শীত ছুঁই ছুঁই সেপ্টেম্বরের ১৭-তে নিউইয়র্কের জুকোট্টি পার্কে মাত্র শ দুয়ের মতো তরুণ-তরুণী অবস্থান নিয়েছিল তাঁবু, টর্চলাইট ইত্যাদি নিয়ে। তার আগে তারা সারাদিন পদযাত্রা করেছে বিভিন্ন রাস্তায়। তখন তাদের সঙ্গে ছিল আরো অনেক সঙ্গী। তাদের সবার লক্ষ্য, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ওয়াল স্ট্রিট দখল করা। ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকোট্টি পার্কে অবস্থান নেয় তারা সবাই- কেননা অন্য কোনো পার্কে অবস্থান নেয়া সম্ভব ছিল না, ব্যক্তিমালিকানাধীন এ পার্কটিই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা, যেখানে অবস্থান নিলে রাষ্ট্রশক্তি জোর খাটিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারবে না রাতের বেলা। কিন্তু সন্ধ্যার পর যতই সময় গড়াতে শুরু করল, বিক্ষোভকারীর সংখ্যাও ক্রমেই কমতে শুরু করল, হাজারখানেক থেকে তা কমে এসে দাঁড়াল শ’দুয়েকে। কেননা অবস্থান নেয়ার অনুমতি থাকলেও পার্কে তাঁবু টাঙানোর অনুমতি ছিল না। কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর এমন হলে হতোদ্যমই হওয়ার কথা কিন্তু হতাশ হননি তারা। যদিও সামাজিক আন্তর্জালগুলো ব্যবহার করে সংগঠিত এই তরুণ-তরুণীরা তখনো জানতেন না, নতুন এক ইতিহাস লিখতে যাচ্ছেন তারা। তারা জানতেন না, নতুন এই ইতিহাস পাল্টে দিতে চলেছে গণতন্ত্রের ধারণা, বদলে দিতে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের প্রক্রিয়া। তারা জানতেন না, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা আর কার্যক্রমও নতুন করে খতিয়ে দেখার পরিসর তৈরি করবে তাদের এই আপাতদৃষ্টিতে অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। তারা এ-ও জানতেন না, যে যে মতাদর্শেরই হোন না কেন, এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে তারা আবারো জীবন্ত করে তুলছেন পুরনো এক মুক্তিকামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক নেতাকে – কার্ল মার্কসকে।
‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের কাউকে কাউকে প্রেরণা জুগিয়েছে আরব বসন্ত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে এ রকম একটি বিক্ষোভের পরিস্থিতি দানা বাঁধতে শুরু করে প্রকৃতপক্ষে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাবের পর থেকেই-যা ২০০৯ সালে আমেরিকায়, পরে যুক্তরাজ্যেও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। ১৯৩০-এর দশকের বিশ্ব অর্থনীতির মহামন্দার পর যেমন বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তির আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়েও তেমনি মানুষের মনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে নতুন করে। করপোরেট মিডিয়াগুলো ‘আরব বসন্ত’কে বড় করে তুললেও বিক্ষোভের সূচনা ঘটে মূলত ইউরোপেই, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, গ্রিস ও স্পেনে। আরব দেশগুলোতে বিক্ষোভ দেখা দেওয়ায় করপোরেট মিডিয়াগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, ইউরোপের বিক্ষোভকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় তাদের হাতে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আরবনীতি এবং এর বিপরীতে আরব দেশগুলোর স্বৈরাচারী সরকারগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ সেসব দেশের আন্দোলনকে নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সামাজিক আন্তর্জালকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা এসব আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মিডিয়াগুলো আদর করে ‘গণতন্ত্রমুখী’ ‘আরব বসন্ত’ হিসাবে অভিহিত করলেও অচিরেই ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলন তাদের স্বপ্নভঙ্গ করে। তারা বুঝতে পারেন, যমে ঘর চিনেছে, মধ্যপ্রাচ্য অতিক্রম করে আন্দোলন এখন তাদের ঘরেও উপস্থিত। যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ‘এম্পায়ার’ আমেরিকা।
‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছেন। এ আন্দোলন পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছে আমেরিকার প্রকৃত চেহারা। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনায় আমেরিকার সামাজিক ও জীবনযাপনগত পরিস্থিতি নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসঙ্কট, বাসস্থান ও কর্মহীনতার সমস্যা প্রকটাকারে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে কখনই তা উঠে আসেনি। ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশনস-এর অধ্যাপক পল লেভিননের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ এবং এ ধরনের আন্দোলনগুলো, প্রতীকায়িত করছে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আরেক উত্থানকে, যা আদপে প্রাচীনকাল থেকে আর কখনই দেখা যায়নি।’ পুঁজিবাদীরা এ আন্দোলনে শঙ্কিত হলেও উলস্নসিত বামপন্থীরা-যদিও তারা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির যে রূপ উঠে আসছে, তাকে গভীর থেকে অনুভব করার চেষ্টা করছেন না। তারা কেবল এটুকুই বিবেচনা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কার্ল মার্কস ফিরে এসেছেন। এটি সত্যি, কার্ল মার্কস ফিরে এসেছেন; আমাদের এ ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে, পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা দিতে গিয়ে একদা মার্কস লিখেছিলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদবিরোধী সামাজিক বিপ্লব তখন প্রথমে দেখা দেবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে। অথচ কার্ল মার্কসের সেই সামাজিক বিপ্লব তখন কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে ঘটেনি। ঘটেছিল অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ সোভিয়েত রাশিয়াতে আর ওই বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবিতা তুলে ধরার জন্য তীব্র মতবাদিক সংগ্রাম করতে হয়েছিল ভ. ই. লেনিনকে। সমসাময়িক অন্য নেতারা যখন সোভিয়েত রাশিয়াকে ‘মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া’র প্রাধান্যজাত ‘সামন্তবাদী সমাজ’-এর ডোবায় আটকে রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, লেনিন তখন মার্কসের সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্নকে সত্যি পরিণত করতে পেরেছিলেন মার্কসের তত্ত্বকে যুগোপযোগী করে তোলার মধ্য দিয়ে। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ আর ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’-এর মতো বই লিখে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে তাকে তুলে ধরতে হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র, রাশিয়ার প্রকৃত অবস্থা, জাতীয় বুর্জোয়ার নতুন বৈশিষ্ট্য। তুলে ধরতে হয়েছিল কৃষি প্রশ্নসংক্রান্ত বিতর্কে কৃষিতে পুঁজি বিকাশের নতুন ধারণা। এভাবে অনেক তথ্য ও বাস্তবতার সমাহার ঘটিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লব সম্পন্ন হবে মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার মতো অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে। লেনিন তার তত্ত্বকে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ায় সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। লেনিনের সেই সোভিয়েত রাশিয়ার মৃত্যু ঘটেছে ১৯৮৯ সালে। আর এ ঘটনার বছর বিশেক পরে অর্থনৈতিক মন্দার মুখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে সরকার বিভিন্ন ব্যাংক জাতীয়করণ করে, বেইলআউট ঘোষণা করে পুনরায় জীবন্ত করে তোলেন কার্ল মার্কসকে। আরও বছরখানেক পরে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেখা দিয়েছে সামাজিক কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে দাঁড় করানো মার্কসের উপসংহার- পুজিবাদবিরোধী সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে অপেক্ষাকৃত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে।
