ভারত কর্তৃক টিপাই মুখে বাঁধ নির্মাণের চক্রান্ত প্রতিহত করুন।। বাসদ

চক্রান্ত? ভারত কি কাউকে না জানিয়ে এই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে? না কি বাঁধ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে, নিজের কিছু ক্ষতি করে হলেও, বাংলাদেশের বড় মাপের ক্ষতি করার জন্যই অসদুদ্দেশ্যে যা তা একটা বাঁধ নির্মাণ করতে উদ্ধত হয়েছে?

২০০৩ ও ২০০৫-এর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল টিপাইমুখ বাঁধ। আলোচনায় বড় কোনো অভিযোগ উত্থাপিত না হওয়ায় ভারত আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহবানের মাধ্যমে টিপাইমুখ প্রকল্পের শিলান্যাস করে। আমরা এই ২০০৯-এর আগে কখনোই এই বাঁধ বিষয়ে বড় রকমের কোনো অভিযোগ বা প্রচার মাধ্যমে কোনো আলোড়ন ঘটতে দেখিনি। আজ খালেদা জিয়ার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু চিঠি চালাচালির পর, কেন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ? আর বাসদ-এর কর্মকাণ্ড দেখে তো মনে হচ্ছে খালেদা জিয়ার একান্ত ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত এই টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুর আন্দোলন সংগঠনে তার দল বিএনপি-র অক্ষমতার কারণে, আন্দোলন সংগঠনের দায়িত্বে বাসদ-কে নিয়োজিত করা হয়েছে। শুধু টিপাইমুখ নয়, এশিয়ান হাইওয়ে ইস্যুতেও বাসদ-এর বক্তব্য, “ এশিয়ান হাইওয়ের নামে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া চলবে না”। আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গে আমরা মমতাময়ী তৃণবাদী এসইউসি-কে দেখছি, অচিরেই কি আমাদের দেশেও আমরা খালেদামোদী জাতীয়তাবাদী বাসদ-কে দেখতে পাব ?

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

১৩ comments

  1. অবিশ্রুত - ২৫ জুলাই ২০০৯ (১১:০০ অপরাহ্ণ)

    পশ্চিমবঙ্গের মমতাময়ী এসইউসির মতো খালেদামোদী বাসদকে দেখা যাবে কি না জানি না, তবে টিপাইমুখসংক্রান্ত তথ্যে দেখছি, ২০০৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থাকার সময়েই বাসদ সিলেট থেকে জকিগঞ্জ অবধি একটি লং মার্চ কর্মসূচি করেছিল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার প্রতিবাদে। কাজেই খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিঠি চালাচালির পর সবাই টিপাইমুখ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার ব্যাপারটি সম্ভবত ঠিক নয়।
    বাসদের ওই লংমার্চের সংবাদ অবশ্য তেমন কোনও মিডিয়া কভারেজ পায়নি। শুধু এটি কেন, আলোড়ন তোলার মতো অনেক কর্মসূচি পালন করেও সিপিবি থেকে শুরু করে বাসদের মতো দলগুলি কোনওসময়েই তেমন কল্কে পায় না মিডিয়াতে। কখনও তাদের সংবাদ ছাপা হয় ফিলার হিসেবে, কখনও উপাঙ্গ হিসাবে, কখনও আবার বিপদসংকেত হিসেবে।
    এখন মিডিয়া যে বাসদকে ভারতবিরোধিতার জিকিরে বিএনপি-জামাতের উপাঙ্গ বানাতে চাইছে, হাজার ব্যাখ্যা দিয়েও কি বাসদের পক্ষে সম্ভব তা থেকে মুক্ত থাকা? মিডিয়া সুকৌশলে সেরকম ব্যাখ্যার প্রচার থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে জানে।
    তবে একটি ব্যাপারে কৌতূহল জাগছে, বাসদের মিত্র ভারতের এসইউসিআই এই টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে কী ভাবছে? তারা কি এখন পর্যন্ত একবারও এর বিরোধিতা করেছে?

    • মাসুদ করিম - ২৬ জুলাই ২০০৯ (৮:১০ পূর্বাহ্ণ)

      খুবই সুচিন্তিত মন্তব্য। চিয়ার্স।
      হ্যাঁ, এসইউসি-র ভাবনা জানতে চেষ্টা করছি। জানতে পারলে জানাব।

      ২০০৫-এর লংমার্চের কথা আমার মনে আছে, কিন্তু মনে নেই, সেসময় বাসদ তাদের ব্যানার ফেস্টুন দেয়াললিখন ভ্যানগার্ডে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণকে ‘চক্রান্ত’ বলেছিল কি না। কারণ আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই বলা যে, একদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণকে প্রতিবেশী দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ‘চক্রান্ত’ ( কারো ক্ষতি করার জন্য গোপন কারসাজি) বলতে পারে কি না। আমরা আজকাল ভারত-মার্কিন নীলনকশার কথাও অহরহ বলি, কিন্তু একদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে আরেকদেশ তার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কায় ‘চক্রান্ত’ ‘নীলনকশা’ এসব বলে, আলোচনা পর্যালোচনা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ থেকেই কি দূরে চলে যায় না? আমরা সবাই সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের কথা জানি, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিটি কাজকে যদি ‘চক্রান্ত’ বলে একে প্রতিহত করার ডাক দিই, তাহলে আমরা তো তাদের মূল পরিকল্পনার দোষ ত্রুটি কর্মপন্থা চিহ্নিত না করেই এক ধরনের অলসতার মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছি।

