোগ কম পান। তর্ক বির্তক না থাকলে ব্লগের লেখনীগুলোতো সংবাদপত্রের কলামের মতো হয়ে যায়, তাই না? মতামতের বিনিময় এবং সংঘর্ষ একটা পোস্টকে অর্থবহ এবং আর্কষনীয় করে তুলতে পারে বৈকি।

  2. মোহাম্মদ মুনিম - ১ জানুয়ারি ২০১০ (৪:০০ পূর্বাহ্ণ)

    ব্লাডিসিভিলিয়ানকে ধন্যবাদ লিঙ্কটির জন্য, উইকিপিডিয়াতে দেখলাম রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারটি মূলত মুসলিম প্রধান দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ। তুরস্ক,আলবেনিয়া এবং মধ্যএশীয় (প্রাক্তন কম্যুনিস্ট) মুসলিম প্রধান দেশগুলো ছাড়া সব মুসলিম প্রধান দেশেরই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তুরস্ক ‘বিসমিল্লাহ’ বিদায় করেছে বিপ্লব করে। আমরাও করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ করে। আবার ফিরিয়ে এনেছি বছর পাঁচেক পরেই। শান্তিপূর্নভাবে বিসমিল্লাহ বিদায়ের নজির কোথাও নেই, আমরাও পারবো না।

  3. মাসুদ করিম - ২১ জুলাই ২০১০ (১২:০৭ অপরাহ্ণ)

    সংবিধান সংশোধনে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির নেত্রী সাজেদা চৌধুরীর প্রতি অনুরোধ

    ভাল মুসলমান হোন ঠিক কাজটি করুন, সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দিন, সেটাই ভাল মুসলমানের কাজ।

  4. মাসুদ করিম - ২৪ জুলাই ২০১০ (৯:০৩ অপরাহ্ণ)

    সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ থাকতেই পারে এবং সেটা থাকবে সংখ্যা গরিষ্ঠের লজ্জার স্মারক হিসেবে, এর এখনো পর্যন্ত চারটি স্তম্ভ : জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা। ভবিষ্যতই শুধু বলতে পারে আরো কত স্তম্ভ আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে।

  5. মাসুদ করিম - ৬ ডিসেম্বর ২০১০ (৬:৪৬ অপরাহ্ণ)

    আমরা সংবিধান রক্ষার জন্য স্বার্থ ত্যাগ করেছিলাম। সেই সংবিধানে যদি বিসমিল্লাহ না থাকে, শুক্রবার ছুটি না থাকে তা আমরা মেনে নেব না : এরশাদ

    শুধু এরশাদ একা কেন বাংলাদেশের আর আর শীর্ষশাসক খালেদা, হাসিনার মনের কথাও তাই। বিসমিল্লাহ শুক্রবারের মূল্য তাদের কাছে যত সংবিধানের অত মূল্য তাদের কাছে নেই। একজন মুসলমানের কাছে বিসমিল্লাহ শুক্রবার অমূল্য হোক আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তাই যখন রাষ্ট্রের সংবিধানে রাখতেই হবে এমন গোঁ ধরেন কোনো মুসলমান, তখন তাদের মুসলমানিত্ব উচ্চকিত হলেও হতে পারে — কিন্তু শাসক হিসেবে তারা ধর্মান্ধই থাকেন।

  6. মাসুদ করিম - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ (৮:৫৫ অপরাহ্ণ)

    রাষ্ট্রধর্ম করে ইসলামকে অপমান করা হয়েছে: অজয় রায়

    রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না মন্তব‌্য করে অধ‌্যাপক অজয় রায় বলেছেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম করে ইসলামকে একদিক থেকে অপমান করা হয়েছে।

    ধর্ম চর্চা ব‌্যক্তির নিজস্ব বিষয় বলেও মন্তব‌্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এই সাবেক অধ‌্যাপক।

    “এমনকি গোষ্ঠীরও নয়, আমি ব্যক্তি হিসেবে কোন ধর্ম পালন করব সেটা আমার একেবারে নিজস্ব ব্যাপার।”

    শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অজয় রায় বলেন, “আজকে বাংলাদেশ নানা ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ সেক্যুলার রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অথচ সংবিধানের তিলকে রাষ্ট্রধর্ম নামে ইসলামকে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি, রেখে দিয়েছি।

    “এর ফলে ইসলামের প্রতি বেশি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। বরং ইসলামকে একদিক থেকে অপমান করা হয়েছে। কেননা রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্ব, তার কোনো ধর্ম থাকে না।”

    বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) নবম জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক অজয় রায়।

    সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি রাখব, এরশাদ সাহেব যে অপকর্মটি করেছেন আমাদের সংবিধানে ইসলাম সংযোজন করে, আপনি আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করুন, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ফিরিয়ে আনুন। এবং সংসদে বিল এনে এরশাদের যে অপকর্মটি তা প্রতিবিধান করুন।”
    তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে পারে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাক বা না থাক, এই ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব ধর্মের সব মতের মানুষের আইন মোতাবেক সম অধিকার থাকবে।

    “সম অধিকার, সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা বলব, অন‌্যদিকে ব্যক্তি-গোষ্ঠী মানুষের অধিকার সংকুচিত করব- এটা হতে পারে না।”

    বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ যে সংবিধান আছে তার উপর ভিত্তি করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা দরকার মন্তব্য করে অজয় রায় বলেন, “আমরা ২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি করেছি, সেটার কিছুটা বাদ দিলে অনেকটা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। এখন সময় সেটাকে বাস্তবায়ন করার।”

    বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি।

    শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাজেটের ন্যূনতম ৪০ শতাংশ বা ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জিডিপির ৬ শতাংশ করার দাবি জানান তিনি।

    সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসা সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি অজয় রায়ের মতে, বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও ‘ক্ষতিকর’ হয়ে উঠছে মাদ্রাসাভিত্তিক ধর্মীয় গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম।
    এর ব‌্যাখ‌্যায় তিনি বলেন, “তাদের (হেফাজত) কথায় পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হল। সেখান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ লেখা বাদ দিয়ে ইসলামী হয়ে গেল। তারা হিন্দু ধর্মবালম্বী লেখকের লেখাতো বাদ দিতে বলল; কায়কোবাদের মতো লেখকের লেখা বাদ দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা, আবদুল ওয়াদুদের মতো লেখকের লেখা বাদ দেওয়ার ধৃষ্টতা তারা কোথায় পায়?”

    কওমী মাদ্রাসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং আলিয়া মাদরাসায় সাধারণ শিক্ষাক্রমের পাঠ ও আচরণ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান অজয় রায়।

    বাকবিশিস সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন, বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম, সর্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বালা বিজয় কুমার, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক বক্তব্য দেন।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.