এই আন্দোলন বামপন্থীদের কাঙ্ক্ষিত সামাজিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাবে কি না সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এর ফলে কি ডানপন্থী কি বামপন্থী সবার সামনেই কতকগুলো প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এসেছে। এ রকম একটি প্রসঙ্গ হলো করপোরেটতন্ত্র। উদ্বেলিত বামপন্থীদের চিন্তা করে দেখতে হবে- এই করপোরেটতন্ত্র শ্রেণীতত্ত্বকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না। কেননা শোষিত শ্রমিক শ্রেণী বলতে আমাদের সামনে শ্রমিকের যে চেহারা ভেসে ওঠে, তা এই করপোরেটতন্ত্রে নেই, এই করপোরেটতন্ত্র শ্রমিককে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে তেমন কার্পণ্য করে না, কেননা শ্রমিক শ্রেণীর পরিধি করপোরেটতন্ত্রে সঙ্কুচিত বরং পরিধি অনেক বৃহৎ সেবা খাতভুক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও করপোরেটতন্ত্র যথেষ্ট সন্তুষ্ট রাখে। তাহলে কে খেপছে করপোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে? খেপছে কনজিউমার শ্রেণী। আর সেই কনজিউমার শ্রেণীর অংশ হিসাবে কি শ্রমিক, কি মধ্যবিত্ত সবাই আবার ক্ষিপ্ত হচ্ছেন করপোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এভাবে করপোরেটতন্ত্র তৈরি করেছে নতুন এক ডিলেমা-যারা তার বিরোধিতা করছেন তারা একইসঙ্গে তার ভুক্তভোগী ও সুবিধাভোগী। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক আন্তর্জালই যখন বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে তখন বিপ্লবের প্রধানতম শ্রেণী ও শক্তি কি সনাতন শ্রমিক শ্রেণী? আবার মালিকানার সূত্রে নয়, বরং করপোরেট-পদে আয়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে নতুন বিত্তবান, যারা শিল্পমালিক নয়, ব্যবসায়ীও নয়, অথচ ধনিক; একইভাবে তথ্যপ্রযুক্তির যে বৃহৎ বাজার সারা বিশ্বে বিস্তৃত হয়েছে, যা ভারী শিল্পক্ষেত্রের চেয়েও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাতে কাজ করছেন শিক্ষিত অথচ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ব্যাপক মানুষ। সাবেক সূচক ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এদের শ্রেণীবিন্যাস করা দুরূহই বটে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রকাঠামো শ্রেণীসংঘাতকে স্তিমিত করার প্রয়াসে মধ্যশ্রেণীকে সযত্নে বিস্তৃত করেছে; এই মধ্যশ্রেণী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি বিক্ষুব্ধ হয়েও ওঠে, তাতে সংঘটিত সামাজিক বিপ্লবের রূপ কী হবে? এ রকম বিভিন্ন বিষয় এখন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে।
আবার এর আগের বিভিন্ন বিদ্রোহ ও বিবের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রেজিমেন্টেড কোনো পার্টি তা সংগঠিত করেছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে। শ্রেণীচিন্তাও তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এবারের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর নতুন করে যেসব বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে, নতুন যে বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তাতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা এখনও নেতৃস্থানীয় নয়, বরং অনেকটাই সঙ্কুচিত। ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেনি, বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ সামাজিক আন্তর্জালের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে এ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মার্কসের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার পড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে বটে, তবে এর কারণ এই নয় যে, তারা মার্কসকে অপরিহার্য মনে করছেন। বরং কারণ এই যে, আন্দোলনের বিরোধিতাকারীরা এর মধ্যে কার্ল মার্কসের ভূত দেখছেন এবং তাই বিক্ষোভকারীরা মার্কসের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও বিক্ষোভকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলহীন অবস্থায় রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কমিটমেন্ট নিয়ে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কতদূর যেতে পারে? এ আন্দোলন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটি পার্টির অভ্যুদয় অনিবার্য করে তুলবে? নাকি প্যারি কমিউনের মতো কয়েক মাস আশার আলো জ্বালিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত দপ করে নিভে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পরিস্কার নয়।