      আপনি বলেছেন মিডিয়া তাদের খবরকে গুরুত্ব দেয় না। সেটা তো পুরোপুরি সত্য। কিন্তু বাম দলগুলোর গতানুগতিক অলসতাও চরম সত্য। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনকিছুকে মুখস্থ ‘চক্রান্ত’ বলাতে আমরা অভ্যস্ত, এবং বুর্জোয়া দলগুলোর এমন আচরণের অনুকরণ বাম দলগুলোর মোটেই উচিত নয়।

      আমাদের বাম দলগুলোর বর্তমান যে অবস্থা, তাতে আমার মনে হয়–দলগুলোর মধ্যে একধরনের অক্ষশক্তির তোষণ প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবে। যেহেতু বেশ কিছু বাম দল আওয়ামী অক্ষের দিকে এরমধ্যেই ঝুঁকে গেছে, বাকিরা বিএনপি(জামাত) অক্ষের দিকে অনিবার্যত ঝুঁকে যাবে। অতিঅলস বাকসর্বস্ব দিকনির্দেশনাহীন বাম রাজনীতির এটাই পরিণতি, আমার অতি সাম্প্রতিক ইতালি ভ্রমণে–সেদেশে বারলুসকোনির সাথে বামদের যে সখ্যের কথা আমার ইতালিয়ান বন্ধুর কাছে শুনেছি, তাতে বাম পরিণতির কথা ভেবে আমার সত্যিই আতঙ্ক হচ্ছে, অথচ কে না জানে একসময়ে পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বাম সংগঠন ছিল ইতালিতে।

    • মাসুদ করিম - ৩০ জুলাই ২০০৯ (১০:১৪ পূর্বাহ্ণ)

      এসইউসি এখনো পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তাদের মুখপত্রে কোনো মতামত জানায়নি। আমি যার সাথে কথা বলেছি, তিনি নিয়মিত এসইউসি-র মুখপত্রগুলো পড়েন। আমি তার কাছে টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে কলকাতার মধ্যবিত্তদের মনোভাব জানতে চেয়েছি, তিনি বলেছেন এখনকার কলকাতার মধ্যবিত্তের ভাবনায় বাংলাদেশের কোনো জায়গা নেই।

  2. সৈকত আচার্য - ২৬ জুলাই ২০০৯ (১২:২৪ অপরাহ্ণ)

    কিন্তু বাম দলগুলোর গতানুগতিক অলসতাও চরম সত্য। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনকিছুকে মুখস্থ ‘চক্রান্ত’ বলাতে আমরা অভ্যস্ত, এবং বুর্জোয়া দলগুলোর এমন আচরণের অনুকরণ বাম দলগুলোর মোটেই উচিত নয়।

    আমারো মনে হয় বাম দলগুলো গতানুগতিক ধারায় প্রতিবাদ আন্দোলন করে চলেছে এবং আমরা তো প্রচার পাই না এই জাতীয় বোকামানুষী আবদার করে চলেছে।

    আপনি যদি হাজারো মানুষের মিছিল রাজপথে নামাতে পারেন, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ন জাতীয় ইস্যুতে, আপনি যদি প্রতিটি গণবিরোধী কর্মসূচীর বিকল্প, সুনির্দ্দিষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান দেশবাসীর সামনে হাজির করতে পারেন এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে তা প্রচার করতে পারেন আপনাকে ঠেকাবে কে? প্রচলিত মিডিয়া কয়দিন আপনাকে প্রচার না দিয়ে পারবে? আরেকটা ব্যাপার হলো প্রচলিত মিডিয়ার উপর ভর করে কবে কোন দেশে বাম আন্দোলন গড়ে উঠেছে, আমার জানা নাই।

    সাংগঠনিক ক্ষমতা না বাড়িয়ে “আমরাতো প্রচার পাই না”, জাতীয় কথা বলার মানে দেশের মানুষকে এবং নিজেদের ফাঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া। বামপন্থী আন্দোলনে এই জাতীয় অজুহাত বহু পুরোণো। এই অজুহাতে বামপন্থীরা আত্নপ্রসাদ লাভ করে সন্তষ্ট থাকতে চান, হয়তো। তাতে কিন্ত সমাজ প্রগতির চাকা ঘুরে যায় না।

  3. মোহাম্মদ মুনিম - ২৮ জুলাই ২০০৯ (১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ)