বিক্ষোভের সংগঠকদের একটি অন্যতম বক্তব্য হলো, গণতন্ত্রকে এখন করপোরেটতন্ত্র গিলতে বসেছে, নানাভাবে প্রভাবিত করছে। গণতন্ত্র আর রাজনীতিকে করপোরেটতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে। বিক্ষোভকারীরা এ বক্তব্য নিয়ে যতই অগ্রসর হয়েছেন ততই সুস্পষ্ট হয়েছে যে কেবল রাজনীতি আর গণতন্ত্রকেই নয়, মিডিয়ার ভূমিকা কী হবে তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে করপোরেটতন্ত্র। আর তাই অভিযোগ উঠেছে এবং এর সত্যতাও রয়েছে যে, করপোরেটবিরোধী এই আন্দোলন মিডিয়া কাভারেজ পায়নি সঠিকভাবে। অনেকেই মিডিয়ার ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন রাজনৈতিক, ধারাভাষ্যকার ও লেখক কেইথ ওলবারমান-ও। বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর শনিবার কিন্তু ‘দ্য নিউইয়র্ক অবজারভার’ এ সংক্রান্ত সংবাদ সর্বপ্রথম প্রকাশ করে ২১ সেপ্টেম্বর বুধবারে। যারা মিডিয়ায় সংবাদটি প্রকাশ করেন, তারাও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দেননি, বরং নানাভাবে সমালোচনা করেছেন। যেমন দ্য বোস্টন গেস্নাবের জোয়ানা ওইস এ আন্দোলনকে সমালোচনা করে বলেন, সার্কাসের আবহে গড়ে ওঠা এ বিক্ষোভকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। মাদার জোনস ম্যাগাজিনের লরেন ইলিস ২৭ সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে সমালোচনা করে লেখেন, এই আন্দোলনের কোনো স্বচ্ছ বার্তা নেই। মিডিয়া বিশেষজ্ঞ ডগলাস রাশকোফ অবশ্য বিক্ষোভ ও আন্দোলনের প্রতি মূলধারার মিডিয়াগুলোর এই উন্নাসিকতা মেনে নিতে পারেননি। বলেছেন তিনি, ‘যিনিই বলুন না কেন, বিক্ষোভকারীরা কী নিয়ে বিক্ষোভ করছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই, তাতে কোন সত্যতা নেই। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একমত হই বা না হই, আমরা সবাই জানি, তারা এত হতাশ কেন; আমরা সবাই জানি, ওয়াল স্ট্রিটে কর্মরত বিনিয়োগকারী ব্যাংকাররা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে কেন, যেখানে বাকি আমাদের পক্ষে তা কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠছে।’ রাশকোফের মতে, এই বিক্ষোভ যতটা না জয়ের জন্য, তারও বেশি নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখার, সমবেত করার ও কনসেনশাসের জন্য।
অবশ্য পশ্চিমা মিডিয়া থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন মিডিয়া যে ভূমিকাই রাখুক না কেন, আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন নগরে। যে দেশের যে স্থান বা কেন্দ্রটি পুঁজিতন্ত্র বা করপোরেটতন্ত্রের প্রতীক হিসাবে পরিচিত, সেটিকেই শান্তিপূর্ণভাবে দখলে নেয়ার প্রতীকী কর্মসূচি নিচ্ছে সে দেশের বিক্ষোভকারীরা, সংহতি জানাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। আন্দোলনকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তি এর মধ্যেই দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। যেমন ‘বোস্টন দখল কর’ শ্লোগান নিয়ে মিছিল করতে করতে বোস্টনের বিক্ষোভকারীরা রোজ কেনেডি গ্রিনওয়েতে পৌঁছালে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভরদুপুরে বোস্টনের পথে সংঘটিত সেই সহিংসতাকে কোনো মিডিয়া সঠিকভাবে কাভারেজ না দিলেও আন্তর্জালের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে অকল্যান্ডে- কিন্তু তাও পায়নি যথাযথ মিডিয়া কাভারেজ।
এক কথায়, বিশ্ব মিডিয়া ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও বিকল্প মিডিয়ার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। এটি হচ্ছে আন্তর্জাল-যুগ বা ইন্টারনেট যুগের প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন, যা কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর নির্ভর না করে সম্পূর্ণ সামাজিক আন্তর্জালকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি। এই সামাজিক আন্তর্জালই তাদের বিকল্প মিডিয়া। পৃথিবীতে আর কখনই কোনো আন্দোলনকারী গোষ্ঠী বা সংগঠন এভাবে বিকল্প মিডিয়া গড়ে তোলার এবং ব্যবহার করার অবারিত সুযোগ পায়নি। কিন্তু এই বিকল্প মিডিয়াকে আন্দোলনকারীরা কীভাবে কতটুকু কাজে লাগাতে পারবেন, সাধারণ জনগণকে এর সঙ্গে কী উপায়ে কতটুকু সম্পৃক্ত করতে পারবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তাছাড়া এই বিকল্প মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ এত অবারিত যে তা ব্যবহার করতে পারছেন আন্দোলনের বিরোধিতাকারীরাও- ফলে তারাও পাচ্ছে সমান প্রতিপ্রচারের সুযোগ।