    বাসদ অফিসে জামান ভাইকে (খালেকুজ্জামান) একবার mainstream এর পত্রিকাগুলোতে লেখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি একই কথা বললেন, ওরা ছাপবে না। বাসদ এর VANGUARD পত্রিকাটি সম্ভবত বাসদ কর্মীরাই পড়েন না, জনসাধারণ তো দুরের কথা। ১৯৯৬ এ ফারাক্কা চুক্তির পরে বাসদ একটি সেমিনার এর আয়োজন করেছিল। আমার এক বাসদ কর্মী বন্ধু বলল সেমিনারে নাকি বলা হয়েছে ভারত ‘খাল কেটে কেটে’ ফারাক্কার upstream থেকে দেড় লাখ CUSEC পানি সরিয়ে ফেলে। ফারাক্কার কারনে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরকৌশলের ছাত্র হিসাবে কেবল খাল কেটে কেটে এত পানি কি করে সরিয়ে ফেলা যায়, এটা আমার বোধগম্য হয়নি। বাসদের অফিসে আমি অনেকবার গিয়েছি, জামান ভাই, সরকার ভাই এবং অন্যান্য নেতাদের আন্তরিকতা এবং সততা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তাদের আত্ববিশ্বাসের অভাব আছে এবং একবিংশ শতকের বাস্তবতায় বাম দলগুলোর কি করার আছে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার অভাব আছে। জামান ভাই একবার আমাদের BUET এর scholarship বাড়ানোর আন্দোলনের পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম BUET ছাত্রদের টিউশানি করে মাসে ৫০০০ টাকা রোজগারের সুযোগ আছে, মাসে ২০০ টাকার scholarship ২৫০ টাকা করার আন্দোলনের কোন মানে হয়না । এমন আজব কথা জামান ভাই কখনও শুনেছেন বলে মনে হয়নি।

  4. Rashid Amin - ২ আগস্ট ২০০৯ (৮:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    বিরোধিতার জন্যই শুধু বিরোধিতা অথবা অপরিনামদর্শি বিরোধিতার কারনে আমাদের দেশটি অনেক অনেক পিছিয়ে গেছে । ছোট ছোট বামদল গুলি এই ধরনের ইস্যু তৈরী করতে ওস্তাদ । বাসদের রাজনীতি নিয়ে আমারও কিছু কথা আছে । জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার্কসবাদ লেলিনবাদ স্লোগান দিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের যাত্রা ,
    বর্তমানে আমি জানিনা তাদের অবস্হা কোন পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে , তবে ছাত্রদের মধ্যে একটা প্রভাব বোধ হয় আছে , দলের নেতাদের ত্যাগী আচরণ এবং সবাইকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা হয়তো কোমলমতি ছাত্রদেরকে আকৃষ্ট করে , তবে তাদের চুরান্ত লক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তির কারনে অনেক সদস্যই ড্রপ আউট হয়ে যায় । আরেকটি বিষয় হচ্ছে কোলকাতার এক অখ্যাত নেতার প্রতি ( শিবদাস ঘোষ , নামটি ঠিক আছে কিনা জানিনা ) তাদের অপরিসিম শ্রদ্ধা । আমি দলটিকে ছোট করছিনা , তাদের সততা নিয়ে নিন্দুকেরাও প্রশ্ন তুলবেনা , কিন্তু ক্লাসিকাল কমিউনিজমের চিন্তা অন্য দিকে সংসদিয় রাজনীতি । একটু লেজে-গবরে হয়ে যায় না ? আর বাসদের মত দল যদি এশিয়ান হাই ওয়ের বিরোধিতা করে তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে , তাহলে কমিউনিষ্টরা কি আন্তর্জাতিক
    যোগাযোগ আর মৈত্রীতে বিশ্বাসী না ?

  5. রায়হান রশিদ - ২ আগস্ট ২০০৯ (১১:০৫ পূর্বাহ্ণ)

    পোস্টটি পড়ে জানতে পারলাম টিপাইমুখ এর ইস্যুতে বাসদ ব্যাপারটিকে “চক্রান্ত” হিসেবে উল্লেখ করেছে। চারু মজুমদারের “বিপ্লবীর কর্মকান্ড হবে চক্রান্তমূলক” উপদেশটি মনে করিয়ে দেয় যেন। শব্দটির প্রয়োগ কতটা যুক্তিযুক্ত সে ব্যাপারে মতভিন্নতা থাকতেই পারে। আর রাজনীতির অঙ্গনে জনগণের সামনে ইস্যু উপস্থাপনে কিছুটা অতিকথন তো থাকতেই পারে (না থাকলেই হয়তো ভাল হোতো); মনে হয় না সেটা খুব একটা বড় ব্যাপার। আর অতীত সরকারের আমলে বাসদ ইস্যুটি নিয়ে প্রতিবাদ করেছে কি না, কিংবা তাদের পশ্চিমবঙ্গের সহ-সংগঠন তা নিয়ে এখনো মাঠে নেমেছে কি না, কিংবা এখনকার আন্দোলনে বাসদ এবং জামাত-বিএনপির দীর্ঘশ্বাস একাকার হয়ে গেছে কি না, আর হলে সেখানে কি ধরণের উদ্দেশ্যপ্রণোদনা কাজ করছে – এসব নিয়ে আমরা অনন্ত কাল ধরে বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারি। সেই বিতর্ক কতটা কি সুফল বয়ে আনবে সেটা বলা মুশকিল।

    বাস্তবতা হল: টিপাইমুখে বাঁধ হচ্ছে, আর সে বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোন গ্রহণযোগ্য অবস্থান আমাদের চোখে পড়েনি। তাদের বিভিন্ন নেতৃবর্গ এখনো নানা ধরণের আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন জনগণকে, যেগুলোর মনে হয় না সত্যিকারের গবেষণাগত বা বৈজ্ঞানিক ভিত আছে। ভারত সরকারের প্রতিনিধিরাও ঠিক সেটাই করে যাচ্ছেন। পানি ব্যবস্থাপনার কিংবা বাঁধ নির্মাণের প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো সম্বন্ধে তেমন জানা নেই, তবে এটুকু বুঝি যে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত যে কোন নদীতে বাঁধ নির্মাণ করলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে বাধ্য।

    এ যাবত নির্মিত ৪৫০০০ বড় বাঁধের ওপর ভিত্তি করে ২০০০ সালে ওয়ার্লড কমিশন অব ড্যামস তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। [প্রতিবেদনটির সারাংশ এখানে; পুরো প্রতিবেদনটি এখানে]। প্রতিবেদনটি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:

    Commission believes there can no longer be any justifiable doubt about five key points:

    1. Dams have made an important and significant contribution to human development, and the benefits derived from them have been considerable

    2. In too many cases an unacceptable and often unnecessary price has been paid to secure those benefits, especially in social and environmental terms, by people displaced, by communities downstream, by taxpayers and by the natural environment.

    3. Lack of equity in the distribution of benefits has called into question the value of many dams in meeting water and energy development needs when compared with the alternatives

    4. By bringing to the table all those whose rights are involved and who bear the risks associated with different options for water and energy resources development, the conditions for a positive resolution of competing interests and conflicts are created

    5. Negotiating outcomes will greatly improve the development effectiveness of water and energy projects by eliminating unfavourable projects at an early stage, and by offering as a choice only those options that key stakeholders agree represent the best ones to meet the needs in question

    আরেক স্থানে বলা হয়েছে:

    A sectoral review of technical, financial and economic performance of dams in the Knowledge Base in terms of planned versus actual performance suggested the following:

    * Large dams built to deliver hydropower tend to perform close to but still below targets for power generation, generally meet their financial targets but demonstrate variable economic performance relative to targets, and include a number of notable under- and over-performers

    * Large dams with a flood control component have provided important benefits in this regard, but at the same time have led to greater vulnerability to flood hazards due to increased settlement in areas still at risk from floods, and in some cases have worsened flood damages for a number of reasons, including poor operation of dams

    * Large dams that serve multiple purposes also under-achieve relative to targets, in some cases exceeding the shortfalls registered by single-purpose projects, demonstrating that the targets established were often over-optimistic

    এই দু‍টো উদ্ধৃতি থেকে দুটি বিষয় মনে হয় পরিষ্কার:
    ১) পরিবেশের ওপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে বড় বাঁধ নির্মাণ একরকম অসম্ভব;
    ২) নানা ধরণের বিকল্প প্রযুক্তি থাকায় কেবলমাত্র বিদ্যুত উৎপাদনের নিমিত্তে এ ধরণের বড় বাঁধ নির্মাণ সর্বোত্তম পন্থা না;

    এই রিপোর্টটি পড়ে এবং জলাধার এবং তাতে আধিপত্য নিয়ে দেশে দেশে সাম্প্রতিক কালের তৎপরতার প্যাটার্ণ দেখে এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে:

    ক) চীন কিংবা ভারত কারোই বাঁধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হয়তো ‘বিদ্যুত উৎপাদন’ নয়। উল্লেখ্য, অন্যপ্রান্তে চীন সরকারও এমনই (এমনকি টিপাইমুখের চাইতেও বড়) আরেকটি বাঁধ নির্মাণ করতে চাইছে একই উদ্দেশ্যে। বিদ্যুত উৎপাদনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই সন্দেহের ভিত্তি হল: এখনকার প্রযুক্তিতে নদী উৎসে বাঁধ দেয়ার মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের পন্থার cost effectiveness । সেই “cost” এ কেবল চুন সুঁড়কি কনক্রিটের খরচ ধরলে চলবে না; পরিবেশ এবং সমাজের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব তাও সঠিকভাবে ধরে হিসেব করতে হবে। সে বিবেচনায় মনে হয় না টিপাইমুখ একটি “বিদ্যুত উৎপাদন ইস্যু”।

    খ) হিমালয় থেকে নিঃসৃত পানির ব্যান্কের ওপর ভবিষ্যত আধিপত্য নিশ্চিত করাই কেন যেন মনে হয় এশীয় এই দুইটি মহাপরাক্রমশালী দেশের মূল উদ্দেশ্য। সেদিক থেকে এটি “পানির ওপর আধিপত্য ইস্যু” হবারই সম্ভাবনা বেশী, যা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ভবিষ্যত পৃথিবীর অধিকাংশ সামরিক সংঘাতের মূল কারণ হবে বলে ধারণা করছেন।