এই মুহূর্তে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’ আন্দোলনকে উপেক্ষা করার চেষ্টা চালানো হলেও পরিস্থিতি খুব বেশিদিন এমন থাকবে না। রাষ্ট্রশক্তিকে কোনো না কোনভাবে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে, যাতে মার্কিন জনগণ নিজেদের প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীন ভাবতে শুরু করে এবং বিশ্বের মানুষদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় অন্য কোনো ঘটনাতে। আর এটি ঘটানোর সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ। কেননা অনেক আগেই বিল ক্লিনটন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, সপ্তদশ শতাব্দীর ওয়েস্টফালিয়ান সেটেলমেন্টের সময় থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি মনে করা হলেও এখন তা সেকেলে হয়ে গেছে। ক্লিনটন প্রশাসনের পর এসেছে বুশ প্রশাসন- যা কি না অকার্যকর করে ফেলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিক যুদ্ধ সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য জেনেভা কনভেনশনকে এবং ‘বৈধ’ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘আগাম-আত্মরক্ষামূলক’ যুদ্ধকে। এখন ওবামার প্রশাসন যদি ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থে’ নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধেও ‘আগাম-আত্মরক্ষামূলক’ হামলাকে বৈধ ঘোষণা করে তাও আর আমাদের কাছে তেমন অস্বাভাবিক মনে হবে না। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। সন্দেহ নেই, এ হামলা ওবামার রাজত্বকেও নতুনভাবে বিন্যস্ত করবে। নির্বাচনের সময় থেকেই পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন ওবামা- তার ভোটারদের কোনো পরিবর্তন না এলেও ইতিমধ্যেই অনেক পরিবর্তন এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং তা অবশ্যই এক শতাংশের পক্ষে। রাজস্ব বাড়ানো নয়, বরং ব্যয় কর্তনই তাই ওবামা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘দার্শনিকরা এতদিন জগৎকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছেন- কিন্তু আসল কাজ হলো পৃথিবীকে পরিবর্তন করা।’ পৃথিবীকে পরিবর্তন করার মহাযজ্ঞে আহ্বান করেছিলেন তিনি সবাইকে। হতাশায় নিমজ্জিত লেখক ম্যক্সিম গোর্কি আত্মহত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাশিয়ার অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার মানুষদের বলেছিলেন, ‘জীবনকে পাল্টানো সম্ভব – জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে।’ সারা পৃথিবীর পুঁজিতন্ত্রীরা বিংশ শতাব্দী জুড়ে পরিবর্তনের এ মহাযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করেছে এবং যত রকম নিষ্ঠুর পন্থা আছে তার সবই ব্যবহার করেছে এই মহাযজ্ঞ দমন করার কাজে।
নির্মম হলেও সত্য, পরিবর্তনের সেই ডাককে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর কব্জা করেছে পুঁজিতন্ত্রী করপোরেটবাদীরা। এখন তাই বারাক ওবামারা পরিবর্তনের জন্য ডাকেন, শেখ হাসিনারা দিনবদলের জন্য জনগণকে ডাকেন, পটপরিবর্তনের লক্ষ্যে খালেদা জিয়ারা রোডমার্চে নামেন করপোরেটতন্ত্রী অথবা তাদের সুবিধাভোগীরা বদলে ফেলার নানা আয়োজন করেন। আবার কেউ কেউ সবকিছু বদলাতে নেই বলে উপদেশও দেন। এমনি বিজ্ঞাপনের ভাষায়ও ভাসতে থাকে বদলে ফেলার আমন্ত্রণ। কিন্তু পরিবর্তনের জোয়ার যে আসলে কী, আসলে কেমন, অস্পষ্ট পরিসরে হলেও ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’র আন্দোলন নিয়ে এসেছে তারই বার্তা। আমরা জানি না, এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোন গন্তব্যে পৌঁছুবে। তবে এ আন্দোলন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে পুরনো সেই উপলব্ধি : পৃথিবী এ রকমভাবে চলতে পারে না, জোড়াতালি দিয়ে পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটে না, পরিবর্তনের অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিবর্তন এবং পুঁজিতন্ত্রপ্রভাবিত গণতন্ত্র, রাজনীতি ও মিডিয়া সেই পরিবর্তন করতে পারবে না। পরিবর্তনের উপলব্ধি নিয়ে জেগে ওঠা সারা পৃথিবীর মানুষ নিশ্চয়ই খুঁজে নেবে পরিবর্তনের জন্য নতুন পথ, নতুন মত, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সংগঠন। আর নতুন করে গড়ে তোলার জন্য দখল করবে পুরনো সেসব কেন্দ্রভূমি, যা মানুষের ওপর চাপিয়ে রেখেছে জগদ্দল অপরিবর্তনের পাথর।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৮ comments
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ২২ নভেম্বর ২০১১ (১:১৬ পূর্বাহ্ণ)
লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়। ওয়াল স্ট্রীট দখল করা’র আন্দোলন বিষয়ে আমেরিকার সরকার দলের মূল মনোভাব কি ? তারা কি এটা চালিয়ে যেতে দিতে চায় ? কেউ কেই বলেন, ওবামা প্রশাসন নাকি এই আন্দোলনে পরোক্ষভাবে ইন্ধন দিচ্ছে। কারন ধনীদের উপর কর আরোপ করা এখন তার প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছে। ফলে, দুই দিক থেকে সে লাভবান। একদিকে কর আরোপ করে ধনীদের কাছে থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি, অন্যদিকে সাধারনের সমর্থন লাভ। হতে পারে, এটা কোন বুদ্ধিজীবি’র ধারনা মাত্র। বাস্তব হয়তো তা নয়। তাই মনে হয়, এই বিষয়ে আরো একটু আলোচনা হতে পারলে ভালো হতো। লেখককে আবারও ধন্যবাদ।
ইমতিয়ার - ২২ নভেম্বর ২০১১ (২:৫৮ অপরাহ্ণ)
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দল ও নেতারা এ আন্দোলন সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করেন, তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে নিচের বাক্যগুলি থেকে :
দেখা যাচ্ছে, ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতাধিপত্যের রাজনীতিকেও বিন্যস্ত করতে চলেছে নতুনভাবে।
রফিকুল আনোয়ার রাসেল - ২৩ নভেম্বর ২০১১ (৮:৫০ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ েলখককে
মাসুদ করিম - ২২ নভেম্বর ২০১১ (১২:৩৯ অপরাহ্ণ)
ক্যাপিটাল, ফিনান্সক্যাপিটাল, সীমানাহীন ফিনান্সক্যাপিটাল : প্রথম দুটির জাত বিচারে দুটি বিখ্যাত বই লেখা হয়েছে, একটি Karl Marx-এর ‘ক্যাপিটাল’ এবং অন্যটি Eduard Marz-এর ‘ফিনান্সক্যাপিটাল’। কিন্তু বর্তমান যুগের পুঁজির বিচার করার জন্য যেবইটি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সেটি এখনো লেখা হয়নি, শুধু শিরোনামটি অপক্ষো করছে কোনো এক যোগ্য লেখকের জন্য — Finance Capital without Borders। এই সীমানাহীন ফিনান্সক্যাপিটালের শাসনই আমাদের শ্রমিক শ্রেণী, কেরানি শ্রেণী, কর্মকর্তা শ্রেণী ও অসংগঠিত ছোট-বড় ব্যবসায়ী শ্রেণীকে ভয়ঙ্কর এক সিদ্ধান্তহীন মন্দার সংকটের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে। মোদ্দা কথা একটা নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে খেটে খায় যারা, করে খায় যারা, উদ্যোগী হয় যারা — তারা সবাই কোনো না কোনো ভাবে সীমানাহীন ফিনান্সক্যাপিটালের চাপে বিপর্যস্ত।
‘দখল কর’ শুধুই শুরু। এই ‘দখল কর’ আমাদের সচেতনতাই শুধু বাড়াতে পারে। কিন্তু বৌদ্ধিক জগতে সীমানাহীন ফিনান্সক্যাপিটালের গতি-প্রকৃতির পাঠ সম্পূর্ণ না হলে আমরা আগাতে পারব না। কাজেই এই ‘দখল কর’কে প্রগতিশীল করতে হলে সদাসতর্ক বৌদ্ধিকতার প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি। কোনো ভাবে এটা যদি প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে যায় তাহলে আমরা শিকার হব ‘প্রাক-আধুনিক’ পশ্চাদপদ সব ধ্যান-ধারণার। যেটা হয়ত আমাদেরকে বদ্ধ বিমর্ষ এক ‘মধ্যযুগ’-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আশেক ইব্রাহীম - ২৭ নভেম্বর ২০১১ (১:৫১ অপরাহ্ণ)
‘অকুপই ওয়াল ষ্ট্রিট’ আন্দোলনে মিডিয়ার ভুমিকা হতাসাজনক হলেও এটার দরকার ছিল বলেই মনে হচ্ছে আমার। এই ভুমিকায় মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যারা এতদিন পাশ্চাত্য মিডিয়ার গুনমুগ্ধ ছিল সেই সব লোকেরা, যারা আজ ‘অকুপাই’ আন্দোলনে অংশগ্রহন করছেন তারাও মিডিয়ার ভুমিকা নিয়ে সমালোচনা করছেন। অথচ এই মিডিয়ার বানানো গল্পের উপর ভর দিয়েই এতদিন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আগ্রাসনের সমর্থন করেছিলেন।