    গ) সবশেষে, টিপাইমুখ যতটা না “বাংলাদেশ বনাম ভারত ইস্যু”, তার চাইতেও সম্ভবত বেশী হল “ভারত বনাম চীন ইস্যু”, সামরিক দিক থেকে। সুতরাং, যে কোন আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক পদক্ষেপের সময় ব্যাপারটা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন মনে হয়।

    এই আশংকাগুলো কতটা সঠিক হবার সম্ভাবনা, হাতে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে এখনি ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আর ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ দুই এশীয় দানবের এধরণের শক্তি প্রদর্শনের মহড়ার মাঝ থেকে নিজের কতটা স্বার্থ রক্ষা করে বেরিয়ে আসতে পারবে সেটা বলা কঠিন। তবে সরকারের এ বিষয়ে এখনই জনগণের সন্দেহাতীত আস্থা অর্জন করতে পারা জরুরী। কারণ, টিপাইমুখকে কেন্দ্র করে জামায়াতের মত স্বাধীনতা বিরোধী দল এখন জনগণের “বন্ধু” হিসেবে আত্মপ্রকাশের পাঁয়তারা করছে; আশংকা – এ কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া না ক্ষতিগ্রস্ত হয়!

  6. pranabesh - ১১ আগস্ট ২০০৯ (৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের উদ্যোগে আজ ১৬ জুলাই ’০৯ বৃহস্পতিবার, সকাল ১১ টায় শহীদ মুনীর চৌধুরী মিলনায়তন, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “টিপাইমুখ বাঁধ, বাংলাদেশে এর প্রভাব এবং বাংলাদেশ-ভারত সর্ম্পক” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ আহবায়ক কমরেড
    খালেকুজ্জামান, জাতিসংঘের সাবেক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খান, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আকমল হোসেন। সভাপতিত্ব করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফখরুদ্দিন কবির আতিক এবং সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জনার্দন দত্তনান্টু। বাসদ আহবায়ক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন— পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম পলিবাহিত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ, যা পরাক্রমশালী নদী
    গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিন বা অববাহিকার সৃষ্টি। এর প্রবাহিত এলাকা প্রায়
    সাড়ে দশ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যার ৭.৫% বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে গিয়ে সাগরে পড়েছে।বাংলাদেশের চার-পঞ্চমাংশ ভূ-খণ্ড তৈরি হয়েছে গঙ্গা (পদ্মা)-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা(বরাক) নদী সিস্টেমের মাঝে। এই গঙ্গা -ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীব্যবস্থা ৫টি দেশ। যথা ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন ও বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে। এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে এবং এর উপর নির্ভর করে পৃথিবীর প্রায় শতকরা ১০ ভাগ মানুষ বাস করে যদিও তা পৃথিবীর মোট স্থলভূমির মাত্র ১.২ ভাগ। এই পানি সম্পদ মানুষের খাওয়া, গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ-এর কাজে লাগানো, সমুদ্রের লোনাপানি প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষা করে কৃষি-বন ও আর্সেনিকের মতো বিষক্রিয়া রোধ, নৌ চলাচল, প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ও মাছের চাষ, পানি দূষণ রোধ, শিল্প-কারখানার
    জন্য পানি সরবরাহ, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুর খামারের জন্য পানি সরবরাহ, বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানা প্রয়োজন পূরণ করে। এইভাবে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিনের জলপ্রবাহের সাথে আমাদের জীবনপ্রবাহ সম্পর্কিত হয়ে আছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহকে কেন্দ্র করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মহাপরিকল্পনার একটা অংশ হচ্ছে বরাক নদীর টিপাইমুখে বাঁধ। বরাক নদী পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ব্রহ্মপুত্র-বরাক-মেঘনা বেসিনের অংশ। ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বত থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত গড়িয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। বরাক নদী উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী প্রবাহ
    (Drainage system)| বরাকের উজান এলাকা মনিপুর রাজ্যের সমগ্র উত্তর, উত্তর পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা জুড়ে রয়েছে। বরাকের মধ্যস্রোত আসাম রাজ্যের সমতল কাছার (Cachar) এলাকা দিয়ে প্রবাহিত। আর নিম্নপ্রবাহ বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সিলেট জেলার জকিগঞ্জে অমলশিদ পয়েন্টে ঢুকে সুরমা-কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরবে এসে মেঘনায় রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মেঘনা নদী প্রায় ৬৫০ মাইল দীর্ঘ। গভীর এবং প্রশস্ত এ নদী দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ নদীও। সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী সিলেট জেলা অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ
    জেলার সীমান্তে মারকুলীতে এসে কালনি নদী নামে কিছুদূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের কাছে পুরনো ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। তারপর দক্ষিণেঅগ্রসর হয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সাথে মিলিত স্রোতধারায় দক্ষিণে নোয়াখালী ও ভোলা দ্বীপের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা জেলার কিছু অংশ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে মেঘনা তার বিখ্যাত দুটি উপনদী তিতাস ও ডাকাতিয়াসহ বহু শাখা নদীসহ
    প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির পানি বহন করে চলে। একে চিরযৌবনা নদী বলা হয়, কারণ এর প্রবাহে বড় ধরনের ভাটা কখনো আসেনি। এখন টিপাইমুখে বাঁধ একে বার্ধক্য এবং মুমূর্ষু অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে যা বাংলাদেশের একটা বিশাল এলাকাকে বিরানভূমিতে পরিণত করবে। বাংলাদেশের অমলশিদ সীমান্ত থেকে ১৯৫ কিলোমিটার উজানে আসাম-মিজোরাম সীমান্তে টিপাইমুখ গ্রামের সন্নিকটে তুইভাই ও বরাক নদীর মিলনস্থলের ৫০০ মিটার নিচে এইবাঁধ নির্মিতহবে। এই বাঁধ ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নির্মিত হবে।এর উচ্চতা হবে ১৬২.৮ মিটার যা ৫০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু হবে এবং লম্বা ৩৯০ মিটার অর্থাৎ প্রায় অর্ধকিলোমিটারের কাছাকাছি। ভারতের জল কমিশন ১৯৫৫ সাল থেকেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণের চিন্তা শুরু করে। ১৯৮৪ সালে প্রথম টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপর ১৯৯৫ সালে ব্রহ্মপুত্র বোর্ড একটি প্রতিবেদন তৈরি করে এবং ১৯৯৯ সালে উত্তর-পূর্ব বিদ্যুৎ কর্পোরেশন লিমিটেড এর কাছে হস্তান্তর করে। ২০০৩ সালে তা অনুমোদন লাভ করে। ২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড.
    মনমোহন সিং টিপাইমুখ বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে তা স্থগিত হয়। তারপর ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী জোট-মহাজোটে বিভক্ত হয়ে ঢাকার রাজপথে সহিংস সংঘাতে লিপ্ত ছিল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া না হওয়া নিয়ে নানা বিতর্ক, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছিল তখন ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী ও ভারী শিল্পমন্ত্রী বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১১ সালের মধ্যে এই বাঁধের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা হবে বলে তারা ঘোষণা করেন। এখানে লক্ষণীয় যে এরশাদের শাসনামল থেকে এ পরিকল্পনা ও নানা
    উদ্যোগ গ্রহণ শুরু হয়। তারপর দীর্ঘ সময় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতাসীন হয়েছে। জামায়াত-জাতীয় পার্টি ক্ষমতার শরীক থেকেছে। একদিকে ভারত যেমন সকল আন্তর্জাতিক আইন-কানুন ও রীতি-নীতি ভঙ্গ করে উজানের দেশে একতরফাভাবে বাঁধের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেমনি বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও এ বিষয়ে নির্বিকার থেকেছে। তাদের তেমন কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। তারা যৌথ নদী কমিশনে বসে এবং বিভিন্ন সময়ে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সাথে দেন-দরবার করেছেন করেছেন বলে দাবি করে থাকেন, কিন্তু কি বিষয়ে কথা বলেছেন এবং ভারতের যুক্তি ও বক্তব্য কি ছিল আর আমাদের সরকারের যুক্তি ও বক্তব্য কি ছিল – এসকল বিষয়ে জনগণ কখনোই কিছু জানতে পারেনি। ফলে জনগণকে অন্ধকারে রেখে এ সকল দাবির কোনো মানে দাঁড়ায় না। আমাদের দল বাসদ-এর পক্ষ থেকে ২০০৩ সাল থেকেই বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। দলের উদ্যোগে ২০০৫ সালের ১ ও ২ মার্চ সিলেট-জকিগঞ্জ লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনার, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে নানাভাবে সরকারগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা হয়েছে। আরও কিছু সংস্থা ও সংগঠনও এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিল। ভারত সরকারের আন্তঃনদী সংযোগ অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধেও বাসদ ২০০৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১
    মার্চ ঢাকা-কুড়িগ্রম লংমার্চ করেছে। এবারও বর্তমান সরকারের শাসনামল শুরু হওয়া থেকেই বাসদ সরকারকে সতর্ক হওয়ার এবং উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলে আসছে। তারই অংশ হিসাবে
    সিলেটে জনসভা এবং বৃহত্তর সিলেট থেকে সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই বাঁধের কাজ বহু আগেই শুরু হয়ে যেত যদি না মনিপুরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ পূর্বাঞ্চলীয় মনিপুর-মিজোরাম রাজ্যের জনগণ এবং নানা স্তরের ভারতীয় বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞগণ এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতেন। শুরুতে মনিপুর রাজ্য সরকারও এর বিরুদ্ধে ছিল। পরে কংগ্রেস সরকার তাদের বাগে আনতে সমর্থ হয়। তাদের বিরোধিতার
    কারণ এই ছিল যে বাঁধ নির্মিত হলে মনিপুর রাজ্যের ৩১১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে যাবে, যার মধ্যে আছে ২২৯.১১ বর্গ কি.মি. সংরক্ষিত বনভূমি আর আবাদী কৃষিজমি ও আবাসন এলাকা। এতে জেলিয়াংগ্রং (Zeliangrong) ও হামার (Hmar) আদিবাসীর ৪০/৫০ হাজার লোক উচ্ছেদ হয়ে যাবে, আমাদের কাপ্তাই বাঁধে যেমন অবস্থা হয়েছিল পার্বত্য আদিবাসীদের। তাছাড়া এই বিশাল বাঁধটি যে অঞ্চলে তৈরি হতে
    যাচ্ছে তা একটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯১৮ সালে সংঘটিত ৭ মাত্রার রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পসহ ১০০ বছর ধরে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোকে বিবেচনায় নিলে ভবিষ্যত ঝুঁকি যে কত মারাত্মক হতে পারে তা আন্দাজ করা যায়। তাছাড়া আসাম-মনিপুর-মিজোরামের একটা অঞ্চলে বর্ষায় বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তারা দেখেছেন। বাংলাদেশের দুর্গতি ও চরম সর্বনাশের বিষয়টিও দু’-চারজন বিশেষজ্ঞ বলার চেষ্টা করেছেন। এই বাঁধের ফলে উজানে-ভাটিতে এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব ও
    ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে ভারতের কেন্দ্রীয় জল কমিশন (Central water commission of India) বলতে চাইছে যে এতে উজান এবং ভাটি অঞ্চলে বন্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তা পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের চাহিদার তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশও বিদ্যুৎ কিনে তার চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এক সময় তারা এও বলেছিলো যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অমলশিদ থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে এবং বাঁধের ৯৫ কিলোমিটার ভাটিতে ফুলের তাল-এ তারা আরেকটি ব্যারাজ বা বাঁধ নির্মাণ করবে যার সাহায্যে আসামের কাছাড় জলসেচ প্রকল্প (Cachar irrigation Project)-কে কার্যকর করা যাবে, বন্যার প্রকোপ কমিয়ে আনা যাবে এবং বরাক নদীর সাথে সংযুক্ত শাখা নদীগুলিতেও শীত মৌসুমে পানি সরবরাহ করে নাব্যতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। এরপরও কি বুঝতে বাকী থাকে যে
    বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর কি পরিণতি হতে যাচ্ছে?
    ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (IWM) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, এই বাঁধ চালু হলে বরাক নদীর অমলশিদ পয়েন্ট পানি-প্রবাহ কমে যাবে জুন মাসে ১০%, জুলাইয়ে ২৩%, আগস্টে ১৬% এবং সেপ্টেম্বরে ১৫%। পানির গড় উচ্চতা অমলশিদ পয়েন্টে জুলাই মাসে ১ মিটারের বেশি নেমে যাবে এবং এই গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে যথাক্রমে ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর ও মারকুলি স্টেশনে ০.২৫, ০.১৫ ও ০.১ মিটার করে। একই সময়ে সুরমা নদীর কানাইরঘাট ও সিলেট স্টেশনে পানির গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে যথাক্রমে ০.৭৫ ও ০.২৫ মিটার করে। শুকনো মৌসুমে যেমন জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে পানির প্রবাহ ২৭%, ১৬% ও ১৪% কমবে। এ বিষয়ে একটা পর্যালোচনা দরকার যাতে আমরা এ তথ্যকে সম্ভাব্য এবং পরীক্ষিত সত্য হিসাবে তুলে ধরতে পারি। সিলেট-সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার এলাকার হাওড়গুলো সুরমা-কুশিয়ারা থেকে পানি পায়। কিন্তু ওই দুই নদীতে পানি-প্রবাহ কমে গেলে সিলেটের ৩০ হাজার ২শ’ ১৩ হেক্টর এবং মৌলভীবাজারের ৫ হাজার ২শ’ ২০ হেক্টর এলাকা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে।
    কুশিয়ারা-বরদাল হাওড় (Wetland) যা কুশিয়ারা নদীর বাম তীরে অবস্থিত তা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাবে। কাওয়ার দিঘি (Kawardighi) হাওড় ও হাকালুকি হাওড়ে তুলনামূলক কম ক্ষতি হলেও নিতান্ত কম হবে না। এর প্রভাব পড়বে গোটা এলাকার ভূপ্রকৃতির ওপর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও অনেক নিচে নেমে যাবে। শুষ্ক মৌসুমে স্রোত কমে যাওয়ার কারণে বাঁধের ১০০/১৫০ কি.মি. নিম্নাঞ্চলে নদীর তলদেশে ক্রমে পলি জমার পরিমাণ বাড়বে এবং এর ফলে নদীর প্রবাহ দুই তীর ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টি করবে, ভাঙনের হার বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মেঘনার পানি-প্রবাহে ভাটা পড়লে সমুদ্রের লোনা পানি
    আরো অধিকমাত্রায় ভেতরের দিকে প্রবেশ করতে থাকবে যার নিশ্চিত পরিণতি মরুকরণ। বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের সামনে অনেকগুলো দায়িত্ব। আমাদের সরকারের উচিতঅবিলম্বে ভারতের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করা এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করা। পৃথিবীর অনেক বড় নদীই একাধিক দেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত
    হয়েছে। নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার
    জন্য১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে গৃহীত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিমালা। বহু দেশই এনীতিমালা অনুসরণ করে তাদের মধ্যকার অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ ও বণ্টন সমস্যার সমাধান করেছে। এই নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ওসামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই যেন অন্য দেশের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। একই আইনের ২৯(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি
    রাষ্ট্র নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার যে কোনো প্রস্তাবিত অবকাঠামোর নির্মাণ এবং ইন্সটলেশনের ব্যাপারে নদী অববাহিকায় অবস্থিত অন্য যে কোনো রাষ্ট্র, এই কাজের ফলে অববাহিকায় ঘটা পরিবর্তনের কারণে যার স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাকে এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশগ্রহীতা দেশটি যেন প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী থাকতে হবে। প্রায় অনুরূপ কথা বলা হয়েছে ১৯৯৭ সালে গৃহীত
    জাতিসংঘের নদী কনভেনশনের (UN Convention on the Law of Non Navigational Uses of International Water Courses) ১২ নম্বর আর্টিকেলে। ফলে বরাক-মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারার পানি বণ্টন ও অন্যান্য বিষয়ে এ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ভারত, বাংলাদেশসহ চীন এবং ভুটানকে যুক্ত করে সামগ্রিক পানি সম্পদ ও পানি বণ্টন বিষয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ। আর ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের স্বার্থ
    বা ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে। টিপাইমুখে বাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করে ভারত যে শুধু আন্তর্জাতিক আইন, রীতি-নীতি
    লঙ্ঘন করেছে তাই নয়, ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গা চুক্তির অঙ্গীকারও লঙ্ঘন
    করেছে। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল উভয় দেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির অংশীদারিত্ব পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে করা এবং নিজ নিজ দেশের বন্যানিয়ন্ত্রণ, সেচ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক মঙ্গলের স্বার্থে জলসম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারে উভয় দেশ সচেষ্ট থাকবে। ওই চুক্তিতে আমাদের স্বার্থরক্ষা করা হয়নি। উপরন্তু, ভারত যে শুধু পদ্মা (গঙ্গা) নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেছেতাই নয়, অনেকগুলো নদীর উজানে ছোট-বড় বাঁধ দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ব্রহ্মপুত্র
    নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার লক্ষ্যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমাদের শাসকরাও এ বিষয়গুলো নিয়ে নির্বিকার ঔদাসীন্য দেখিয়ে কার্যত ভারতের অন্যায্য উদ্যোগকেই সহায়তা করে চলেছে। টিপাইমুখে বাঁধসহ ভারতের অন্যান্য পরিকল্পনা নিয়ে দেশের ভেতরে যেমন
    সর্বব্যাপক সচেতনতা ও জনমত গড়ে তুলতে হবে তেমনি ভারতের গণতন্ত্রমনা, প্রগতিশীল জনগণ এবং রাজনৈতিক শক্তির সাথেও আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ বৃদ্ধি করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ ভারতের শাসকগোষ্ঠী আর ভারতের জনসাধারণ এক নয়।
    আমাদের শাসকগোষ্ঠী যে শুধু মানুষকে শোষণ-লুণ্ঠন করছে তাই নয়, এ মানুষ যে প্রকৃতির ওপর ভর করে বেঁচে আছে তাকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। এ
    অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়বে। আর তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটা সর্বব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এরই অংশ হিসেবে আয়োজিত আজকের সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাদের
    শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।