অকুপাই আন্দোলনে অংশগ্রহনকারীরা যে ষ্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তা মনে হচ্ছে না। কিন্তু রাষ্ট্রের সাথে করপোরেট পুজির যে অবিচ্ছেদ্য সখ্যতা এবং গোপন আঁতাত- যার ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, এটা তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে উঠতে বাধ্য করছে। সত্য এটাই যে, আমরা যেটাকে দেখছি করপোরেট পুঁজি হিসেবে সেই পুঁজি আসলে আমেরিকানদের কাছে জাতীয় পুঁজি; যা বিভিন্ন দেশের বাজারে বিদেশী পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ হয়েছে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে। গড়ে উঠেছে বৃহৎ করপোরেশন। অল্প কথায় বলতে গেলে- এই সব করপোরেশন ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল, এবং এই সব রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শাসকদের কাছে করপোরেট পুজির এই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় চাওয়া এবং পাওয়া। এর ফলে তারা বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কুটকৌশল নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।
ঘটনার সুত্রপাত বিশ্বমন্দার মাধ্যমে। মার্কস এর মতে ‘পুঁজি তার নিজের সংকট নিজেই তৈরী করে’। এই সংকটের ফলশ্রুতিতে পুঁজি (করপোরেশন) নিজেকে বাঁচাতে বাধ্য হল শ্রমিক ছাঁটাইয়ে, বাড়ল বেকারত্ব; করপোরেশন গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্রিয়ভাবে গৃহিত হলো বিভিন্ন প্যাকেজ এবং তার সবই সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। এই অবস্থায় একজন চাকরীচ্যুত শ্রমিক বিদ্রোহ করতে বাধ্য।
কিন্তু একজন (রাজনীতি)সচেতন শ্রমিকের চেহারা আমরা আমেরিকায় দেখতে পাই না। তার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে (হতে পারে উপরিকাঠামোর জটিল বিন্যাস); কিন্তু একটা কারণ হতে পারে সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যার্থতা। ফলে আমরা দেখেছি ‘অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রিট’ আন্দোলনে একে একে জড়ো হয়েছেন ষাটের দশকের বিপ্লবীরা, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আহত সৈনিক, হিপ্পি এবং বিটনিক আন্দোলনের অংশগ্রহনকারী, আফগানিস্থান-ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সৈনিক। ফলে শুরু হয়েছে এক অন্যরকম সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। সর্বোপরী আমেরিকার আত্মবিচ্ছিন্ন এবং সদ্য বেকার শ্রমিক শ্রেনী নতুন এক পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে, যেখানে তারা এখন পারষ্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ঠ বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামত বিনিময়ের অবসর পাচ্ছেন।
হয়ত রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত শিক্ষিত এবং সচেতন হয়ে ওঠার আগেই মার্কিন প্রশাসন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে। ‘অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রিট’ আন্দোলনকে আমেরিকার এবং বিশ্ব পুজিবাদের একটা ‘টোটাল ক্রাইসিস’ হিসেবেই দেখছি আমি। আমার মনে হয় এটা থেকে সত্যিই অনেক কিছু শেখার আছে বামপন্থি রাজনীতিকদের।
মাসুদ করিম - ৩০ নভেম্বর ২০১১ (৫:৩৫ অপরাহ্ণ)
ওয়াল স্ট্রিট দখল করোর প্রথমদিকে মাইকেল মুরের বক্তৃতা দেখুন এখানে। মাইক্রোফোন ছাড়া এই বক্তৃতা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। আমাদের দেশে বড় ইদের জামাতে এরকম করে নামাজের ইকামত ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়। ইংরেজিতে একে বলে ‘ক্রাউড মিক'( crowd mic)।
মাসুদ করিম - ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ (২:২৩ অপরাহ্ণ)
গ্রামীণ মাতব্বরদের বিরুদ্ধে চীনে চলছে ‘অকুপাই উকান’ আন্দোলন। পড়ুন এখানে।
শাহজাহান - ১৭ মার্চ ২০১২ (১১:৫৭ অপরাহ্ণ)
An insider’s view of Wall Street criminality