    • মুক্তাঙ্গন - ১১ আগস্ট ২০০৯ (৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ)

      @pranabesh,
      আপনার মন্তব্যটির টেক্সট কোন কারণে আসেনি। অনুগ্রহ করে আবার সাবমিট করলে ভাল হয়।
      ধন্যবাদ।

  7. মাসুদ করিম - ১১ আগস্ট ২০০৯ (৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ)

    বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি কাজী খলীকুজ্জামান টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি সুচিন্তিত কলাম লেখেছেন গতকালের যুগান্তরে। পড়ুন এখানে

  8. মাসুদ করিম - ১৬ আগস্ট ২০০৯ (৪:৪৩ অপরাহ্ণ)

    সম্মিলিত নারী সমাজ আজ মাঠে নেমেছে। টিপাইমুখ নিয়ে প্রথম আলোতে খোলা কলমে ফরিদা আখতারের কলাম

  9. মাসুদ করিম - ১৭ আগস্ট ২০০৯ (৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    ০২ আগস্ট ২০০৯-এর প্রথম আলোতে দেব মুখার্জির সাক্ষাৎকার : অভিন্ন নদীগুলোর সমস্যা নিয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিত
    আজকের যুগান্তরে আবু আহমেদের কলাম : টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকারকে শক্ত হতে হবে

  10. মাসুদ করিম - ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ (৪:২৩ অপরাহ্ণ)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.